শখের সাদা শাড়ি পর্ব-১৭+১৮

0
262

#শখের সাদা শাড়ি
#ফাতেমা তুজ
পর্ব-১৭+১৮
১৭.
তুলি রাগ দেখিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। সৌজন্য দু একবার ফোন করা সত্তে ও তুলির বাবা মুখের উপর সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ে দিবেন না। আর খুব দ্রুত নাকি ডিভোর্স ফাইল করা হবে।ঝোকের বসে বিয়ে করেছিল সৌজন্য। তাই কাবিন এর টাকা টা বসিয়েছে পনেরো লাখ। তুলি বড়লোকের মেয়ে। সে যখন পনেরো লাখ টাকা কাবিন এর কথা বললো স‍ৌজন্য নিজেকে প্রভাবিত করে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল। কারণ স্বপ্নে ও ভাবে নি দুজনের ছাড়াছাড়ি হবে। এদিকে সেভিং এর টাকা টা ও করেছিল তুলির নামে। সেটা থাকলে ও কিছু একটা সাহায্য হতো। এতো গুলো টাকা কোনো ভাবেই সৌজন্যের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। কি দিন কাল এলো ভালোবাসার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন টাকার চিন্তা করতে হয়।একবার ভাবলো বাড়ি টা বিক্রি করবে কিন্তু নিজের ভাগের টা বিক্রি করলে ও খুব হলে এই অসময়ে সাত লাখ টাকা আসবে। এর বেশি পেতে হলে অপেক্ষার প্রয়োজন। উর্মি আর মেঘনা নিজেদের অংশ দিয়ে দিবে বলে স্থির করলো। ঠিক তখনি বের হলো বাড়ি টা আটকা পরে আছে ব্যাংক এ। নোটিশ দেওয়া হয় নি ষড়যন্ত্র করে। এতো শতো চিন্তা এসে উদয় হলো যে উর্মি সহ সকলের মাথা খারাপ। বড় ভাবি কান্না জুড়ে দিয়েছেন। স্বামীর বেতন ভালো না। অতি সামান্য ই সেভিং পরে আছে। অন্তুর ভবিষ্যৎ একে বারেই ফাঁকা। মেঘনা খুব ই বিরক্ত। আজকাল এমনি তেই আবেগ এর থেকে মেজাজ চলে বেশি। ব্যক্তি গত জীবনে খুব একটা সুখে নেই যে। উর্মি ভেতরে ভেতরে একে বারেই ভেঙে গেছে তবে বাইরে টা নারিকেলের মতোই শক্ত। জীবনে প্রথম বারের মতো সৌজন্য কেঁদে উঠলো। খুব ছোট সময়ে কাঁদলে ও একটু বুঝ হওয়ার পর থেকে কেন যেন ছেলেটার চোখে কখনো জল আসে নি। কেমন যেন শক্ত ধাঁচের। এটা সত্য তুলি কে খুব ভালোবাসে সে। না হলে স্ত্রী এর কথা তে পরিবার কে কেউ অবহেলা করে? নিজের ভুলে পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ভাইয়া। এসব দেখে উর্মির মনে চলছে নিরব ঝড়। যে ঝড়ে উর্মি কে সঙ্গ দেবার জন্য কেউ নেই। ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরে সৌজন্য। অমর খুব একটা সান্ত্বনা দিতে পারলো না। সঞ্চয় যা আছে এতে করে নিজেদের ই টানাটানি লাগবে। এদিকে ব্যাংক এর লোন বেড়ে গিয়ে হয়েছে বিশ লাখ টাকা। এগুলো পরিশোধ না করলে মাস খানেক এর মাঝে পরিবার নিয়ে বের হতে হবে রাস্তায়। জোৎস্না চোখ রাঙালো। স্বামী সন্তান নিয়ে কেটে পরাই মঙ্গল। তবে অমর আসছে না দেখে তেঁতে উঠলেন তিনি।
” কি শুরু করলে তুমি? এখানে পঁচে গলে মরবে নাকি? আর কার জন্য ঠাই খুঁজো? দুদিন আগে ও যে বউ এর আঁচলের তলা তে পরে থাকতো। ”

