শহর জুড়ে আলোর মেলা পর্ব-২৪

0
395

#শহর_জুড়ে_আলোর_মেলা
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৪

আলো কি*ডন্যা*পের বারো ঘন্টা অতিবাহিত হতে চলেছে যেটা শ্রাবণ আর ওর টিমের বিশেষ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানেনা। সেফটির কথা চিন্তা করে বাড়িতে কৌশলে দুজন কাজের লোক পাঠিয়েছে। যদিও লিমা বেগম রাজি ছিলেন না কিন্তু শ্রাবণ বুঝিয়ে বলেছে। আপাতত কয়েকটা দিন ওরা এখানে থাকবে। সবটা দেখাশোনার জন্য। শ্রাবণ পরিচিত এক পুলিশের সঙ্গে আলাপ করেছে। ওরাও খোঁজ করছে গোপনে। আলো কি*ডন্যা*প হয়েছে বিষয়টা পাবলিক হলে মেয়েটাকে জীবিত পাওয়া মুশকিল হয়ে উঠবে। শ্রাবণ গাড়ি রাখা আইটি স্টোরের ভিডিও পেয়েছে সকাল ছয়টার সময়। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। গাড়িতে কোনো নাম্বার ছিল না। মুক্তির দাবিতে কোনো ফোন আসবে না এটাও জানা। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে তবে নিজের বেডরুমে নেই। থাকলে ছদ্মবেশী মেয়েটার উপরে নজর রাখা যেতে। কথাটা ভেবে শ্রাবণ টেবিল চাপড়ে হুঙ্কার ছাড়লো,

> আমি কোনো অপেক্ষা করতে পারবো না। বরং ছদ্মবেশী মেয়েটাকে তুলে আনি। ওকে ইচ্ছামতো পি*টা*লে সব উদ্ধার হবে।

রাহিন আলোর কাছে রাখা ক্যামেরা সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করছে। ওটাই একমাত্র মাধ্যম আলোর কাছে পৌঁছনোর জন্য। রাহিন ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে বলল,

> শোন তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আজ ভাবির কলেজ আছে। নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা আজ কলেজে যাবে? বাড়িতে শিরিন আছে না? ওকে বল চুপিচুপি ওই মেয়ের ব্যাগে স্পিকার লাগিয়ে দিতে।তুই বাড়িতে যা। একদম নরমাল ব্যবহার করবি। মনে হচ্ছে সুযোগের পেতে ও রাতের জন্য অপেক্ষা করছে। দিনে কিছু করবে না। ওর ব্যাগে শুধু ছু*রি না বরং অন্য অ*স্ত্র থাকতে পারে।

শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। রাহিন কথাগুলো মিথ্যা বলছে না। আলোর নিকটে এই ছদ্মবেশী আলো ওকে পৌঁছে দিবে। কি*ডন্যাপার যেমন ঠান্ডা মাথায় কিড*ন্যাপ করেছে ওকেও তেমন মাথা ঠান্ডা রেখে এগুতে হবে। জাষ্ট একবার ওকে হাতে পেলে হয়। শ্রাবণ একে চিবিয়ে খাবে। পুলিশে দেবার আগে ইচ্ছামতো ধো*লাই চলবে। শ্রাবণ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির দিকে ছুঁটলো। বাড়িতে পৌঁছাতে ওর কয়েক মিনিট লাগলো। ইশা শিরিনের কোলে ছিলো শ্রাবণ গিয়ে ওকে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। ফিসফিস করে বলল,

> মেয়েটাকে নাস্তা করতে পাঠিয়ে ওর ব্যাগের সঙ্গে স্পিকার সেট করে দিবা। কক্ষে প্রবেশের সময় সামান্যতম শব্দ যেনো উচ্চারণ না হয়। বুঝলে?

