শখের সাদা শাড়ি পর্ব-১৫+১৬

0
240

#শখের সাদা শাড়ি
#ফাতেমা তুজ
#পর্ব-১৫+১৬
১৫.
সমীর সব থেকে বড় ধাক্কা টা খেল অনুষ্ঠানের ফাইনাল রাউন্ডে। নিজের বাবা কে জাজ হিসেবে দেখে একে বারেই ভরকে গেল। কয়েক সেকেন্ড একদম ই পলক ফেললো না। আর তারপর ই চোয়াল শক্ত করে উঠে এলো। ভদ্র লোকের নাম সওলাত খান। বর্তমান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বড় এক নাম। বেশ ভালো ডিজাইন করতে পারেন। আর সেই গুন টাই পেয়েছে ছেলে সমীর খান। তবে দুজনের মাঝের দূরত্ব যে সব দুমড়ে মুচড়ে দিলো। এর আগের বার ন্যাশনাল পর্যায়ে অনলাইন অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভদ্রলোক। শুধু সেই কারনে জিতে যাওয়া রাউন্ড টা ফেলে আসে সমীর। সবাই খুব বুঝিয়েছিলো তবে সে নারাজ। এতে নিজ ক্যারিয়ারের ক্ষতি করে ফেললো সমীর।এই নিয়ে কখনোই আপসোস করে নি। ভদ্রলোকের ছায়া টা যেখানে থাকবে সমীর ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান করবে। সমীর এর নাম ডাকা হলো। তার করা ডিজাইন গুলো অলরেডি মনিটরে দেখানো হচ্ছে। শুধু ব্রিফিং দিবে। সমীর এর নাম টা শুনে সওলাত খান বেশ চমকালেন। আগের বারের ঘটনা টা তিনি জানতেন না। প্রধান অতিথি হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন কেবল। তবে এবার যে একে বারে বিচারকের আসরে। সমীর আসছে না দেখে সওলাত খান বার বার তাকাচ্ছেন। ছেলের মুখ টা দেখা হয় না আজ কতো গুলো বছর। সত্যি বলতে তিনি সন্তান দের ভালোবাসেন। মাঝের করা এক ভুলের জন্য সন্তান রা আলাদা হয়ে গেলো। কি করার ছিলো ওনার? দ্বিতীয় স্ত্রী তথা কাননবালার পেটে যে ভুলক্রমে ওনার সন্তান এসেছিলো। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ভুলের জন্য বিয়ে টা করে নিতে হলো তাড়াহুড়ো করে। বড্ড ভুল ছিলো সেসব। নিজ স্ত্রী কে খুব একটা ভালোবাসতেন না তিনি। পরনারী তে আসক্ত হয়ে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিলেন। আর নিজের বৈধ সন্তান দের হারিয়ে ফেললেন। বুকের ভেতর টা ছ্যত করে উঠে। পাশ থেকে একজন বিচারক বললেন ” সওলাত সাহেব দেখেন এই ছেলের কাজ গুলো। কি নিখুত ডিজাইন। যতো গুলো ডিজাইন এসেছে সব থেকে বেস্ট। ”

ছলছল নয়নে হাসার চেষ্টা করলেন তিনি। চোখের জল টুকু বহু কষ্টে আটকে রেখে দিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য মনের ভেতর ঝড় বইতে শুরু করলো। অধৈর্য হয়ে কয়েক বার সিট থেকে উঠার চেষ্টা ও করলেন। অতঃপর সমীর এর দেখা মিলে। ছিমছিমে শরীরের লম্বা দেহের ছেলে। চেহারা ভালো খারাপ না। তবে সব থেকে সুন্দর হচ্ছে চিকন কপাল টা। এমন সুন্দর কপাল যে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। লম্বা চুল গুলো যখন কপালে এসে আছড়ে পরে তখন মনে হয় এই পৃথিবীর সব থেকে সুদর্শন পুরুষ সমীর। মনে মনে চাপা গর্ব করলেন তিনি। এই গুনী ছেলে টার যে তাঁর সেটা ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। সমীর খুব স্বাভাবিক ভাবেই মঞ্চে এলো। মাইক তুলে দেওয়া হলো।
” থ্যাংকস টু অল। যারা আমাকে এমন সুন্দর, বিশেষ আয়োজনে অংশ হতে নির্বাচিত করেছিলেন। আমি দীর্ঘ এক মাস যাবত কাজ করে আজ ফাইনাল রাউন্ডে মাইক হাতে উপস্থিত। বিজয় হয়তো বা খুব নিকটে। যেহেতু ফাইনাল সেহেতু বিজয়ী না হলে ও আমরা সবাই এক একজন রানার্সআপ এটা সিউর। মোট কথা হেরে যাওয়ার কোনো চান্স নেই। সে যাই হোক, আমি হয়তো সকল কে এমন এক সংবাদ দিতে চাই এর ফলে মিডিয়া কিংবা ভিউয়ার্স সকলেই তিক্ত মতামত পোষন করবেন। এই ভিন্ন ভিন্ন মতামত গ্রহণে আমি দ্বিধান্বিত না। আমি জানি আমাকে ফেস করতে হবে অনেক কিছু তবু আমি সেটা বলবো। আর ইটস ফাইনাল। ”

