শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-০৫

0
158

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৫|
সাদিয়া মেহরুজ

সবেমাত্র দুপুর পড়েছে। ধরিত্রীতে আজ বহুদিন পর সূর্যের আগমন। সূর্যরশ্মিতে নেই কোনো উত্তাপ। হলদেটে আলো গিয়ে পড়ে রয়েছে গাছের শুকনো, ম রা পাতায়। ঝলমলে পরিবেশ দর্শন মাত্র মেহজা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ছোট্ট মেহজার আনন্দম, আনন্দম মুখোশ্রী লক্ষ করে হাসলেন সালমা। সুস্থ হওয়ার পর এই প্রথম সে মেহজার হাস্যরত মুখোশ্রী দেখল। এতদিন এই প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন মনমরা, নিশ্চুপ ছিল। সালমা কাছে ডাকলো ওকে,

-‘ মেহজা, শুনে যা তো। ‘

মেহজা বাধ্য মেয়ের মতো সালমার কাছে এগোল। প্রশ্ন করলো,

-‘ জি আন্টি। ‘

-‘ তুই যে বললি তোর যখন জ্বর হয়েছিল তখন মেহতিশা তোর কাছে ছিল না। তাহলে তোকে ঔষধ খাইয়ে দিলো কে? সাবিনা? ‘

মেহজা মাথা নাড়ল। সে খুলে বলল সারতাজের তার মুমূর্ষু অবস্থায় সেবা করার কথা, আদর করে আগলে নেয়ার কথা। মেহজার সম্পূর্ণ কথা মন দিয়ে শুনল সালমা। অতঃপর আনন্দে তার নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠল। তার প্রাণোচ্ছল, হাসি খুশিতে মেতে থাকা ছেলেটা কি তবে স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসছে?

শুক্রবার হওয়াতে মেহতিশার আজ ছুটি। তাই সে বাসাতেই অবস্থান করছে আজ। সকাল থেকেই কোমড় বেধেঁ নেমেছে সে রান্নার কাজে। সালমার পছন্দের খাবার রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাথে সারতাজের জন্যও কিছু রান্না করতে বলেছিলেন সালমা। মাত্রই হাতের সকল কাজ সেড়ে গোসল করে বের হলো মেহতিশা। নামাজ পড়ে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে চলল সালমা এবং মেহজাকে। বাগানে পৌঁছাতেই সে দেখল মেহজা ছোটাছুটি করছে। তা দেখে মেজাজ চটে গেলো তার। রাগান্বিত সুরে বোনকে উদ্দেশ্য করে হাঁক ছাড়ল,

-‘ মেহজা, কালই সুস্থ হলে আর আজ কেন এভাবে ছোটাছুটি করছিস? ঘরে আয়। ‘

সালমা এগিয়ে আসলেন। তাকে আজ অন্যরকম লাগল মেহতিশার নিকট। ভদ্রমহিলাকে আজ একটু বেশি বেশি খুশি লাগছে না? সালমা এগিয়ে এসে মেহতিশাকে শাসন করলো,

-‘ খবরদার মেয়েটাকে কিছু বলবিনা মেহতিশা। এই ক’দিন কেমন মনমরা হয়ে পড়েছিল। আর এখন দেখ কতোটা হাসিখুশি লাগছে। খেলতে দে। দৌড়াদৌড়ি করলে ওর আরো ভালো লাগবে। ‘

মেহতিশা কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

– ‘ কালই তো সুস্থ হলো আন্টি। এখন এভাবে ছোটাছুটি করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। ‘

-‘ পড়বেনা। ‘

পুরুষালী ভারী কন্ঠস্বর। মেহতিশা পিছনে ঘুরলো। সারতাজ ট্রাউজারের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসছে ধীরস্থ গতীতে। সে গিয়ে দাঁড়ালো মায়ের পাশে। ভারী কন্ঠে বলল,

-‘ ওকে ওর মতো থাকতে দিন। হাসিখুশি থাকলে বেটার ফিল করবে। ‘

মেহতিশা এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াল না। নত মস্তকে দাঁড়িয়েই বলে উঠলো,

– ‘ আন্টি টেবিলে খেতে দিয়েছি। খেতে আসুন। ‘

মেহতিশা স্থান ছেড়ে চলে গেল। সালমা সারতাজের পানে তাকাল। ছেলেটা এক মনে সম্মুখে তাকিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হবে যেন, পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে সে আপনমনে গবেষণা করছে। তিনি এগোলেন শব্দহীন পায়ে। সারতাজের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