শিরিন মাথা নাড়িয়ে উঠে গেলো।লিমা বেগম সকালের নাস্তা তৈরী করে টেবিলে দিতে দিতে বললেন,

> শ্রাবণ, আলোর কি শরীর খারাপ? মেয়েটা গতকাল কেমন চুপচাপ ছিল। আজ এখনো নিচে আসেনি। চিন্তা হচ্ছে খুব।

শ্রাবণ তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে ইশার গালে চুমু দিয়ে উত্তর দিলো,

> শেষ বিশ্রামটা করতে দাও মা। অযথা ওকে নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করোনা। ও ঠিক আছে।
শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। পাশ থেকে সুফিয়া এসে ইশাকে নিতে চাইলো শ্রাবণ দিলোনা। মেয়েটা শ্রাবণের সামনের চুলগুলো মুঠোয় পুরে মুখে দেবার অপচেষ্টা করছে। শ্রাবণ বেশ মজা পাচ্ছে। মন অশান্ত কিন্তু এখন শান্ত থাকতে হলে এটাই একমাত্র প্রন্থা। আলো কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে আসলো। মেয়েটা একদম আলোর মতো দেখতে। তবে হাঁটা চলার ধরণের বেশ ফারাক আছে। এই মেয়েটা আলোর থেকেও মোটা। ডান হাতের কব্জিতে তারকাচিহ্ন আঁকা। শ্রাবণ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে হাসিমুখে বলল,

> কলেজে যাবে না? ভাবছি তোমাকে গেটে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাবো। তোমার ক্লাস কয়টায়?

শ্রাবণে কথার বিনিময়ে আলো জোরপূর্বক হাসলো। চেয়ার টেনে বসতে বসতে উত্তর দিলো,

> দশটার সময়। আপনি না গেলেও চলবে। আমি একা যেতে পারবো। আসলে রাস্তায় লুবনার আসার কথা আছে। আমার হালকা ঠান্ডা লেগে গলাটা কেমন বসে আছে।

শেষের কথাটা হয়তো শ্রাবণের বিশ্বাস জেতার জন্যই বলা হলো। শ্রাবণ মাথা নিচু করে কিছু ওকটা চিন্তা করে বলল,

> আচ্ছা যাও তবে। ভাবলাম তোমাকে একটু সাহায্য করি ব্যাপার না। শুনো তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। একটু ঘুরতে যাব। কেমন রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছি। কাজকর্ম সেতো পরেও করা যাবে।

ছেলে এতোদিনে মানুষ হয়েছে ভেবে লিমা বেগম বেশ খুশী হলেন। যেই ছেলে বাড়িতে ঠিকঠাক দুই মিনিট বসতে পারতোনা সে আজ বউ নিয়ে ঘুরতে যাবে ভাবা যায়না। আলো চুপচাপ খাবারের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েরা তিন প্রকারের হয় থাকে। প্রথমত সে স্ত্রী,দ্বিতীয়ত প্রেয়সী আর তৃতীয়ত সে জননী। এদেরকে সহজে পরিচালিত করা যায়। কূটনীতিক বুদ্ধিতে এরা যতই দক্ষতা দেখাক আবেগ এদের অনেক বেশি। শ্রাবণের মতো সুদর্শন একরোখা পুরুষের হৃদয়ে খ*ঞ্জর চালাতে ওর প্রেয়সী হৃদয় বারবার হাহাকার করে উঠেছিলো। হাত চলছিলোনা। হৃদয়ের ধুকপুকানি অনবরত ওকে বলছিলো, একে খু*ন করে না বরং নিজের করে আয়ত্তে নিয়ে আজীবনের জন্য দেশান্তরী হতে। কিন্তু পরকক্ষণে নিজের পরিচয় আর ভিন্ন আত্মা ওকে বুঝিয়ে “সংসার তোর জন্য নয় বালিকা। তুই পানিতে ভাসমান সামান্য ডিঙি নৌকা। বিশাল পালতোলা জাহাজের মূদু ধাক্কায় সমুদ্রের অতল গহীনে হারিয়ে যাবি”। এমন একটা পরিবারের আশা প্রতিটা মেয়ের জন্য স্বপ্ন। আলোর মতো ভাগ্য নিয়ে কয়জন জন্মাতে পারে? কথাগুলো ভেবে মেয়েটা মিনমিন করে বলল,

> কোথায় যেতে চাইছেন?

