শব্দহীন প্রণয়কাব্য পর্ব-০৬

0
250

#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(ছয়)
#Mst.Shah Mira Rahman
হসপিটালের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুলেমান।দৃষ্টি হসপিটালের তিনতলায় আবদ্ধ। রাত প্রায় নয়টা।এতক্ষণে তো মীরার এসে যাওয়ার কথা।আসছে না কেন? সুলেমান হাত ঘড়ির দিকে তাকালো।কোর্ট থেকে সোজা এখানে এসেছে।অফিসের ড্রেসও চেন্জ করে নি।মীরা আসলো আরো আধা ঘন্টা পর।তবে একা নয়।সাথে তার একজন ছেলে কলিগ। সুলেমান তাকালো সে দিকে।মীরা যেন তাকে দেখেও দেখল না।কিছুদূরে পার্কিংলটে থাকা গাড়ি নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পরলো।সুলেমানের চোয়াল শক্ত হলো।শান্ত স্বভাবের লোকটার ও চোখের কোণা লাল হলো।
মিনহাজের চোখ আজ খুশিতে চকচক করছে।পাশেই বসে থাকা মহিলাটির পেছনে পাঁচ মাস যাবৎ সে ঘুরছে।নানা ভাবে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করেছে।মীরা তার থেকে মাত্র বছর দুয়েকের বড়।এটাই যেন তাদের সম্পর্কের একমাত্র দেয়াল।নয়তো মিনহাজ নিশ্চিত তার এই কিউট কিউট চেহারায় এতদিনে ঠিক গলে যেত মীরা।তবে এখনো মনে হচ্ছে একটু একটু গলতে শুরু করেছে।তাই তো আজ তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার অফার করতেই কেমন চটপট মেনে গেল সে।
নিজের হাজার খানেক ভাবনার মাঝে তার নজর গেল সাইডের লুকিং গ্লাসে।ভ্রু কুঁচকে এলো তার। মীরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আচ্ছা এই গাড়িটা সেই কখন থেকে পিছু করছে না আমাদের?”
মীরা ও তাকালো লুকিং গ্লাসে। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“কই না তো।আমার তা মনে হয় না।”
____
মীরাকে একবারে তার ফ্লাটের সামনে ছাড়ল মিনহাজ।মীরা বাধা দেওয়ার পর ও সে গিয়েছিল।মীরা কথা বাড়ায় না।ফ্লাটের সামনে আসার পর ও যখন মীরা তাকে ভেতরে যাওয়ার অফার দেয় না তখন মনে মনে বেশ অপমান বোধ করে সে।তবে মীরাকে বুঝতে দিল না।মুখে হাসি ঝুলিয়ে চলে আসে সেখান থেকে।আসার সময় আবার সেই গাড়িটিকে দেখল এক সাইডে দাঁড়ানো। গাড়ির ভেতরে কেউ নেই। মিনহাজের এবার একটু কেমন যেন লাগল বিষয়টা।কিন্তু বেশি ঘাটালো না।হয়তো এখানকার ই কেউ।মিনহাজ যেতেই মীরা ফ্লাটের ভেতর ঢুকে দরজা লাগাবে তখনই দরজায় চাপ পরল।ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই আতকে উঠলো মীরা। সুলেমান সময় নষ্ট না করে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে চেপে দাঁড়ালো। মীরার পিঠ গিয়ে ঠেকলো দরজার সাথে।দুপাশে সুলেমানের হাতের বেষ্টনী।ভয় পেল মীরা। এতক্ষণ যাবৎ কী কী করেছে স্মরণ করলো মনে মনে।তবে দমে গেল না।চোখ মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে কাটকাট কণ্ঠে বলল,
“এটা কি ধরনের অসভ্যতামি।আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ফ্লাটে ঢুকেছেন কোন সাহসে?”
সুলেমান কিছু বলল না একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে।মীরা অপ্রস্তুত হলো।
“ছেলেটা কে?সরাসরি ফ্লাট অবধি নিয়ে এলে।”
“আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি।”
সুলেমানের চোয়াল শক্ত হলো। কঠিন দৃষ্টির শিকার হলো মীরা।খানিকটা দমে গেল সে। অস্ফুট স্বরে জবাব দিল,
“কলিগ ছিল।”
“শুধু কলিগ?”
মাথা গরম হলো মীরার। সুলেমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পছন্দ করে আমায়। পাঁচ মাস ধরে পেছনে পরে আছে।ভাবছি একটা সুযোগ দেব।তাকেও সাথে নিজের জীবন কেও। কতদিন আর এভাবে কাটবে।বয়স হচ্ছে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে তো!”
