শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
4553

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট :৪৫

হোটেলের পুল সাইডে টেবিলে বসে আছি । অগ্নি রিসেপশনিস্ট এর সাথে কথা বলছে ।ভাইয়াও অগ্নির সাথে । কিছুক্ষণ পর ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবো । তানিন পুলের সামনে খেলছে । ভাবী আমার সাথে বসে আছে । ভাবী আমার গালে হাত রেখে বলে,

– “আজ তোমার চেহারায় এক অন্যরকম খুশি দেখতে পারছি। চেহারার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে । এতোটা দিন এই রুপ এই হাসি কোথায় ছিলো শুনি ? ”

– “ভাবী এই হাসির কারণ যে অগ্নি । আমার রুপ সুখ খুশি সবকিছু যে অগ্নিকে ঘিরে । ভাবী তুমি ঠিক বলেছিলে আমার অগ্নির কথা শুনার দরকার ছিলো !
যদি তখন অগ্নিকে একটা সুযোগ দিতাম তাহলে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হতো না । না আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব আসতো !
ভালোবাসার প্রথম ধাপ বিশ্বাস ! যা আমি কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার ভুল। কোনো দিন অগ্নির আর আমার মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হতে দিবো না । ”

ভাবী আমার গাল টেনে দিয়ে বললো,

– “বুঝলে ননদী অগ্নি তোমাকে অনেক চায় ।তোমাকে খুব ভালোবাসে । এতোটা হয়তো কেউ কাউকে ভালোবাসে না । প্রথম যখন অগ্নি তোমার ভাইয়াকে ফোন করে তোমার সাথে কথা বলতে চায় । তোমার ভাইয়া মুখের উপর সাফ মানা করে দেয় । আমাদের ও ভুল ধারনা ছিলো অগ্নির সম্পর্কে কিন্তু পরে অগ্নির পাগলামো তে রাজী হয়েছি দুজন ।যা পাগলামো করেছে আল্লাহ্‌ !
পারছিলো না তোমাকে উড়ে এসে নিয়ে যেতে । ”

– “কিন্তু ভাবী অগ্নি কি করে জানলো আমি এখানে সিলেটে আছি ! ”

– “তোমার মনে আছে সেদিন তোমার ভাই যখন মিটিং করছিলো ? ”

– “হ্যা ভাবী ”

– “সেখানে অগ্নির কম্পানির লোক ছিলো । অগ্নির সাথে আমাদের নতুন প্রজেক্ট শুরু করছে । আর অগ্নির ইমপ্লই ছিলো যে অগ্নিকে তোমার এখানে থাকার খবর দেয় । অগ্নি সেই রাতেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। তোমার জিদ সম্পর্কে আমাদের ধারনা আছে । যদি তুমি এসব শুনে এখান থেকে চলে যাও তাই আমি আর তোমার ভাইয়া ডিসাইড করি তোমাকে আর অগ্নিকে সামনা সামনি দেখা করাই তাহলে হয়তো সব ঠিক হবে ।তাই জোর করে তোমাকে বৈশাখী মেলায় তোমাকে দিয়ে যাই ! ”

– “ও তাই তো বলি ,সেদিন লোকটাকে এমন চেনাচেনা লাগছে কেন !
অগ্নির অফিসে দেখেছি মনে করতে পারিনি । ”

– “যাই বলো হুর ,অগ্নি কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে একদম পাগলের মত !
দোয়া করি তোমাদের সংসার সুখের হোক । আমরা যেন বছর বছর গুড নিউজ পাই ”

আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে হেসে বলি,

– “ওহহ! ভাবী তুমিও না শুধু লজ্জা দেও । ”

– ” আহারে ! আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা । ”

অগ্নি আসতেই ভাইয়া আর ভাবী কে বিদায় জানাই । আসার সময় তানিন খুব কান্না করেছে । ভাবীও অনেক আবেগী হয়ে পড়েছিলেন । এতো দিন একসাথে থেকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু অগ্নির বুকের গভীরতা সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে ।

__________________________

মানুষ পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই থাকুক না কেন ! নিজের বাড়ির মত শান্তির স্থান কোথাও নেই । আজ এতোদিন পর নিজের বাড়ি ফিরে খুব শান্তি লাগছে বড় এক শ্বাস ছেড়ে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুঝে থাকলাম । ফিরার সাথে সাথেই হিয়া আপু ,মামা ,মামীর কাছে অনেক জবাব দিতে হয়েছে । সবাই প্রথমে খুব রেগে ছিলেন । কিন্তু পরবর্তীতে সবাই ক্ষমা করে দিয়েছে । এ কয়েক দিনে রুমের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে । কিছুকিছু ফার্নিচার নতুন আনা হয়েছে । আমি চোখ খুলে তাকাই । আশেপাশে সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে দেখছি । পুরো রুম জুড়ে আমার ছবি । নিশ্চয় অগ্নি এসব করেছে । এতোটা ভালো কেউ কি করে কাউকে বাসতে পারে ?
কিছুক্ষণের মাঝে অগ্নি রুমে আসে । সোজা ফ্রেশ হতে চলে যায় । খানিক পর অগ্নি হাতে তয়াল নিয়ে বেরিয়ে আসে ।
অগ্নিকে দেখে আমি বিছানা থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে বসি ।অগ্নি দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছিনা । কেমন জানো লজ্জা লজ্জা লাগছে। হয়তো এতোদিনের দূরত্বের কারণে এই লজ্জার সৃষ্টি । আড়চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি অগ্নি আমার দিকে এগিয়ে আসছে ।অগ্নি আমার সামনা সামনি বসে আমার দিকে উনার নিখুঁত চাহনি নিক্ষেপ করছে আমি ঢোক গিলে আবার বাঁকা চোখে অগ্নির দিকে তাকাই । অগ্নি একপাশ হেসে আমার গালে হাত ছুঁয়িয়ে বলে ,

