শব্দহীন প্রণয়কাব্য পর্ব-০৪

0
253

#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(চার)
#Mst.Shah Mira Rahman
“ভালোবাসা সুন্দর।ভয়ংকর সুন্দর।তবে যদি হয়ে থাকে তা ভুল মানুষের সাথে তবে তা আর সুন্দর থাকে না।ভয়ংকরে পরিণত হয়।আমার ভালোবাসা ভুল ছিল না। শুধু আপনি মানুষটা ভুল ছিলেন আমার জন্য।”
ডায়রির পাতায় অনুভূতি গুলো আঁকিবুঁকি করে তা অতি সন্তর্পণে টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা হলো।ডায়রিটা শুধু একটা ডায়রি নয় এ যেন আস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস।
___
সুলেমান লিফটে পিঠ ঠেকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।মীরা শক্ত হাতে বাজারের ব্যাগ গুলো ধরলো। নিজের দুর্বলতা ঢেকে চোখে মুখে কঠোরতা ফুটিয়ে তুলে লিফটে প্রবেশ করল। সুলেমানের দিকে পিঠ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।হাতের ব্যাগ গুলো নিচে রেখে ষোল তলার বাটনে চাপ দিল।অস্থিরতায় ছেয়ে গেল মন।পেছন ফিরে অতি পরিচিত ওই মানুষটার মুখ টা আরেকবার দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠেছে।নাহ, নিজেকে শক্ত করল মীরা।জ্বলে ওঠা চোখের কোণাদের শাসালো নিদারুণ ভাবে।একটা সময় এই মানুষটা তার অনুভূতির সমস্তটা জুড়ে থাকলেও আজ এই মানুষটার প্রতি শুধু তার ঘৃণাই অবশিষ্ট রয়েছে।হুম ঘৃণা করে সে এই লোকটাকে।নির্দয় লোকটা তার অনুভূতি গুলোকে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে।নিঃস্ব করে দিয়েছে তাকে।আজ নিজের বলতে তার কিছু নেই।সে একা।সে নিঃস্ব। শুধুমাত্র এই লোকটার জন্য।মীরার নিজের ভাবনা ভঙ্গ হলো।অনুভব হলো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুলেমানের শকুন দৃষ্টি তার ওপর আবদ্ধ হয়েছে। অসস্থিতে হাঁসফাঁস করতে লাগলো সে। সুলেমানের দৃষ্টি যেন তার শরীর এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে।শ্বাস ঘন হলো।শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর।মীরা এদিক ওদিক তাকালো।আজ লিফটের ভেতর কয়েক সেকেন্ড যেন কয়েক যুগের মতো লাগছে তার কাছে।এখনো‌ ষোল তলা আসছে না কেন?এই লোকটার সাথে একা একটা লিফটের ভেতর আছে কথাটা ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল তার।পরপর শুকনো ঢক গিলল।দুই হাত একে ওপরের মাধ্যমে মোচড়াতে লাগল।মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করল সে।এরই মাঝে তাকে একরাশ সস্থি দিয়ে লিফটের দরজা খুলে গেল।মীরা তাড়াতাড়ি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে গেল। সুলেমান বাঁকা হাসল।মীরা বেরিয়ে যেতেই সে আট তলার বাটনে চাপ দিল।লিফট আবার নিচে নামতে লাগলো।
____
“আপাতত বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে নিস।রাতে আমি আসার সময় ডিনার নিয়ে আসবো।”
সালমান টিভি দেখতেই দেখতেই বিরক্ত প্রকাশ করল।
“উফ্, বললাম তো ভাই আর আসার প্রয়োজন নেই তোমার।”
সুলেমান গাড়ির চাবি পকেটে ঢুকিয়ে মৃদু হেসে ফ্লাট থেকে বেরিয়ে গেল।আজ যে তাকে আসতেই হবে।নিজের ভালো থাকার জন্য হলেও এখন তাকে বারবার আসতে হবে এখানে।সুলেমানের কেমন যেন সুখ সুখ লাগছে।ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে।নিজের অজান্তেই ঠোঁট থেকে হাসিটা যাচ্ছে না।আচ্ছা,এসব কি ওই পাষাণ নারীকে দেখার পর থেকেই হচ্ছে!
