শখের সাদা শাড়ি পর্ব-০১+০২

0
503

#শখের সাদা শাড়ি
#ফাতেমা_তুজ
#পর্ব-০১+০২

উর্মির বিয়ের শাড়ির রঙ সাদা। বর পক্ষ কনের জন্য সাদা শাড়ি দেওয়া তে সকলে চটে গিয়েছেন। মগের মল্লুগ নাকি! বিয়ের শাড়ি হবে লাল নীল কত শত গাঢ় রঙ। সেটা তো দেওয়া হয় ই নি বরং সাদা রঙের মলিন এক শাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। সকলে বেশ তিক্ত। তবে বিয়ের কনের মুখের রা অব্দি নেই। ধীর হস্তে ফোন তুলে। ফোনের ভাঙা স্ক্রিন। আজ সকালেই ভেঙেছে। এক টা ম্যাসেজ দেখা যাচ্ছে। ম্যাসেজ টা কার সেটা জানে উর্মি। ভগ্ন হৃদয়ের তাজা সব দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বসে থাকে। এ জীবনের দৈর্ঘ্য এতো বিশাল না হলে ও পারতো।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমঝোতা বলে যে শব্দ রয়েছে তাকে ঠিক ঠাক বর্ননা করলে দেখা যাবে যে নারীর সমপর্ন। এই তো দুদিন আগেই বরের বাড়ি থেকে লাথি মেরে বের করা হলো মেঘনা কে। পেটে চার মাসের সন্তান। মেঘনার দোষ হচ্ছে দিন রাত না খেয়ে স্বামী সেবা করা। এটাই তার দোষ। এটা কে ইতিবাচক ভাবে না দেখে যদি ভাবনা কে পরিবর্তন করে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণে ফেলা হতো, তাহলে হয়তো তাকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হতো না। যেদিন স্বামী প্রথম গায়ে হাত তুলেছিলো সেদিন সমঝোতার নাম ডুবিয়ে পাল্টাঘাত করে আসলে আজ পেটের সন্তান টা বেঁচে যেতো। ও হ্যাঁ আজ ও বেঁচে আছে। সেটা শুধুমাত্র ই উর্মির দয়া কিংবা মায়া তে। মাত্র অনার্স শেষ করলো। চাকরির টেনশন টা মাথায় ছিলো না এখন। তবে এই সময় টায় দাঁড়িয়ে টেনশন টা এসেছে পুরো ঢাক ঢোল পিটিয়েই। হাতে ফাইল নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে হয়। চাকরি না পেলে বোনের পেটের বাচ্চা টার দায়িত্ব নিবে কে?
উর্মি ঘামছে। এই বুঝি ইন্টারভিউ সেশনে তার নাম কল করা হলো। বুকের ভেতর ধীম ধীম শব্দ হয়। উর্মি বসা থেকে উঠতে গিয়ে দেখে পায়ের স্লিপারের এক কোন ছিঁড়ে। কোনো মতে টেনে টুনে ইন্টারভিউ রুমে প্রবেশ করলো। গত কয়েক দিনে এতো ইন্টারভিউ দিয়েছে যে উর্মি এখন ইন্টারভিউ কে ঐ ম্যাথ এক্সামের সব থেকে সহজ যোগের মতো ভাবে। যা পারে ঠিক তবে ফলাফল কেমন করে যেন শূন্য হয়ে যায়। কালের বিবর্তন কিংবা পরিমাজন বোধহয় আজকাল ঐ যোগ বিয়োগ কে ও স্পর্শ করেছে। এগিয়ে গেছে দুনিয়া। দেহে শক্তি ফুরিয়ে আসে। এক হাতে দরজা টা ঠেলে ভেতরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। চোখ রাখে স্বীয় হাত বর‍াবর।
” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনার নাম? ”

” উম্মে উর্মি। ”

” পড়াশোনা কোন ক্লাস? ”

” এই ইয়ারে অর্নাস শেষ করেছি। ”

” জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়? ”

” জী। ”

