লীলাবালি পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
305

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৫
আফনান লারা
.
পেটে খিধে নিয়ে কুসুম বিছানায় উঠে বসে আছে।অর্ণব বারান্দায় গিয়ে রকিং চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
কুসুম হাঁটু গেড়ে একটু একটু করে বিছানা দিয়ে বারান্দার আগে যে জানালাটা আছে সেটার কাছে গিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ছিল।মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দরজায় ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে নেমে গেলো দেখতে।কুসুমের মা খাবার হাতে এসেছেন। কুসুম আজ সারাদিনে কিছু খায়নি তা জানা ছিল বলেই খাবার নিয়ে আসলেন তিনি।আরেকটা প্লেট দিয়ে বললেন অর্ণবকে খেতে বলতে।কুসুম জানে সে এখন অর্ণবকে খেতে বললে কথা শুনতে হবে তাকে।
তাই খাবারটা টেবিলে ঢেকে রাখলো।অনেক খিধা লাগলেও অর্ণব খায়নি বলে তার ও খাওয়ার ইচ্ছা জাগলোনা।নিজেরটাও ঢেকে রেখে দিলো।বিছানায় ফিরে যাবার আগে অর্ণবের ফোন জ্বলতে দেখে কাছে গিয়ে দেখলো সে।
জুথির কল।নাম পড়তে পারলোনা।অর্ণবের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে ধরে বললো,’আপনার ফোন’

অর্ণব ফোনের দিকে তাকিয়ে জুথির নাম দেখে ফোন আর নিলোনা।বললো টেবিলে রেখে দিতে।
কুসুম চুপচাপ আগের জায়গায় ফোন রেখে এসে বসলো বিছানায়।কিন্তু জুথি বারবার কল করে যাচ্ছে।অর্ণব আবারও চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে গেলো।কুসুম পা টিপে টিপে ফোনটার কাছে এসে ভাল করে দেখতে লাগলো।কি লেখা আছে তার আগাগোড়া কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।পর পর বেজেই যাচ্ছে শুধু।
শেষবার বাধ্য হয়ে আবারও ফোনটা নিয়ে উঁকি দিয়ে বললো, আপনার ফোন বাজছে এখনও।কি করবো?

অর্ণব রেগে গিয়ে বললো,’ভেঙ্গে ফেলো।এক্ষুনি’

কথাটা বলার পর।বারান্দার দরজা থেকে কুুসম সরে যাবার পাঁচ সেকেন্ড পর ঠুস করে আওয়াজ পেলো সে।আশ্চর্য হয়ে ছুটে রুমে এসে দেখলো কুসুম সত্যি সত্যি ফোন ভেঙ্গেছে।এখন অর্ণবের দিকে চোরের মতন তাকিয়ে আছে।অর্ণব হাসবে নাকি কাঁদবে কিছুই বুঝতেছেনা।কুসুম আমতা আমতা করে বললো,’আপনি যেটা বললেন সেটাই করলাম।’

কিছু না বলে অর্ণব নিচ থেকে ফোনের অংশগুলো গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছে এখন।কুসুম একটু এগিয়ে এসে বললো,’আপনি বললেন তাই করেছি’

অর্ণব মাথা তুলে বললো,’এই কারণে আমি কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চাইনি।সাধারণ জ্ঞানবোধ তোমার নেই যে, রেগে বলা কথা আর সিরিয়াসলি বলা কথায় আকাশ পাতাল তফাৎ’

-‘আমি যে ছোট সেটা বুঝি আপনি আজ জানলেন?খুব জানেন আমি রাগে বলা আর সত্যি সত্যি বলার তফাৎ জানিনা তাহলে এখন ভাঙতে বললেন কেন?আমি না ছোট?’

কুসুমের কথায় অর্ণবের কথাই বন্ধ হয়ে গেলো।চুপচাপ ফোন ঠিক করে অন করতে পেরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
আবার গিয়ে বারান্দায় বসলো সে।কুসুম দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে আবারও দেখছে ওকে।সেটা অর্ণব বুঝতে পারেনি।ফোন টিপে দেখলো জুথির পনেরোটা মিসড্ কল।
স্ক্রিনের প্রতিবিম্বে কুসুমকে দেখে ফোন হটিয়ে পেছনে তাকালো সে।কুসুম লুকিয়ে পড়েছে।
-‘শুরু থেকে যে পরিমাণ জ্বালাচ্ছে আমি এতক্ষণ কি করে ঠাণ্ডা আছি তা ভেবে পাইনা।এতক্ষণে মেরে ভূত বানিয়ে দেওয়ার কথা ওরে অথচ আমি চুপচাপ আছি।কেন?কারণ দোষ ওর না।দোষ আমার কপালের।’

ফোন রেখে চোখ বন্ধ করতেই ঘুম নেমে আসলো চোখে।মশার কামড়ে চোখ খুলে গেলো রাত দুটোর দিকে।হাত চুলকাতে চুলকাতে উঠে বারান্দা থেকে বের হতে গিয়ে দেখতে পেলো কুসুমকে।সে একটা চেয়ারে পা তুলে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ঘুমাচ্ছে।মনে হয় যেন পাহারা দিচ্ছিলো।ওর পাশ দিয়ে রুমে ঢুকে টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার ঢাকা দেওয়া পেলো সে।মানে সে খায়নি বলে কুসুম ও খায়নি।

-‘এই!শুনো??কুসুম!’