শ্রাবণ কফির ক্যাপে মুখ ঢুবিয়ে ঢোক গিললো। কোনো স্বাদ নেই সবটা কেমন তিক্ততাতে ভরা। ধৈর্য ধরে চুপচাপ বসে থাকার স্বভাব ওর নেই। ওষ্ঠ কামড়ে উত্তর দিলো,

> ঝাউবনের কাছাকাছি নদীর তীরে। নির্জন জায়গা কিন্তু পরিবেশ ভালো। যাবেনা?

মেয়েটা প্রস্তাবটা লুফে নিলো। এটাইতো সুযোগ। মেঘ না চাইতে জল তেমন অবস্থা। ছদ্মবেশী মেয়েটা খুশী হলো। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। মাথা নেড়ে রাজি হলো। খাওয়া শেষ করে ব্যাগ নিয়ে বিদায় হলো। শ্রাবণ বের হলো ওর দুই মিনিট পরে। রাস্তায় লোকজন আছে। সব সময় এই মেয়েটার উপরে নজর রাখতে হবে।
**************
গ্রামের বাড়িতে রতনের বিয়ের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। রাকার অস্তিত্ব এই বাড়ি থেকে আজকের পর থেকে চিরতরে মুছে গেলো। বিয়ের খরবটা রাকার কান অবধি পৌঁছাতে সময় লাগলোনা। মেয়েটা কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা। রতনের সঙ্গে ওর দীর্ঘদিনের সংসার। সবটা একটু একটুর করে মনে পড়ছে। অথচ রতন উল্লাসপূর্ণ চিত্তে বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। ফুলমালাকে দেখতে পরীর মতো সুন্দর লাগছে। পার্লারের মেয়েদের চার ঘন্টার পরিশ্রমের ফলে মেয়েটা পুরোদস্তুর পরিবনে গেছে। লোকজন দল ধরে বউ দেখতে এসে প্রশংসা করছে সেটা শুনে রতন আহ্লাদে আটখানা। মিতু সবাইকে ডেকে ডেকে বউ দেখাচ্ছে। শ্রাবণদের পরিবারের কেউ আসেনি। মিতু ভেবেছিলো শ্রাবণ আসবে। আশায় আশায় পথ চেয়ে ছিলো। মিতুর বাবা ওকে নেয়নি। রেট পড়েছে ওদের বাড়িতে। শহরের বেশ কয়েকটা জমি মার্কেট আর ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকা জব্দ হয়েছে। অবস্থা শোচনীয়। যাদের জন্য এতোকিছু তাদের কথা ওর বাবা শুনতে রাজি না। তাছাড়া ভদ্রলোক জেলে এখন। অনেক আগে
উনার বাড়ির অর্ধেক অংশ মিতুর নামে ইউল করেছেন। এটা নিয়ে ভদ্রলোকের দ্বিতীয় স্ত্রী ঝামেলা করছে। মিতুর স্বামী সোয়েব ডিভোর্স পেপারের সঙ্গে দশ লক্ষ্য টাকা পাঠিয়েছিলো। মামার বাড়ির সম্পত্তিও নেহায়েত কম পাবেনা। ওর চলে যাবে দিন। তাই বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছায় ওর অবশিষ্ট নেই। মিতু নতুন বউয়ের পাশে বসে ছিল উদাসীন ভাবে।হঠাৎ ফুলমালা বলে উঠলো,

> তোমার জন্য আমার খারাপ লাগে মিতু। শ্রাবণের উচিত ছিল তোমার খারাপ সময়ে পাশে থাকা। তুমি কিছু ভেবোনা আমি যখন এসেছি ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পুরুষ মানুষ কিভাবে হাতে রাখতে হয় ওটা আমি জানি। ডিভোর্সী হয়ে কতদিন আর মামার বাড়িতে পড়ে থাকবে? একটা গতি হওয়া প্রয়োজন।