-‘ অনেকদিন তো আমার সাথে বসে খাও না। আজ নাহয় এসো? ‘

প্রতিত্তোরের আশায় কয়েক প্রহর সালমা সেখানেই স্থির রইলেন। উত্তর এলো না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে যেতে নিতেই তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই বার্তাটি,

-‘ আসছি মেহজাকে নিয়ে। ‘

সবাই একসঙ্গেই খেতে বসেছে। সারতাজের পাশে মেহজা। এই অল্প কয়েকদিনের ব্যাবধানে তাদের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সারতাজের বাম পাশে সালমা বসেছেন। তিনি এক লোকমা খাবার গলাধঃকরণ করছেন তো আড়ালে বারংবার নেত্র কোণে জমে থাকা সুখের অশ্রুকণা মুছছেন। ছেলে তার পাশে বসে খাবার খাচ্ছে কতদিন হলো? তা জানা নেই সঠিক। আজ বহুদিন পর সারতাজ তার পাশে খেতে বসেছে। এর থেকে আনন্দ তার জীবনে আর কবে এসেছিল?

_

তিন সপ্তাহ পাড় হওয়ার পর মেহতিশা নিজের কর্মক্ষেত্রে এবার পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আগের মতো তার এখানে আসতে অস্বস্তি বোধ হয় না। নতুন কয়েকজন বান্ধবীও জুটেছে তার। যারা তার মতোই ট্রেইনার৷ তবে ট্রেইনার হিসেবে সুনাম মেহতিশারই বেশি। তার হাতের কাজ অতি নিপুণ, সুক্ষ্ম এবং চোখ ধাঁধানোকর। সারতাজের বড় মামা তাকে প্রায়সই অনুপ্রেরণা দেন,

-‘ তুমি একদিন খুব বড় হবে মা। আমার বিশ্বাস! ‘

বড় মামার এরূপ কথা মেহতিশাকে দারুণ মনোবল জোগায়। আত্নবিশ্বাসী করে তোলে। বড় মামাকে তার ভীষণ পছন্দ। কি দারুণ একজন মানুষ তিনি!

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহতিশা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আয়েশা। তার কলিগ। মেয়েটা মিষ্টি বেশ। চটপটে হলেও চমৎকার মনের অধিকারী। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত ধরে বসলো মেহতিশাকে। সে বিরক্তি নিয়ে শুধালো,

-‘ চলো আয়েশা, আজ বরং হেঁটে যাই। ‘

আয়েশা মন খারাপ করে বলল, ‘ হু চলো। আজ তো রিকশা পাচ্ছিই না। অন্য সময় হলে তো ‘ আপা চলেন, আপা চলেন ‘ করে করে কানের পোকা বের করে ফেলতো। আজ কোথাও উধাও হলো কে জানে। ‘

হাঁটা ধরলো দু’জন।ইদানীং তারা রিকশার যাতায়াত
শুরু করেছে। দু’জনে ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা ভাগ করে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। আয়েশা নানান ধরনের কথা বলছে। মেহতিশা শুনছে তো চারপাশেও নজর রাখছে। বাসা খোঁজা শুরু করেছে সে ইতিমধ্যে। মাস শেষ হতে বেশি দেরী নেই। প্রথম মাসের বেতন পেলেই সালমার বাসা ছাড়তে হবে। অর্ধেক পথে আসার পর আয়েশা তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে। মেহতিশার বাকি পথটা একা যেতে হবে ভেবেই মন খারাপ হলো! এই রাত বিরাতে একাকী চলতে তার ভালো লাগে না। একটুও না!

হীম শীতল বাতাবরণ। সমীরে বইছে নাম না জানা মাদকীয় পুষ্পের ঘ্রাণ। সড়কপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সোডিয়ামের হলদেটে আলো। কিয়ৎ দূরে আঁধারের মাঝে ছোটাছুটি করছে ঝোনাকি পোকা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে পুরো শহর। অদূরে বিশাল বড় অট্টালিকা লুকোচুরি খেলছে যেন কুয়াশার সাথে। দমকা সমীরনের ঘন ঘন ছুটে চলা অদূর পর্যন্ত। ক্ষীণ দূরে কিঞ্চিৎ রশ্মির প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে মেহতিশা। রাতে শহরে ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না আর তা যদি হয় শীতের রাত। তবে সে মেয়ে! একাকী মেয়ে। এ শহরে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র হা য়ে না। নিকষ আঁধারের মাঝে গা ডুবিয়ে রেখেছে তারা। সুযোগ পেলেই ছুটে আসে। এই মানুষরূপী হা য়ে না গুলোকে ঘৃ ণা করে সে! বড্ড বেশি। তাই তো রজনীতে তার শহরে বের হতে এতো দ্বিধা, সঙ্কোচ।
গন্তব্যের শেষ সীমানায় প্রায়। তৎক্ষনাৎ ঘটলো এক অঘটন! তার সম্মুখে আকস্মিক উপস্থিত হলো তার অতি অপছন্দের ব্যাক্তিটা, অনিক।