– ” এতো লজ্জা ? লজ্জায় লাল হওয়ায় তোমাকে যে আরো সুন্দর লাগছে তা কি জানো !
আমি যে কন্টোললেস হয়ে যাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছো কি ? ”

অগ্নির কথায় লজ্জায় মাথা নিচু করে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছি । এই লোক লজ্জা দেওয়ার কোনো সুযোগ হাত ছাড়া করে । বদ লোক !
অগ্নি আমার কাছে এসে আমার ঘাড়ের একপাশ থেকে চুল সরিয়ে সেখানে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আমার গাঁয়ের সুবাশ নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছে । আমি কাঁপাকাঁপা হাত পা নিয়ে চোখ বুঝে নিজের কাঁপুনি শান্ত করার চেষ্টা করছি । হ্ঠাৎ অগ্নি মাতাল স্বরে কানে আসে ,

– “এতোটা দিন তোমার গাঁয়ের এই মিষ্টি সুবাসটাকে খুব মিস করেছি । তোমার ছবি দেখে এতোটা দিন কাটিয়েছি । তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করতো
। শক্ত জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখতে ইচ্ছে করতো ।কিন্তু তুমি আমার কাছে ছিলেননা । আর কোনো দিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা । তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা । এই হুরহীন অগ্নি মরে যাবে ! ”

আমি দুহাতে অগ্নিকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরি । অগ্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে কম্পিত আওয়াজে বলি,

– “এই হুর ও যে অগ্নিহীন প্রানহীন । ওয়াদা করছি কোনো দিন আপনার থেকে দূরে যাবো না । আপনার পরীজান তার অরন্যের মাঝে সারাজীবন বিলিন থাকবে ।ভালোবাসি ,খুব বেশি ভালোবাসি ! ”

অগ্নি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কপালে গভির করে ঠোঁট ছোঁয়ায় ।

সন্ধ্যায় বাড়িতে নিশিত উৎস ভাইয়া ,শেফা ,তানভীর ভাইয়া আসে । আজ রাতটা তারা এখানেই থাকবে ।মানা মামী কিছুক্ষণ পূর্বেই বেরিয়েছে ।আজ সবাইকে এক সাথে দেখে খুব শান্তি লাগছে । এতোদিন যেন নিজেকে কোনো জেলখানায় বন্ধী করে রেখেছিলাম । আজ মন খুলে হাসতে পারছি । কাছের মানুষ গুলোর কেয়ার ভালোবাসা সবকিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলাম ।

রাতের দিকে ছাদে আড্ডা বসেছে । অগ্নি আবির ভাইয়া উৎস ভাইয়া একপাশে অন্যপাশে আমি নিশিত হিয়া আপু । নিশিত কথার মাঝে মজার ছলে বলে,

– “ও মাই গড ভাবী ! তুমি হুট করে কিভাবে গায়েব হয়ে গেলে । আর ফিরার পর এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো কল্পনাও করতে পারিনি । ”

– “কেন খুশি হওনি ফুফি হবে ! ”

– ” অফকোর্স ভাবী ! খুশি মানে ? আমি তো মহা খুশি ।
বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে । হিয়া ভাবী আমাদের রাজপুত্র দিয়েছে । তুমি একটা রাজকন্যা দিবে !”

বলেই বাবুর কপালে চুমু দেয় ।নিশিতের কথায় হেসে উত্তর দেই ,

– ” বাহ্ ! কি ডিমান্ড ,কিন্তু আমার যে একটা রাজপুত্রই চাই একদম তার বাবার মত । ”

হিয়া আপু বড় বড় চোখ করে হেসে বললেন ,

– “না বোন বাবার মত হওয়ার দোয়া করিস না । বাবার যা রাগ জিদ যদি ছেলেও এমন হয় তাহলে তুই তো শেষ হুর । ফিনিশ ! ”

আমি হিয়া আপুর কথায় অবাক হয়ে বলি,

– “ও মা আপু তুমি দেখি আজ তোমার দেবরের সাইড না নিয়ে উল্টো দেবরের বদনাম করছো । তোমার শরীর- টরীর ঠিক আছে তো ? ”

শেফা বলে উঠে ,

– “করবে না তো কি করবে ! অগ্নি ভাইয়া যা করেছে এই দুমাস মাই গড আমি এমন বউ পাগল কোনো দিন দেখিনি । সারাদিন পর যখন তোকে না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতো সব ভাঙচুর করতো । কতবার হসপিটালে ভর্তি হয়েছে । সত্যি অগ্নি ভাইয়া তকে পাগলের মত ভালোবাসে । তুই যা করেছিস একদম ঠিক করিসনি ”