মিতু বিরক্ত হলো। মেয়েটার কথাবার্তার ধরনের অনেক সমস্যা আছে। সোজাসুজি না বললেও খোচা দিয়ে ঠিকই বলে দিলো মিতু এই বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আছে। পাশ থেকে রতন থামালো,

> ফুল রুমে চলো। মিতুর বিষয়ে ভাবার জন্য অনেকে লোক আছে। আপাতত তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো।

রতনের বিয়ে করে বেশ খুশি। ভেবে নিয়েছে সংসার করে সবাইকে বুঝিয়ে দিবে দোষ যা কিছু ছিল সবটা রাকার ছিল। ওর বিন্দু পরিমাণে কোনো দোষ নেই।
********
দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির হনের শব্দে আলোর জ্ঞান ফিরলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখে আবছা দেখছে ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না। হাতের বাঁধন আলগা। হয়তো খুঁলে দেওয়া হয়েছে। গ্যারেজ রুমের পেট্রোল পোড়া তীব্র ঝাঝালো গন্ধে গা গুলাচ্ছে। তেলাপোকা পায়ের আঙুলের কিছু অংশ খেয়ে নিয়েছে তাতে জ্বালাপোড়া করছে। কি অসহনীয় বেদনা যা কাউকে বলার মতো না। আলো দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়লো। মাথা ঘুরছে শরীর কাঁপছে। এক পাও সামনে এগোতে পারবে না। কিভাবে এই কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে আল্লাহ মালুম। নিশ্চয়ই শ্রাবণ ওকে খোঁজ করছে।কামিজের বুকের কাছাকাছি ওড়না দিয়ে ঢাকা ছোট্ট মাইক্র ক্যামেরা চেক করে কিছুটা শান্ত হলো। এটা কিড*ন্যাপের আগে থেকে ওর সঙ্গে ছিল। আরাফের কিড*ন্যাপের আগে কিনেছিলো। সেই থেকে এটা ব্যাগে রেখেছে। যখন লোকটা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো তখনই বুঝেছিলো সহজে মুক্তি নেই। কৌশলে ওটা নিজের কামিজের সঙ্গে আটকে নিয়েছিলো। আলো নিশ্চিত এখান থেকে ওকে জীবিত ফিরতে দিবে না। কথাটা ভেবে ওর প্রথমে ইশার মুখটা মনে পড়লো। বাচ্চাটা কি সুন্দর করে হাসতে শিখেছে। আর শ্রাবণ? নামটা মনে হতেই আলো ছটফট করে উঠলো। হৃদয়ের গহীনে ওই নামটা অতি গোপনের সহিত সুক্ষভাবে লিখে রেখেছে। না চাইতেও সেটা ও এড়িয়ে যেতে পারেনা। মানুষটার প্রেমে ও অনেক আগেই পড়েছে শুধু বুঝতে দেয়নি। নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রেখেছিলো। আলোর ভীষণ আফসোস হচ্ছে। লোকটার সেই সুদর্শন মুখটা হয়তো আর দেখা হবে না। তার কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যাবে। আলোর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হৃদয়ের যন্ত্রণা হাহাকার সেটা নিয়ে হয়তো অন্তিম যাত্রায় পা বাড়াতে হবে। মানুষটার বক্ষস্থল নেত্রজলে প্লাবিত করার সৌভাগ্য ভাগ্য বিধাতা ওকে দেয়নি। কেন দিলোনা? কোন মহাপাপে ওকে এভাবে কষ্ট পেতে হচ্ছে,এই প্রশ্নের জবাব কে দিবে? দিনের পর দিন কিছু নোংরা চরি*ত্রহীন পুরুষের ললুপ দৃষ্টিতে আলোর মতো হাজারো আলো অকালে নিভে যাচ্ছে সেখবর পৃথিবীর কয়জন রাখে? আলো ধাতস্থ হলো। নিজেকে শান্ত রাখা জরুরি। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। এলোথেলো চিন্তা হচ্ছে। পূণরায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা দূরে টেবিলের উপরে একখানা ফোন,দুইটা ইনজেকশন,কিছু প্যাকেট অচেনা সাদা পাউডারের গুড়া, দুই বোতল তরল ওষুধ রাখা। আলো কোনোরকমে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিলো। কপাল ভালো লক দেওয়া নেই। কিন্তু অদ্ভুতকাণ্ড কোনো নাম্বার মনে পড়ছে না। আলো কয়েকবার চেষ্টা করলো শ্রাবণে নাম্বার মনে করার জন্য। মস্তিষ্ক শূণ্য। আলো থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ভেবে নিয়ে আবারও চেষ্টা করলো তারপর একটা পরিপূর্ণ নাম্বার তুলতে সক্ষম হলো। দুবার রিং বাজার পর রিসিভ হলো। পুরুষালী কণ্ঠে ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