অনিক বি শ্রীভাবে হাসছে। তার হাসির শব্দে যেন চারপাশও কেমন গুমোট রূপ ধারণ করেছে। রাত বেশি নয়! কেবল আটটা বাজল। তবুও আশপাশের অমোঘ নীরবতা সাথে অনিকের উদ্ভট হাসি দেখে মেহতিশার কেমন যেন গা কা টাঁ দিলো। অনিক লম্বা পা ফেলে এগোল।দাঁড়াল মেহতিশার সন্নিকটে। ফের গা জ্বালানো হাসিটা হেঁসে বলল,

-‘ কি গো জান? আমারে ফালাইয়া কই যাও তুমি? ‘

মেহতিশা অনিককে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফলে গেল। অনিক তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ এতো সহজে যেতে দিব? তুমি আমার চল্লিশ লাখ টাকার মাল। পালায় এসে ভাবছ পাড় পাবা? এতো সহজ অনিক খন্দকারের হাত থেকে ছোটা? হু জান? ‘

মেহতিশা অনিকের গালে চ ড় মা র ল। একটা না দুইটা না পরপর পাঁচটা চ ড় পড়ল অনিকের গালে। অনিক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মেহতিশার হাত সে মুচড়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ধরতেই মেহতিশা উল্টো তার হাত চট করে ধরে মুচড়ে দেয়। তিক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-‘ আমার হাত ধরা এতোই সোজা? ‘

হাতের ব্যা থা য় আ র্ত না দ করে উঠল অনিক। যতটা সহজ ভেবেছে মেহতিশাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনিক পকেট থেকে ধা রা লো অস্ত্রটা বের করলো। কর্কশ গলায় বলল,

-‘ চুপচাপ আমার সাথে যাবি নাহলে এখনি পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিব। ‘

-‘ মানুষের হাতের মা র না খেতে চাইলে তুই এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হবি শয়তান। নাহলে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে মানুষ ডাকব। ‘

-‘ তাই? ‘ অনিক তাচ্ছিল্যে ভরা কন্ঠে বলল!

অনিককে এগোতে দেখে মেহতিশা এবার তার দুই পায়ের মাঝ বরাবর লাথি মে রে বসল সজোরে। দু হাঁটু ভে ঙে অনিক বসতেই মেহতিশা সড়কে পড়ে থাকা ইট তুলে এনে তার মাথা বরাবর মা র ল। ফের নিয়ে এলো লাঠি। অনবরত আঘাত চলল! মাথা এবং স্প র্শ কাতর অঙ্গে ব্যা থা পেয়ে অনিক টু শব্দ অব্দি করতে পারলো না। চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু মেহতিশার রণমুর্তি রূপ। মেয়েটা এতো কঠিন? এতো সাহস বুকে? অনিক ভীরু মনে মেহতিশাকে থামতে বলল। মেয়েটা থামল না। আচানক পেছন থেকে সারতাজ কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো। সে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তায় এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব! ছুটে গিয়ে মেহতিশাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘ স্টপ মেহতিশা! কি করছেন এসব? ওনাকে এভাবে আঘাত করছেন কেন? ‘

মেহতিশা ঘন ঘন শ্বাস টানছে। হাত জোড়া কাঁপছে প্রবল। নেত্রপল্লব কম্পমান। ঘোলাটে চাহনি সম্মুখে ছুঁড়ে দিয়ে শুধালো,

-‘ আমাকে থামালেন কেন? কেন থামালেন? ওকে আজ আমি মে রে ফেলব! স্বামী নামে কলঙ্ক ও। মিথ্যা কথা বলে বিয়ে করেছে। বিয়ে করেছে কেবল নারী ব্য ব সা য়ীদের কাছে বিক্রি করার জন্য। ‘

অনিক ছুটে পালিয়েছে। সারতাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ রিলাক্স মেহতিশা।এভাবে মে রে কি লাভ? ওনাকে শা স্তি দিতে হবে। আমাকে খুলে বলুন ব্যাপারটা। হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবো। ‘

ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে মেহতিশা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল। এ কি করলো সে? বিষয়টা নিতান্তই গোপন রাখতে চাইছিল। সারতাজ, সালমা কিংবা অন্য সকল মানুষদের থেকে। কিন্তু আজ কিনা মুখ ফসকে সত্যিটা বলেই দিল?

চলবে~