” আহ জোৎস্না। ”

” একদম কথা বলবে না। চুপ থাকি বলেই আজ আমাদের কপাল পুরলো। ”

জোৎস্না আবার মরা কান্না জুড়ে দিলো। সৌজন্য ফুপিয়ে উঠে। অমর দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে চলে যায়। মেঘনা বসে আছে সোফা তে। পেটে চেঁপে রাখা হাত। মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বলে। উর্মি ধীরে ধীরে সব কাগজ পত্র ঘাটে। একে একে বের করে সমস্ত ডিটেলস। চোখের সামনে সব যেন ভাসে। বড় আপার বিয়ের জন্য বাবা লোন নিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিলো দুই লক্ষ। এখানে দেখাচ্ছে বারো লক্ষ। একে একে সব কাগজ ঘাটতে লাগলো উর্মি। এই যে লোনের কাগজ পত্র সব ঠিক করেছিল নয়ন ভাই। ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়া তে লোন টা ও খুব সহজেই পেয়ে গিয়েছিল। আর এই কারনেই নয়ন ভাই এর সম্মান ছিলো একটু বেশি। বিয়ের আগে থেকেই এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে এটাই ছিলো সকলের ধারণা। উর্মির মাথা টা ভন ভন করছে। একটা ব্রেক দরকার। সে যা ভাবার ভেবে নিলো। শেষ টা যাই হোক না কেন সব টা খোলসা করবেই।

সমীর কে নিয়ে আর্তনাদ চলছে বাড়ি তে। সব থেকে বেশি পাগলামো শুরু করেছেন সুস্মিতা বেগম। একমাত্র ছেলের জন্য প্রাণ যেন বেরিয়ে আসে। ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছে সৌমেন এর। এর কারণ জানা নেই। উর্মি এসেছিল অফিস এর ফাইল নিয়ে। কান্নার শব্দে স্থির হয়ে যায়। অনুজ কিছু একটা ভাবছে। যেন দ্বিধা তে ভুগছে। মাহফুজ সাহেব তীব্র বেগে চিৎকার করে যাচ্ছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন সমীর কে দীর্ঘ দিন ধরে এমন বি ‘ ষ দেওয়া হয়েছে যার ফলে সমীর এর ব্রেনের নার্ভ গুলো শুকিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পুরো দমে পাগল করার জন্য এই মেডিসিন এর ব্যবহার করা হয়। এসব ষড়যন্ত্র কার সেটা জানার জন্যই তিনি পুলিশের কাছে কেস ফাইল করেছেন। উর্মি কে দেখে বাড়ির কাজের লোক সরবত দিয়ে গেলেন। সরবতের তরল গলা দিয়ে নামছেই না।
অনুজ মাহফুজ সাহেব এর সাথে কথা বলে।
” আঙ্কেল আপনার সাথে আমার কথা আছে। ”

” বলো বাবা। আমার ছেলেটার অবস্থা ভালো হবে না তাই না? ”

” ভেঙে পরবেন না। ডাক্তার বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” সান্ত্বনা দিও না বাবা। ”

ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পরলেন। উর্মি মুখ চেপে ধরে আছে। চোখ দুটো কেন যেন ভিজে আসে। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে ভেতরে চলে গেল। ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে রইলো উর্মি। সমীর এর কল দেখে নিজেকে পরিপাটি করলো। কথা বলতে বলতে বের হলো বাসা থেকে।
” স্যার এর অবস্থা ভালো না সমীর। ”

” সেটাই শুনলাম। সেই জন্য ই তোমায় কল করেছি। ”

” ওও। ”

” তুমি কোথায় এখন? ”

” সৌমেন স্যার এর বাসা থেকেই বের হলাম। ”

” ঠিক আছে। ”

” তুলি ভাবির বিষয় টা? ”

” খোঁজ চালাচ্ছি। আমার এক বন্ধু আছে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। সে দেখবে বিষয় টা। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। ছোট ভাইয়া কে বড় অসহায় লাগে। ভালো লাগে না আর। ”

” তুমি খুব একা ফিল করছো তাই না? ”

” আরে না। একা ফিল কেন করবো। আমি ঠিক ই আছি। ”