” গুড। রেজাল্ট ও খুব ভালো। তবে কথা হচ্ছে ডিউটি করতে হবে রাত দুপুরে আই মিন দুপুর একটা থেকে রাত আট টা অব্দি কিংবা তার ও বেশি। মাঝে লাঞ্চ টাইম স্ন্যাকস টাইম আর রেস্ট টাইম মিলিয়ে পাবেন দুই ঘন্টা। ”

” ফুল ডে সিফট? ”

” হচ্ছে না। আমাদের ফরেন কান্ট্রির সাথে যতো ধরনের অনলাইন সেশন থাকে সেটা রাতেই করতে হয়। এজ অ্যা প্রজেক্ট ম্যানেজার, মিটিং এ শুরু তে না থাকলে ও শেষে অবশ্যই থাকতে হবে। নতুবা নেক্সট ডের জন্য যেই সিডিউল গুলো সেটা চেঞ্জ হয়ে যাবে। কোম্পানি কেন ই বা আপনাকে এই পোস্ট তথা প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিবে নিজের লস করে। ”

সত্য কথা স্বীকার করতে দোষ নাই। লোক টা ঠিক ই বলেছেন। তবে রাতের পরিবেশ যেমন রিক্স ঠিক তেমনি সামাজিক দিক থেকে নিচু। উর্মি ভাবলো এ সমাজে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। কেউ এক বেলা দু মুঠো ভাত দিবে না। উর্মি রাজি হয়ে গেল এবং তাকে জানানো হলো এক ঘন্টার জন্য ওয়েটিং জোনে বসে থাকতে। পরে ডেকে নেওয়া হবে। উর্মি উঠে চলে এলো। যাওয়ার পূর্বে ঠোঁটের অগ্রভাগ দুলিয়ে বলল ধন্যবাদ।

ক্ষিদে তে পেটের নাজেহাল। পেট বাবা জি যে এতো টা সময় যাবত শান্ত আছেন এটাই উর্মির সাত পুরুষের ভাগ্য। সেই ভোর পাঁচ টায় নামাজ শেষ করে এক মুঠো মুড়ির সাথে টেলটেলে দুধের চা পান করেছে। এখন প্রায় বিকেল গড়াতে চললো। মাঝে সময় টুকু তে শুধুই এক বোতল পানি শেষ করেছে। তিন তিনটে জায়গায় ইন্টারভিউ দিলো। লোকাল বাসে চরে আজ যেন পিঠ বেকে গেছে একদম। ঘামের দুর্গন্ধ এখন অব্দি নাকের মাঝে আধিপত্য চালায়। সেশন শেষ করে আধ ঘন্টা বসলো। তারপর আশপাশ খুঁজে একটা টং এর দোকান থেকে রুটি কলা কিনে চিবুতে লাগলো। যাক অল্প দামে পেটের ব্যধি সেরেছে তবে। এক ঘন্টা পরেইসউর্মি কে আবার ডাকা হলো। হাতে তখনো কলার অর্ধেক অংশ। ঝটপট মুখে পুরে মিটিং রুমে এলো। ভয়ে অন্তরে বাক বাকুম পায়রা চলে। কম্পমান কন্ঠের রেশ টা ধরেই জিঙ্গাসা করে–
” আমার কি চাকরি টা হয়েছে স্যার? ”

” কনগ্রাচুলেশন্স উম্মে উর্মি। আপনি এই প্রজেক্ট এর প্রজেক্টর ম্যানেজার হিসেবে সিলেক্ট হয়েছেন। ”

বিস্ফোরণ ঘটে যায় উর্মির দেহে। কাঁপতে থাকে কচি পাতার মতো। সৌমেন হাসি মুখে একটা পেপার এগিয়ে দেয়। যাতে উর্মির নিয়োগ হওয়ার সমস্ত ডিটেলস। স্পষ্ট করে লেখা আছে তিন মাসের কাজ দেখে তবেই চাকরি কনফার্ম হবে। উর্মি খুশির কারনে আত্মহারা হয়ে পরে। অপেক্ষা করার সময় মনে হয়েছিলো বাকি চাকরি গুলোর মতো এটা তে ও ফলাফল আসবে শূন্য। তবে সৃষ্টিকর্তা তেমন টা চান নি।

