শব্দহীন প্রণয়কাব্য পর্ব-০৫

0
230

#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(পাঁচ)
#Mst.Shah Mira Rahman
আর পাঁচটা সাধারণ বিয়ের মতোই তাদের বিয়েটা ও পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল।পাত্র হিসেবে সুলেমান কে দেখে মীরা প্রথমবার হোচট খেল।বিয়ে করবে না বলা মীরার বিদ্রোহী মন তখন উল্টো সুরে গাইতে লাগলো। চুপিচুপি মীরার কানে এসে বলে উঠল,”মীরা এই কি তবে তোর সেই স্বপ্ন পুরুষ।”মীরা লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুইয়ে পরলো।বন্ধ ঘরে মৃদু চিৎকার করল,
“হুম হুম।এই তো আমার সেই স্বপ্নপুরুষ।”
প্রতিটি মেয়ের কল্পনায় একজন স্বপ্নপুরুষ থাকে।মীরা তার সেই স্বপ্নপুরুষ কে সুলেমানের মাঝে খুঁজে পেয়েছিল।প্রথম প্রেম বলে যে একটা শব্দ আছে তার সত্যতা মীরা ক্ষণে ক্ষণে টের পেল।
দিন গেল মাস গেল।তাদের বিয়ের তখন এক মাস পার হয়েছে সবে।খুব সহজেই যেনো নিজের প্রেম পুরুষটিকে পেয়ে গেল মীরা।এতো সহজেই সবকিছু পেয়ে গেল সে!অবাক হলো মীরা। আবার খুশি ও হলো।সেই খুশির জোয়ারে ভেসেই আয়নার সামনে বসে পরল নিজেকে সাজাতে।বিয়ের পর এই প্রথম শাড়ি জড়ালো গায়ে।চোখে কাজল দিল।আজ সে সুলেমানের জন্য নিজেকে সাজাবে।সুলেমান ফিরল রাত নয়টার দিকে।মীরা দৌড়ে এলো তার কাছে।হাতের ব্যাগ কোর্ট নিজের হাতে নিয়ে সুলেমানের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।সুলেমান পানি খেয়ে গ্লাস টেবিলের উপর রাখল।মীরা দৌড়ে গিয়ে কাবার্ড থেকে ট্রাউজার টি শার্ট বের করে এনে সুলেমানের হাতে দিল।সুলেমান মনে মনে অবাক হলো। কিন্তু কিছুই বলল না। মীরার হাত থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো।মীরা মনক্ষুণ্ণ হলো।এই যে এতক্ষণ যাবৎ এতো সুন্দর করে সাজলো লোকটার জন্য লোকটা কি তাকে দেখে নি। অভিমান হলো খানিকটা তবে বেশিক্ষণ সেই অভিমান ধরে রাখতে পারলো না।
“সুন্দর লাগছে।”
সুলেমানের এই একটা ছোট্ট বাক্যই যথেষ্ঠ ছিল তার অভিমান ভাঙাতে।মন বাগানে প্রজাপতি ডানা মেলল।খুশিতে ডগমগ হয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো রাতের খাবারে ব্যাবস্থা করতে।মাঝপথে দেখা হলো হায়াতের সাথে।থমকে দাঁড়ালো হায়াত।একদৃষ্টে উপর থেকে নিচ অবলোকন করল মীরার। মীরার তখন চোখে মুখে উপচে পড়া খুশির জোয়ার। হায়াতের হিংসে হলো।আজ এখানে তার থাকা উচিত ছিল।তাহলে মীরা কেন?নিজের ভাবনার মাঝেই মীরার চঞ্চল কণ্ঠ কানে এসে বিধল,
“নিচে এসো হায়াত। তোমার ভাই এসে গেছে।রাতের ডিনারের জন্য সবাইকে ডাকতে যাচ্ছি। তুমিও এসো খেয়ে নেবে।”
হায়াত নড়লো না।কথা বলল না।মীরা উৎফুল্ল মনে সামনে এগিয়েই আবার থেমে গেল।কিছু একটা ভেবে পিছু ফিরে তাকালো হায়াতের দিকে।
____
রাতের খাবার শেষে যখন মীরা ঘরে এলো তখন প্রায় এগারোটা।মীরা ঘুমানোর জন্য বিছানা গোছাতে লাগল।এই সময় সুলেমান এলো ঘরে।একপলক মীরাকে দেখে দৃষ্টি রাখলো ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা তার ছোট্ট প্যাকেট টার ওপর।সুলেমান ইতস্তত করল।অতঃপর বেশ শান্ত গলায় বলল,
“ড্রেসিংটেবিলের ওপর তোমার জন্য কিছু রাখা আছে দেখো।”
মীরা চমকালো।তাকালো সুলেমানের দিকে। সুলেমান চুপচাপ ব্যাগ থেকে ফাইল বের করছে।মীরা দ্রুত পায়ে গেল ড্রেসিংটেবিলের সামনে।ছোট্ট পুঁটলি টা হাতে নিয়ে খুলতেই চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো।বেলি ফুলের গাজরা।মীরার চোখ ছলছল করল।প্রিয় মানুষের দেওয়া ছোট্ট উপহার বুঝি মনে এতো শান্তি দেয়।মীরা তাড়াতাড়ি নিজের বেণী করা চুল গুলো খুলে ফেলল।খোঁপা করার জন্য হাত ঘুরাতেই সুলেমান চটপট বলে উঠল,
“খোলাই থাক”
থেমে গেল মীরার হাত।বড় বড় চোখে আয়নার মাঝেই তাকালো সুলেমানের দিকে। সুলেমান তার দিকে তাকিয়ে আছে।বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দ টা যেন তীব্র হলো।অনুভূতির জোয়াড়ে মীরা হাতের খেই হারিয়ে ফেলল।ধরে রাখা চুল অনিমেষে ছড়িয়ে পড়ল পুরো পিঠময়।মীরা হাতে ক্লিপ নিল।ক্লিপ দিয়ে খোলা চুলের ওপর বেলী ফুল গুলো এদিক থেকে ওদিক আটকালো। সুলেমান একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সেদিকে।ছোট্ট একটা জিনিসে ও যে কোনো নারী এতটা খুশি হতে পারে জানা ছিল না তার।মীরার চোখে মুখে উপচে পড়া এই আনন্দে বারবার মুগ্ধ হলো সুলেমান। নিজের অজান্তেই পা বাড়ালো মীরার দিকে। শাড়ি গলিয়ে এক শক্তপক্ত হাত মীরার পেট স্পর্শ করতেই গা হিম হয়ে গেল তার। সুলেমান পেছন থেকে মীরাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। মীরার পিঠ গিয়ে ঠেকলো সুলেমানের বুকে।
“এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছে।”
সুলেমানের কণ্ঠে যেন কী ছিল মীরা একদম লজ্জায় নেতিয়ে গেল।ফর্সা গালের একাংশ জুড়ে লাল আভায় ছেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।সুলেমান দেখল সেই লজ্জা।মুহূর্তেই মনে কোণে উঁকি দিল এক বৈধ আকাঙ্ক্ষা।এক হাতে মীরার এলো চুল একপাশে সরিয়ে ঠোঁট বসালো তার ঘাড়ে।কেঁপে উঠলো মীরা। অজানা শিহরণে শিরশির করে উঠল পুরো শরীর।শ্বাস ঘন হলো।সেই সাথে সুলেমানের ঠোঁটের স্পর্শও।হাতের বিচরণ হলো এলোমেলো। কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে দিতেই মীরা খেই হারালো।পিছু ফিরে মিশে গেল সুলেমানের বুকে।আগলে নিল সুলেমান।কিছু সময় কাটলো ওভাবেই।শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলে মুখ তুলে তাকালো মীরা। সুলেমানের চোখে নেশা।সেই নেশাগ্রস্ত চোখে হারিয়ে যেতে যেতে মীরা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
“ভালোবাসি স্বামী।”
____
সন্ধ্যার সাথে শাহিন মির্জার বেশ গুরুতর ঝগড়া লাগল। ঝগড়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু তাদের সন্তান।তিন তিনটে বিবাহযোগ্য সন্তান বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও এই লোকের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মেয়েটার বয়স সাতাশ পার হলো।ছেলে গুলোও বুড়ো ধামড়া হচ্ছে।এরপর কি ছেলেরা লাঠি হাতে ধরলে বিয়ে দিবে?এ যেন তার সুখের সংসার হয়েও সুখের নয়।সন্ধ্যার এমন কথায় বেশ কষ্ট পেল শাহিন। সন্তান তো তারও।সেও চায় ছেলেমেয়েরা ভালো থাক সুখে থাক।সে বারবার ছেলেদের বুঝিয়েছে।তারা ছোট নয়। নিজের ভালো নিজেরা বুঝে তারা।তবে এক্ষেত্রে যদি তারা অবুঝপনা তো সে কি করবে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ওপর তো জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না।সুলেমানকে যাও বিয়ে দিল সেও কোনো এক ভুল বোঝাবুঝির কারণে নিঃস্বঙ্গ হলো।এরপর তার সামনে ও বার দুয়েক বিয়ের কথা তুলেছে সে। কিন্তু সুলেমানের কথা সে একবার বিয়ে করেছ।এক নারীতে আসক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় কোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথা সে স্বপ্নে ও কল্পনা করে না।পারিবারিক ভাবে বিয়ে হওয়ার পরও যে বউয়ের প্রতি এতটা আসক্ত হওয়া যায় তা বড় ছেলেকে না দেখলে সে বুঝতো না।তবে ছোটটাকে নিয়ে সে চিন্তায় আছে।তার কি সমস্যা?
___
সালমান বাড়ি ফিরল চারদিন পর। মাথার ব্যান্ডেজ খুলেছে।ঘাও শুকিয়ে গেছে।তবে অনেকটা দাগ থেকেই গেছে।সেই দাগ দেখেও সন্ধ্যা চুপ রইল।সবাই অবাক হলো তার এমন ব্যাবহারে। শাহিন মির্জা বুঝলেন এ কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। তার ধারণা কে সত্যি প্রমাণ করে খাবার টেবিলে সকলের সামনে সন্ধ্যা গমগম স্বরে বলে উঠলো,
“আমি সালমানের জন্য মেয়ে দেখেছি। আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে যাবো।এ বিষয়ে যদি কেই কাইকুই করেছে তো আমি তোদের বাপ কে তালাক দিয়ে এই ভিটে মাটি ছাড়বো।”
শাহিন মির্জার গলায় খাবার আটকে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো স্ত্রীর দিকে।ছেলে বিয়ে দেবে দিক। কিন্তু স্বামীর বউ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে কেন এই মহিলা?
বাড়ির কেউ এই বিষয়ে কোনো কথা বলল না।তবে মাথা গরম হলো সালমানের।খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গটগট করে হেঁটে এসে নিজের রুমে ঢুকলো।সশব্দে দরজা লাগিয়ে মাথা চেপে ধরল।যন্ত্রণা হচ্ছে তার বড্ড যন্ত্রণা।বুকের বাঁ পাশটা বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে।সে ও ভালোবেসেছে। অনুভূতি গুলো লিখেছে শুধু একজন নারীর নামে।অথচ সেই নারীটি প্রতিটি মুহূর্তে অন্য কেউতে মত্য থেকেছে।
চলবে🌺