নিজের নাম শুনে কুসুম হকচকিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে বললো,’কি হয়েছে?’

-‘টিপিক্যাল বউের মতন করলে সকাল বিকাল আমার হাতে শুধু মার খাবা।তোমাকে এটা কে শিখিয়েছে বর না খেলে বউয়ের খেতে হয়না??আমি খাইনি বলে তুমি তোমার খাবার ঢেকে রেখেছো কেন?আমার মেজাজ কেন এত খারাপ করতেছো?’

কুসুম হঠাৎ দরজা খুলে চলে গেলো।অর্ণব মাথার চুল ধরে টানতে টানতে বিছানায় বসে আছে।কোন দোষ করেছিল যে এমন বাচ্চা বয়সী একটা মেয়ে তার বউ হতে গেলো।কিসের শাস্তি পাচ্ছে সে??
-‘খায়নি কেন তা বলছি তাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেছে।আশ্চর্য!’

দু মিনিট পর কুসুম আবার আসলো।অর্ণব ওর আসার অপেক্ষা করছিল।ওকে দেখে বললো,”কি বিচার দিছো আমার নামে?’

-“আমি ঔষুধ খেয়েছি।বমি আসছিল তাই মিশু ভাবীর ঘর থকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে এলাম’

-অর্ণব লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললো,’খাও।নাহলে লাইট অফ করো।খাবার নিয়ে এত প্যাচাল করতে পারবোনা।মুড নাই আর’

কুসুম লাইটটা সঙ্গে সঙ্গে অফ করে দিয়েছে।অন্ধকারে চুপিচুপি আগের চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।অর্ণব ল্যাম্প শ্যাড অন করে বললো,’তোমাকে এক কথা কয়শবার বলল তোমার মাথায় ঢুকবে?শুরুতেই বলেছি বিছানায় শোবে!’

কুসুম বললো,’না।পরপুরুষ!!না মানে কিছুনা আমি এখানে ঠিক আছি’

-“পরপুরুষ? দুবার বিয়ে করে পরপুরুষ? তুমি এমন করে আমার মুড ঠিক করার চেষ্টা করছো?তবে তুমি কি জানোনা আমার মন খারাপের কারণ কে?’

-‘আমি।তাই তো আমি….’

-‘শোনো আমার মন খারাপ কেউ ভাল করতে পারেনা।আমি নিজের মন খারাপ নিজেই ঠিক করি।শুধু শুধু আমার মন আরও খারাপ করবেনা।এখানে এসে শুয়ে পড়ো।কাল ঈদ।অনেক অনেক কাজ আমার’

কুসুম খাটের উল্টো পাশ দিয়ে এসে ওর পাশে শুয়ে পড়লো।বুকের ভেতর কেমন কেমন করছে।অর্ণবের গায়ের গন্ধে পিঠটাকে বিছানায় লাগাতেই লজ্জা করছে ওর।কোনোমতে আলগা করে শুয়ে চোখ বুজে রাখলো।দুজনের চোখেই ঘুম নেই তাও চোখ বন্ধ করে রেখেছে তারা।কুসুমের মাথায় ঘুরছে খিধার কথা আর অর্ণবের রাগের কথা।অর্ণবের মাথায় ঘুরছে বিয়েটা কেন এভাবে হলো।এতগুলো বছর এই বিয়েটা আটকে রেখেছিল বলে এমন করে বিয়েটা হলো যে তার মানতেই কষ্ট হচ্ছে?জুথিকে কি করে ইগনোর করবে?জুথি কি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে?
যদি সামনে এসে কান্নাকাটি করে?
মেয়েদের কান্না দেখলে তো আমার মন চায় নিজের কলিজাটা খুলে দিয়ে দিই সেখানে জুথি কাঁদলে কি করবো?মৃদুলের সাথে কথা বলতে হবে আমায়।ও পারবে জুথিকে বুঝাতে।
আমি জুথিকে বুঝানোর রিস্ক নিতে পারবোনা।আমার এত সাহস নেই।’

এত ভাবনার ভেতর কারোর পেটের ভেতরের গুরগুর আওয়াজ কানে আসতেই অর্ণব উঠে বসলো।কুসুম ও উঠে পড়েছে।খিধায় ওর পেটে ডাক দিচ্ছিলো।
অর্ণব ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,’যখন জীবনে কাজের কমতি হয়,চিল মুড আলা লাইফ লিড করতে থাকি আমরা,অতীতে ভাগ্যের সাথে নাছোড়বান্দা গিরি দেখিয়ে থাকি তখন নিয়তির খেলা একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সংসার পেতে দেয়।জোর করে!’

-‘আমি বিয়েটার কথা কাউকে জানাইনি।আপনি ঢাক ঢোল পিটিয়ে দ্বিতীয় বার কেন বিয়ে করতে গেলেন?এখন আমার উপর চেঁচাচ্ছেন কেন?’