– ” তুই তো সব জানিস সুপ্তি যা করেছে সবকিছুর পর আমার ঠিক থাকতে পারিনি । আর বোকামির বসে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি । কিন্তু আমার শিক্ষা হয়ে গেছে আর কোনো দিন এমন কিছু করবো না । ”

নিশিত পরিস্থিতি এমন থমথমে হতে দেখে আওয়াজ করে বলে উঠে ,

– “ভাবী এসব ছাড়ো । এটা বলো তুমি এমন বোকামি কি করে করতে পারো ? তোমার প্রেগন্যান্সির তিন মাস চলা কালিন সময় তুমি প্রেগন্যান্সি চেকআপ করিয়েছো ! সিরিয়াসলি ? তুমি এই যুগের মেয়ে তো নাকি টাইম মেশিন দিয়ে আদিম যুগ থেকে এসেছো ? এখনকার মেয়েরা ছয় সাপ্তাহ চলা কালেই বুঝতে পারে তাড়া প্রেগন্যান্ট কিনা । চেকআপ করায় । ফুপি মারা যাওয়ার পর তোমার লক্ষন দেখে আঁচ করতে পেরেছিলাম তুমি প্রেগন্যান্ট । তোমাকে চেকআপ করাতে বলেছিলাম । কিন্তু তুমি কি করলে ? খামখেয়ালি ! ”

ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,

– “ইয়ার ,এভাবে লজ্জা দিও না । আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । আর ঐ কয়েক মাসের এতো তোড়জোড়ে মাঝে বিষয়টা মাথা থেকে একদম চলে গিয়েছিলো । ”

– ” এখন তুমি আর বেবি ঠিক আছো তো ? ”

আমি নিশিতের কথায় শুকনো ঢোক গিলে উত্তর দেই ,

– “হুম ,একদম ! ঠিক আছি । ”

এমন সময়ই অগ্নি আওয়াজ কানে ভেসে আসে । পিছনে তাকিয়ে দেখি প্লেট ভরা ফ্রুট নিয়ে একগাল হেসে দাড়িয়ে আছে । ইসস! কি সুন্দর হাসি । আমার ঠোঁট একাই প্রসারিত হয়ে যায় । অগ্নি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললেন ,

– “গার্ল’স কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো ? ”

নিশিত অগ্নির কথায় হেসে জবাব দেয়,

– ” তোমার বউয়ের বোকামি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো ”

অগ্নি আমার দিকে চোখ রেখে বলে,

– ” আমার বাচ্চা বউ একটু আকটু বোকামি করে তা আমি জানি । কিন্তু এখন আবার কি বোকামি করেছে ! ”

– “এখন না আগেকারই ,তোমা,,,,

নিশিত কিছু বলতে নিলে আমি মুখ চেপে ধরি।নিশ্চিত আগের কথা বলবে।ভাই বোন সব লাগামহীন । শুধু আমায় লজ্জায় ফেলার সুযোগ খুঁজে । ইয়া আল্লাহ্‌ ! তুমি এদের সুবুদ্ধি দান করো ।
অগ্নি আমার লজ্জা মাখা মুখ দেখে হেসে আমার পাশে এসে বসে । আমার সামনে ফ্রুটসের প্লেট রেখে বললো,

– “বিকেলে নাস্তাটা কমপ্লিট করোনি । যা খেয়েছিলে সব বমি করে ফেলেছো । সব গুলো শেষ চাই । ”

কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বললাম,

– “আয়ায়ায়া! কেমন অত্যাচার ? ”

অগ্নি আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন ,

– “তোমার হেলথের জন্য খেতে হবে । সবটা যেন শেষ হয় । ”

আমি মুখ ফুলিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি হিয়া আপু ,নিশিত ,শেফা নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছে । আমি লজ্জায় শেষ । এই লোকটা আমাকে লজ্জায়ই মারবে । এমন কেন উনি ? একদম বেপরোয়া !
উনার ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না! অগ্নির ভালোবাসা সীমাহীন অফুরন্ত বেপরোয়া ।

চলবে …❤️

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট :৪৬

সাদার তুষারে ডাকা এক পাহাড়ে দাড়িয়ে আছি । সবকিছু সাদা । যেন প্রকৃতির বাহারি রঙের উপর কেউ সাদারঙ ডেলে দিয়েছে । আসমান থেকে তুষার বৃষ্টি ঝোড়ছে । সাদা রঙে প্রকৃতির যেন অদ্ভুত সৌন্দর্যময় রূপ ধারণ করেছে । আমার চোখের ঠিক সামনেই অগ্নি দাড়িয়ে আছে । তার কোলে এক ফুটফুটে বাচ্চা ।বাচ্চাটার চোখ জোড়া খুব গভীর । আলোর মত ঝলমল করছে । অগ্নির পড়নে কালো কাপড় আর চোখে অশ্রুর বিন্দু । আমি মুচকি হেসে অগ্নির দিকে দু’কদন বাড়াতেই ।প্রকৃতি এক ভয়ংকর রূপ ধারন করে । হঠাৎ ই চারদিকে কালো অন্ধকারে ডেকে যায় । শোকের ছায়া নেমে আসে । আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি অগ্নির দিকে যাওয়ার কিন্তু কোনো ভাবে তার কাছে পৌছাতে পারছিনা । পিছন থেকে কেউ যেন আমার হাত ধরে রেখেছে ।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মা দাড়িয়ে আছে । আমাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আমি ছাড়ানোর হাজার চেষ্টা করছি কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না । আমাকে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে । আমি অনেক কান্নাকাটি করছি কিন্তু আমার কোনো কথাই মা কানে নিচ্ছে না । আমাকে একদম পাহাড়ের কিনারায় নিয়ে আসে । নিজের সাথে নিয়ে ঝাপ দেয় । আমি অগ্নি বলে সজোরে চিৎকার করি ।

আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে কান্না করছি ।অগ্নির গলার স্বর কানে আসতেই আমি চোখ খুলে তাকাই । অন্ধকারে হাল্কা ড্রিম লাইটের আলোতে অগ্নির ভয়ার্ত চেহারা দেখা যাচ্ছে আমি হুট করে অগ্নিকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না করে দেই । একসময় হিচকি উঠে যায় । আমি ধীরেধীরে অগ্নির বুকের সাথে মিশে যাচ্ছি । প্রচন্ড ভয় করছে । অগ্নির বুকে ভিতর আশ্রয় নিলে হয়তো এই ভয় নিবারণ হতো । অগ্নি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছি না । অগ্নি আমার কাঁধে বেশ কয়েকটা চুমু দিয়ে । চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ,

– “কি হয়েছে কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো ? ”

আমি অগ্নিকে জড়িয়ে ধরেই ‘হ্যা ‘বোধক মাথা নাড়াই । অগ্নি আমাকে ছাড়িয়ে বেডের পাশে বেড বক্র থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয় । আমি এক ডোকে পুরোটা পানি শেষ করি । অগ্নি আমার চোখে জল মুছে দিয়ে । বললো,

– “চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেও । ”

আমি অগ্নির দিকে একদৃষ্টি তে তাকিয়ে আছি । অগ্নি আবার বললো ,

– “নেও না ”

আমি চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেই । চোখে খুলে অগ্নির দিকে ভীতু চোখে তাকাতেই অগ্নি আমার কাছে আমার কপালে বেশ কিছু চুমু এঁকে দেয় । আমি বন্ধ চোখে অগ্নির প্রত্যেকটা স্পর্শ অনুভব করি । অগ্নি আমার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলে ,

– “কিছু হবে না । আমি তোমার সাথে আছি তো ! তোমার কিছু হতে দিবোনা । সর্বদা তোমার সাথে থাকবো । নিজের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার সবটা দিয়ে তোমার হেফাযত করবো । ”

আমি অগ্নির বুকে মাথা রাখি । অগ্নি বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে । আলতো হাতে আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে । আমি অন্যমনস্ক হয়ে আছি । অগ্নির টিশার্টের কিছুটা অংশ খুব শক্ত করে নিজের মুঠোয় ধরে আছি । যেন মুঠো হাল্কা হলেই আমি অগ্নির থেকে দূরে চলে যাবো ।অগ্নি কিছুক্ষণ পর পর আমার মাথায় নিজের ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে ।

সে রাতে আর ঘুম হয় না । অগ্নিও আমার সাথে সারাটা রাত জাগে । ফজরের আজানে বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ আদায় করেনি ।
বারান্দার রেলিং ধরে দাড়াই । এখনো ভোরের আলো ফুটেনি চারদিকে এখনো আবছা অন্ধকারে মোড়ানো । আমি উদাসীন দৃষ্টিতে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।সূর্য কি সুন্দর করে রাতের আঁধার কাটিয়ে নতুন দিনের সূচনা করছে । কিন্তু আমার জীবন ? আমার জীবনে কি নতুন দিনের সূচনা হবে !
নাকি সোনালি দিনের সূচনার আগেই জীবন কালো মেঘে ছেয়ে যাবে ?
সেই ভয়ংকর স্বপ্নের অর্থ কি ছিলো ? কেন দেখেছি অগ্নি আমাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে !
এতোদিন পর আমার জীবনে সব ঠিক হচ্ছে নতুন করে সব শুরু হচ্ছে । সবেমাত্র সুখের ছোঁয়া লেগেছে । তবে কি এই সুখই জীবনের শেষ সুখ ? এখানেই সমাপ্তি হবে !
ভয় ,অনিশ্চয়তায় বুক ভার হয়ে আছে ।
অগ্নির স্পর্শে আমার ধ্যান ভাঙে । অগ্নি পিছন থেকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়েছে । কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ,

– “কি ভাবছো? ”

– “রাতের সেই ভয়ংকর স্বপ্নের নিয়ে । এর অর্থ কি ছিলো ! ”

– “কি এমন দেখেছো যা আমার পরীজানকে এতোটা বিরক্ত করছে ? ”

– “দেখেছি আমরা এক মনোমুগ্ধকর অপরূপ সুন্দর পাহাড়ের উপর আছি । আপনার কোলে একটা নুরের মত ছোট্ট শিশু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে । ”

– “এতে ভয় পাবার কি আছে । এটা তো ভালো স্বপ্ন । ”