উর্মির ভাঙা গলা বুঝতে পারে সমীর। চোখ দুটো ছলছল করছে। উর্মি কে খুব দ্রুত গুড নিউজ দিতে চায় সে। সে জন্যেই এখন চুপ রয়েছে।

” কি করো এখন? ”

ধ্যান ফিরে সমীর এর। গলা টা কেশে নিয়ে জানায় কাজ করছে। তারপর বলে
” আজ সন্ধ্যায় সময় আছে তোমার? ”

” হ্যাঁ। এখন তো অফিসে কাজ ও হয় না। স্যার যাওয়ার পর যা হলো। কি জানি চাকরি টা থাকবে কি না। বাড়ির লোন আর ছোট ভাবির কাবিন এর টাকা। একে বারে পয়ত্রিশ লক্ষ টাকার ধাক্কা। ”

টাকার অংক টা এতো বেশি যে কোথাও থেকে সাহায্য চাওয়ার ও পথ নেই। উর্মি হাসার চেষ্টা করে।
” তবে দেখি কি করা যায়। ”

” হুম। আর শোনো,আজ শৌখিন এর সাথে দেখা করবে সন্ধ্যায়। ও আমার গোয়েন্দা বন্ধুর ব্যপারে খোঁজ দিবে আর তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। ”

” আচ্ছা। ”

অফিস থেকে কাজ সেড়ে শৌখিন এর সাথে দেখা করলো উর্মি। এক টা কেস নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে আধ ঘন্টার মতো লেট হলো প্রবীণের। ছেলেটা খুব করে আশা দিয়েছে উর্মি কে। আর যাই হোক সত্য টা বের করে দিবে সে। এতে করে বেশ ভরসা পেল উর্মি। তবে বাসায় ফিরে দেখলো অবস্থা খারাপ। রান্না হয় নি আজ। মেঘনা কোনো মতে কিচেনের দিকে আগাচ্ছে। উর্মি ছুটে গিয়ে বাঁধা দিলো। তারপর ডাল চাল ফুটিয়ে রান্না করলো। এক পর্যায় মনে হলো আজ তো ডাল ভাত জুটলো কপালে। তবে কাল কি হবে? কে জানে কি আছে কপালে।

তিন দিন পর
তুলি আজ পরেছে ওয়েস্টার্ন ড্রেস। লাল টকটকে লিপস্টিক ঠোঁটে। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে বসেছে বার এর সব থেকে শেষের টেবিল টা তে। উর্মি কে ফোন করেছে প্রবীণ। লোকেশন পাঠাতেই চলে এসেছে উর্মি। ট্যাক্সির ভাড়া দিয়ে ভেতরে আসলো। কল করতেই প্রবীণ চলে এলো। উর্মি চার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল
” বার এ কেন? ”

” ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবে। ”

” ছোট ভাবির কোনো ইস্যু? ”

” ইয়েস। ”

ব্যস্ত দেখালো উর্মি কে। খুব দ্রুত হাঁটা তে হাত ধরে ফেললো প্রবীণ। উর্মি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
” কি হলো? ”

” ধীরে যাও। না হলে কিছুই দেখতে পাবে না। ”

” ও আচ্ছা। ”

নিস্তব্ধ গতিতে হাঁটতে লাগলো উর্মি। প্রবীণ ক্ষণে ক্ষণে কারো সাথে কথা বলছে। দুটো মাক্স হাতে নিলো। এক টা মাক্স উর্মি কে দিয়ে আরেক টা নিজে পরে নিলো। আর তারপর দুজন এমন ভাবে ভেতরে গেল যেন গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। উর্মির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। যদি ও সমীর এর খুব ভালো বন্ধু প্রবীণ। তবে ওর জীবনে সমীর ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। জীবনে কোনো পুরুষের স্পর্শ পাওয়া হয় নি। তবে সমীর এর অনেক কাছাকাছি ছিলো। এক মুহুর্তের জন্য সেই ভাবনায় ডুবে গেল উর্মি। প্রবীণ ইষৎ টান দিতেই ছেলেটার কাছাকাছি চলে এলো। দম বন্ধকর পরিবেশ!

