শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-০৬

0
145

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৬|
সাদিয়া মেহরুজ

সারতাজকে বেশ ব্যাস্ত দেখাচ্ছে।সে তাড়াহুড়ো করে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে রাখছে। এ লহমায় তার মুখশ্রী দেখে মনে হবে যেন রাজ্যের সব ব্যাস্ততা তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। ভীষণ ভীষণ ব্যাস্ততার মাঝেই তার মুঠোফোনে কল এলো। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে কলদাতা ব্যাক্তির নাম না দর্শণ করেই ফোন রিসিভ করে কানে লাগাল। অপাশ হতে তৎক্ষনাৎ চাপা গলায় কেও শুধাল,

-‘ বাড়ি ফিরেছ শুনলাম। থাকাও শুরু করেছ নাকি! কি ব্যাপার ভাই? এতো এতো সম্পত্তির লোভ বুঝি এবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে? খুব তো বড় গলায় বলছিলে বাবার কোনো সম্পত্তি তোমার চাই না। ‘

সটান হয়ে দাঁড়াল সারতাজ। এটা তার ছোট ভাই শারাফের কন্ঠস্বর। যাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা তার। সারতাজ ধাক্কা সামলে নিল। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,

-‘ কাজে এসেছি। চলে যাচ্ছিলাম আর তোর ফোন।’

-‘ সত্যি বলছো নাকি মিথ্যা কিভাবে বুঝব? ‘

-‘ ইউজলেস কথাবার্তা! যেভাবে আমার আসার খবরটা পেয়েছিস সেভাবে নিশ্চয়ই আমার চলে যাওয়ার খবরটাও জানতে পারবি। ‘

-‘ রাখছি তবে। ‘

শারাফ কল কা টা র পূর্বেই সারতাজ ফোন কা টল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শূন্যে। অতঃপর ধীরস্থ গতীতে বিছানায় গিয়ে বসলো। দৃষ্টিপাত ফেললো চারপাশে। তার ভীষণ পরিচিত কামড়াটা। ছোট থাকতে যখন এ বাড়িতে ছিলো তখন নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিলো কক্ষটা। এ বাড়িটা যেখানে তার অজস্র সৃতি মিশে রয়েছে, বাড়ির সামনের সেই বাগানটা যেখানে তার কাটানো হাজারো বিকেলের সাক্ষী সবশেষে বাড়ির মানুষ গুলো?অথচ পৃথিবীর কি কঠিন সত্যত্যা দেখো, এসব কিছুই নাকি তার আপন নয়! সে কেবল এই বাড়ি এবং মানুষ গুলোর নিকট ছিল ক্ষণস্থায়ী মেহমান।

_

সালমার সামনে জড়তা নিয়ে বসে আছে মেহতিশা। অন্তঃকরণে তার ভীতি, সঙ্কোচ! নত মস্তকে নিশ্চুপ হয়ে ছিল সে। সালমার নীরবতা পালন তাকে আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। তার অন্তরালে জমা হয়েছে একঝাঁক প্রশ্ন। সালমা কি তবে ভুল বুঝলেন তাকে? কথা কেনো বলছেন না? কয়েক প্রহর মৌন রূপেই কে টে গেল। অতঃপর নৈঃশব্দ্যে ধস নামাল মেহতিশা নিজেই। জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ আন্টি কিছু বলছেন না যে? ‘

সালমার থমথমে মুখোশ্রী স্বাভাবিক হলো। তিনি দুই, তিনবার লম্বা শ্বাস ফেললেন। নেত্রপল্লব ঝাপটালেন ঘন ঘন। শুষ্ক গলদেশ সিক্ত করলেন ঢোক গিলে। বলে উঠলেন,

-‘ তোকে কি আর বলবো? আসলে দোষটা আমারই মেহতিশা। আমি হয়তো তোর সাথে অতোটা ফ্রী হতে পারিনি তাই তুই সব কথা আমায় খুলেও বলতে পারিসনি দ্বিধায়। ‘

-‘ প্লিজ আন্টি। নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আমি আসলে..আপনাকে বলবো ভাবছিলাম কিন্তু পরে মনে হলো অযথা আপনাকে টেনশন কিংবা কষ্ট দেয়ার কি দরকার। তাই আর বলিনি। ‘

-‘ আচ্ছা বুঝলাম! এখন কি করবি? অনিককে তোর শা স্তি দেওয়া উচিত না মেহতিশা। ছেলেটা কতোটা জ ঘ ন্য! না জানি আরো কতো মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস করেছে। তুই যদি এখন চুপ থাকিস তাহলে ও প্রশয় পাবে। তোকে হয়তো আর জ্বালাবে না ভয়ে কিন্তু অন্যকেও কিন্তু ছাড় দেবেনা। ‘