> শ্রাবণ বলছি। কে আপনি?

আলো কথা বলতে পারলোনা। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে চুপচাপ ফুপিয়ে যাচ্ছে। বাকীটা আর বলতে হলো না। কানে বেঁজে উঠলো,

> আলো? আলো নিজেকে শান্ত রাখো। কান্নাকাটি করোনা। কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি ঠিক তোমাকে খুঁজে নিবো। শুধু বলো তোমাকে ওরা কোথায় রেখেছে? মানে আশেপাশে কি আছে। এইটুকু বলো। আমার আলো না ভীষণ সাহসী? একটুও ভয় করবে না। তোমার সঙ্গে যায় হয়ে যাক আমি পাশে থাকবো। হীনমন্যতায় ভুগবে না। শুধু নিজেকে শক্ত রাখো প্লিজ। প্যানিক করবে না।

শ্রাবণ এলোমেলো বকছে। কি করবে দিশেহারা অবস্থা। আলো শব্দ করে ফুপিয়ে উঠলো। জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,

> ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ নিয়ে জান আমাকে। আমি ম*রে যাব হয়তো। আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। ইশাকে দেখে রাখবেন প্লিজ। রেবার মতো ওরা আমাকে মে*রে ফেলবে।

> আমার উপরে তোমার বিশ্বাস নেই?

শ্রাবণ আলোর কলেজের কাছাকাছি ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। পাশে রাহিন আলোর ফোন করা নাম্বার দিয়ে লোকেশন জানার চেষ্টা করছে। শ্রাবণ পূণরায় বলল,

> বিশ্বাস হারিয়ে ফেলোনা। শ্রাবণ মাহমুদের ব্যক্তিগত মানুষটার দিকে উঠানো হাত আমি রাখবোনা। তুমি জাষ্ট শান্ত হয়ে বলো তোমার আশেপাশে কি আছে।

আলো থেমে থেমে বলল,

> তিনাটা ভেঙে যাওয়া গাড়ি। একটা সাদা রঙের নতুন গাড়ি। তাছাড়া লোহার বিভিন্ন জিনিসপত্র আর ডিজেল। হয়তো এটা পরিত্যক্ত কোনো গ্যারেজ। ভেতরে আবছা অন্ধকার। পাশের রুমে কারা জানি সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে। আমার মাথা ঘুরছে।

আলো আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। বাইরে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। হয়তো কেউ ভেতরে প্রবেশ করবে। আলো তাড়াতাড়ি ফোন রেখে নাম্বার ডিলিট করে টলতে টলতে নিজের স্থানে ফিরে আসলো। অচেতন হওয়ার ভান করে চোখ বন্ধ করলো। ঠিক তখন লোকটা ভেতরে প্রবেশ করলো। একটু একটু করে আলোর পাশে এসে থামলো। মৃদু কণ্ঠে বলল,

> মিসেস শ্রাবণ মাহমুদ,আপনি দেখতে জব্বর সুন্দরী। কি করি বলুন তো আপনাকে নিয়ে? নিজেকে আর কতভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় সেটাই ভাবছি। আমি সুন্দরের পুজারী। আপনার কোমল বদনখানাতে উষ্ণ স্পর্শ করতে বড্ড ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু আমি নিরুপায়। সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

লোকটা আলোর খুব নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। আলোর বুক ধুকপুক করছে। একটিবার লোকটার নোংরা মুখটা দেখবার বাসনা ওর মনে তীব্র হলো তাই চোখ টেনে ঘুম ভাঙার অভিনয় করে সোজা হয়ে বসলো। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির মুখে মাস্ক লাগানো আছে। আলো ভয়ে ভয়ে জিঞ্জাসা করলো,

> আমাকে আটকে রেখে কিসের লাভ হচ্ছে? কে আপনি?