উর্মি হাফসাফ করছে। প্রবীন ওয়াইন এর গ্লাস এগিয়ে দিলো। উর্মি অবাক হয়ে বলল
” আমি এসব খাই না। ”

” আরে আমি ও খাই না। জাস্ট দেখানোর জন্য। ”

” ওও। ”

প্রবীণ এর অনুকরণ করলো উর্মি। দুজন ই মদের গ্লাস টা ঠোঁটের কাছে নিয়ে আবার রেখে দিচ্ছে। দেখে মনে হলো দুজনেই মদ পান করে। উর্মির গা গুলিয়ে আসে। বমি বমি ভাব হতেই ওয়াসরুমের দিকে যেতে নেয়। ঠিক তখনি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে নয়ন। গায়ে টি শার্ট। প্যান্ট এর হাঁটুর দিক টা স্টাইল করে কাঁটা আর ভ্রু তে লাগানো রিং। মাথার ক্যাপ টা পরা তে পুরোপুরি বখাটে লাগে। উর্মির মাথা ঘুরে যায়। বমির কথা ভুলে যায় সে। প্রবীন ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। উর্মি হতবিহ্বল! ইষৎ কাছে আসে প্রবীণ।কানের কাছ টায় ঝুকে বলে
” এখন দেখবে ফিল্ম টা। ”

হাতের আঙুল উপরে উঠিয়ে মৃদু স্বরে কাউন্ট করে প্রবীণ। উর্মি দেখতে পায় নয়ন ধীর পায়ে তুলির দিকেই আগাচ্ছে। এবার যেন উর্মি মাথা ঘুরিয়ে ই পরে যাবে। পায়ের তলা তে মাটি নেই বললেই চলে। প্রবীণ মুখ দিয়ে জিরো উচ্চারণ করার সাথে সাথে নয়ন আর তুলি একে অপর কে জড়িয়ে ধরে! শুধু তাই নয় একে অপর এর সাথে এমন মাখামাখি শুরু করে যে ঘৃনায় জ্বলে উঠে উর্মির চোখ। সব টা পরিষ্কার এখন। উর্মি আর সহ্য করতে পারে না। ছুটে গিয়ে তুলি আর নয়ন এর গালে চড় বসায়। প্রবীণ মাথায় হাত রেখে বলে ” শীট”। আর একটু আগালে ব্যাপার টা অন্য রকম করার একটা চান্স ছিলো। হয়তো বা দুজনের চরিত্রের গুন গুলো নিয়ে কেস ফাইল করা যেতো। তবে এখন দুজনেই সাবধান হয়ে যাবে। বড় ভুল হয়ে গেল!

চলবে….

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৮.
মেঘনা কাতর চোখে তাকালো। উর্মির বলা প্রতি টা কথা শুনতে পেয়েছে। নেত্র যুগল বাঁধাহীন অশ্রু ঝড়ায়। এক সময় পেট চেপে ধরে বসে পরে। আর্তনাদ শুরু হয়। উর্মি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আপা কে। সৌজন্য নিজের রুমে বসে শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো সিলিং এর পানে। উর্মির চিংকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে। মেঘনার পেইন দেখে বুঝতে পারে হসপিটালে নিতে হবে। প্রথমে চেষ্টা করে মেঘনা কে কোলে নেওয়ার। রোগা পাতলা বোন টা খুব ভারী হয়ে গেছে। একা নেওয়ার মতো শক্তি নেই শরীরে। পরমুহুর্তেই মনে হলো এই দায়িত্ব টা এক ভাইয়ের। আর ভাইয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তার রহমত ছিলো বোধহয়। মুটিয়ে যাওয়া বোন টা কে কোলে তুলে ফেললো সে। উর্মি আর্তনাদ এর স্বরে বলল–
” ভাইয়া তুমি পারবে না। ”

” পারবো। ”

কথা শেষ না করেই ছুটতে থাকে স‍ৌজন্য। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে উর্মি। তার বউ সোহাগি ভাই টা আজ বোন সোহাগি। এই ভাইয়ের দেহে কোনো পাপ নেই আর না আছে কোনো সংকোচ।

হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে মানুষ গুলো। সবাই মেঘনার নিজের লোক। বড় ভাবি বড় ভাইয়া ছোট ভাইয়া অন্তু আর ওর মা সম বোন উর্মি। প্রতি টা মানুষ আজ এখানে উপস্থিত কেবল ভালোবাসা নিয়ে। বড় ভাবি লোভী হলে ও মেঘনার খবর টা পেয়ে ছুটে এসেছেন আজ। গত কয়েক দিন বাবার বাড়ি তে থেকে শিক্ষা হয়ে গেছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ি যে অবহেলার স্থান হয়ে যায় সেটা খুব ভালো টের পেয়েছেন।অপরাধবোধ হয়েছে এতোদিন। আজ একে বারে সব ছেড়ে চলে এসেছেন। খুব করে বলে এসেছেন ভাই ও তাদের বউ দের বাঁচি মরি সব স্বামীর বাড়ি তে। রাস্তায় থাকলে স্বামী সন্তান ননদ দেবর দের নিয়ে এক সাথে থাকবো। তবু তোমাদের মতো হবো না আর। উর্মি এতো কষ্টের মধ্যে ও সুখ পেল। বহু দিন ধরে এমন পরিবার পায় নি সে। অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে আজ আলোর দিশা পেয়েই গেল। উর্মি কে বুকে টেনে ধরলো জোৎস্না। কয়েক বার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকাতেই উর্মি বাধা দিলো। সে শুধুই বাবা মায়ের গড়ে তোলা শখের পরিবার টা কে দেখতে চায়। লাল বাতি টা নিভে গেল। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। প্রতি টা মানুষ ছুটে এলো। ডাক্তার গম্ভীর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন
” মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ”

প্রতি টা চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলে মেয়ে নিয়ে কখনোই হিংসে ছিলো না কারো মনে। সুস্থ এক বাচ্চা চেয়েছে কেবল। উর্মি ভেতরে যেতে চাইলে ডাক্তার বললেন পরে যেতে। রোগীর রেস্ট এর প্রয়োজন।

একটু সুস্থ বোধ হতেই মেঘনা বাবু কে দেখতে চাইলো। পাশ থেকে নার্স বললেন বাবু কে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মেঘনা উঠে বসার চেষ্টা করে। ঠিক তখনি ডাক্তার এসে আটকে দেয়। স্পর্শ টা এতো টা কোমল যে মেঘনার নারী মন কেঁপে উঠে। স্পষ্ট অনুভব করে ডাক্তার এর হাত কাঁপছে। ডাক্তার বলে
” উঠো না এখন। ”

কন্ঠ টা ঠিক চেনে না মেঘনা। তবে চেনা লাগে। অচেনা কন্ঠের স্বর টা মাক্স পরে থাকায় মুখ টা দেখা যাচ্ছে না। মেঘনার শ্বাস কেমন ঘন হয়। ডাক্তার দ্রুত অক্সিজেন লাগিয়ে দেন। মেঘনা চোখ বন্ধ করতেই মাথায় হাত বুলায়। মেঘনা মৌন থাকে। তারপর হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে। জীবন তাকে কি পরীক্ষায় ফেললো?

নর্মাল ডেলিভারী। এতো সময় যাওয়ার পর ও রোগীর সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। বাবু কে নিয়ে আসা হয়েছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা। তুলতুলে দেহ টা উর্মি কে কেমন দায়িত্বশীল করে তুলে। মনে হয় এই মাংসপিন্ড টা ওর নিজের শরীরের। খুব সুন্দর কপাল টা। এই কপালের দিকে তাকিয়েই সমীর এর কথা মনে হয়েছে। এই সময়ে ছেলে টা কে বিরক্ত করতে চায় না উর্মি। এমনি তে ও অনেক করেছে ওর জন্য। উর্মি কেবিন এর দিকে আগায়। দরজা খুলে যে দৃশ্য দেখে এতে করে ও নিজেই কেঁপে উঠে। দ্রুত প্রস্থান করে। হাত পা শীতল ঠেকে।