সওলাদ সাহেব ছেলের কথা টা কে খুব পজেটিভ ভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন ছেলে বুঝি বলবে সওলাত খান আমার বাবা। তিনি একেবারে তৈরি হয়ে রইলেন ছেলে কে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য। সমীর কে অলরেডি সাংবাদিক রা প্রশ্ন করা শুরু করেছে। সমীর এক বার ও তাকালো না বাবার দিকে। চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলল ” আমি নিজের নাম এই প্রতিযোগিতা থেকে উইথড্রো করতে যাচ্ছি। ”

উর্মির সাথে কথা বলছে সমীর। দুজনের কন্ঠ টাই মলিন। একে অপরের থেকে কি যেন লুকোচ্ছে। সমীরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই সমীর অন্য কথায় এলো।
” সৌমেন ভাই এর কি খবর গো? শুনলাম বিদেশে আসবেন। ”

” হ্যাঁ মাহফুজ স্যার তেমন টাই বলেছেন। সেদিন সৌমেন স্যার ও বললো। ”

” তাহলে তো ঠিক ই যাবে। ”

” হ্যাঁ। এখন বলো তোমার অনুষ্ঠানের কি হলো। আজ কালের মধ্যেই তো ফাইনাল হওয়ার কথা তাই না? ”

” হুম। খেয়েছো? ”

” অনেক আগেই। আপা কে খাইয়েই খেয়ে নিয়েছি। ”

” ও হ্যাঁ রাত তো অনেক হলো। আপার কি খবর? ”

” ভালো। বেবি টা আজকাল যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিক করলেই আপা ককিয়ে উঠে। ”

” ইস কি বলো এটা যন্ত্রণা? এটা তো দারুণ লাগার কথা। বেবি কিক করার ফিল টা ভাবো কেমন লাগে। ”

” হুম হয়েছে মিস্টার। মায়েরাই বুঝেন কেমন লাগে। ”

” কষ্ট হলে ও সুখ তো আছে। আমি তো আমার বেবির প্রতি টা কিক ফিল করতে চাই। ”

” হা। আগে বিয়ে করে একটা বেবি পয়দা তো করো। ”

” করবো তো। খুব দ্রুত করবো। ”

” তাই। তো মেয়ে দেখেছো নাকি? ”

” উম দেখি নি। তবে চাইলে তুমি দেখতে পারো। ”

আনমনেই হাসলো সমীর। এদিকে উর্মি দাঁত চেপে বলল–
” হুম দেখবো তো। ”

” দেখো প্লিজ। মেয়ে টা যেন খুব সুইট হয়। একদম তোমার — ”

” আমার কি? ”

উর্মির উদিগ্ন কন্ঠ। সমীর ফিঁচেল হেসে বলল
” তোমার বিপরীত। তুমি তো একটা ঝাল মেয়ে। আমার সুইট কাউ কে লাগবে। বহু দিনের শখ। ”

কল কেটে দিয়েছে উর্মি। সমীর হেসে আবার কল করলো। ভাবলো এখনি বলে দিবে শখের মেয়েটি উর্মি। তবে দ্বিতীয় বার কল করে সুইচ অফ পেলো ফোন। এতো রাগ করেছে মেয়েটা?