সুলেমান ঝুঁকে গেল মীরার দিকে। গলায় নাক ঘষে জড়ালো কণ্ঠে বলল
“ঠিক বলেছ।বয়স হচ্ছে।বুড়ি হয়ে যাচ্ছো।এবার ছোট ছোট বাচ্চাদের নিজের রুপের জালে ফাঁসানো বাদ দিয়ে সংসারে মন দেওয়া উচিত তোমার।”
“মুখ সামলে কথা বলুন সুলেমান।”
মীরা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুলেমানের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টির চেয়ে সুলেমানকে বেশি ঘায়েল হলো তার কণ্ঠে নিজের নাম শুনে।মিষ্টি যন্ত্রণায় ছেয়ে গেল বক্ষস্থল।এতক্ষণ যাবৎ ধরে রাখা রাগ গলে জল হলো। দৃষ্টি নরম হলো।কঠিন বাক্যর পরিবর্তে অদ্ভুত এক বাক্য আওড়ালো।
“আমি কি মুখ দিয়ে তোমায় কামড়াকামড়ি করেছি?তবে সামলাবো কেন?”
কান গরম হয়ে গেল মীরার।পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো।লজ্জায় এদিক ওদিক তাকালো।সুলেমান মৃদু হাসল।সেই হাসিই দেখেই মীরা আবার কঠিন হলো। মৃদু চিৎকার করে বলল,
“বাজে বকা বন্ধ করুন আর বেরোন এখান থেকে।”
“যাবো না।খিদে পেয়েছে আগে খাবো আমি।”
মীরা কেঁপে উঠলো।শ্বাস ঘন হলো।হাঁসফাঁস করতে লাগলো পালাবার জন্য।তবে তাকে সস্তি দিয়ে সুলেমান মুখ তুলে তার দিকে তাকালো।
“রান্নাঘরে কি কি আছে খাবার মতো? দুপুর থেকে কিছু খাইনি খিদে পেয়েছে আমার।”
মীরা দম ছাড়লো।সে কি না কি ভেবে বসে ছিল।সাথে মায়াও হলো।সত্যিই কি মানুষটা দুপুর থেকে কিছু খায়নি?বুকটা হু হু করে উঠলো। মৃদু কণ্ঠে বলল,
“সব আছে।”
“ঠিক আছে।তুমি ক্লান্ত।যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি ততক্ষণে দেখি ডিনারে কি করা যায়।”
মীরা কথা বাড়ালো না।ভালো মেয়ের মতো নিজের ঘরে চলে গেল।সুলেমান গেল কিচেনের দিকে।ফ্রিজ খুলে দেখ মাছ মাংস ডিম সবই আছে।সাথে কিছু ফ্রুটস ও আছে। সুলেমান একটা মাছের পুঁটলি বের করল আর একটা আপেল।মাছ পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে আপেল ধুয়ে তাতে কামড় বসালো।
মীরা বেরোলো একবারে গোসল করে।চুলে টাওয়েল পেঁচিয়েই কিচেনের দিকে গেলো। চুলোয় ভাত বসানো।সুলেমান পেঁয়াজ কাটছে।মীরা এগিয়ে গেল সেদিকে।
“আমাকে দিন আমি করছি।”
সুলেমান দেখল মীরাকে।কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে রইল।তারপর নিজ থেকেই সরে এলো পেছনে।ডিভানের ওপর ভর দিয়ে দাড়ালো।মীরা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে টমেটো কাটতে লাগল। শান্ত গলায় বলল,
“রান্না হতে দেরী হবে। ততক্ষণে ফ্রিজে কিছু ফল আছে ওগুলো কেটে দেব?বিস্কুট ও আছে দেব বের করে?
সুলেমান দেখল মীরার উদ্বিগ্নতা।মনে মনে খুশি হলো ভীষন।মীরা যখন তাকে নিয়ে ভাবে চিন্তা করে তার ভালো লাগে।নিজেকে স্পেশাল মনে। সুলেমানের কোনো সাড়া না পেয়ে মীরা ফ্রিজের দিকে এগোলো।একটা আপেল আর একটা কমলা বের করে ধুয়ে আপেলটা কাটতে লাগল।এমন সময় হঠাৎই একটা পুরুষালি হাত পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে।চুল থেকে তাওয়ালে খুলে নিচে ফেলে দিল।মুখ ডোবালো ভেজা চুলে।আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব মীরা।নিজেকে সামলানোর সময় ও পেল না।পেছন থেকে ভেসে এলো এক নিদারুণ নেশাগ্রস্ত কণ্ঠ,
“তুমি আমার মীরা।তোমার সবকিছু আমার।তোমার ভালোবাসা হোক আর ঘৃণা সবটা আমাকে জুড়ে হোক।এর এক ভাগ অংশ ও যেন অন্যকারো না হয়।আমি কিন্তু খুব পজেসিভ হাসবেন্ড মীরা।”
____
সকালকে স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে নিজের কাছে আসতে দেখে ঠোঁট চেপে হাসল সিদ্ধান্ত।দূর থেকে সেই হাসি দেখল সকাল।তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের কাছে এসে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“সমস্যা কি?এভাবে জরুরি তলব করলেন কেন?জানেন না আশেপাশে আব্বার লোক ঘোরাঘুরি করে।যদি কেউ দেখে নেয়?”