মিষ্টির প্যাকেট ধরে মেঘনা বলল–
” কিসের মিষ্টি। ”

” আমার চাকরি টা হয়ে গেছে রে আপা। ”

” চাকরি হয়ে গেছে? ”

” হ্যাঁ। জানিস আপা বেতন দিবে বাইশ হাজার টাকা। মাস্টার্স কমপ্লিট করতে পারবো এবার। কি যে ভালো লাগছে।”

” ইস আমার জন্য তোর কত কষ্ট। যদি আমি ও অনার্স কমপ্লিট করতাম। তাহলে ঠিক নিজের পেট নিজেই চালাতে পারতাম। আমার সন্তান টা ও — ”

” মুড নষ্ট করিস না প্লিজ। আমি তো আছি তাই না। আর তোকে অনেকবার বলেছি আমি, আপা প্লিজ অন্ততপক্ষে অনার্স টা শেষ কর। মাত্র কিছু মাসের বিষয়। তখন তুই দুলাভাই এর প্রেমে এতোই হাবুডুবু খাচ্ছিস যে আমার কথা আমলেই নিলি না। ”

উর্মি দেখলো মেঘনা মাথা নত করে কাঁদছে। বেশ খারাপ লাগলো। একটু বেশিই বলে ফেললো বোধহয়।
” এই আপা দেখ আমার দিকে। ”

” আমি খুব স্যরি রে বোন। আমার আর আমার সন্তানের জন্য তোকে কত কথা শুনতে হলো। ”

” চুপ কর আপা। আর কে কথা শুনিয়েছে বল? এরা তো আমার ঘরের লোক তাই না। বড় ভাইয়া কে আমি সম্মান করি। না হলে খুব করে দিতাম ঝামা ঘষে দিতে।তুই ই দেখ বড় ভাবি যখন সন্তান জন্ম দিলো তখন ভাইয়া বেকার। বাচ্চার ফিটার থেকে শুরু করে সাবান লোশন সমস্ত টা তো আব্বাই দিয়েছে। তাহলে? ”

শুকনো হাসে মেঘনা। বলতে ইচ্ছে করে ভাইয়া তো বংশের বাতি নিয়ে এসেছে। আর আমার সন্তান তো অন্ন ধ্বংস করবে।

পরদিন বিকেলে আসর জমেছে। উর্মি মেঘনা কে ডেকে পাশে বসালো। সত্যি বলতে পরিবারের মনমালিন্য ভালো লাগে না তার। একটু সুখ শান্তি তে বাঁচতে চায়। তাছাড়া চাকরি পাওয়ার খবর টা বড় ভাবির কানে ও গিয়েছে। আপাততো তিনি মুখ খুলবেন না। বরং চেষ্টা চালাবে উর্মির সেবা করার। এতে করে উর্মির মন যে আইসক্রিম হয়ে গলবে। তখন তার ছেলের জন্য মাসে মাসে যে দুই হাজার টাকা করে সঞ্চয় করতো সেটার কথা বলবে। এখন টানাটানি চলছে। কয়েক মাস হলো সঞ্চয় করতে পারছে না। যদি এ যাত্রায় হাজার দশেক টাকা হাতানো যায় উর্মির থেকে। উর্মির সামনে মুড়ি আর ভাজা তুলে দিলো। উর্মি বলল–
” বাড়ি তে না ডাল নেই। ”

” তোর ভাইয়া কে দিয়ে আনালাম আজ। সকাল থেকেই তো শুনছি কি যেন গান বাজনার আসর করবি। ”

” ও খুব ভালো করেছো। বসো তুমি ও। ”

