লাল নীল সংসার পর্ব-০৪

0
176

#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৪_

আদনান ভার্সিটিতে মাঠের একপাশে একা একা চুপচাপ বসে আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও মন চাচ্ছে নাহ তার। আজ সকালে, বাবা, মা আর ভাইয়ের সব কথা সে শুনেছে। রুম থেকে বের হওয়ার সময় এইসব কথা শুনে আর মাঝের রুমে সে আসে নি। তাহলে শিশির কথা বলা বন্ধ করে দিতো। শিশির কখনোই তাকে আর সাঝকে এইসব চিন্তামূলক কথার মাঝে রাখে নাহ।

আদনানের একটাই কাকা। তার বাবার থেকে বড়। কাকা-কাকী কেউই তাদের ভালোভাবে দেখে নাহ। কারন, তাদের আর্থিক অবস্থা। কাকা – কাকী সব সময় টাকা পয়সা দেখে মানুষ জনের সাথে মিশে। নিজেদের কম টাকা নেই। অনেক টাকার মালিক ওনারা। তাও যেন হয় নাহ। আদনান তো কখনোই তার কাকা – কাকী কে সহ্যই করতে পারে নাহ।

আদনান নিজের মানিব্যাগ বের করে দেখে এক হাজার টাকার দুইটা নোট আর পঞ্চাশ টাকার দুইটা নোট আছে। তিনটা টিউশন করায় আদনান, দুই হাজার করে টাকা নেয়। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা পায় আদনান। সব সময় হিসাব করেই চলার চেষ্টা করে। তাই মাস শেষে হাতে এখনও দুই হাজার একশ টাকা আছে। আদনান সব সময় টাকা জমায়। কিন্তু মাঝে মাঝে সম্ভব হয় নাহ। সংসারের পিছে দিয়ে দেয়। কিন্তু, যে মাসে পারে, সেই মাসে জমিয়ে রাখে। আজ বাসায় গিয়ে দেখবে কতো টাকা আছে। কিন্তু, বেশি হবে নাহ সে জানে। কেননা মাস গেলে এইবারের মতো হাজার দুইয়েক টাকা থাকে নাহ। এতো টাকা এই প্রথমই আছে তার কাছে। বেশির ভাগ সময় দুইশো, পাঁচশ, তিনশ, শতকের ঘরে থাকে।

আদনান সকাল থেকেই এইসব চিন্তা করছে। কাকাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। কাকা টাকার জন্য নাকি চাপও দিচ্ছে সাথে শেষে কিছু একটা অফারও দিয়েছে, যেইটা সকালের কথায় বুঝেছে। কিন্তু, কি অফার সেইটা আদনানের অজানা। আদনান এইসব ভাবছে এমন সময় তার পাশে এসে বসে রিয়াদ ( ওর বন্ধু )। রিয়াদ আদনানের দিকে তাকিয়ে দেখে আদনান গভীর ভাবে চিন্তা করছে কিছু নিয়ে। সে এতোটাই চিন্তা করছে যে সে তার পাশে এসে বসেছে অথচ তার কোনো খেয়াল নেই। রিয়াদ আদনানের কাঁধে চাপড় মেরে বলে ওঠে,
–” কি হয়েছে তোর?”

হঠাৎ এমন হওয়ায় কিছুটাহ চমকে উঠে আদনান। পাশে তাকিয়ে রিয়াদকে দেখে বলে ওঠে,
–” রিয়াদ! ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। আমিও ভাবছিলাম, তোকে ফোন দিবো।”

আদনানকে এমন ভাবে বলতে দেখে রিয়াদ কিছুটা ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
–” কি হয়েছে দোস্ত? তোকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা?”

–” হ্যা! একটু সমস্যাই আছি। তুই যদি একটু সাহায্য করিস তাহলে আমার কিছুটা উপকার হয়।”

–” কি সাহায্য? বল।”

আদনান কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে,
–” তোর মামা তো একটা গার্মেন্টেসের মালিক, তাই নাহ?”

