শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-০১

0
519

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা (১).
সাদিয়া মেহরুজ .
|

নতুন সংসারে পদার্পণের একসপ্তাহের মাথায় মেহতিশা জানতে পারলো তার সদ্য বিবাহিত স্বামী তাকে বিয়ে করেছে নারী ব্যবসা;য়ীর নিকট চওড়া দামে বিক্রি করতে। নিস্তব্ধ, বিমূঢ় মেহতিশা উক্ত কথা জানার পর জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো নিজের চরম অসহায়ত্ব। তবে কি সে ফুপির ওপর ভরসা করে জীবনের মস্ত বড় ভুলটা করে বসলো? মেহতিশা অনুভূতিহীন চোখে তার স্বামী অনিককে দেখলো। সে তখন নিচু গলায় মেহতিশার দাম হাকাতে ব্যাস্ত মুঠোফোনে। টলমলে পায়ে মেহতিশা সরে দাঁড়াল দরজার আড়াল হতে।

সফেদ আকাশে কালশিটে মেঘ জমেছে। কিয়ৎক্ষণ পর মেদিনী কাঁপিয়ে বজ্রপাত হলো। তৎক্ষনাৎ শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। মেহতিশা পাথরের ন্যায় ভূমিতে ঠায় বসে। টিনের চালে পড়া বৃষ্টির শব্দ পাশের ঘরের অনিকের ফিসফিস আওয়াজকে হুট করেই অদৃশ্য করে দিয়েছে। বিমূঢ় মেহতিশা ভাবছে কিছু গভীর মনে। তার হটাৎ করেই মনে হলো পৃথিবীর সকল মানুষ বড্ড নি ষ্ঠু র, মুখোশধা রী! এইযে তার ফুপি বাবা- মা মা রা যাওয়ার পর তাকে এবং তার ছোট্ট বোনকে ঠাঁই দিলো যখন, মেহতিশা তখন বুঝেছিল পৃথিবীতে ফুপির মতোন ভালো মানুষ আর একটিও নেই। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে ফুপির মতো ছলনাময়ী, মিথ্যাবাদী কেও হতেই পারেনা। এইযে তাকে মিথ্যা আশা, স্বপ্ন দেখিয়ে নিজে প্রায় দুই লাখ টাকা অনিকের থেকে হাতিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলো এক ন র কে এই কাজটা কি একজন ভালো মানুষ করতে পারে কখনো?উঁহু!
আর অনিক? মিষ্টিভাষী, মধুর মতো কথা বলা শ্যাম বর্ণের ছেলেটা। সে কি করলো মেহতিশার সাথে? এতো বড় ধোঁ কা, এতোটা নিখুঁত নাটক? মেহতিশার অধর কাঁপছে প্রবল! হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে। কয়েকটা মাত্র শব্দ! অথচ এই কয়েকটা শব্দ শ্রবণ করেই তার নিজেকে বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় লাগছে!

-” একি মেহতিশা? কখন এলে তুমি? এই ঠান্ডার ভিতর মাটিতে বসে আছো কেন? ” অনিকের বিচলিত কন্ঠস্বর।

উল্টোপিঠ হয়ে বসে থাকা মেহতিশা তাচ্ছিল্যের হাসিঁ দিলো। কয়েকপল পূর্বেও সে এই ছেলেটার কন্ঠ শোনার জন্য মরিয়া হয়ে যেত অথচ এখন?তার এই মূর্হতে ইচ্ছে করছে অনিককে গলা চে পে হ;ত্যা করতে। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল সে। অনিককে কিছু জানতে দেওয়া যাবে না। তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অনিক মানুষ নয়! যদি সে জানতে পারে মেহতিশা তার গোপন কথা জেনে গিয়েছে তাহলে তার ক্ষ তি করতে যে বিন্দুমাত্র সময় অনিক নেবে না মেহতিশার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক তাই বলল।

-” মাত্রই এসেছি। মাটিতে বসে বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে হলো তাই বসেছিলাম। ”

অনিক স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সে ভ য়ে ছিল! আজ তার ডি লারের সাথে কথা বলার তারিখ ছিল। মেহতিশা বাড়িতে নেই দেখে বাসায় বসেই দরজা চাপিয়ে কথা বলছিল। তবে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে মেহতিশাকে ফিরতে দেখে মনে কিঞ্চিৎ ভ য়ে র সৃষ্টি হয়েছিল তার। চিন্তা মুক্ত হয়ে ফুরফুরে মেজাজে সে মেহতিশার পাশ ঘেঁসে দাঁড়াল।দৈবাৎ গা কা টাঁ দিয়ে উঠল মেহতিশার। এই লোকটাকে তার এ লহমায় বিন্দুমাত্র স হ্য হচ্ছে না! অনিক মেহতিশার কোমল হাত চেপে ধরে বলল,

-” অহ তাই বলো। আমি তো ভাবলাম তোমার শরীর খা রা প করেছে। তা এতো জলদি ফিরলে যে? ”

-” কাজ শেষ হয়েছে জলদি। তাই তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছি। ”