উর্মির পাশে বসলো জোৎস্না।পাশে বসলো ছোট ভাবি তুলি। বয়সে উর্মির থেকে ঢের বড় তবে ভাব দেখায় অষ্টাদশির মতো।গত বছরের শেষ সপ্তাহে বিয়ের বয়স হয়েছে চার বছর। এখনো নাকি তার সন্তান ধারণ করার উপযুক্ত গঠন হয় নি। উর্মি তখনি প্রতিবাদ করে বলে হবে কেমনে আমার চাঁদের মতো ভাই টার গলায় ঝুলে পরেই তোমার কামসাড়া। বিয়ের পর এক রাত্রি ও বাপের বাড়ি থাকো নাই। স্বামী রে তো আঁচলের তলায় বেঁধে রাখো তারপর ও বলো বাচ্চা নেওয়ার বয়স হয় নাই। এসব কথা উর্মি মনে মনে স্মরণ করে। মুখ ফুটে আসে না। পাছে যদি ভাইয়া কষ্ট পায়। এমন তো না ভাইয়া ভাবির সুখ দেখতে পারে না সে। শুধু মাত্র তুলির করা কিছু বদআচারণ তার গায়ে লাগে। এর পেছনে ও কারন রয়েছে। তুলি প্রায়শই বড় ভাবির বদনাম করে পাশের বাড়ির সুলেখা ফুপুর কাছে। ভদ্রমহিলার হচ্ছে আবার আরেক দোষ। স্বামীর বাড়ি তে ভালো লাগে না। মাসের উনত্রিশ দিন ই বাপের বাড়ি পরে থাকে। অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার দরুন দুই টা কথা শোনানোর লোক নেই। অথচ এই মহিলার মুখেই শোনা যায় পুরো মহল্লার কোন মেয়ে কতো দিন ধরে বাপের বাড়ির অন্ন ধ্বংস করছে।

আসর শুরু হয়েছে। তুলি একটু মন খারাপের মতো করে বলল–
” আহা গো আমার স্বামী থাকলে কতোই না ভালো হতো। ”

” ভাইয়া কই গেছে ভাবি? ”

তুলি নিশ্বাস ছাড়ে। যেন কতো কাজের পর এই মাত্র ফুসরত পেয়েছে। তুলি উত্তর না দেওয়া তে মনে মনে চরম ভাষায় গালি দিয়ে ও দিলো না উর্মি। মেঘনার মুখ টা কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। উর্মি একটু নিচু স্বরে বলল–
” ভাইয়ার অফিস থেকে দুই দিনের জন্য চিটাগাং ট্যুরে গেছে। ”

” ও। ”

” কবে যে আসবে। ভালো লাগে না আর। ”

তুলি আসর ছেড়ে উঠে গেল। উর্মি ঠোঁট টা উল্টিয়ে তাকালো। মেঘনা আর বড় ভাবি কে নিয়ে টুকটাক কথা চললো। রাতের খাবারের ঠিক আগের মুহূর্তে সৌমেন এর কল। ঝটপট কল রিসিভ করে।
” হ্যাঁ স্যার। ”

” উর্মি, শোনো আমাদের আর্জেন্ট মিটিং পরে গেছে। তোমাকে আসতে হবে। ”

” কিন্তু স্যার আমার জয়নিং ডেট তো আগামীকাল। তাছাড়া এখন সন্ধ্যা সাত টার উপরে বাজে। ”

” কোম্পানির জন্য সেক্রিফাইস করতেই হবে। ইটস আর্জেন্টস। আদার ওয়াইস কোম্পানির ভালো চিন্তা করতে আমি বাধ্য হবো। ”

ফোন নামিয়েই নিজ ঘরে দৌড় লাগায় উর্মি। হাতে সময় নেই। এতোশত ভাবা ও যাবে না। এখন ওর মস্তিষ্কে শুধু কখন অফিসে পৌছাবে সেই চিন্তা।