দু দিনের মাথায় দেখা গেল সৌমেন খুব অসুস্থ। মুখ দিয়ে লালার মতো কি যেন বের হয়। এসব দেখে সৌমেন কে ফাইল দিতে আসা ড্রাইভার চিৎকার করে উঠে। দ্রুত পায়ে ছুটে আসে উর্মি সহ সবাই। উর্মি দেখতে পায় সৌমেন কেমন যেন বিহেভ করছে। সবাই ধরে হসপিটালে নিয়ে আসে। যাওয়ার পূর্বে উর্মি মাহফুজ স্যার কে কথা টা জানান। ভদ্রলোক এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান। কারো গলা শুনতে পায় উর্মি। তিনি বলছেন কে ফোন করেছে? সৌমেন?

হসপিটালের করিডোরে মানুষের ভীড় জমেছে। প্রতি টা স্টাফ ছুটে এসেছেন। সৌমেন স্যারের এমন অসুস্থতা কেউ আশা করে নি। মাহফুজ সাহেব আর ওনার স্ত্রী লতিফা বেগম ছুটে এলেন। ভদ্র মহিলা উন্মাদের মতো কাঁদছেন। ছেলের জন্য যেন শরীরের প্রতি টি রক্ত বিন্দু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। উর্মি লতিফা বেগম কে সিটে বসালেন। মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই তো দুপুরেই উর্মি কে ডেকে বলল উর্মি এবার এর কাজ টা খুব ভালো করেছো। তুমি খুব ভালো কর্মী। ডাক্তার বের হয়ে আসতেই লতিফা বেগম ছুটে গেলেন। থমথমে ডাক্তার কিছু বলতে নারাজ। তবে মাহফুজ সাহেব কে দেখে না বলে আর থাকতে পারলেন না। তিনি শুধু জানালেন সৌমেন এর অবস্থা ভালো নয়। শরীরে বিশেষ ধরনের মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পরিবর্তন এসেছে সৌমেন এর জেনিটিক বৈশিষ্ট্য সহ ব্রেনের। হয়তো বা সৌমেন এর স্মরণ শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় প্রভাব পরবে। ব্যাস এই টুকু শুনেই জ্ঞান হারালেন লতিফা বেগম। মাহফুজ সাহেব ও ভেঙে পরলেন। প্রতি টা মানুষ চুপ চাপ। শুধু উর্মি চিৎকার করে বলল
” আন্টির হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে দ্রুত বেডে নিতে হবে ওনাকে। ”

রাতে সমীর এর নাম্বারে কল করলো উর্মি। পুরো আটা নব্বই টা মিস কল এসেছে। উর্মি রিসিভ করতে পারে নি কারন সৌমেন এর পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। সমীর কল রিসিভে সময় নিলো না। ঝটপট বলল–
” সারাদিনে কল রিসিভ করো নি উর্মি। তুমি ঠিক আছো। ”

” চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি। তবে সৌমেন স্যার অসুস্থ। ”

” কি হয়েছে? ”

পুরো ঘটনা বর্ননা করলো উর্মি। এতে সমীর ব্যথিত হলো। দুজনের মাঝের সম্পর্ক টা সুন্দর। সৌমেন এর খোঁজ নিতে ফোন করবে বলে ঠিক করলো। এদিক টা সামলে দ্রুত ফিরে আসবে বলে ও স্থির হলো। উর্মির মন টা ভীষণ পানসে ঠেকে। সমীর ও নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিছু সময় গেলে দুজনেই প্রসঙ্গ বদল করলো। এক পর্যায় এসে উর্মি জানতে চাইলো সমীর এর ফাইনাল রাউন্ড এর রেজাল্ট। আজ বাদে কাল তো সত্যি টা জানবেই উর্মি। সে জন্য সমীর বলল
” আমি নিজের নাম উইথ ড্রো করে নিয়েছি উর্মি। ”

” কেন? ”

আজ আর লুকায় নি সমীর। একে একে বর্ননা করলো নিজের বাবার প্রতারণা। মা ভাই কে নিয়ে চলে আসার ঘটনা। সবশেষে উর্মি চুপচাপ। চোখ দুটো ভরে গেছে জলে। অথচ সমীর কতো টা সহজ গলায় বলে যাচ্ছে। সমীর আর ও বলল মা কতো টা ভালোবাসতেন বাবা কে। মাংস কে একদম চিড়ে ফেলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাজি করা ছিল বাবার সব থেকে প্রিয়। সেদিন মা শখ করে বাবার জন্য সেই রান্না টাই করেছিলেন। তবে বাবা এসেছিলেন অন্য নারীর হাত ধরে। কেউ সেদিন মুখে তুলে নি খাবার। পরদিন ময়লার গাড়ি করে চলে গিয়েছিল শখের রান্না।কয়েক সপ্তাহ মুখ বুজে ছিলো সমীর। খুব কষ্ট করে জব খুঁজে মা ভাই কে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল ওর শখের গল্প।

চলবে…..