–” হ্যা! কিন্তু কেন?”

–” আমাকে ওখানে একটা ছোট খাটো কাজ ধরিয়ে দিতে পারিস? ভার্সিটির ইম্পর্টেন্ট ক্লাস গুলো করলাম আর বাকি সময় ওখানে কাজ করবো।”

আদনানের কথায় বেশ অবাক হয়ে যায় রিয়াদ। রিয়াদ বলে ওঠে,
–” তুই এমনিই তিনটা টিউশন করাস। এগুলো বাদ দিবি?”

আদনান নেতিবাচক ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠে,
–” না! তিনটা টিউশন রাতে করাবো আর দিনে ইম্পর্টেন্ট ক্লাস তো একটা দুইটার বেশি থাকে নাহ। ঐ ক্লাসগুলো বাদ দিয়ে বাকি সব সময় নাহ হয় ওখানে কাজ করলাম। আমার খুব দরকার।”

রিয়াদ কিছু সময় চুপ থেকে বলে ওঠে,
–” আমি মামার সাথে কথা বলে, তোকে রাতে জানাবো। কিন্তু, তুই এতো পরিশ্রম করবি?”

আদনান হালকা হেসে বলে ওঠে,
–” মাঝে মাঝে নিজের কথা শুধু ভাবলেই চলে নাহ। আমাকে পারতে হবে।”

রিয়াদ আদনানের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে। আদনানের পারিবারিক অবস্থা ওর অজানা নয়। হয়তো পরিবারে কোনো সমস্যা এসে দাড়িয়েছে তাই আদনান এতো পরিশ্রম করে নিজের পরিবারের পাশে দাড়াতে চাইছে। এই কারনেই রিয়াদ আদনানকে সব সময় সম্মান করে।


শিশির অফিসে নিজের ডেস্কে বসে আছে। সামনে পিসি অন করা কিন্তু কাজে কিছুতেই মন বসছে নাহ তার। কিভাবে বসবে? ধুপ করেই যেন একটা বিরাট সমস্যা কাঁধে এসে পড়লো। পঞ্চাশ হাজার টাকা, এতো গুলো টাকা কিভাবে জোগাড় করবে সে? যা স্যালারি পায় তার সবটুকুই তো সংসারের খরচে ঢেলে দেয়। তাও হিমশিম খেতে হয়। মাস শেষে টানাটানি চলে আসে। নিজের ব্যাংক একাউন্ট আছে, কিন্তু তাতে মনে হয় একশ টাকার মতো আছে। স্যালারি ব্যাংক একাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাই নিজের একটা একাউন্ট সে খুলেছে। নাহলে, যখন থেকে কাজে ঢুকেছে তখন থেকেই সংসার তার কাঁধে চলে এসেছে। টাকা জমানোর আর সময় হয়ে উঠে নি।

টাকা তাকে জোগাড় করতেই হবে। কয়েকদিন আগে কাকা- কাকী ঢাকা এসেছিলো ডাক্তার দেখাতে, তখন নিশ্চয়ই সাঝকে দেখে তাদের পছন্দ হয়েছে। তাই নিজের বদমাশ ছেলের বউ বানাতে চাচ্ছে। কথাটাহ মাথায় আসলেই শিশিরের শরীর রাগে ফেটে যাচ্ছে। এখন যে করেই হোক টাকা তাকে জোগাড় করতে হবে।