#শখের_সাদা_শাড়ি
২.
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে নয় হয়েই গেল। এই ঝামেলা টা না এলে কি এমন যায় এসে যেতো! ছাতা মাথায় হাঁটা দেয় উর্মি। টেউ খেলানো এই জীবন টা গাছের পাতার মতো। সময়ে অসময়ে ঝরা যেন বিশেষ কোনো দায়িত্ব। দশ মিনিট হাঁটার পর রিক্সা পেল। ভাড়া আশি টাকা। অথচ বাস দিয়ে গেলে লাগতো বিশ টাকা। এখন টাকার মায়া করলে হবে না। আশি টাকা ভাড়া তেই রিক্সায় উঠে পরলো। এই তুমুল বৃষ্টি তে রিক্সার বাঁকানো হুডে মাথা তো বেঁচে গেল তবে দুই হাঁটু তে ঠিক ই পানি পরছে। উর্মি রিক্সা ওয়ালা মামা কে জিজ্ঞাসা করলো পলিথিন হবে কি না। মামা বললো নেই। চরম বিরক্তি নিয়ে বসে রইলো উর্মি। ছাতা টা আধ ফুটো করে ধরলো হাঁটুর বরাবর। এতে কিছুটা রক্ষা হলো। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিতেই মামা বললেন–
” আপা আর বিশ টাকা দেন। ”

” কি বলেন মামা। এই টুকু পথের ভাড়া তো পঞ্চাশ টাকা। সেখানে আশি টাকা নিলেন। এখন আরো বিশ টাকা চান। ”

লোক টা কিছু বললো না। একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ চলে গেল। উর্মি কে দেখে ভেবেছিলো খুব বড়লোক গোছের কেউ। তাই সুযোগ বুঝে বিশ টাকা আরো বেশি চাইলো। উর্মি হা করে তাকিয়ে থেকে ছাতা খুলে। এই যুগে সবাই সুযোগ বুঝে। আর মধ্যবিত্ত দের পরতে হয় বিপাকে।

সৌমেন ছুটোছুটি করছে। উর্মি কে দেখে ও না দেখার ভান করে চলতে লাগলো। উর্মি বুঝলো যে জয়েনের আগেই ভুল করে বসেছে। কোম্পানি নিশ্চয়ই নিজের স্বার্থ দেখবে। ইমপ্লয়ির অভাব নেই যেখানে, সেখানে কেন ই বা অধিক সুযোগ দেওয়া হবে উর্মি কে। ছাতা গুটিয়ে এক সাইটে রাখলো। তারপর ব্যাগ থেকে ছোট একটা রুমাল বের করে হাঁটুর দিক টা মুছে ফেললো। সৌমেন এক টা মেয়ে কে পাঠিয়েছে। সম্ভবত তার পি এ। সব সময় পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।
” আপনি আমার সাথে আসুন। ”

” জী। ”

” উম্মে উর্মি রাইট? ”

” ইয়েস ম্যাম। ”

” আপনার কাজ হচ্ছে প্রজেক্ট এর সকল সিডিউল তৈরি করা। তাছাড়া আরো কিছু কাজ আছে সেটা ও জানানো হবে। ”

” আচ্ছা ম্যাম। ”

” জামা বদলে ফেলুন। বিদেশী দের মাঝে স্মার্ট দেখাতে হবে। এই যে আপনার ড্রেস কোড। তিন স্যুট পাবেন। একদিন পর পর বদলে আসবেন। আর প্রতি সপ্তাহে লন্ড্রি থেকে ড্রাই ওয়াস করাবেন। ”

” আচ্ছা। ”

অগোচরে মুখ বাকায় উর্মি। কোন ঠেকা লন্ড্রি থেকে ড্রাই ওয়াস করার। উর্মির হাতের জাদু তে লন্ড্রি পাত্তা পাবে না। অফিসের কোড ড্রেস পরে নিয়ে আয়নায় তাকালো উর্মি। কেমন কেমন যেন লাগে। পোশাক যদি ও শালীন তবু ও আনইজি লাগছে। চুলে বেনী করা ছিলো সেটা খুলে নিয়ে উচু করে ঝুটি বাঁধলো। মন্দ লাগছে না।