লোকটা হাসলো। টেবিলের নিকট গিয়ে হাতে ইনজেকশনের জন্য ওষুধ তুলে নিয়ে উত্তর দিলো,

> আলো রানী এভাবে হুটকরে জেগে উঠবেন না। আপনার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত প্রতিটা আওয়াজে আমি এলোমেলো আর দিশাহারা হয়ে উঠি। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে জানেন? শ্রাবণ মাহমুদের সৌভাগ্য আছে বলতে হয়। কিন্তু নিয়তি বড়ই কঠিন। ভদ্রলোকের মৃ*ত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। আপনাকে শুধুমাত্র আর একটা রাত কষ্ট করতে হবে। আপনার ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে ড্রাগস পজেটিভ আসা অবধি এইটুকু কষ্ট আপনাকে করতে হবে। যাতে পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে উঠে আছে মিসেস শ্রাবণ মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগস আসক্ত। এই বিষয় নিয়ে ঝগড়া ঝামেলা করে আপনি আপনার স্বামীকে হ*ত্যা করেছেন। বুঝলেন প্রতিশোধ নিয়ে ভীষণ ভালো লাগে। আপনি যদি সেদিন চুপচাপ থাকতেন তাহলে আর এইদিন দেখতে হতো না। একটা বাইরের মেয়ের জন্য হুদাই অশান্তি ডেকে আনলেন। আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে।

লোকটা কথা বলতে বলতে আলোর দিকে এগিয়ে আসলো। আলো এক দৃষ্টিতে ইনজেকশনের দিকে চেয়ে আছে। গলা বুক শুকিয়ে আসছে। দুইটা দিন পেটে দানাপানি পড়েনি। গতকাল সকালে সামান্য নাস্তা করেছিলো।আলো ফিসফিস করে বলল,

> পিপাসা পেয়েছে একটু পানি দিবেন?

লোকটা নিজের কাজে ব্যস্ত। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন,

> ভয় নেই।আলো রাণী আপনি ম*রবেন না। সামান্য ড্রাগস নিলে কেউ ম*রে না। এটা নিয়ে দেখুন ভীষণ ভালো লাগবে। আনন্দ পাবেন। দুনিয়ার চিন্তা আপনাকে মুক্তি দিবে। পানি খেয়ে কি হবে বলুন?

লোকটা পানি দিবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে। আলো হতাশ হলো। কিভাবে একে আটকানো যায়?

> পাশের কক্ষে ওরা কাঁদছে কেনো?

আলোর প্রশ্ন শুনে লোকটা বিরক্ত হলো। থেমে গিয়ে উত্তর দিলো,

> এতো কৌতূহল আপনার?উফফ! চুপচাপ থাকতে পারেন না দেখি।

আলো কিছু বলতে পারলোনা। পূণরায় ইনজেকশন ওর ধমনীতে প্রবেশ করলো। একটু একটু করে পুরোটা শেষ হওয়ার আগে দরজা ভাঙার আওয়াজ আসলো। লোকটা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আলোর দিকে। আলো মৃদু হাসলো। চোখ টেনে ওষ্ঠ কামড়ে একবার টেবিলের উপরে রাখা ফোনের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,

> দরজার ওপাশে আপনার মৃ*ত্য দূত অপেক্ষারত। কি করবেন ভাবছেন?

লোকটা সামনে থাকা টেবিলে লা*থি বসিয়ে মাথার চুল টেনে ধরলো। বাকীটা দেখার সৌভাগ্য হলোনা। আলো একটু একটু করে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো।

চলবে