একবার ভেবেছিলো ব্যাংক লোন নিবে। কিন্তু, তাতে টাকা দিবে কিভাবে? সংসারের পিছনেই সব বেতনের টাকা চলে যায়। সেখানে ব্যাংকের টাকা দিবে কিভাবে? অফিস লোন নেওয়ার চিন্তা একবার এসেছে। যদি অফিস থেকে লোন নেয় তাহলে হয়তো কিছু ফ্যাসিলিটিস পেতে পারে। কিন্তু, তাতেও যে স্যালারি থেকে টাকা কেটে রাখবে। হয়তাে বলে কয়ে, টাকার পরিমান টাহ কম হতে পারে। এছাড়া আর কোনো উপায় তো মাথায় আসছে নাহ তার। শিশির ডেস্ক থেকে বেরিয়ে তার বস মি. সাজিদের কেবিনের দরজায় নক করতেই তাকে ভেতরে যেতে বলা হয়। মি. সাজিদ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কাজ করছিলেন। শিশিরকে দরজা ঠেলে ভেতরে আসতে দেখেই মি. সাজিদ বলে ওঠে,
–” আরে, মি. শিশির। আসুন, বসুন।”

শিশির মি. সাজিদের অপোজিটে বসতেই মি. সাজিদ ল্যাপটপ টাহ পাশে রেখে হাসি মুখে বলে ওঠে,
–” বলুন, কি অবস্থা আপনার?”

মি. সাজিদকে শিশিরের ভালোই লাগে। ওনি আসলেই ভালো একজন মানুষ। সব সময়ই সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেন, সবার খোঁজ খবর নেন। কিন্তু, কাজের ব্যপারে খুব পানচুয়াল। কাজে একটু হেয়ালি দেখলেই ওনি বকাঝকা করেন, কিন্তু তাতে শিশির কোনো অন্যায় দেখে নাহ। কারন, নিজের ভালোমানুষি দেখার জন্য কাজের ক্ষতি করা এইটা কোনো বুদ্ধিমান মানুষেরই কর্ম নয়। তাছাড়া খুবই আময়িক লোকটা। শিশির মি. সাজিদের তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–” জি, স্যার আলহামদুলিল্লাহ। আপনার শরীর কেমন আছে?”

–” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কাজ কেমন চলছে?”

–” চলছে স্যার আলহামদুলিল্লাহ!”

শিশিরকে একটু উশখুশ করতে দেখে মি. সাজিদ হালকা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,
–” আপনি কি কিছু বলতে এসেছেন আমাকে?”

শিশির একপলক মি. সাজিদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
–” আসলে, স্যার…..”

শিশিরকে এমন করতে দেখে মি. সাজিদ হালকা হেসে বলে ওঠে,
–” মি. শিশির! আপনি যা বলতে এসেছেন, বলুন। এতো আনিজ্যি ফিল করছেন কেন? এনি প্রবলেম?”

শিশির একটু কেশে বলে ওঠে,
–” স্যার! আমার একটু পারিবারিক সমস্যা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার খুব প্রয়োজন। আমি কি অফিস থেকে লোন পেতে পারি?”

–” অবশ্যই! কেন নয়? আপনি আপনার এমাউন্ট জানিয়ে একটা এ্যাপলিকেশন করুন। আমি এপ্রোভ করে দিবো।”

শিশির একটু হেসে বলে ওঠে,
–” Thank you, sir! আর একটা কথা, এখানে আমি টাকা কিভাবে ব্যাক দিবো?”

–” ওয়েল! যেহেতু আপনার সমস্যা যাচ্ছে, তাই আমি আপনাকে বেশি চাপ দিবো নাহ। পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনার দশ মাসে শোধ দিতে হবে। প্রত্যেক মাসে আপনার স্যালারি থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে সাথে এক হাজার টাকা বাড়তি নেওয়া হবে। মোট ছয় হাজার টাকা কেটে রাখা হবে আপনার স্যালারি থেকে।”

শিশির একটু চুপ থেকে বলে ওঠে,
–” ঠিক আছে, স্যার! আমি একটু ভেবে চিন্তে এ্যাপলিকেশন করবো।”

–” Ok.”