___
“তোদের বারন করেছিলাম ওদের সাথে ঝামেলা না করতে।”
“ভাই আমাদের কি দোষ?ওরাই আমাদের ছেলেদের উস্কানি মূলক কথা বলে উস্কে দিয়েছে।”
“ওরা উস্কালো আর তোরা লাফাতে লাফাতে চলে গেলি মারামারি করতে?”
“সরি ভাই,আর এরকম হবে না।”
অনিক মাথা নিচু করে ক্লাব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত চেয়ারে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিল।রাগে মাথার ভেতর দপদপ করছে। সালমান কি চাইছে এইভাবে ঝামেলা সৃষ্টি করে। সকাল যদি এসব জানে তো অহেতুক তাদের মাঝে আবার ঝামেলা শুরু হবে।যা সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই চায় না।
রাজনীতিতে পদার্পণ করেছে খুব বেশিদিন হয় নি সিদ্ধান্তর।এই রাজনীতি নিয়ে তার কোনো কালেই কোনো মাথা ব্যথা ছিল না।এমন কি বাবার মৃত্যুর পর ও না।তবে একটা সময় হুট করেই জড়িয়ে গেল রাজনীতিতে।নাহ, তার উদ্দেশ্য শাহিন মির্জা কে হারানো নয়।বরং জনসেবা করে নিজের বাবার ওপর আসা অভিযোগ গুলো মিথ্যে প্রমাণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য।সে সবাই কে বোঝাতে চায় যেই বাবা নিজের সন্তানদের এতো ভালো সুশিক্ষা দিতে সে কখনোই অনৈতিক কাজ করতে পারেন না। কখনোই না।
____
মাত্র গোসল সেড়ে বেরিয়েছে মীরা।শরীরে টাওয়েল টা ভালো ভাবে জড়িয়ে ওভাবেই শুয়ে পরল সাদা বেডশীট জড়ানো বেডে। দৃষ্টি সিলিংয়ের ওপর।এক সেকেন্ড,দুই সেকেন্ড,তিন সেকেন্ড সাথে সাথে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল সাদা চাদরে।লোকটা কে দেখার পর থেকেই তার এরকম হচ্ছে। বুকের ভেতরটা হু হু করছে।যন্ত্রণায় ছটফট করছে হৃদয়।মীরা কাত হয়ে শুলো।মনে করল তাদের প্রথম দেখা প্রথম আলাপের দিন টি।সাথে সাথে এক মিশ্র অনুভূতি জড়িয়ে ধরল তাকে। তাদের প্রথম দেখাটা যেমন তার মনে প্রশান্তি এনে দেয়।ঠিক তেমনই হৃদয়টা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
____
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। মীরার আজকে হসপিটালে নাইট ডিউটি আছে।একটা বেসরকারি হসপিটালের জুনিয়র ডক্টরের পদে যুক্ত সে। এপার্টমেন্টের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।পরনের কচু পাতা রঙের শাড়ি।বেনুণী করা চুল গুলো কাঁধ গলিয়ে সামনের দিকে ফেলে রেখেছে।চোখে চশমা ও সাদা রঙের এপ্রোণ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উনত্রিশ বছর বয়সী এই রমণীকে দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।দূর হতে তাকে দেখতে থাকা সুলেমান নিজের বুকে হাত রাখল।হৃদপিণ্ড এতো দ্রুত চলছে কেন?
মীরা হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আবার রাস্তায় চোখ রাখল।খালি রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না।মীরা কিছুটা পথ হেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।সামনে রিকশার অভাব হবে না।কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই হঠাৎ ই সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।মীরা বিরক্ত হলো এভাবে হুট করে গাড়ি সামনে এসে পড়ায়।তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ির ভেতরের ব্যাক্তিটিকে দেখে সেই বিরক্ত অবাকের পর্যায়ে গেল।সুলেমান কে এখানে আশা করে নি সে। এখানে কেন উনি?
গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলেও দৃষ্টি সামনের দিকে। মীরার দিকে না তাকিয়েই শান্ত গলায় বলল,
“উঠে এসো।”
মীরার যেন বুকের রক্ত ছলকে উঠলো।আজ কত বছর পর এই কণ্ঠটা শুনলো সে।চোখ জ্বলে উঠলো তার।লোকটা একটুও পাল্টায় নি আগের মতোই রয়ে গেছে।তবে এখন যেন তার সৌন্দর্য একটু বৃদ্ধি পেয়েছে।এদিক ওদিক তাকালো মীরা।এই লোকের মোহে পড়া যাবে না।লোকটা ভয়ংকর।আর এই ভয়ংকর লোকটাকে শুধু ঘৃণা করা যায়।শুধুই ঘৃণা।
অতীতের কথা মনে পড়তেই হুট করে মীরার রাগ হলো। শরীর তিড়তিড় করে কেঁপে উঠলো। সুলেমানের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়ির পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলো।সুলেমান দুই ঠোঁট ফাঁক করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।অতঃপর গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে এগিয়ে গেল মীরার দিকে।
নিজের হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে পেছনে তাকালো মীরা।সুলেমান দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি তার দিকে।সেই দৃষ্টিতে এলোমেলো হলো মীরা।বলার মতো কথা হারিয়ে ফেলল।চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।সুলেমান চোখ সরালো।ধরে রাখা হাত টানতে টানতে গাড়ির দিকে যেতে লাগল। মীরার সম্বিত ফিরল। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হলো।রাগে দুটো কথা শোনানোর আগেই সুলেমান তাকে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে সাথে সাথে সিটবেল্ট বেঁধে দিল।মীরার শরীর কাঁপতে লাগল।রাগে না অনুভূতির জোয়াড়ে বুঝল না।সুলেমান কোনো বাক্যব্যয় না করে ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। মীরার রাগ আকাশ ছুঁলো।রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে উঠলো সে,
“সাহস কি করে হয় আপনার আমাকে এভাবে জোর করার।আমার অনুমতি ছাড়া আপনি আমাকে স্পর্শ ও করেছেন?হাউ ডেয়ার ইউ? আপনার স্পর্শ আমি ঘৃণা করি।আপনি মানুষটাকেই আমি ঘৃণা কর….”
কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটালো সুলেমান।মীরার দিকে এগিয়ে এসে এক হাতে মীরার মাথার চুল আঁকড়ে ধরে তার ঠোঁট
জোড়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করল।মীরা জমে গেল।চোখের দৃষ্টি ফ্যাকাশে হলো। সুলেমান অন্য হাতে মীরার সিটবেল্ট খুলে তাকে নিজের আরো কাছে নিয়ে এলো‌।ঠোঁটের স্পর্শ গভীর হলো।নেতিয়ে গেল মীরা।চোখ বুজে পড়ে রইলো সুলেমানের বুকের ওপর।সুলেমান মৃদু কামড় বসালো মীরার ঠোঁটে।কেঁপে উঠলো মীরা।তবে শব্দ করল না।সুলেমান নিজের বহুদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে ছাড়ল মীরাকে।দুই হাতে আগলে নিল তাকে বুকের মাঝে।মীরা ওভাবেই পড়ে রইলো।নড়লো না।কথা বলল না।শুধু অনুভব করল। সুলেমানের হাতের বন্ধন দৃঢ় হলো।এই যে এত শত মুহূর্তের পর এই জড়িয়ে ধরাটা যেন শ্বাস নেওয়ার মতোই বড্ড প্রয়োজন ছিল।ওভাবেই কাটল কিছু মুহূর্ত কিছু পল। সুলেমান হাতের বাঁধন হালকা করল।মীরাকে উদ্দেশ্যে করে মৃদু কণ্ঠে বলল,
“তুমি ঘৃণা করতে জানো আর আমি জানি কি করে সেই ঘৃণাকে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করতে হয়।”
এরকম লাগামছাড়া কথায় মীরা অজান্তেই লজ্জা পেয়ে গেল।নিজের অবশ হওয়া শরীর টা গাড়ির সিটে ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বসে রইল।সুলেমান দেখল সেই লজ্জা।মৃদু হেসে সে এবার গাড়ি চালানোয় মন দিল।তবে বেশিদূর যেতে পারল না। মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আবার মীরার দিকে ফিরল। হাঁসফাঁস করতে করতে বলল,
“একটু শ্বাস নিতে চাই মীরা।এদিকে এসো আরেকটু জড়িয়ে ধরি।”
চলবে❤️