-‘তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি বিয়েটা আমায় করেছিলে।আর সেটা আমার থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিলে?তোমার কথায় প্রায় সময় বুঝদার মনে হতো কিন্তু এই রাতে আমি নিশ্চিত হলাম তোমার যে বয়স তুমি একসের একটা বাচ্চাই বটে!যাও খেয়ে নাও।প্লিজ আমায় ঘুমোতে দাও’

-“আপনার পেট ও একবার ডেকেছিল।আমি শুনেছি।হয়ত আপনারও মনে আছে’

অর্ণব নিজের পেটে হাত দিয়ে মুখ ঘুরে শুয়ে পড়লো।কুসুমের মুখে হাসি ফুটলো সাথে সাথে।হাসতে হাসতে সেও শুয়ে পড়েছে।
অর্ণব কুসুম ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে ফোন নিয়ে বারান্দায় গিয়ে মৃদুলকে কল করলো।সাথে সাথে ও রিসিভ করেছে।করেই বললো,’কিরে বিয়ে সাদি করলি আমাদের জানালি না।?’

-‘তুই জানলি কি করে?’

-“তোর ভাবী ফেসবুকে আপলোড করেছে তোর আর বাচ্চা ভাবীর ফটো।শেষমেষ ঐ বাচ্চারেই বিয়ে করলি তাহলে?’

-“ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে কজনে জেতে?আমি হেরে গেলাম।’

-‘তো এখন না তোর বাসর?বাচ্চা বউ কি করে তোর?’

অর্ণব পেছনে তাকালো।কুসুম গভীর ঘুমে।চোখ সরিয়ে নিয়ে গ্রিলে হাত রেখে বললো,’আমি ভাবছি অন্য কিছু’

-“জুথি তোরে লাইক করে।কাঁচা চিবাবে তোর বিয়ের কথা শুনলে।ভাই ওরে আমি ডরাই।আমাকে বুঝাতে বলিস না’

-‘আমিও ভয় পাচ্ছি।সত্যিটা জানলে কি করে বসবে তাই ভেবে আমার গলা দিয়ে খাবারও নামছেনা।খিধায় মরে যাচ্ছি’

-“তোর বাবু বউরে বল তোকে খাইয়ে দিতে’

-‘সে নিজেও খায়নি।গ্রামীণ বধূদের মতন আমি খাইনি বলে সেও খাবেনা।’

-‘এই বাচ্চা বড় হওয়া ছাড়া তুই ওর মাঝে নিজের বউরে দেখবিনা কোনোদিন।আহারে আমার বন্ধুটারে!সহজ সরল বন্ধুটা রে… আহ হারে!!!
কাল আসছি আমরা সবাই।তুই তো দাওয়াত দিবিনা।কিন্তু আমরা তো বৌভাতের অনুষ্ঠান মিস দিতে পারিনা।জুথিকে ইনবাইট করবো?’

-‘খবরদার!আমি ওর সাথে আর কথাই বলতে পারবোনা। আমার ভয় করছে।কোনোদিন যদি তোকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, দয়া করে বলে দিস আমি ওর সাথে যে অন্যায় করেছি তাতে যেন আমায় মাফ করে দেয়’

-“কেস ক্রিটিক্যাল।তুই নিজে বোঝালে ও বুঝবে’

-“নাহ।ও কাঁদবে।প্রচুর কাঁদবে।আজ আমার হাত ধরে আমাকে চাইছিল সে।আমাকে সহজে ভুলতে পারবেনা তা জানি আমি।হয়ত কখনওই ভুলবেনা।
আমি পরোক করে বলতে পারি ও আমার বিয়ের কথা শুনলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে।আর ওর কান্না দেখার সাহসটুকু আমার মাঝে নেই।তুই প্লিজ আমার হয়ে ওকে সামনা সামনি বোঝাবি।বলবি যা দোষ সব আমার কপালের।ওর কোনো দোষ নেই।কাউকে ভালোবাসা অপরাধ না।কিন্তু নিয়তির কাছে আমার কিছু করার ছিলনা।তিন বছর আগ থেকে এই বিয়েটা আটকানোর হাজারটা যুদ্ধ আমি করেছি কিন্তু কুসুমের নাম আমার স্ত্রীর নামের জায়গায় লেখা ছিল।যেটাকে আমি বদলাতে পারিনি।ও যদি কাঁদে এই কথাটাও আমায় ফের বলবিনা।ও কেঁদেছে শুনলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে।ভীষণ!শেষে বলবি….থাক কিছুনা।’

-‘ও যদি আমার কলার টেনে ধরে তবে আমি সত্যি বলছি তোর বাসার এড্রেস দিয়ে দিব’

চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৬
আফনান লারা
.
ফোন টেবিলের উপর রেখে অর্ণব নিজের মাথার চুল টানছিল অনেক সময় ধরে।আজ মাথার যন্ত্রণা সারছেনা।হাতুড়ি দিয়ে মাথাটাকে বাড়ি মারতে পারলে হয়ত শান্তি হতো।তিনটা বেজে গেছে।চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।কুসুম এপাশ ওপাশ করতে করতে অর্ণবের জায়গায় এসে ঘুমাচ্ছে এখন। অর্ণব দরজা আস্তে করে খুলে বাসা থেকে চলে গেলো।সোজা মসজিদে।
সেখানে বসেছিল ঈদের নামাজ শুরু হবার আগ অবধি।সেটা পড়েও বসে ছিল সে ওখানেই।বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করেনা তার।শরীর খারাপ লাগছে।এখন ঘুম পাচ্ছে।একটু শুলে হয়তবা মনে শান্তি ফিরে আসতো।মসজিদের টাইলসের কারণে ঠান্ডা আরও বেশি করে লাগছে।
যার সাথেই দেখা হয় সেই বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। আচমকা হয়ে যাওয়া ঘটনায় সকলেই চমকে আছে ।এবার সে উঠে হাঁটা ধরলো।পথে দেখা হয়ে গেলো আজিজ আর ফজলুলের সাথে।ওরা অর্ণবের বাল্যকালের বন্ধু।
দেখার সাথে সাথে ওকে থামিয়ে তারা বসিয়ে দিলো পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে।হেসে হেসে জিজ্ঞেস করলো বিয়ের কথা।পাড়া প্রতিবেশী যারা এসেছিলেন কাল রাতে বিয়ে দেখতে তারা বিয়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।অর্ণব কোনোমতে তাদের পিছু ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসলো এই বলে যে পরে কথা বলবে।এখন তার শরীর খারাপ করছে।সত্যি তাই।নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শূন্য বিছানায় দেহটাকে এলিয়ে দিলো সাত পাঁচ আর ভাবলোনা।বিছানায় কুসুম ছিলনা।বরং রুমেই ছিলনা।পুকুর ঘাট থেকে গোসল করে সে রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে পিঠা বানানো দেখছিল।
বাবা চায়ের কাপ হাতে দরজার কিণারায় এসে দেখলেন অর্ণব ঘুমোচ্ছে। নামাজ পড়ে ওকে আসতে দেখেছিলেন তিনি।আবার চলে গেলেন ওখান থেকে।অন্য দিন হলে ধমকিয়ে বলতেন সেমাই খেতে আয়।কিন্তু আজ আর ডাকলেননা।
কুসুম মিশু ভাবীর একটা খয়েরী রঙের শাড়ী পরেছে।চুলের পানি ঠিকঠাক করে না মুছে ছেড়ে দিয়ে রেখেছে।ওর মা বললেন তারা আজ চলে যাবেন।কিন্তু অর্ণবের মা তাদের আজ থেকে যেতে বলেছেন।কলি কোথা থেকে যেন ছুটে এসে কুসুমের কানে ফিসফিস করে জানালো অর্ণব ফিরে এসেছে।কুসুম এমন ভাব করলো যেন সে শোনেই নাই কথাটা।
মিশু ওর দু হাতে পিঠার আর সেমাইয়ের বাটি ধরিয়ে দিয়ে বললো অর্ণবকে দিয়ে আসতে যেহেতু ও কাল রাতে কিছু খায়নি। এখন নিশ্চয় খাবে।কুসুম আস্তে আস্তে রুমের কাছাকাছি এসে উঁকি মেরে দেখলো।অর্ণব গভীর ঘুমের অতলে।তা বুঝতে পেরে জোরে হোঁটে ভেতরে গিয়ে টেবিলে খাবার রেখে কুসুম এবার আস্তে আস্তে কাছে এসে অর্ণবকে দেখতে লাগলো।মুখটা কুসুমের বালিশ দিয়ে ঢেকে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সে।কুসুম কম্বলটা টেনে ওর গায়ে ঢেকে দিতে গিয়ে ওর ভেজা চুল সবগুলো পিঠ থেকে গড়িয়ে অর্ণবের গলায় গিয়ে পড়লো।সাথে সাথে ও জেগে গেছে।কুসুম তার চুল মুঠো করে ধরে আবার পিঠে নিয়ে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে চুপ করে আছে।অর্ণব গলা মুছতে মুছতে মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে।চোখ লাল হয়ে আছে তার।ঠিক করে ঘুমোতে পারেনা আর এখন যা একটু ঘুম এসেছিল তাও ভেঙ্গে গেলো।কুসুম চুপ করে আছে দেখে অর্ণব কিছু না বলে আবার আগের মতন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম আস্তে করে বলে দিলো,’সেমাই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।কোরবানির কাজে সবার সাথে যাবেন না?’

অর্ণব উত্তর দিলো না।কুসুম চলে যাওয়া ধরলো কিন্তু তখন আবার ওর ফোন জ্বলতে দেখে থামলো সে।আজ ফোন টিপে রিসিভ করে একেবারে কানে ধরলো কুসুম।

-‘কি সমস্যা আপনার?আমি কয় হাজার বার ফোন করেছি?মৃদুল ভাইয়া পর্যন্ত আমার ফোন ধরছেনা।আজব মানুষ তো আপনি!সেই জঙল থেকে সুস্থ সবল ভাবে বাড়ি পৌঁছেন কিনা তা জানার কি কোনো অধিকার নেই আমার?আমার সাথে কথা বললে কি আপনার বাবা মা আপনাকে কথা শোনা তো?নেটে তো আসবেন না জানি।কি হলো কথা বলছেন না কেন?’

কুসুম আগামাথা কিছুই বুঝলোনা।এত বকবক করা মেয়েটা কে হতে পারে তা ওর মাথায় আসলোনা।ভাবলো অর্ণবের অফিসের বুঝি কেউ।কিন্তু এমন ঝাড়ি যে দিলো মনে হয় কাছের কোনো বান্ধুবী।
এতসব ভাবতেছিল সে। তখন জুথি আবার চেঁচিয়ে বললো,’আপনার বাড়ির এড্রেস দিন।আমি আপনার বাড়ি ঘুরতে আসবো, যা হবার তখন সামনা সামনি হবে’

কুসুম এবার বললো,’উনি তো ঘুমাচ্ছেন।উঠলে বলে দেবো।আপনার নাম কি বলবো?’