-” অহ। ভালোই হয়েছে জলদি ফিরেছ। তোমাকে মনে পড়ছিল এই মূর্হতে বড্ড বেশি। ”

অনিকের এক হাত মেহতিশার সম্পূর্ণ পিঠ জুড়ে অদ্ভুত ভাবে বিচরণ করছে। অপর হাত মেহতিশার গ্রীবাদেশে স্থাপিত। মেহতিশা কাঁপল! ঘৃ ণা য় ইচ্ছে করল অনিকের হাতটা ভেঙে ফেলতে এক্ষুণি! আগত ক্রন্দন রুখে নিয়ে মেহতিশা দ্রুত বলে উঠলো,

-” অনিক আমি বরং রান্না করতে যাই। ”

অনিক তখন অন্য দুনিয়ায় ব্যাস্ত। মেহতিশার পানে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চঞ্চল গলায় বলল,

-” পরে যেও এখন না। ”

-” অনিক ছাড়ো কাজ আছে আমার। ”

নিজের সাথে লতাপাতার ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অনিককে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো মেহতিশা। অতঃপর তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে এলো রান্না ঘরে। অনিক মেহতিশার এহেন কান্ডে মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বি শ্রী এক গালি ছুড়ল মেহতিশাকে উদ্দেশ্যে করে। ভা ঙা -চোড়া, রঙচটা টিন দিয়ে কোনোরকম বাঁধানো রান্নাঘরে ঠাঁই নিলো মেহতিশা। তাকে বড্ড অবিন্যস্ত দেখাচ্ছে। কয়েকপল স্তব্ধ থাকার পর সে কেঁদে উঠল করুণ সুরে। অনিক কিংবা নিজের ফুপির বিশ্বাসঘা;তক;তার কারণে নয় বরং নিজের ভাগ্যের ওপর উপ হাস করে।কে টে গেল ঘন্টা দুয়েক। বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে। সম্মুখে দৃষ্টিপাত ফেলে মেহতিশা বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-” পৃথিবী তুমি বড়ই নি ষ্ঠু র! ”

_

বিকেল বেলা। মেহতিশার ছোটবোন মেহজা মাত্রই বাড়ি ফিরেছে।এসেই সে বোনের খোঁজে বেড়িয়েছে। মেহতিশা বাড়ি নেই। টিনশেডের দু’টো রুম ঘুরে এসে মেহজা তাই বুঝল। হতাশ হয়ে সে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ছোট্ট ঘরটায় এসে কাঁধের স্কুল ব্যাগ নামাল। তার প্রচন্ড গরম লাগছে। মাত্রাহীন গরম।গলা শুকিয়ে কাঠ তার! পানির সন্ধানে বের হতেই তার দর্শন মিললো মেহতিশার সঙ্গে।মেহজা ছুটে গেল সেদিকে। বোনকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলো,

-” কই ছিলা আপা? আমি সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি। ”

মেহতিশা বিমর্ষ গলায় জবাব দিলো,

-” ছিলাম আশেপাশেই। ”

কিয়ৎক্ষণের মৌনতা। মেহজা মাথা তুলে তাকালো মেহতিশার পানে। তার আপাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। কেমন বি ষ ন্ন, ছন্নছাড়া লাগছে! মেহজা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

-” কি হয়েছে আপা? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”

মেহতিশা চটপট কিছু ভাবল। অনিকের কাছে তার আর থাকা চলবে না। সে এই নর পি শা চ এর কাছে নিরাপদ নয় আর নাই বা তার বোন। সে শক্তপোক্ত সিদ্ধান্ত নিলো নিমিষেই। মুখোশ্রীর রূপরেখা পাল্টে গেল তার। মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-” মেহজা যাও তো ব্যাগ গুছাও তাড়াতাড়ি। তোমার দরকারি জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকাও। আমরা আর এখানে থাকব না। ”

আট বছর বয়সী মেহজা ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। ভীষণ কৌতূহলী কন্ঠে সে শুধালো,

-” কেন আপা? আমরা কোথায় যাব? কেনই বা যাব? ”

-” মেহজা তোর দুলাভাই ভালো মানুষ না। আমাদের পালাতে হবে। নাহলে আমাদের ভীষণ বি প দ! যা বলছি তা কর জলদি। আমি আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। ”

ছোট্ট মেহজাকে আর বুঝাতে হলো না। সে বোধহয় মেহতিশার অব্যাক্ত কথা ভালোই বুঝতে পারলো। বুঝতে পারলো তার আপার কপালে বুঝি নতুন জীবনেও সুখের সন্ধান হয়নি। সে ছুটল তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায়।