-‘ জানি আন্টি। আমি অনিককে কখনোই এভাবে সুখে থাকতে দিবোনা। ও আমার জীবন নষ্ট করেছে, কষ্ট দিয়েছে, মিথ্যা বলেছে। অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার আগে আমি ওকে আইনের হাতে তুলে দিব। কিছু প্রমাণ জোগাড় করা দরকার। ‘

-‘ কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে বলিস। ‘

বিরস চেহারা নিয়ে সালমা উপরে চলে গেলেন। রেখে গেলেন অনুশোচনায় ভোগা মেহতিশাকে।

_

চাকরির একমাস পূর্ণ হয়েছে আজ মেহতিশার। ১০ হাজার টাকা বেতন ঠিক হয়েছিল তার। পারিশ্রমিক হাতে নিয়ে সে সর্বপ্রথম বাবা – মা’র কথা মনে করলো। তার বাবা ছেঁড়া, শত তালি দেয়া পাঞ্জাবি পড়তো। অভাবের সংসার তাদের, যেখানে খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হতো বাবা – মার সেখানে পোশাক কেনা তো স্বপ্ন কেবল! তবুও মেহতিশার বাবা মা চেষ্টা করতো মেয়েদের ইচ্ছে পূরণ করতে। নিজেরা তালি দেয়া পোশাক পড়লেও মেয়েদের পড়াতো ভালো পোশাক। মেহতিশা কেবল ভাবতো তখন, যখন সে চাকরি করবে তখন চাকরির প্রথম মাসিক বেতন দিয়ে বাবাকে পাঞ্জাবি আর মাকে শাড়ী কিনে দেবে। আজ তার হাতে টাকা আছে কিন্তু বাবা মা পাশে নেই।

সালমার জন্য একটা শাল এবং মেহজার জন্য স্বল্প দামে একটা সোয়েটার কিনে বাড়ি ফিরল মেহতিশা। সর্বপ্রথম সে শাল হাতে নিয়ে ছুটলো সালমার রুমে। মেহজা সেখানেই ছিলো। মেহতিশা দেখা মাত্রই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বোনকে। সালমা হেঁসে বললেন,

-‘ মাত্র ফিরলি নাকি? আয় ভেতরে। ‘

মেহতিশা মেহজা নিয়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। জবাব দিলো,

-‘ এক্ষুণি ফিরলাম আন্টি। এটা আপনার জন্য। ‘

-‘ কি এটা? ‘

-‘ খুলে দেখুন। ‘

সালমা ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। ব্যাগের ভেতর থেকে বের করলো লাল রঙের শাল। ভারী সুন্দর দেখতে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। তবে ক্ষণিক বাদে কড়া কন্ঠে বলল,

-‘ বেতন পেয়েই এই আকাম করেছিস তাই না? ‘

মেহতিশা হেঁসে বসলো সালমার পাশে। মিহি কন্ঠে শুধালো,

-‘ আকাম না ভালো কাজ এটা। আগে বলুন তো দেখি, আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা? ‘

-‘ তা হয়েছে। তোর পছন্দ খারাপ হয় কখনো? কিন্তু আমার জন্য না এনে মেহজার জন্য কিছু আনলেও তো পারতিস। ‘

-‘ এনেছি তো ওর জন্য। ‘

-‘ আর নিজের জন্য? ‘

মেহতিশা নিশ্চুপ রইল এবার। আমতা আমতা করে প্রতিত্তোর করতে নিলেই তাকে ধমকালেন সালমা।

-‘ ফাজিল মেয়ে! সারাজীবন অন্যের কথাটাই তুই ভেবে যাবি। নিজের শখ, আহ্লাদ বলতে কিছু নেই?’

-‘ আমার কোনো শখ নেই আন্টি। আমার কাছের মানুষ গুলো খুশি হলেই আমি খুশি। ‘

-‘ বড়দের মতো কথা শিখেছিস। ‘

মেহতিশা শব্দ করে হাসল! সালমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে পরখ করলেন সেই হাসি। মেয়েটা হাসছে অথচ হাসির আড়ালে মাটি চাপা দিয়েছে নিজের তিক্ত অতীত, কষ্ট! সালমা কয়েকপল চুপ রইলেন। তারপর হুট করে মনে পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বললেন,

-‘ ওহ ভালো কথা। বাসা দেখেছিস নাকি? মেহজা আমায় বললো। ‘

-‘ জি আন্টি। এই কাছাকাছি উঠব। চৌরাস্তার মোড়ে দুই তলা যেই পুরোনো বাড়িটা সেখানকার নিচ তলায় ভাড়া নিয়েছি। ‘