জুথি একটা মেয়ের আওয়াজ শুনে এবার ভাবতে লাগলো কে ধরেছে।জিভে কামড় দিয়ে ভাবলো ওর বাড়ির কেউ কিনা।ওকে চুপ হতে দেখে কুুসুম আবার বললো,’কি হলো, বলুন আপনি কে?’

-‘অর্ণব ভাইয়াকে বলবেন আমি মৃন্ময়ী ‘

কুসুম আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।
জুথি অর্ণবের খুব কাছের কেউ হতে পারে কিনা সেরকম কিছু তার মাথায় তখন আসলোনা।ওর অফিসের লোক ভেবেই চলে গেলো মায়ের কাছে।অর্ণব আবারও ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে গেছিলো যার কারণে এত বড় ঘটনার সামিল হলোনা।কোরবানির সময় হয়ে আসায় বাবা এবার নিজে এসে ধমক দিয়ে বললেন,’আজ যে ঈদের দিন সেটা কি ভুলে গেছিস?কি হলো তোর?’

অর্ণব এবার উঠে বসেছে।এক ঘন্টার ঘুমে দুজন এসে উঠিয়ে গেছে।মনে হচ্ছে বিয়ের সাথে সাথে শান্তি নামক বস্তু জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।আর দেখা মিলবেনা।
—-
বাবা আর অর্ণব চলে গেছে।মা পথে ওকে থামিয়ে জোর করে ওর মুখে পিঠা একটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।খালি পেটে আর একটু সময় থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যেতো সে।
কুসুম ভয়ে আর ওর সামনে গেলোনা।কেমন যেন ভয় করে।যেভাবে তখন ঘুমের চোখে তাকিয়ে ছিল।
ফোন যে এসেছিল ঐ আপুর সেটা কখন বলা উচিত উনাকে?
কুসুমের কাছে এখন ওটাই একমাত্র উপায় অর্ণবের সাথে দ্বিতীয়বার আলাপ করার।
সব কাজ শেষ হতে বারোটা বোজে গেলো।অর্ণব হাত ধুয়ে রুমে ঢুকেছে।সবার আগে ফোন হাতে নিলো।জুথির ছাপ্পান্ন টা মিসড্ কল ছিল।
শেষের কলটা রিসিভ হয়েছে দেখায়।অর্ণব ভাবলো কে ধরেছে।পরে কুসুমের কথা মনে পড়ায় ওকে ডাক দিলো।কুসুম ছুটে আসলো।হাতে তেঁতুলের ছড়া।অর্ণব ফোন দেখিয়ে বললো,’তুমি আমার ফোন ধরেছো?’

-“মিননয়ি আপু ফোন দিছিল।আমি বলছি আপনি ঘুমে’

-‘মিননয়ি মানে?ওহ মৃন্ময়ী! তুমি তারে বলছো তুমি কে?’

-“নাহ সেটা তো জিজ্ঞেস করেনি।’

-“আর কি বলছে?”

-“শুরুতে এক গাদা ঝাড়ি দিছিলো।তার এক লাইন বুঝেছিলাম।বলছিল বাড়ির কি যেন দিতে।উনি তাহলে আসবেন’

-‘ঠিক আছে যাও’

কুসুম মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।অর্ণব ভাবলো কুসুম হয়ত পাল্টা জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা কে কিন্তু সে তা না করে আরো একবার তার কম বয়সী আর অবুঝ হবার প্রমাণ দিয়ে চলে গেলো।অর্ণব বিছানায় হাত রেখে একটু হেল দিতে গিয়ে হাতের নিচে কি যেন পেয়ে পেছনে তাকালো।কুসুমের চুলের ক্লিপ।সেটাকে সরিয়ে এবার লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।কুসুম আবার উঁকি মেরে বললো,”সেমাই খাবেন?’

-‘না ‘

-‘পাকন পিঠা খাবেন?’

-‘না’

-‘চা খাবেন?’

-‘তোমায় খাব।আসো!’

অর্ণবের কথা শুনে কুসুম আর ওখানে রইলোনা।ভয় পেয়ে পালিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাওয়া ধরতেই মিশু ভাবীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো।ভাবী দুষ্টু করে হাসি দিয়ে বললো,’কি গো?বর দৌড়ানি দিলো নাকি?’

-“না বললো খেয়ে ফেলবেন আমায়’

ভাবী হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়লেন ধপ করে।তার হাসি শুনে মা খুন্তি হাতে রান্নাঘরে থেকে উঁকি দিয়ে বললেন,”কিরে মিশু হাসিস কেন?কি হলো?’

মিশু হাসির জন্য কথা ও বলতে পারছেনা।মা এবার কুসুমের দিকে চেয়ে বললেন,’কিরে?কেন হাসতেছে এমন?’

-‘কি জানি।আমি তো শুধু বললাম উনি আমায় বলেছেন খেয়ে ফেলবেন’

কথাটা শুনে মায়ের মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেলো।চুপচাপ আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন তিনি।
মিশু আরও বেশি করে হাসছে।মনে হয় হাসতে হাসতে আজ মরেই যাবে।
কুসুমের মা এইসব কথা শুনে ওর হাত ধরে টেনে ভেতরের রুমে নিয়ে এসে বললেন,’তোর কি আর কোনোদিন কান্ডজ্ঞান হবেনা?কোথায় কি বলতে হয় তা জানিস না?এগুলো কোন ধরনের কথা কুসুম?জামাই তোকে কি বলে না বলে কাউকে আর কোনোদিন বলবিনা!কি বললাম মনে থাকবে?’