মেহজার হাত ধরে মেহতিশা উদ্দেশ্যহীন পথ ধরে হাঁটছে। তার সামনে বিশাল পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক দূর অব্দি যেতে হবে। এই আকাঙ্খায় সে অবিরত পায়ে হাঁটছে। তবে তার জানা নেই সে এখন কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? হাঁটতে হাঁটতে মেহতিশার আচানক মাথায় আসলো মায়ের কথা। তার মা ঢাকার এক নামকরা এমপির বাড়িতে কাজ করতো। এমপির বউ ছিলেন বেশ নম্র ভদ্র মানুষ। মেহতিশাকে কি ভীষণ আদরটাই না করতো ভদ্রমহিলা। মেহতিশার মনে হলো এই মানুষটার কাছে একটুখানি সাহায্য চাইলে তিনি নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবেন না। তাছাড়া সে তো সারাজীবন আর থাকতে চাইছে না। একটা রাতই তো। মেহজাকে নিয়ে মেহতিশা গন্তব্যে রওনা দিলো। হাতে জমানো ছিল কিছু টাকা। সে টাকা দিয়েই ঢাকার বাসে চড়ে বসলো। পৌঁছালো পাঁচ ঘন্টা পর। বর্তমানে সে তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে বসে।

সিঁড়ি দিয়ে নামছেন সালমা ওয়াজিদ। মেহতিশা তাকে লক্ষ্য করে উঠে দাঁড়াল। কাছে আসতেই নম্র কন্ঠে সালাম দিলো। সালমা ওয়াজিদ সালামের জবাব নিয়ে বললেন,

-” ওমা মেহতিশা! এতদিন পর তোরা কোথা থেকে এলি? তোদের মা মা রা যাওয়ার পর তো কখনো এমুখো হলিই না। একটা বার কখনো আমার সাথে দেখা করতেও আসলি না। আজ কি মনে করে? ”

মেহতিশা ইতস্তত বোধ করছে। অন্তরালে জড়তা, ভীতি নিয়েই শুধালো,

-” একটা সাহায্যের দরকার ছিলো আন্টি। দয়া করে আপনি আমায় আজকের রাতটা আপনার বাসায় থাকতে দিবেন? আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমি কাল সকালেই চলে যাব মেহজাকে নিয়ে। আসলে রাত হয়েছে তো নাহলে আমি কখনো এভাবে আশ্রয় চাইতে আসতাম না। ”

-” এভাবে বলছিস কেন মেহতিশা? আমি কি তোদের আপন কেও নই? তোরা আমার মেয়ের মতো। শুধু আজকের রাত কেন তোরা সারাজীবন আমার বাড়িতে থাকলেও আমি কিচ্ছুটি মনে করবো না। ”

মেহতিশা নত মস্তকে দাঁড়িয়ে। ভূমির প্রতি দৃষ্টি ফেলে মিইয়ে আসা কন্ঠে বলে উঠলো,

-” সারাজীবন না আন্টি। আজকের রাতটাই শুধু থাকতে চাই। কাল সকালেই আমি চলে যাবো। ”

_

রাত তখন দু’টো বেজে দশ মিনিট। মেহতিশাকে ঝাপটে ধরে মেহজা তখন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন।মেহতিশার চোখে তন্দ্রার নেই কোনো ছাপ। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো দুশ্চিন্তা, মুখোশ্রীতে লেপ্টে রয়েছে বে দ নার চিহ্ন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবা মা’র জন্য পড়াশোনাটা করতে পেরেছিল যা একটু কিন্তু একটা সড়ক দু র্ঘ ট না যখন বাবা মাকে ছিনিয়ে নিলো তার নিকট হতে তখন সে সদ্য এইচএসসি পাশ করা মেয়ে। জীবন ডুবে গেল তার তমসায়। বাবা মা গত হওয়ার পর আশ্রয় দিলেন ফুপি। টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনা সহ ছোট বোন মেহজার পড়াশোনাও চালাচ্ছিল মেহতিশা। তবে মাঝে ঘটে এক উ দ্ভ ট ঘটনা। জীবনটা বুঝি তার আবারও গেলো থেমে। সময় গড়ালো, বয়স বাড়তে বাড়তে পঁচিশের কৌঠায় বাড়ি খেতেই ফুপি তোড়জোড় করলেন বিয়ের। মেহতিশা নিষেধ করার অবকাশ পেলো না। বিয়েটা তাকে আরো এক কালো অধ্যায়ে ঠেলে দিলো।

নিঃশব্দতা বিদ্যমান পরিবেশে হটাৎ কলিংবেলের প্রখর শব্দ বিরাজমান নৈংশব্দে ধস নামাল। পরপর চার থেকে পাঁচ বার কলিংবেল বাজল। থামাথামির নাম নেই। মেহতিশা উঠে বসল। সবাই ঘুমিয়ে গেছে কি?দরজা খুলছে না যে। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকা মেহতিশা মাথায় কাপড় টেনে উঠে দাঁড়াল। ড্রইং রুমে এসে দরজা খুলতেই সামনে আবিস্কার করলো সুঠাম দেহের এক পুরুষকে। মেহতিশা ছেলেটাকে দেখে কিয়ৎ ভড়কাল, চমকাল! তার সম্মুখে স্থির রূপে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা হটাৎ দ্রুত পায়ে এগোল। হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল তার দুই বাহু! বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকা মেহতিশাকে এবার বুঝি বাকরুদ্ধতা গ্রাস করে নিলো।

চলবে~