– “এখানেই শেষ না ! তারপর হঠাৎ চারদিক কালো হয়ে গেলো । আপনার চোখে অশ্রু । মা আমাকে টেনে উনার সাথে নিয়ে পাহাড়ের কিনারায় যাচ্ছে । তারপর ,তার,,,পর
আমাকে নিয়ে হুট করে পাহাড় থেকে ঝাপ দেয় । ”

আমার কথা শেষ হতেই অগ্নি আমাকে তার দিকে ফিরায় । তখনো আমার হাত পা ভয়ে কাঁপছে । চোখে জল ভিড় করছে ।
অগ্নি আমার দু গালে আলতো করে হাত রেখে বললো,

– “পরীজান ,শান্ত হও! এটা শুধুমাত্র একটা খারাপ স্বপ্ন । আমরা সারাদিন যা নিয়ে ভাবি তা আমাদের মন আর মস্তিষ্ককে স্টোরি ক্রিয়েট করে । যা বিশ্রামের সময় আমাদের মস্তিষ্ক দেখায়। এটা খারাপ স্বপ্ন যার সাথে আমাদের জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই । এসব নিয়ে চিন্তা করে মন খারাপ করো না । তোমার এখন হাসিখুশি থাকার সময় । সবসময় হাসিখুশি থাকবে কেমন ? ”

আমি পলক ঝাপটে হ্যা বোধক ইশারা করি । অগ্নি আমাকে আমার নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় । আমি মুচকি হেসে অগ্নির বুকের বাঁ পাশে হাত রাখি । অগ্নি আমার কানের পিছনে চুল গুজে দিয়ে বললো ,

– “ভিতরে চলো । নাস্তা রেডি করে নেও ! ”

আমি মাথা তুলে অগ্নির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলি ,
– “এখনো তো সবাই ঘুমে । এতো সকালে কে নাস্তা তৈরি করলো ? চম্পা ? ”

– ” কেন মেম আমাকে কি চোখে পরে না ? ”

আমি বিষম খেয়ে বলি,

– “আপনি নাস্তা রেডি করেছেন? আপনি ? ”

– “ইয়েস! পরীজান । ”

– “অগ্নি আপনি কি পাগল ! শুধু শুধু কষ্ট করে এসব করেছেন । এখনো তো নাস্তার টাইম হয়নি আর আমার খুদা লাগেনি । ”

– “তুমি ডিস্টার্ব ছিলে ,সারারাত জেগেছো ঘুমাও নি । তাই ভাবলাম আমার পরীজানকে ছোট একটা সার্প্রাইজ দেওয়া যাক । এতে যদি আমার পরীজানের মন সামান্য ভালো হয়! ”

– “অগ্নি আপনি সত্যি পাগল ”

– “হুম ,আর তা শুধু তোমার জন্য । এখন ভিতরে চলো নাস্তা করে নেও । ”

আমি ভিতরে যেতেই হা করে তাকিয়ে থাকি । অগ্নি খুব সুন্দর করে ব্রেকফাস্ট সাজিয়েছে । একটা প্লেটে দুইটা চিকেন সেন্ডুইচ পাশেই টমেটো কেচাপ দিয়ে স্মাইলি ইমোজি ড্র করা । দুইটা জগ একটায় অরেঞ্জ জুস অন্যটায় গ্রেপ । একটা প্লেটে ফ্রুডস কাটা । বয়েল এগ। মাঝে ফুলদানি তে তাজা গোলাপ ফুল । এখনি হয়তো বাগান থেকে ছিড়ে এনেছে । সবকিছু পরিপাটি সুন্দর করে সাজানো ।আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি । এই মানুষ টা এমন কেন ? উনার সবকিছু এতো সুন্দর পরিপাটি । আর উনার ভালোবাসা তো লাজবাব !
অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে অপরাধীর ভঙ্গি তে বললো ,

– “সরি,আসলে বেশি কিছু করতে পারিনি ।
তোমার পছন্দ হয়েছে কি ? ”

আমি আচমকা অগ্নিকে জড়িয়ে ধরে তার গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে নেই । অগ্নি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে । আমি অতি আনন্দের স্বরে বলি ,

– “অগ্নি আমার খুব খুব খুব পছন্দ হয়েছে । আপনি এতো সুন্দর সার্প্রাইজ দিয়ে আমার দিনটা স্পেশাল করে দিয়েছেন । ”

– “তো এবার ব্রেকফাস্ট করে নেও । আমরা মর্নিং ওয়াকে যাবো । ”

– “মর্নিং ওয়াক ?”