কুসুম মাথা নাড়ালো।এবারও বুঝলোনা খেয়ে ফেলবে কথাটা এত হাসির যদি হয়ে থাকে তবে মা ওকে বকলো কেন?
অর্ণবকে সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করবে।কারণ এদের আবার জিজ্ঞেস করে সে আর হাসির মুখপাত্র হতে চায়না।চুপচাপ আবারও রুমে উঁকি মেরে অর্ণবকে দেখতে লাগলো সে।
অর্ণব বারান্দার গ্রিলের সাথে লেগে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।পুরো বাড়িতে গোশত রান্নার ঘ্রান মমম করছে।কুসুমের খুব খিধে পেলো।সকালে সেমাই খেয়েছিলো।গরুর গোশতের প্রতি আলাদা টান ওর।গিয়ে একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আসলো।এখনও রান্না হয়নি বলে পুনরায় অর্ণবকে উঁকি মেরে দেখতে চলে আসলো।এছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই আপাতত। মা আর মিশু ভাবী রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছেন।বাবারা বাহিরে।আর কলি টিভি দেখতে দেখতে সোফায় শুয়ে আছে।অর্ণবের ফোন আবারি জ্বলতে দেখে কুসুম ফোন হাতে নিলো।আবারও জুথির কল।
সাইলেন্ট ছিল বলে অর্ণব জানলোনা তার কল এসেছে।কুসুম রিসিভ করে ওর কাছে গিয়ে বললো,’ধরুনন, মিননয়ি আপু মনে হয় ফোন করেছে’

অর্ণব চোখ বড় করে ফোনের দিকে তাকালো।সেকেন্ডের সময় উঠছে।জুথি সব শুনছে।সাথে সাথে অর্ণব ফোন নিয়ে কেটে দিলো কল।তারপর বললো,’আমার ফোন ধরবেনা আর কোনোদিন।যদি কেউ ফোন করতে করতে বাড়িও চলে আসে তাও ধরবানা।বুঝেছো?

-‘কিন্তু মিননয়ি আপু…’

-‘ওর নাম নিবানা।আচ্ছা তোমার জানতে ইচ্ছে করেনা ও কে?’

কুসুম বললো,’আপনার অফিসের বান্ধুবী’

-‘আর কিছু হতে পারেনা?’

-“আর কি হবে?বউ তো আমি’

অর্ণবের মুখের কথা আবারও হাওয়া।এই মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন কথা বলে বসে যে মুখের কথাটা আর মুখে থাকেনা।বাপ বাপ বলে গলা দিয়ে পেটে চলে যায় আবার।
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৭
আফনান লারা
.
কুসুম চলে এসেছে ওখান থেকে।অর্ণব ভাবছে ফোনটা বন্ধ করে রাখবে কিনা।
.
কুসুম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমগাছটা মনযোগ দিয়ে দেখছিল।বিশাল বড় আমগাছটা।একটা আম ও নেই।মনে মনে সে ভাবলো গরমকালে কতইনা আম ধরবে এটাতে।আচার খাবে কিছু দিয়ে,আর কিছু দিয়ে আমসত্ত্ব বানাবে।বাকিগুলো মরিচের গুড়া আর লবণ দিয়ে মিশিয়ে খাবে।জিভে এখনই পানি চলে আসে।সেসময়ে অর্ণবের বাবা ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,”এই গাছের আম অনেক টক।আমরা খেতেই পারিনা।যত চিনি দেওয়া হোক না কেন টক যায়না।
মানুষ এমনি নিয়ে যায়।অনেক পুরনো তাই কাটতেই মন চায়না।কুসুম বললো,’টক আমার অনেক প্রিয়’

অর্ণবের বাবা হেসে বললেন,’তাহলে তো আমাদের বাড়ির একজন সদস্য হলো যে এই গাছের আম মুখে দিতে পারবে।’

বাবা চলে যাবার পর মাটির সরু পথটাতে একটা ছেলেকে দেখে কুসুম চেয়ে রইলো।পরনে ছিল ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট।তার সাথে ছিল কালো রঙের শার্ট কাঁধে কালো রঙের একটা ব্যাগ।সঙ্গে একটা মেয়ে।মেয়েটার গায়ে শাড়ী।কড়া নীল রঙের শাড়ী।ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে হেঁটে এদিকেই আসছিল।কুসুম এক ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।পোশাক দেখে শহরের মনে হলো তাদের।যাওয়ার সময় অর্ণবের সাথে জোরেশোরে একটা ধাক্কা লেগে গেলো ওর।
অর্ণবের শক্ত শরীরে ধাক্কা লেগে সে নিজেই ব্যাথা পেয়ে ব্রু কুঁচকে চেয়ে আছে এখন। অর্ণব ধমকিয়ে বললো কেন সে উন্মাদের মতন ঘোরাফেরা করে সবসময়।
কুসুম আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আসছে এদিকে।
মনে হয় শহর থেকে আসছে।অর্ণবের মনে হলো পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।মৃদুল আর জুথি নয়তো?তাহলে সে আজ শেষ।কুসুম ওকে এমন রোবটের মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ওখান থেকে চলে গেলো চুপচাপ।অর্ণব ভাবছে কি দিয়ে শুরু করবে।কিন্তু ঠিক তখনই সামনে মৃদুল এসে দাঁড়ালো।অর্ণব ওকে সরিয়ে বেরিয়ে গেলো জুথি এসেছে কিনা দেখতে।কিন্তু সেখানে জুথি ছিলনা।ছিল অন্য একটা মেয়ে।মৃদুল পেছনে তাকিয়ে বললো,’ও আমার বোন।ঘুরতে এলাম।আসার জন্য জোরাজুরি করলো তাই ওকেও নিয়ে এসেছি’