সিদ্ধান্ত কিছু বলল না।সকাল কে উপর থেকে নিচ পর্যবেক্ষণ করল।সাদা লেডিস শার্ট কোমড়ের নিচ অবধি পড়ে রয়েছে।সাথে ব্লু জিন্স। কাঁধের স্কার্ফ টা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে‌।চুল গুলো নিচু করে রাবার দিয়ে বাঁধা। সবকিছু গোছানো।তবুও যেন অগোছালো একটা ভাব রয়েই গেছে। সিদ্ধান্ত মুগ্ধ হলো। সকাল কে যতবার দেখে যেভাবেই দেখে সিদ্ধান্ত শুধু মুগ্ধ ই হয়।সকাল বিরক্ত হলো সিদ্ধান্তের এমন খামখেয়ালি ভাব দেখে।ভ্রু কুঁচকে কিছু বলবে তার আগেই সিদ্ধান্ত গাড়ির দরজা খুলে দিল।
“বসো।”
“কেন?আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না।যা বলার এখানেই বলুন।”
সিদ্ধান্ত শীতল দৃষ্টি ফেলল সকালের ওপর।কাজ হলো তাতে। সুরসুর করে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে পরল।আজ ড্রাইভার নেয়নি সিদ্ধান্ত নিজে ড্রাইভ করবে বলে। সকাল কে বসিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।গাড়ি চলতে শুরু করল।কিছুদূর যেতেই কৌতুহলী সকাল প্রশ্ন ছুড়ল তার দিকে।
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“যেখানেই যাই তবে আজ আর তোমার বাড়ি ফেরা হবেনা।বাড়িতে ফোন করে বলে দাও বন্ধুর বাড়ি থাকবে আজ।”
আতকে উঠলো‌ সকাল‌।হই হই করে বলল,
“এই না না বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।আমি কোথাও যাবো না প্লিজ।”
সিদ্ধান্ত তাকালো সকালের দিকে। অতঃপর গাড়ি ঘুরিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“ঠিক আছে।”
সকাল চমকালো।লোকটা কি রাগ করেছে।এরকম করছে কেন?সকাল চুপচাপ পকেট থেকে ফোন বের করে সন্ধ্যা কে ফোন দিল।
“হ্যালো মা।আমি আজ বাড়ি ফিরবো না লতার বাসায় আছি।”
সিদ্ধান্ত অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল।
_____
উত্তপ্ত দুপুর।বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের বাইরে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিলো হায়াত।এখানেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে।তার সিনিয়র তাকে প্রপোজ করে বসে‌।পরে বুঝলো এসব কিছু তার বন্ধুদের বুদ্ধি।ভয় পেয়ে গেল হায়াত।পরিস্থিতি না বুঝেই চলে এলো সেখান থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাম্পাসে একটা বাইক ঢুকলো। হায়াতের আত্মা কেঁপে উঠলো।তড়িঘড়ি লাইব্রেরীর দিকে ছুটল সে।সালমান দেখল তার যাওয়া।তবে সে গেল তার উল্টো দিকে।
বাইরে কিছু ছেলে একজন সিনিয়র কে মারছে খবর শুনেই ছুটে বেরোতে গেল হায়াত তবে তার হাতে টান পরলো।কেউ তাকে টেনে নিয়ে গেল বইয়ের বড়বড় তাকের পেছনে।হায়াত ভয় পেলেও গর্জে উঠল,
“কি করছো ছাড়ো আমার হাত।”
সালমান ছেড়ে দিল।শান্ত দৃষ্টি ফেলল হায়াতের দিকে। হায়াত রেগে গেল। কঠিন গলায় বলল,
“ওকে মারছো কেন তুমি।ওর কি দোষ?”
“একবার ওয়ার্নিং দেয়ার পরও ও তোকে বিরক্ত করছে।এটাই তার দোষ।”
হায়াত ফুঁপিয়ে উঠলো,
“এমন করছো কেন?তুমি জানো তোমার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই।”
সালমান এগিয়ে এলো।কান্নারত হায়াতের মাথা টেনে নিজের বুকে ঠেকালো। ঠোঁটের স্পর্শ আকলো হায়াতের মাথায়।
“সেটাই তো!তোর অনুভূতি সবসময় নিষিদ্ধ মানুষের প্রতি।যে তোকে ফিরিয়ে দেয় তুই বারবার তার কাছেই যাস।আর যে তোকে চায় তাকে তুই ফিরিয়ে দিস শত বার।এখানে ভুল কার হায়াত? নিয়তির নাকি তোর?”
চলবে 🌺