– “হুম এখন থেকে প্রতিদিন দুজন একসাথে মনিং ওয়াকে যাবো । তোমার আর বেবির জন্য খুব উপকারী । ”

আমি উত্তরে মুচকি হাসি । অগ্নি আর আমি একসাথে নাস্তা করে মনিং ওয়াকের জন্য রেডি হই । জুতার ফিতা বাঁধতে গিয়ে পরি মুশকিলে । কোনো ভাবেই নিচু হয়ে জুতার ফিতা বাঁধতে পারছিনা । পেটে চাপ পড়ছে । ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেই । মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকি । এমন সময়ই পায়ে কারো স্পর্শ পাই । তাকিয়ে দেখি অগ্নি । আমার পায়ে ধরতেই আমি পা সরিয়ে নিয়ে বলি,

– “কি করছেন ! পায়ে ধরছেন কেন ? স্বামীদের স্ত্রীর পায়ে ধরতে নেই । ”

অগ্নি আমার কথা কানে না নিয়ে নিজের মন মত কাজ করে যাচ্ছে । আমার পায়ে জুতা পড়িয়ে ফিতা বেঁধে দেয় । আমার চোখে চোখ রেখে বলে ,

– “স্ত্রী সবরকম সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ করা স্বামী দায়িত্ব । আর আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি । আর সারাজীবন তোমার দাস হয়ে থাকতেও রাজী আমার সুন্দরী ।”

কথা শেষ করে আমার দুহাতে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে আমি খুশিতে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি । এতো ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী স্ত্রী মনে হচ্ছে ।অগ্নির এই অন্তহীন ভালোবাসা আমাকে পাগল করে দেয় । কে বলেছে স্বর্গ দূর ? আমার জন্য তো স্বর্গ এই দুনিয়াতেই । আমার অগ্নির মাঝেই আমার স্বর্গ । যদি পৃথিবীর প্রতিটা পুরুষ তার স্ত্রী কে এভাবে ভালোবাসতো ,তাহলে হয়তো প্রতিটা স্ত্রীর জন্য এই দুনিয়াটা স্বর্গ হতো !

চলবে …❤️

শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট :৪৭

দুপুরে সবাই একসাথে লাঞ্চ করছি । অগ্নিও কিছুক্ষণ পূর্বেই বাড়িতে ফিরেছে । অগ্নি নিজের পুরোটা সময় আমাকে দেয় ।আমি অগ্নির পাশের চেয়ারে বসে আছি ।খাবারের ঘ্রাণে মাথা ভনভন করে ঘুরছে । ভিতরে যা আছে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । কিছু মুখে তুলতে পারছিনা । যা খাচ্ছি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । পেটটাও ঘুরঘুর করছে । আমি কোনো রকম নাক মুখ চেপে ধরে আছি । অগ্নি আমার প্রত্যেকটা কাজ খুব গভীর ভাবে খেয়াল করছে ।আমার এখন অবস্থা দেখে অগ্নি জিগ্যেস করে ,

– ” কি হয়েছে হুর ,খাচ্ছো না কেন ! খুব খারাপ লাগছে কি? ”

টেবিলে সবার দৃষ্টি আমার দিকে । আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম,

– “না কিছুনা ,খাচ্ছি । ”

অগ্নিকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে এক লোকমা মুখে তুলি । অগ্নি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের খাবারে ধ্যান দেয় । দুতিন লোকমা মুখে তুলতেই আমার খারাপ লাগা শুরু করে দেয় ।ভিতরে সবকিছু ভল্কাতে শুরু করে ।যতটুকু খেয়েছি সব উপরের দিকে চলে আসছে । টেবিল ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনের দিকে যাই । যতটুকু খেয়েছি সববেরিয়ে আসে ।অনবরত বমি হচ্ছে । আমার নাজেহাল অবস্থা শরীর চলছে না । বড়বড় শ্বাস নিচ্ছি । ততক্ষণে অগ্নিও এসে গেছে । আমাকে পিছন থেকে এসে ধরে । আমি পুরো শরীরের ভর অগ্নির উপর ছেড়ে নেই । ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসছে । অগ্নি আমার মুখ পরিষ্কার করে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যায় ।
রুমের বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আমার পাশে আধ শোয়া হয়ে বসে । আমি তখনো অগ্নির শার্ট শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি । মুখটা অগ্নির বুকের মাঝে লুকানো ।
অগ্নি আমার গালে আলতো করে স্লাইড করছে । আমি নিভু নিভু চোখে অগ্নির মুখের দিকে তাকাই । অগ্নির চেয়ারায় স্পষ্ট চিন্তার ছাপ । কপাল কুঁচকানো । আমার গালে আগের মত স্লাইড করতে করতে চিন্তিতো স্বরে বলে,

– “খুব খারাপ লাগছে ! তুমি ঠিক আছো ? ”

আমি চোখে পাতা ঝাপটিয়ে উত্তর দেই আমি ঠিক আছি । কথা বলার মত শক্তি আমি পাচ্ছিনা ।শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছে । আমি বুঝতে পারছি আমি ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি । এমনটা তো হওয়ারই ছিলো !
ভবিষ্যৎ এর চিন্তা মাথায় আসতেই বুকটা অজানা ভয়ে নাড়া দিয়ে উঠে । দুশ্চিন্তা আর শারীরিক দুর্বলতায় গাঁ আর সায় দিচ্ছেনা । আমি আবার চোখ বুঝে অগ্নিকে আগের চেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করি ।এই বুকটাই আমার সবচেয়ে শান্তির স্থান । যদি এই মানুষটা আমার কাছে থাকে সব ধরনের লড়াই আমি করতে পারবো । হোক তা মানুষিক বা অন্যকোন । অগ্নি আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ।
আমি যখন অগ্নির বুকে প্রশান্তি আর ভয় নিবারণের ঔষধ খোঁজ করছিলাম অগ্নি তখন গভীর চিন্তায় লিন । সেই চিন্তার কারণটাও আমি । আমি জানি ঘুম ভাঙার পর আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ।