শিশির মি. সাজিদের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। প্রতি মাসে স্যালারি থেকে ছয় হাজার টাকা কেটে নিয়ে গেলে সে সংসার চালাবে কিভাবে? ওভার টাইম কাজ করলে তার টাকা আলাদা দেওয়া হয়। কিন্তু, সেইটা কাজের উপর নির্ভর করবে কতো টাকা দিবে অফিস। শিশির কি করবে বুঝে উঠতে পারছে নাহ। মাথায়ও কেমন জানি ব্যাথা ব্যাথা করছে। শিশির বাথরুমে গিয়ে মাথায় একটু পানি দিয়ে রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। তারপর আবার ডেস্কে বসে কাজ শুরু করে দেয়।


সাঝ নিজের রুমে বসে পড়ালেখা করছে। এখন কলেজে খুব একটা যাওয়ার দরকার হয় নাহ। সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। তাকে যে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তাহলেই ভাইয়ের এতো কষ্ট সার্থক হবে। সাঝ শুনেছে, তার ভাইয়াও অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলো। কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পড়েছে তার ভাই, ভালো রেজাল্ট নিয়ে। কিন্তু, সেই অনুযায়ী চাকরি পায় নি ভাইয়া। সংসার চালানোর জন্য এই চাকরি ঠিক করে নিয়েছে।

সাঝ সব সময় খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে। নিজের ভাইকে তো আর আপাততো টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবে নাহ, যদি তার ভালো রেজাল্টে ভাই একটু খুশি হয়। এইটাই তার প্রচেষ্টা। সাঝও টিউশনি করাতে চেয়েছিলো কিন্তু শিশির সোজা নাহ করে দেয়। সাঝের কাজ নাকি শুধু পড়া, খাওয়া আর ঘুম।তাকে ডাক্তার হতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে। ভয় হয় সাঝের, ভাইয়ের এতো স্বপ্ন তাকে নিয়ে, পুরণ করতে পারবে তো সে? যে ভাই নিজের রক্ত বেচে বোন কে পড়াতে চাই, সেই ভাইয়ের স্বপ্ন পুরন করতে পারবে তো সে? নাহ, তাকে পারতেই হবে, ইনশাআল্লাহ।

এমন সময় আহিয়া রহমান এক গ্লাস দুধ নিয়ে সাঝের রুমে আসে। সাঝ মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দেয়। আহিয়া রহমান এগিয়ে এসে সাঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” নে দুধটাহ খেয়ে নে।”

সাঝ তার মায়ের দিকে বলে ওঠে,
–” দুধ? কোথায় পেলে?”

আহিয়া রহমান মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–” তোর ভাই পাঁচ লিটার দুধ কিনে এনে দিয়েছে। বলেছে, তোকে রোজ সকালে যেন এক গ্লাস করে দুধ দেয়।”

সাঝ একটু হেসে দুধের গ্লাস নিয়ে খেয়ে নেয়। আহিয়া রহমান সাঝের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে ওঠে,
–” মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ভাইয়ের স্বপ্ন পুরন করতে হবে। অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে তোকে।”

চলে যায় আহিয়া রহমান। সাঝ আহিয়া রহমানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ টাহ কেমন জানি ছলছল করে উঠে। আসলেই, তার ভাইটা যে এতো ভালো, মাঝে মাঝে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহর কাছে ভাইয়ের জন্য দোয়া করে সাঝ। তারপর আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়।


শিশির অফিস থেকে বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে আছে। এমন সময় দরজায় আওয়াজ হতেই দেখে আজিজ রহমান এসেছে। বাবা কে দেখে উঠে বসে শিশির। আজিজ রহমান এগিয়ে এসে শিশিরের সামনে বসে বলে ওঠে,
–” শরীর কেমন আছে, বাপ?”

শিশির হালকা হেসে বলে ওঠে,
–” আলহামদুলিল্লাহ, আব্বু! আপনার শরীর কেমন আছে?”

–” আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই।”

এই সময় বাবাকে নিজের রুমে আসতে দেখে শিশির কিছুটা অবাকই হয়েছে। কেননা, তাদের বাবা সচরাচর তাদের রুমে আসে নাহ। আজিজ রহমান কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে ওঠে,
–” শিশির, বাপ! আমি একটা কথা ভাবছিলাম।”

শিশির অবাক হয়ে আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” কি কথা আব্বু?”

আজিজ রহমান বলে ওঠে,
_” আসলে, আমি আর কখনো গ্রামে গিয়ে সব সময়ের জন্য থাকবো কি নাহ জানিনা। আর সত্যি কথা বলতে, গ্রামে গিয়ে আমি থাকতেও চাই নাহ। আসলে, যখন তোর দাদা মারা যায়, আমার বড় ভাই দুই নাম্বারি করে প্রায় সব জমিই নিজের নামে করে নেয়। আমাকে দেওয়া হয়, বিলের মাঝের কিছু জমি আর বাড়ির ভিটের এক পাশ থেকে কিছু জমি। যা শুধু আমার ঘর করার পর আর জায়গা নেই পাশে।”

শিশির চুপচাপ বাবার কথা শুনছে। আজিজ রহমান আবারও বলে ওঠে,
–” রাগেতে আমি ঢাকা চলে আসি। তোর বয়স তখন মাত্র সাত আট মাস হবে। ঢাকার মতো জায়গায়, এইটুকু বাচ্চা সাথে স্ত্রী কে নিয়ে কি করছি, দুই বেলা খাচ্ছি কিনা, এইসব কিছুই জানার জন্য কখনো বড় ভাই ফোন করে নি আমি রক্তের টানে মাঝে মাঝে ফোন দিতাম, তাতে আমাকে একদিন বলে, আমি নাকি টাকা পাওয়ার আশায় বেশি বেশি ফোন দেয়। কষ্টে ফোন দিতাম নাহ খুব একটা। তাও ভাইটা কেমন আছে, জানার জন্য মনটা ব্যকুল হয়ে থাকতো। অনেকদিন পর পর ফোন দিতাম।”

শিশিরের খুব খারাপ লাগে এইসব শুনে। কিন্তু, তাও নিজের বাবাকে আটকায় নাহ। বলুক তার বাবা, বলে একটু হালকা হয়ে যাক। শিশিরেরও তো তাদের ইতিহাস জানা উচিত। তাই চুপচাপ শুনতে থাকে শিশির। আজিজ রহমান আবার ছলছল চোখ নিয়ে করুন ভাবে বলে ওঠে,
–” জানিস শিশির, তুই আমার প্রথম সন্তান। তুই যখন হলি, আমি আর তোর মা খুব খুশি হয়েছিলাম। তোর দাদা দাদী তোদের কোনো ভাইবোনকেই দেখে যেতে পারে নি। শুধু বড় ভাইয়ের ছেলেকে দেখতে পেরেছে। তুই জন্ম নেওয়ার কয়েক মাস আগেই তোর দাদা মারা যায়। তাের দাদী তারও আগে মারা যায়। আমার বড় ভাই, আমার প্রথম সন্তানের মুখ দেখে একটা এক টাকার পয়সাও দেয় নি। উল্টো ভেংচি কেটেছিলো। কিন্তু, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম বাপ। আমি আমার বড় ভাইয়ের দুই সন্তানকেই সোনার চেইন বানিয়ে দিয়েছিলাম।”

শিশির অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। এক ভালো লাগায় ভরে গেলো শিশিরের মনে। তার বাবা কতো টাহ ভালো মানুষ এইসব কাহিনির মাধ্যমেই বোঝা যায়। কেমনে পারে তার কাকা এমন হতে? দুই ভাই তো একই মায়ের সন্তান। তাহলে? দুইজনের মাঝে এতো তফাৎ হয় কিভাবে? ভেবে পায় নাহ শিশির। আজিজ রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
–” শিশির, বাপ! আমি ভাবছিলাম যে, যদি আমাদের বিলের জমিটুকু বিক্রি করে, তোর কাকার টাকাটা শোধ করা যায় তাহলে কি ভালো হতো না?”