সৌমেন কে বেশ ব্যস্ত দেখাচ্ছে। মুখের অভিব্যক্তি বলে দেয় কতো টা গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ। হাতের সাহায্যে শব্দ করে এক একজন কে জড়ো করলো।
” লিসেন এভরিওয়ান। মিটিং টা আর্জেন্ট ভাবে এরেঞ্জ করা হয়েছে। এতে হয়তো আপনাদের সবাই কে প্যারা নিতে হলো। বাট কোম্পানির প্রফিট মানে আপনাদের সবার প্রফিট। এই টাকাতে আমি যেমন খাই আপনারা ও ঠিক তেমনি। আই হোপ সবাই নিজেদের বেস্ট দিয়ে চেষ্টা করবেন। আর আমরা সফল হবো। ”

সৌমেনের কল এলো। ফোন রিসিভ করে কিছু কথা বলল। তারপর ই ডাকলো ওর পি এ মাইশা কে। মাইশা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। সৌমেন কিছু নির্দেশনা দিয়ে বলল
” দ্রুত কাজ করবে। ”

” ওকে স্যার। উর্মি কে পাঠাই? ”

” পাঠাও। ”

” উর্মি শুনেন। ”

কাপড় দেখছিলো উর্মি। ফ্যাশন হাউজ মানেই চোখ ধাঁধানো সব জামা কাপড়। এক একটার দাম হাজার থেকে লাখ টাকা।
” ইয়েস ম্যাম। ”

” বাহিরে গিয়ে দাড়াবেন। অনেক গুলো কস্টিউম আসবে। সব গুলো চেইক করে নিয়ে আসবেন। ”

” আচ্ছা। ”

” যে নিয়ে আসবেন অর্থাৎ ডিজাইনার এর নাম হচ্ছে সমীর শাহ। ”

” ঠিক আছে ম্যাম। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। ”

কাগজ আর কলম নিয়ে বাইরে এলো উর্মি। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে গাছের কচি পাতা গুলো তে এখনো পানি। টপটপ করে ঝরছে হালকা বাতাসে। মিনিট পাঁচেক পর একটা বড় গাড়ি এসে থামলো। ড্রাইভার সহ আরেক টা ছেলে বের হয়ে এলো। লম্বা দেহের রোগা পাতলা ছিম ছাম চেহারা। উর্মি এগিয়ে গেল। ছেলেটা শার্টের হাতা ফোল্ড করছে।
” সমীর শাহ? ”

” ইয়েস। আপনি কি উম্মে উর্মি। ”

” হুম। ”

” ও আচ্ছা। আপনি আসুন আমার সাথে। আমি কস্টিউম গুলো চেইক করে দেই।”

সমীর কস্টিউম চেইক করে দিলো। পুরো আটত্রিশ টা কস্টিউম। আধ ঘন্টা লাগলো সব মিল করতে। এদিকে সময় সাড়ে আট টা। উর্মি একজন লোক কে বললো সব গুলো কাপড় সাবধানে ভেতরে নিয়ে যেতে। সমীর চাচ্ছিলো না ভেতরে যেতে। তবে পেমেন্ট নেওয়ার জন্য যেতেই হলো। সৌমেন এর সাথে বেশ ভালোই সম্পর্ক। সমীর হেসে এগিয়ে গিয়ে সৌমেন কে জড়িয়ে ধরলো।সৌমেন বলল–
” সব ঠিক ঠাক হয়েছে তো? ”

” অলমোস্ট ডান। তাছাড়া মিস উর্মি তো চেইক করেছেই। ”

উর্মির দিকে তাকালো সৌমেন। উর্মি কাজ করছে। যাক ভালোই তবে। সমীর এর একটু তাড়াহুড়ো তাই সৌমেন ও ধরে রাখলো না। পেমেন্ট বুঝিয়ে দিলো।

অফিস থেকে বের হওয়ার সময় সমীরের সাথে আর একবার দেখা হলো উর্মির। মেয়েটি তাকে দেখে মৃদু হাসলো। গড়গড় করে বলল–
” আপনার হাতের কাজের প্রশংসা করতেই হয়। যা সুন্দর হয়েছে। আমি তো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েই ছিলাম। ভারী সুন্দর। ”