ঘুম ভাঙে বিকেলের শেষ প্রহরের দিকে । অন্ধকার নেমে আসছে , মাগরিবের আজান এখনো দেয় নি । আমি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে দেখি অগ্নি আমার খুব কাছে নিখুঁত চাহনি তে আমাকে দেখছে ।দুজনের গাঁয়ের উপর কম্বল ছড়ানো । রুমে এসি চলছে । অগ্নির খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আলতো হাতে স্পর্শ করি , মলিন হেসে নিচু স্বরে বলি,

– “এভাবে কি দেখছেন ? ”

অগ্নি আমার হাতের তালুতে চুমু দিয়ে আলতো করে নিজের মুঠোবদ্ধ করে ।অগ্নির গভীর চোখজোড়ায় ভয় ।যা সচ্ছভাবে ফুটে আছে । অগ্নির আমার দিকে তখনো আগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আমি আবার প্রশ্ন করলাম ,

– “কি বলবেন না ? ”

অগ্নি ভাঙা স্বরে জবাব দিলেন ,

– “হুর আমার ভয় হচ্ছে । প্রচন্ড ভয় । মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাবে ,হারিয়ে যাবে । আমার অন্যকোন কিছুর প্রয়োজন নেই । আমার শুধু তোমাকে চাই । তোমার শরীরের দিন দিন এই অবউন্নতি আমার ভয় বাড়াচ্ছে । ”

– “অগ্নি ,আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন । আমি ঠিক আছি । ”

– “না হুর তুমি ঠিক নেই । কি ভেবেছো? তোমার শরীরের দুর্বলতা আমার চোখে পড়ছে না !
আমি স্পষ্ট দেখছে পারছি তুমি প্রচুর অসুস্থ । গলা ভেঙে যাওয়া ,এমন ঘনঘন বমি , ঘুমের সময় এভাবে ঘেমে যাওয়া এগুলো স্বাভাবিক ? ”

– ” অগ্নি প্রেগন্যান্সির সময় এসব স্বাভাবিক । প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর হয় যার ফলে কোনপ্রকার তৈলাক্ত খাবার বা অতিমাত্রা ঘ্রাণ যুক্ত কোন জিনিশের কারণে এমন বমি হয় । গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে প্রতিদিনে একবছরের তুলনায় বেশি ইস্ট্রোজেন হরমোর ক্ষরণ করেন যার ফলে গলার স্বর ভেঙে যায় । অতিরিক্ত ঘাম হয় । পায়ে পানি আসে । এসব কিছু অস্বাভাবিক কিছু না ।”

– “যতই স্বাভাবিক হোক না কেন আমার মন মানছে না । তাই তোমার চেনা ডক্টরের এপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছি । সাতটার দিকে যাচ্ছি চেকআপের জন্য । রেডি থেকো । ”

অগ্নির কথায় আমি চিন্তিত হয়ে পরি । ভয় আরো বেড়ে যায় । ভিতু স্বরে বলি ,

– “অগ্নি আপনি শুধু শুধুই টেনশন করছেন । চেকআপ করতে হবে কেন ! আমি ঠিক আছি । ”

– “চেকআপ না করা পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হতে পারছি না ”

– “অকে ,তাহলে ঠিক আছে । আমি আর হিয়া আপু যেয়ে চেকআপ করে আসবো । ”

– “উহু ,তোমার সাথে আমি যাবো । আমি তোমার সুস্থতার কথা ডক্টর এর মুখ থেকে শুনে নিশ্চিত হতে চাই । তা না হলে আমার মন অশান্ত থাকবে । ”

– “অগ্নি আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন । আমি আর আপু সব ম্যানেজ করতে পারবো তো ! ”

– “তুমি কেন আমার সাথে ডক্টরের কাছে যেতে চাইছো না ! ইজ এভরিথিং ওকে ? তুমি কি আমার থেকে কিছু লোকাচ্ছো ? বা লোকাতে চাইছো ? ”

আমি শুকনো ঢোক গিলে বলি ,

– “না ,একদম না ! কি লুকাবো ? কিচ্ছু লুকাচ্ছি না । ”

কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উঠে বসি । অগ্নি আমার দিকে সন্দেহ যুক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । যেন আমার কথা অগ্নির খুব একটা বিশ্বাস হয়নি !