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৬.
সৌমেন এর বেস্টফ্রেন্ড অনুজ। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলে ও দুই প্রান্তের দুই ব্যক্তিত্ব শুরু থেকেই মিলেমিশে ছিলো একাকার। কেউ কখনো কোনো বিষয় লুকায় নি একে অপরের থেকে। সৌমেন ও নিজের জীবনের এক এক টা খন্ড জানিয়ে রাখতো ভিন্ন ধর্মী এই বন্ধু টি কে। ইতো মধ্যেই সৌমেন এর অসুস্থতার খবর চলে গেছে অনুজের নিকট। অস্ট্রেলিয়া থাকে সে। ভালো ব্যবসা সেখানে। সব কিছু ঠিক থাকায় টিকেট পেতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। তবে স্ত্রী কে সাথে নিয়ে আসতে পারে নি। কয়েক দিন পর সে ও চলে আসবে। বন্ধুর অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে চলে এসেছে বন্ধুর নিকট। উর্মি লোক টা কে দেখে যা বুঝলো এতে করে অন্তরের মধ্য ভাগে এক রাশ ভালো লাগা কাজ করছে। মানুষ টা কতো টা উদ্বিগ্ন বন্ধুর জন্য। সত্যিই বন্ধু শব্দ টির মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল এক মুগ্ধতা। যা ধর্ম বর্ণ সব কিছুর থেকে বহু দূরে। যেখানে শুধু বিশ্বাস রাখা হয় সত্য কে আর গ্রহণ করা হয় মনুষ্যত্ব কে। আত্মিক বন্ধন কে আগলে রেখে তৈরি হয় সম্পর্ক। বেডে শুয়ে থাকা সৌমেন কে দেখে সবাই অনেক টাই স্তব্ধ। তাকে আনা হয়েছে কেবিনে। একে একে সবাই ভীড় করছে দরজার নিকট। সবাই এক ঝলক দেখছে ছেলে টা কে। সবল দেহের জন্য প্রায় সময় কলেজ কিংবা ভারসিটির এনাউল ফাংশন গুলো তে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সৌমেন। আজ সেই মানুষ টা হসপিটালের বেডে! মাহফুজ সাহেব কে বিশেষ ব্যস্ত দেখাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় টা তে বোধহয় নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী কে এখনো জাগ্রত করা হয় নি। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। অনুজ কে দেখে সৌজন্যতার হাসি দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলেন। পরক্ষণেই সেই হাসি টা অশ্রু তে পরিণত হলো। উর্মি এক বার নিশ্বাস ফেললো। প্রতি টা বাবা মা ই চান সন্তান দের ভালো হোক। অনুজ উর্মি কে দেখে চিকন চোখে তাকালো। মেয়েটি কে এর আগে দেখেছে বলে মনে হয় না। ভাবনার মাঝেই ডাক্তার বের হলেন। উর্মি এগিয়ে এলো তবে কিছু বললো না। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো কিছুক্ষণ। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো হাতেই কিছু নেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে। সব শুনে অনুজ শুধালো
” ব্রেন হেমারেজ হয়েছে কি? ”

” এখনো সিউর করে বলা যাচ্ছে না। কথা বললে বোঝা যাবে। ”

” রিপোর্ট কি বলে? ”

চুপচাপ দেখালো ডাক্তার কে। তিনি অনুজ কে সাথে নিয়ে একটু দূরে এলেন। উর্মি নজর ফিরিয়ে নিলো। মাহফুজ সাহেব বসে ছিলেন। সুস্মিতা বেগমের চিৎকারে ছুটে গেলেন। তিনি চেতনা ফিরে পেয়েছেন। ছেলের জন্য এখন পাগলামি শুরু করেছেন। জাপটে ধরলো উর্মি।সোফা তে বসে পরলেন মাহফুজ সাহেব। মস্তিষ্ক চলে না আর। মুখ ঢেকে ফেললেন হাতের তালু তে। উর্মি কোনো মতে মিথ্যে বুঝ দিচ্ছে তবে আদৌ কি সুস্থ হয়েছে সৌমেন?