” এগুলো আমি করি নি। আমি ডিজাইন করেছি শুধু। ”

” সেটার কথাই বলছি। দারুন হয়েছে। ”

” থ্যাংকস। আপনাদের পছন্দেই আমার পেট চলে। ”

হালকা হাসলো উর্মি। সমীর বলল–
” আজ আসি। আবার দেখা হবে। ”

উর্মি ও সম্মতি জানায়। সমীর চলে যাওয়ার পর পর ই সৌমেন এর কল আসে, ঝটপট রিসিভ করে সে।
” হ্যালো স্যার। ”

” দ্রুত আসো উর্মি। মিটিং এখনি শুরু হবে। ”

” আমি এখনি আসছি। ”

মিটিং রুমের অবস্থা দেখে হা হয়ে গেল উর্মির মুখ। দুই ঠোঁটের মাঝ খানে তৈরি হলো মৃদু ফাঁক। এতো সব মডেল দাঁড়িয়ে আছে যে সে বুঝতে পারছে না কিছুই। মাইশা এসেই এক টা খাতা কলম ধরিয়ে দিলো। এই নাম অনুযায়ীই মডেল ডাকা হবে। সৌমেন যেন একটু পর পর ই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। এতোক্ষণ পর একটা পজিশন পেলো। অবশেষে অনলাইন মিটিং শুরু হলো। উর্মি একে একে মডেল ডেকে যাচ্ছে। আধ ঘন্টার মাঝেই মিটিং শেষ। ক্লাইন্ড এর হাফ ভাব দেখে যা মনে হলো তাঁরা বেশ খুশি। সৌমেন কে অনেক টাই রিফ্রেশ দেখাচ্ছে। তবে উর্মি আবার ব্যস্ত। সে কালকের জন্য সিডিউল তৈরি করছে। মাইশার চোখ টা তখন উজ্জ্বল। সে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলল–
” দেখে নিবেন স্যার আজকের সেশন টা সফল হবেই। ওনাদের চোখ মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছি আমি। ”

” এতো নিশ্চিত হইয়ো না। লাস্ট সেশন এর কথা মনে আছে তো? ”

মাইশার মুখ টা মলিন হলো। গত বারের সেশন টা খুব ভালো ছিলো। তবু ও বিফল হয়েছে। সৌমেন এর মতে অন্য কোম্পানি থেকে কারসাজি করা হয়েছে।
” উর্মি কে পাঠাও। আমি সিডিউল চেইক করবো। ”

” ওকে স্যার। ”

মিনিটের মাঝেই উর্মি উপস্থিত। সৌমেন ক্লান্ত দেহ টা এলিয়ে বসলো। চোখের ইশারায় বসতে বললো উর্মি কে। উর্মি কে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মাথা টা উঁচু করে সৌমেন বলল–
” তোমার কাজ ভালোই ছিলো। তবে সব থেকে বেশি যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে আগ্রহ। আমি খুব ই খুশি তোমার উপর।”

” ধন্যবাদ স্যার। ”

” ডিনার করতে পারো নি নিশ্চয়ই? ”

” না মানে বসে ছিলাম মাত্র। তখনি কল আসলো। আর ঝটপট তৈরি হয়ে এসে গেছি। ”

” হুম বুঝেছি। এখন ফ্রি টাইম আছে। ডিনার করে যাবে। ”

” না না সমস্যা নেই। আমি বাসায় গিয়েই করবো। ”

” ইটস অর্ডার। ”

নুইয়ে গেল উর্মি। সকলের জন্য ই ডিনার আনা হয়েছে। অল্প করে খাচ্ছে উর্মি। অথচ ওর ই অপর প্রান্তে বসে গপ গপ করে খেয়ে চলেছে সৌমেন। এতো টাই ক্ষুধার্ত! বয়সের কিংবা অন্য কোনো কাজের এক টা রেখা নেই মুখে। এই ত্রিশ বছর বয়সেও কতো টা সতেজ।

চলবে….