________________________

ডক্টর আন্টির সামনে বসে আছি । আমার হাত পা ঘেমে আসছে । টেনশনে কপালেও ঘাম জমেছে । আন্টি আমার রিপোর্ট গুলো চেক করছে । চেহারায় চিন্তার আভা ।কিছুক্ষণ পর আমার দিকে হতাশ চোখে তাকায় । অগ্নি আমার পাশেই বসে আছে ।
অগ্নি চিন্তিত স্বরে আন্টিকে জিগ্যেস করেন ,

– “আন্টি সব ঠিক আছে তো ? ”

আন্টি হতাশ স্বরে বললেন ,

– “অগ্নি কিছু ঠিক নেই ।অবস্থা খুব একটা ভালো না । ”

কথাটা শুনে অগ্নির চেহারার রঙ পাল্টিয়ে যায় । অগ্নি থতমত গলায় বললো ,

– “আন্টি প্লিজ বিস্তারিত বলুন । আমার খুব ভয় হচ্ছে । ”

– “অগ্নি হুরের প্রেগন্যান্সিতে কিছু কমপ্লিকেশন আছে ।অগ্নি আমি এখন যা বলবো খোলাখুলি ভাবে বলবো তোমার সবটা জানা দরকার ।
আমি প্রথম থেকেই হুরের ট্রিটমেন্ট করছি ।হুরের পাস্ট মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে সবকিছু আমার জানা ।হুরের কিছু প্রব্লেম ছিলো যার ফলে আমি হুরের ট্রিটমেন্ট করে। মেডিসিন কোর্স দিয়েছিলাম ।প্রব্লেম টা এমন ছিলো যে হুরের মা হওয়ার চান্স ফিভটি পার্সেন্ট ছিলো । আল্লাহ্‌ র অশেষ কৃপায় হুর প্রেগন্যান্ট হয়েছে কিন্তু এতে কিছু প্রব্লেম আছে । এটি প্রেগন্যান্সির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । হুরের হিমোগ্লোবিনের পয়েন্ট এমনিতেই কম । শরীরের রক্তশূন্যতা রয়েছে তার উপর প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আসেনা ,শরীর দূর্বল । এতে মায়ের জন্য লাইফ রিস্ক হতে পারে । তাই আমি হুর কে এভরোশন করতে বলি । কিন্তু হুর মানতে নারাজ । সে এ বাচ্চা চায় তাই কোনো উপায় না পেয়ে হুরকে প্রতিকারের জন্য ইনজেকশন নিতে বলি কিন্তু এর পর হুরের আর কোন খোঁজ নেই ।রিপোর্ট অনুযায়ী হুর টাইম টু টাইম ইনজেকশন নেয়নি ।
এখনকার রিপোর্ট অনুযায়ী বেবি সুস্থ আছে । কিন্তু ডেলিভারির সময় হুর ও বেবি দুজনের প্রব্লেম হতে পারে । মৃত্যু হতে পারে বাঁচার চান্সেস কম ! ”

অগ্নি আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায় । আমি বেশ বুঝতে পারছি অগ্নির রাগের কারণটা কি । অগ্নির চোখ টলটল করছে । অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ,

– “আমাকে এসব আগে জানাও নি কেন ? ”

আমি চুপ করে আছি । ভয় আমার হাত পা কাঁপছে । এতোটা দিন ঠিক এই ভয়েই ছিলাম । অগ্নির আমার ধমক দিয়ে বলে ,

– “আমি কিছু বলছি হুর ! আমাকে জানাও নি কেন ? হোয়াই ? ”

অগ্নির শেষ ধমকে আমি কেঁপে উঠি । অগ্নিকে এভাবে রেগে যেতে দেখে ডক্টর আন্টি অগ্নিকে বলে ,

– “বি কুল অগ্নি ! এখন মাথা গরম করার সময় না । হুর যা বোকামি করার তা করে ফেলেছে । কিন্তু এখন সলিউশন খোঁজা দরকার । ”

– “আন্টি আমাকে বলুন কি করতে হবে আমি সব করবো । আমার হুর যেন সুস্থ থাকে । এর জন্য যতটাকা লাগে যা যা করতে হবে আমি সব করবো ।”

অগ্নি করুণ স্বরে বললেন । অগ্নির চোখে মুখে ভয় । যেন সে দিশেহারা হয়ে গেছে । অগ্নির এমন মুখ দেখে আমার ভিতরের সব ভেঙে কান্নার ঢল নামতে চাইছে । আন্টি বললেন ,

– ” হুরের সাথে আমার সম্পর্ক এখনকার না অনেক আগের । আমি আর হুরের মামী ক্লাসমেট । হুর কে দেখে তার মা হুমায়রার কথা মনে পড়ছে। সে ও হুরের মতই ছিলো ,জেদি! হুমায়রার ও প্রেগন্যান্সিতে কম্পলিকেটেট ছিলো । কিন্তু সে হুরকে বেছে নিয়েছে । যার ফলে ডেলিভারির সময় তার মৃত্যু হয় ।হুর আমার কাছে আমার মেয়ের মত । আমি নিজের বেষ্ট ট্রাই করবো ।আর হ্যা এই সময়টায় সবচেয়ে বড় ঔষধি হলো সাহস । তোমাদের ভেঙে পড়লে হবে না । সাহস করে লড়তে হবে । আল্লাহ্‌ চাইলে অবশ্যই হুর আর বেবি সুস্থ থাকবে ।তুমি চিন্তা করোনা অগ্নি আল্লাহ কে ডাকো ”

আমি মাথা নত করে প্রত্যেকটা কথা শুনলাম । চেম্বার থেকে বের হতেই অগ্নি আমার হাত ধরে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত আসে । অনেকটা জোরেই ধরেছিলো । একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায় নি । সারারাস্তা দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা ছিলো । অগ্নির ভিতরে রাগে ফুসছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি । না জানি অগ্নি কোন ঝড় তোলে ।

চলবে……..❤️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন 😊😊😊।