উর্মি বাসায় ফিরলো রাত একটায়। এই মাঝ রাত্রি তে ফিরতে দিতে চান নি মাহফুজ সাহেব। তবে কাল সকালে কোর্ট এর ডেট পরেছে। নয়ন ডিভোর্স ফাইল করার জন্য কেস করেছে। উর্মি কে কেমন যেন রুক্ষ দেখায়। এপাশ ওপাশ করলে ও ঘুমায় নি মেঘনা। উর্মির মুখের অবস্থা দেখে উঠে পরে। উর্মি সেটা খেয়াল করে নি। ওর মন অন্য স্থানে। ধীর কন্ঠে ডাকে মেঘনা। উর্মি সচকিত হয়ে মেঘনা কে জাপটে ধরে। হাত পা কেমন নিশ্চল দেখায়। মেঘনা বুঝে না কি হয়েছে। উর্মি ফুপিয়ে কাঁদে।
” ছোট ভাইয়ার সাথে ভাবির খুব ঝগড়া হয়েছে রে আপা। ”

” এ আর নতুন কি। এটা তো প্রায় ই হচ্ছে এখন। ঘুমিয়ে পর। ”

” না রে আপা। নিত্য দিনের ঝগড়া না রে। এটা অনেক বড় ইস্যু। ”

” তাতে তোর কি? মনে আছে সেদিন কি বলেছিল ওরা। আমাদের সংসার আমরা বুঝবো। শোন বোন, বড় ভাবি লোভী হতে পারে তবে কখনো অহংকার করে না। ”

একটু থামে মেঘনা। পা টা মেলে দিয়ে আবার বলে–
” তবে ছোট ভাবি অহংকারী। সাথে সাথে আমাদের ভাই টা কে অহংকারী বানিয়ে তুলেছে। আমি ওর সম্পর্কে কিছু শুনতেই চাই না। ”

মেঘনা রাগ করে ঘুমিয়ে পরলো। উর্মি চুপ চাপ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মন টা বড্ড খারাপ। চারদিকে ঝামেলা। সুখ, শখ, আল্লাদ সব কিছু কেমন মলিন। সমীর এর কথা ভীষণ মনে পরে। কল করে উর্মি। সমীর ঘুমিয়ে ছিল। উর্মির নাম দেখেই ধরমরিয়ে উঠে।
” ভালো লাগছে না সমীর। ”

” কি হয়েছে উর্মি? ”

” জানি না। শুধু জানি ভালো লাগছে না। ”

” তুমি ঠিক আছো তো। এমন লাগে কেন কন্ঠ টা? ”

সমীর এর কন্ঠ টা ও চিন্তিত। উর্মি শিউরে উঠে। ব্যথা হয় বুকে। বিশেষ আয়োজন নেই আজ। কোনো রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলে উঠে
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”

ওপাশের মানুষ টি বোধহয় বিস্মিত। কেঁপে উঠেছে প্রতি টা শিরা। সমীর এর চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। উর্মি উত্তরের অপেক্ষায়। সমীর চুপচাপ থেকে মৌনতা ভেঙে বলল–
” আমার একটু সময় প্রয়োজন উর্মি। ”

উর্মি এবার স্তম্ভিত। তবে কি সমীর তাকে ভালোবাসে না? এ কি করে হয়! দুজনের চোখে চোখে বহু বার প্রেম নিবেদন হয়ে গেছে। ভরকায় উর্মি।ভালোবাসার সংকটে হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। সমীর এর কন্ঠ শোনা যায় না। উর্মি বলে–
” আমি এখন তবে রাখছি? ”

” হুম। ”

ফোন হাতে রেখে উর্মি ব্যস্ত হয়ে যায়। কেমন অশান্ত লাগে বুক। চোখ দুটো জ্বালা করছে।

নয়নের সাথে কোর্টে মুখোমুখি মেঘনা। উঁচু পেট টা নিয়ে চলতে কষ্ট হয় খুব। যতো দিন এই বাচ্চা টা পেটে আছে ততো দিন ডিভোর্স দিতে পারবে না নয়ন। সেই জন্যই ছিলো এতো নাটক। তাচ্ছিল্য হাসে মেঘনা। উর্মি কেবল তাকিয়ে থাকে। নয়ন কে দেখলে এখন ঘৃনা হয়। আপার বিয়ের শুরুর দিকে উর্মি মনে মনে গর্ব করতো, এমন একজন ভাই কে পাওয়া তে। তবে কে জানতো সময় স্রোতে ভালোবাসা উঠে যায়।আচানাক সমীর এর কথা মনে পরে উর্মির। অসুস্থ বোধ হয় হুটহাট।