শিশির একপলক আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
–” আব্বু! দাদার শেষ স্মৃতি গুলো শেষ করে দিবেন?”

–” শুধু বিলের জমিটুকু বিক্রি করবো। ভিটে তো থাকছে।”

–” আমার মনে হয়, কত দাম দর হবে তার উপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”

আজিজ রহমান শিশিরের কথায় সম্মতি প্রদান করে বলে ওঠে,
–” আমি এক কাজ করি, জসীমকে দিয়ে খবর নিই। দরকার হলে নিজে যাবো।”

–” জি, আব্বু!”

আজিজ রহমান রুম থেকে যেতে গিয়ে আবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আদনান কোথায় জানিস? এখনও এলো নাহ যে?”

শিশির আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আব্বু! আমার কথা হয়েছে। আসছে। হয়তো বন্ধুদের সাথে ছিলো।”

–” হুম!”

আজিজ রহমান বেরিয়ে যায়। শিশিরের খুব খারাপ লাগতে শুরু করে নিজের বাবার জন্য। কিভাবে কাকা এমন করতে পারে তার বাবার সাথে? এতো টা নিষ্ঠুর মানুষ কিভাবে হয়? শিশিরের চোখ জ্বালা করছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে শিশির।


আদনান বাস থেকে ফার্মগেটে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে বাসার উদ্দেশ্যে। এমন সময় ফোন বেজে উঠতেই দেখে রিয়াদ কল করেছে। আদনান কল রিসিভ করে বলে ওঠে,
–” হ্যা! রিয়াদ বল।”

ওপাশ থেকে রিয়াদ বলে ওঠে,
–” আদনান! কোথায় তুই?”

–” এইতো বাস থেকে নেমে বাসার দিকে যাচ্ছি।”

–’ ওহ! তুই ঐযে বলেছিলি নাহ মামার সাথে তোর গার্মেন্টেসের কাজ করার ব্যাপারে কথা বলার জন্য, আমি কথা বললাম মামার সাথে।”

আদনান একটু উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে,
–” কি বললো তোর মামা?”

–” বললো যে, করতে পারবি। সমস্যা নেই। তোর পারফম্যান্স ভালো হলে মাস গেলে দশ হাজার করে টাকা দিবে।”

কথাটাহ শুনে আদনান একটু হেসে বলে ওঠে,
–” বাহ! ভালোই তো। শোন, আমি আর একটু ভেবে তোকে কনফর্ম করবো। ঠিক আছে?”

রিয়ার একটু বোঝানোর সুরে বলে ওঠে,
–” আদনান! একটু ভালোভাবে ভেবে দেখ ভাই। এতো প্রেশার নেওয়াটা কি ঠিক হবে? আমি জানি হয়তো কোনো সমস্যায় পড়েই তুই হয়তো এই কাজ টাহ করতে চাচ্ছিস। কিন্তু, তাও বলবো, একটু ভেবে দেখ। তোর উপর অনেক প্রেশার হয়ে যাবে।”

–” ঠিক আছে। আমি ভেবে তোকে জানাবো। রাখছি।”

আদনান কল কেটে জোরে হাঁটা শুরু করে। আর ভাবছে, ব্যপার টাহ ভাই কে জানাবে কি নাহ? কাউকে নাহ জানিয়ে কাজ করলে, পরে যদি জানতে পারে তাহলে ভাইয়া যে খুব কষ্ট পাবে। আর আদনান কখনোই তার ভাইকে কষ্ট দিতে চায় নাহ। এইটা ঠিক ভার্সিটি, টিউশনি করে এই কাজ টাহ করা তার জন্য প্রেশার হয়ে যাবে। কিন্তু, যেখানে পরিবারের এতো বড় সমস্যা সেখানে সে কি করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে?

#_চলবে……….🌹