আলিদের বুকের ঠিক মাঝ খান টায় মাথা ছিলো মেঘনার। এই ছেলেটা কে জীবনে সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে সে। বাবার সাথে কমিশনারের মৌন বিবাদ ছিলো। আলিদ কে ভালোবাসা সত্তে ও অনুভূতি গুলো কে লুকিয়ে রেখে ছিলো মেঘনা। সব টা উজাড় করে ভালোবেসেছে নয়ন কে। আলিদ কে ভুলেই গিয়েছিলো এক প্রকার। সেই আলিদ আবার ফিরে এলো ওর জীবনে। মেঘনা সচকিত হয়। আলিদ এর থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ছেলেটা যেন কষ্ট পায়। মেঘনা চোখ মুছে।
” আমি আসলে স্যরি মেঘনা। ”

” স্যরি তো আমার বলার কথা। ”

” তুমি কেন স্যরি হবে তাই না। দোষ তো আমার কপালের। ”

ঠোঁট কামড়ে উত্তর করে মেঘনা
” আমিই অভাগি। যেখানে যাই কপাল পুরে যায়। ”

” ছিই ছিই কি সব বলছো! ”

” ভুল কি বললাম বলো। জীবনে সব থেকে বড় পাপ ছিলো তোমার মতো মানুষ কে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি কখনোই তোমার যোগ্য ছিলাম না। অথচ সেই আমি টাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ”

” প্লিজ মেঘনা এসব বাদ দাও। ”

” বরাবর ই আমার দোষ লুকাও তুমি। ”

কথা বলার সময় চোখ হাসে মেঘনার। আর তারপর ই মেঘনার রক্তে রক্তে ছেঁয়ে যায় বিষন্নতা। আলিদ এর মুখ টা এক বার দেখে নিয়ে বুঝে জীবন অনেক এগিয়ে চলেছে। আলিদ যেটা বলতে চায় সেটা সম্ভব না। দ্বিতীয় বারের মতো ছেলে টাকে ফিরিয়ে দিল মেঘনা।সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আজ ফিরিয়ে দিলো আলিদ এর ভালো ভেবে। আজ ওর কষ্ট নেই শুধু আফসোস হলো কেন সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলো সুদর্শন এই প্রেমিক পুরুষ কে? কি হতো বাবার অবাধ্য মেয়ে হলে। কত শত এলোমেলো চিন্তা করলো মেঘনা যার সৃষ্টি আছে তবে সমাধান নেই। বিচিত্র এ জীবন নিয়ে যতোই ভাবে ততোই অবাক হয়। শখের জিনিস গুলো বড্ড দামী হয় নতুবা হয় নিষিদ্ধ।

সৌমেন এর অসুস্থতা যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভাঙচুর হয়ে গেছে নিত্য অভ্যাস। ডাক্তার রা সমাধান দিতে পারছে না। মানসিক ডাক্তার রা ভয়ে কাছে আসে না। উর্মি দূর থেকে এসব দেখছিল। ভয় লাগে কেমন। আচমকা একটা শো পিস ছুড়ে মারে সৌমেন। যার আঘাতে হাত কেঁটে যায় উর্মির। মেয়েটার আর্তনাদে সবাই ঘুরে তাকায়। এমন কি সৌমেন নিজে ও ঘুরে তাকায়। হাতের রক্ত দেখে দ্বিগুন আর্তনাদ করে। উর্মি বেরিয়ে আসতেই সৌমেন ওর দিকে ছুটে আসে। বেশ ভরকে যায় উর্মি। সৌমেন খপ করে ওর হাত টা ধরে ফেলে। রাগি ভাব টা এখনো যায় নি। উর্মির দিকে লাল চোখে তাকায়। উর্মি শুকনো ঢোক গিলে।
” এখানে কি করো তুমি? ”

” আমি তো এমনিই এসেছি স্যার। ”

” ফাঁকি বাজ হয়ে গেছে তুমি। যাও এখুনি কাজে যাও। ”

” জী স্যার। ”

উর্মি কিছু দূর যেতেই সৌমেন আবার ডাকে। উর্মি আসে। সৌমেন বলে–
” হাতে কি? ”

” কিছু না তো। ”

” লাল তরল কেন? ”

” একটু আগে আপনি– ”