অর্ণব দম ফেলে ভেতরে চলে আসলো আবার।মৃদুল ওর পাশে সোফায় বসে বললো,’জুথি আমায়ও কল করেছিল।কথা বলিনি।আসলে আমিও বুঝতেছিনা কি করে ওকে বোঝাবো।তুই আমার কথা ধর,জুথিকে সামনা সামনি বোঝা।দেখবি ও বুঝে যাবে’

-‘তার জন্য আমার নিজের মনকে শক্ত করতে হবে।আমি ভেঙ্গে পড়েছি মৃদুল।কোনো কিছুতে আর শান্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। সব কিছু বিস্বাদ লাগে।’

-“কুসুম কই?’

কথাটা বলে মৃদুল সামনে তাকাতেই দূরে দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখতে পেলো।পরনে সবুজ রঙের সেলোয়ার কাামিজ।চুলে জুটি করা।ঠোঁটে হাসি।সে মৃদুলকে দেখছিল মনযোগ দিয়ে।মৃদুল চোখ সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,’ও?’

-“নাহ।ও কুসুমের ছোট বোন’

মৃদুল একটু নড়েচড়ে বসে বললো,’আমার দিকে ওমন তাকিয়ে আছে কেন?আমি বাচ্চা মেয়েদের মধ্যে ইন্টারেস্টেড না।ওকে বল আমাকে যেন এমন করে না দেখে’

অর্ণব মৃদুলের বোনকে বসতে বলে বললো,’আমারও ইন্টারেস্ট ছিলনা।ভাগ্য ইন্টারেস্টকে দুমড়ে মুচড়ে মুখের ভেতর পুরে পানি দিয়ে গিলিয়ে দিয়েছে।সো আমি কিছু বলছিনা এ বিষয়ে’

কুসুম ইয়া বড় ঘোমটা টেনে পিঠা আর সেমাই এনে রাখলো মৃদুলের সামনে।এরপর সালাম দিয়ে চেয়ে রইলো মৃদুলের বোনের দিকে।কি সুন্দর করে শাড়ী পরেছে, চুল বেঁধেছে।এর আগে এমনটা সে দেখেনি বলে আগ্রহ নিয়ে দেখছিল মেয়েটাকে।মৃদুল কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছে।কুসুম এত সুন্দর একটা মেয়ে জানলে অর্ণবের আগেই এসে সে নিজেই বিয়ে করে নিতো।কি সুন্দর তার কোঁকড়ানো চুল।চুলের কারণে আরও বেশি সুন্দর লাগে।কোনো কৃত্রিম সাজগোছ মেয়েটা করে আসেনি।অথচ তার চেহারার ঝলক যেন চিৎকার করে বলে যাচ্ছে মেয়েটার নিষ্পাপ হওয়ার যথাযথ প্রমাণ।
ওকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ণব বললো,’রুপে মোহিত হইওনা ভৎস।প্রথমত বয়সে সে বাচ্চা,দ্বিতীয়ত সে বিবাহিত ‘

মৃদুল হা বন্ধ করে বললো,’আচ্ছা তাই?এই মেয়েকে তুই প্রত্যাখান করে আসছিলি এতদিন?আমার তো মন চাইছে তুলে নিয়ে গিয়ে পরকিয়া করি’

অর্ণব কপাল টিপতে টিপতে বললো,’জানিনা এই পিচ্চি কবে মানুষ হবে।আমার দ্বারা হচ্ছেনা’

-‘আমাকে দে।পরকিয়া করে ম্যাচিউরিটি এনে দেবো।’

-“কুসুম হয়ত তোর এসব কড়া কথা বুঝতেছেনা বলে কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢুলছে,কিন্তু তোর পাশে যে তোর বোন বসে আছে সে কিন্তু বয়সে ছোট না।সব বুঝতেছে।মুখ বন্ধ করবি নাকি চটকানা মেরে তোর বকবকানি বন্ধ করে দিতাম?’

মৃদুল কুশন একটা কোলে ধরে অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’ক্যান?জ্বলতেছে তোর?একদিনেই গায়ে লাগছে?’

-“সেটা কখন বললাম।ধুর!তুই কি এসেছিস আমার মেজাজ আরও খারাপ করতে?আইডিয়া দে কি করে সামনে এগোবো’

দূর থেকে কুসুম অর্ণব আর মৃদুলের ফিসফিস করা আলাপ বুঝতে না পেরে চলে এসেছে ওখান থেকে।রুমে ঢোকার আগে দেখলো মিশু ভাবী আর কলি কিসের ব্যাগ এনে এনে বিছানায় রাখছে।মনে হলো ফুলের ব্যাগ।তাই সে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো এগুলো কেন।
ভাবী ওকে বললেন এখন যেন সে রুমে না আসে।কলি ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো রুম থেকে।কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা তার।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।তাই সে আবারও উঁকি দিয়ে মৃদুলের বোন মমকে দেখছে চুপিসারে। অর্ণব ওকে দেখতে পেয়ে ডাক দিলো এসে মৃদুলের সাথে কথা বলার জন্য।তাই ধীর পায়ে হেঁটে কাছে এসে দাঁড়ালো সে।মৃদুল হেসে বললো,’কেমন আছেন?’