নয়নের সাথে কথা বলে না মেঘনা। শুধুই উঁচু পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” বেবি এই দেখ তোর পাপা কে। যে তোকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায় নি। ”

নয়ন চুপ করে শুনলো কথা টা। কেন যেন ভেতর টা ইষৎ আর্তনাদ করে। চরম বিরক্তি প্রকাশ করে মেঘনা। উর্মির হাত ধরে এগিয়ে যায়। খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে নয়ন। মেঘনা কে আগে এমন তেজস্বী লাগে নি। খেয়াল করা হয় নি নয় মাসের উঁচু পেটে ঠিক কতো টা সুন্দর লাগে মেয়েটি কে। মায়েরা বোধহয় এমনি সুন্দর হয়।

অন্তু ছুটে এলো মেঘনার কাছে। উর্মি তখন সাওয়ার নিতে গেছে। মেঘনা স্থির চোখে দেখছে অন্তু কে। আজকাল শরীর টা এতো ভারী হয়ে গেছে যে কথা বলতে গেলে ও কষ্ট হয়। অন্তু চার দিকে চোখ বুলায়।
” বড় ফুপি ছোট ফুপি কোথায়?”

” সাওয়ারে গেছে বাবা। কি হয়েছে? ”

” একটু দরকার। ”

কথা শেষ না করেই বাথরুমের দরজায় নক করে অন্তু। ভেতর থেকে উর্মি বলে–
” কি হয়েছে? ”

অন্তু কথা বলার পূর্বেই বিকট শব্দ শোনা যায়। মেঘনার বুক টা ছ্যত করে উঠে। অন্তু শুধু বলে–
” তাড়াতাড়ি আসো ফুপি। ”

অন্তু দৌড়ে যেতে থাকে। মেঘনা বলে
” আমায় ধরে নিয়ে যা তো। ”

তুলির চুল গুলো এলোমেলো। সৌজন্য খুব বেশিই রেগেই আছে। তুলির গায়ে হাত ও তুলে ফেললো। তুলি তখনি জিনিস পত্র ভাঙচুর করতে লাগলো। মেঘনা যেন কিছুই বুঝে না। অন্তু ছোট হলে ও চেহারা টা কেমন বড় দের মতো করে রেখেছে। অমর বাসায় নেই। এদিকে জোৎস্নার কোনো হেলদোল নেই। সে এই ভেজালে যাবে না বলেই স্থির।
” কি হচ্ছে কি এসব? ছোট ভাইয়া। ”

” বোঝা ওরে, অসভ্য হয়ে গেছে। সংসার করে আমার সাথে, আর প্রেম চালায় আরেক জনের সাথে। ”

” কি বলছো কি এসব? ”

” বে ‘ শ্যা হয়ে গেছে। ”

সৌজন্যের গলা চেপে ধরে তুলি। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় সৌজন্য। তুলি আর্তনাদ করে উঠে। উর্মি তখনি ছুটে এসেছে। তুলি কে টেনে তুলে।
” কি হচ্ছে কি ভাইয়া? ভাবির গায়ে হাত তুলতে বারণ করেছি না। ”

” কি হবে। নাটক শুরু হয়েছে। যেই নাটকের শেষ নেই।”

তুলি অশ্রু ফেলে। সৌজন্যের কথা গুলো শুনতে থাকে নিরবের সহিত। সৌজন্য রাগে ফুসতে ফুসতে বের হয় বাসা থেকে। তুলির হাতের কব্জি তে কেটে গেছে। উর্মির বুকে হাহাকার। অন্তু যেন মৌনতা তে সব বুজতে পারে। ব্যান্ডেজ এনে দেয় দ্রুত। উর্মি ব্যান্ডেজ করে দেয় ঠিক ই তবে তুলি কে কোনো প্রশ্ন করে না। কেবল বুক চিরে বের হয় দীর্ঘ নিশ্বাস। মায়ের বানানো শখের সংসার আজ হুমকির মুখে।

চলবে……