” আমাকে ব্লেম দিচ্ছো তুমি? সাহস তো কম না। ”

” স্যার আমি সেটা বলি নি। ”

” চুপ। ”

উর্মি একদম স্থির হয়ে যায়। সৌমেন ঘুরে ঘুরে দেখে উর্মি কে। মাথা চুলকিয়ে বলে
” আমি তো মজা করছিলাম। ”

উর্মি এবার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবে যেন। সৌমেন খিটমিটে হাসে। যাওয়ার জন্য আগাতেই সৌমেন রাগি কন্ঠে বলে
” আমি যেতে বলেছি তোমায়? ”

” নো স্যার। ”

” তাহলে যাচ্ছো কেন। ”

” স্যরি স্যার। ”

” আই ডোন্ট নিড ইউর স্যরি ওকে। গো ”

” ওকে স্যার। ”

উর্মি আবার এক পা আগায়। ওমনি সৌমেন ডাক দেয়। মাথা ভনভন করে উর্মির। সৌমেন কেমন যেন করছে। এই এখনি সিরিয়াস তো এখনি ফানি। মূলত ওর ব্রেনের নার্ভ গুলো কাজ করছে না ঠিক ঠাক। ছোট বেলা আর বড় বেলার এক টা মিলন ঘটেছে। এর ফলে দুটো বিষয় নিয়েই চলছে। হঠাৎ করেই আবার মাথা ব্যথা শুরু হয়। মাথা চেপে ধরে সৌমেন। লুটিয়ে পরে মেঝে তে।

সব ঘটনা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে সমীর। উর্মি এ পান্ত থেকে বল‍ে
” মানুষের জীবন কেমন যেন। ”

” কেমন? ”

” কি জানি। ”

” অদ্ভুত তো। ”

” ভালো লাগে না আমার। মনে হয় সব টা ভস্ম করে চলে যাই। ”

” আপার ডিভোর্স এর কি অবস্থা? ”

” ঐ আর কি। টাকার খেল। নয়ন ভাই ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আর কোর্ট এর রায় ছিলো বেবি আসার পর। ”

” আর তুলি ভাবির বিষয় টা? ”

” জানি না কি হবে। পনেরো লাখ টাকা জোগাড় করা সহজ না। কোর্ট এ রায় চলছে। ”

” সে সব তো বুঝলাম। কিন্তু তুলি ভাবির সাথে নয়ন ভাই এর কি সম্পর্ক? ”

” এটা আমার কাছে ও পরিষ্কার নয় সমীর। সব টা ঘোলাটে। ”

ভাইব্রেশন হয় সমীর এর ফোন। মা ফোন করেছেন। উর্মির কল রেখে মায়ের ফোন রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে মিষ্টি মৃধার গলা শোনা যায়।
” এক টা কথা বলবো? ”

” বলো না। এতো আড়ষ্টতা কেন মিষ্টি মা? তোমার ছেলে আমি। ”

” তোর বাবার ছবি দিবি একটা। কিংবা ভিডিও কলে দেখাতে পারবি একটু। ”

মিষ্টি মৃধার কন্ঠে কেমন লজ্জা কাজ করে। সমীর উত্তর করে না। কল কেটে ভিডিও কল দেয়। আর তারপর ব্যলকনি তে গিয়ে বাবার বরাবর দাঁড়ায়। ব্যথাতুর দৃষ্টি টা মিষ্টি মৃধার চোখ এড়ায় না। ভদ্র লোক জীবনে ভুল করলে ও একটা সময় এসে ভুল বুঝতে পেরেছেন। তবে একজন বাবা সর্বদাই বাবা। সন্তান বৈধ হোক কিংবা অবৈধ। এসকল চিন্তায় বাবার সাথে মিলমিশ করবে বলে স্থির করেছে সমীর। যদি ও সব টা কেবল মা ভাইয়ের কথা ভেবে। হয়তো কখনোই বাবা কে ক্ষমা করতে পারবে না তবে চেষ্টা করবে। অন্তত মায়ের জন্য এই চেষ্টা টা করবে সে। জীবনের শেষ কটা দিন ভালো থাকার এক প্রচেষ্টা করবেন মিষ্টি মৃধা।

চলবে…