-“ভাল।’

-“আমার বন্ধু ধমকায়??’

-“না’

-“এইটা মিথ্যা বললেন।আমার বেশ জানা আছে অর্ণব কাছের মানুষদের সাথে তিন লাইনে পাঁচবার ধমকিয়ে কথা বলে, সেখানে আপনাকে তো মনে হয় হাজারবার ধমকানো হয়ে গেছে ওর।’

কুসুম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।মৃদুল তার বোনকে বললো কুসুমের সাথে ঘুরে আসতে।তাই সে উঠে কুসুমের সাথে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো।
মৃদুল এবার অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’শোন।যা হবার তা তো হয়েই গেছে।মেয়েটাকে কষ্ট দিস না।ওর মুখ দেখে এখন আমার খারাপ লাগছে।আমি আগে ওর ব্যাপারে কত কি বলেছিলাম তোকে।বাচ্চা একটা মেয়ে।ওকে বুঝিয়ে,পড়িয়ে নিজের মতন করে নে, দেখবি শান্তি আবার ফিরে এসেছে’

অর্ণব এক দৃষ্টিতে সামনের ওয়ালের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’আমি চেহারায় মুগ্ধতা খুঁজিনা মৃদুল।যদি তাই হতো তবে বিয়ের আগে কুসুমকে দেখে আমি আবারও বিয়ের ব্যাপারে না করে দিতাম না।একটা মানুষ চেয়েছিলাম যে আমায় বুঝবে, আমি কেন তাকে জোর করবো আমায় বুঝতে?’

-“কুসুম ও তোকে বুঝবে।কিন্তু তার জন্য ওকে সময় তো দিবি।গাছের চারা মাটিতে বুনলে সেদিনই ফল পাস??’

-‘গাছ আর মানুষের মাঝে অনেক তাফৎ।সব চেয়ে বড় কথা হলো কুসুমের প্রতি আমার বিশাল আকারের রাগ জমে আছে কিন্তু রাগটা আমি চেয়েও প্রকাশ করতে পারছিনা।এ সবকিছুর জন্য ও দায়ী।কিন্তু আমি!ওকে শাস্তি না দিয়ে উল্টে নিজে শাস্তি পাচ্ছি তার সাথে শাস্তি পাচ্ছে জুথিও’

-‘এই শোন!কুসুমকে কিসের শাস্তি দিবি তুই?ও যে বাচ্চা তা বারবার প্রমান করছে,বয়সের কথা তো বাদই দিলাম।আর যাই হোক সে এখন তোর স্ত্রী হয়ে গেছে।ওকে তো আর ফেলে দিতে পারবিনা’

-‘সারারাত ঘুমোতে পারিনি।জুথির কথা ভেবে আমার কেমন যেন খালি খালি লাগছে সব।ওর সাথে এটা হওয়া উচিত হয়নি।একেবারেই উচিত হয়নি।আমি ওর মতন একটা মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলাম’

মৃদুল পিঠা একটা মুখে পুরে বাড়িটার সামনে ঘুরতে যেতে যেতে বললো,’এর কারণে আজ সে তোর স্ত্রী নয়।
মানুষ যাকে চায় তাকে পায়না।আর যাকে চায়না তাকেই পায়।যাকে পায় তাকে নিজের মনমত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়।এমন করেই জীবন সংসার।তোকে সংসারের সংজ্ঞা বুঝতে হবে।দুজন পারফেক্ট মানুষ একই জুটিতে আবদ্ধ হতে পারেনা।যদি হয় তবে তাদের স্বভাবের এত মিলের কারণে সংসার স্বাদহীন লাগে।কুসুমকে নিজের মতন করে সাজিয়ে নেওয়ার যে মূহুর্তগুলোর সাথে তুই পরিচিত হবি তখন বুঝবি মৃদুলই ঠিক ছিল’

অর্ণব ভাবছে অনামিকা ওকে এমন ছ্যাঁকা দিছে।ব্যাটা কবি হয়ে গেছে।যাহা বলে অন্তরস্থল থেকে বলে।স্যার সে কারণে সবসময় ওকে ভাষণ দেওয়ার দায়িত্ব টা দিতেন।

কুসুম কোথা থেকে ছুটে এসে বললো,’আপনার ফোন আবার জ্বলছে।
ধরিনি।আপনি তো মানা করেছেন’

অর্ণব এবার বললো,’ফোন ধরবানা, ফোনের দিকে তাকাবেও না।কি বললাম মনে থাকবে?’

কুসুম কিছু না বলে আবার চলে গেছে।মৃন্ময়ীর ফোন কেন অর্ণব ইচ্ছে করে ধরছেনা তা ভাবছিল সে।আপুটা কি কোনো দোষ করেছে?তার দোষ কি আমার চেয়েও বেশি?
তাহলে উনি আমাকে যেমন ধমকালেন উনাকে ওরকম ধমকালেই তো হয়।রাগ কমে যেতো তাতে।
এরপর লুকিয়ে মিটমিট করে হাসতেন।যেমনটা আমকে বকে আবার তার ঠোঁটের কোণায় আমি হাসি দেখেছিলাম সেরকম।’
চলবে♥