সালমা মরা গলায় শুধালেন,

-‘ চলেই যাচ্ছিস তবে। এতদিন ভালোই ছিলাম এখন আবার একা হয়ে যাবো। ‘

মেহতিশার অন্তঃকরণ ছটফট করে উঠল কিছু জিজ্ঞেস করার আকাঙ্খায়। শেষে সাহস নিয়ে সে প্রশ্ন করেই বসলো,

-‘ আন্টি কিছু মনে করবেন না একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ‘

-‘ হ্যা বল! ‘

-‘ আঙ্কেলকে এ বাসায় দেখলাম না আসার পর থেকে। আর আপনার বড় ছেলে সারতাজ। উনি কেন আপনাদের সাথে থাকেন না? ‘

ফ্যাকাশেটে বর্ণের হলো সালমার মুখোশ্রী। মুখোবয়বে ভেসে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। মেহতিশা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করলো তা। সালমা নিষ্প্রাণ চাহনি ফেললেন সম্মুখে। কণ্ঠে থমথমে ভাব টেনে বললেন,

-‘ তোকে আমি একবার একটা কথা বলেছিলাম যে, তোর মায়ের কাছে ঋণী আমি। মনে আছে নিশ্চয়ই কথাটা। সে কথা বলার কারণটা বলি শোন, সারতাজ আমার আপন পেটে ধরা সন্তান না। আমার আপন ছেলে দু’টো বিদেশে। শারাফ আর শাহিন। শাহিনের কথা মনে আছে তোর? ছোট বেলায় তো এ বাড়িতে এলে ওর সাথেই খেলতি। সারতাজকে পাওয়ার পিছনে সম্পূর্ণ তোর মায়ের অবদান রয়েছে। বেশ আগের কথা! অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। বিয়ের পাঁচটা বছর কে টে যাওয়ার পরও বাচ্চার দেখা নেই। সারতাজের বাবা, দাদি অতিষ্ঠ করে ফেলছিলো আমাকে একটা বাচ্চা দেয়ার জন্য। ওরা আমাকে দিনে রাতে হুমকিও দিত বাচ্চা না হলে আমাকে তালাক দেবে। বাবা ছিলো না আমার। আমরা ছিলাম তিন বোন। বড় আপার আর মেঝ আপার বিয়ে হচ্ছিলো না কারণ তারা ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। মা একা হাতে ইনকাম করে আপাদের চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলো আর তার ওপর যদি আমার তালাক হয়ে যেতো তাহলে আমার মা স্ট্রোক করে মা রা যেতেন। তাই আমি প্রতি রাতে নামাজে আল্লাহর কাছে একটা সন্তান ভিক্ষা চাইতাম। তারপর একদিন আল্লাহ বুঝি আমার প্রতি মুখ তুলে তাকালেন। সন্তানসম্ভবা হলাম। কিন্তু ডেলিভারির সময় জানতে পারলাম আমার বাচ্চা মৃ ত জন্মেছে! সারতাজের বাবা তখন কথাটা জানতো না। হটাৎ করে প্রসব ব্যা থা উঠায় আমায় হসপিটালে নিয়ে আসে তোর মা। তোর মা তখন অনেকদিন হলো আমার বাড়িতে কাজ করে। মৃ ত সন্তানকে বুকে নিয়ে যখন আমি নিজের ভবিষ্যত এবং সন্তানের দুঃখে কাঁদছিলাম তখন কোথা থেকে যেনো একটা বাচ্চা নিয়ে এলো তোর মা। ফুটফুটে কি সুন্দর একটা বাচ্চা! পরে তোর মা আমাকে জানালো ঐ হাসাপাতালে এক গণিকার সন্তান হয়েছে। গণিকা তার সন্তানকে হাসপাতালের ময়লার ঝুড়িতে রেখে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তোর মা দেখে ফেলে। গণিকার থেকে বাচ্চাটা নিয়ে আমার কাছে আনে। আমি বেশ কিছু টাকা তখন ঐ গণিকাকে দিয়ে সাথে যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে বাচ্চাটা দত্তক নেই। ঐ বাচ্চাটাই আমার বড় ছেলে, আমার সারতাজ! এই পরিবারের থেকে এই কথাটা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু একদিন, ‘

প্রখর শব্দ কর্ণপাত হওয়াতে সালমা থামলেন। দৃষ্টি ফেললেন দরজায়। তিনি দেখলেন কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে সারতাজ। ছেলেটার হাত থেকে পড়ছে তাজা র ক্ত! সালমার গলা শুকিয়ে কাঠ। তিনি স্বগতোক্তি করলেন, ছেলেটা এই অসময়ে এখানে কেন? কখনই-বা এলো!

চলবে~