শানুর সংসার পর্ব-০২

0
263

#শানুর_সংসার (২)

‘বউ মা, কাশিফের বউ আম পাঠালো, কেটে নিয়ে আসো। ‘

শানু মাত্র ভাত খেতে বসেছে। টেবিলে আয়োজন সাধারন। এক পদের মাছ, বাচ্চাদের জন্য মুরগী দিয়ে চালকুমড়া, পাট পাতা ভাজা, বড়ি দিয়ে মিষ্টি কুমড়া। শানু তার ভেতর একটু করল্লা ফেলে ভাঁপিয়ে রেখেছে। সকালে আসিফের মা আম খেয়েছেন। ডায়বেটিস বেড়ে যাবে।

‘আম্মা, সকালে একবার আম খেলেন। এখন আবার খাবেন?’
‘তোমারে কেটে আনতে বলসি, আনবা। আমার ছেলের বউ আম এনেছে৷ খাব না?’
‘ডায়বেটিস বাড়লে?’
‘হাসপাতালে নিয়ে যাবা। তোমরা আছো কি করতে, ঘাস কাটতে?’

আসিফের মা আলেয়া আক্তারের বয়স সত্তর। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেড আপা হয়ে রিটায়ার করেছেন অনেকদিন। এখন ছেলের সাথে থাকেন। পেনশনের টাকায় দুটো দোকান কিনে ভাড়া খাটাবেন বলে মনস্থির করেছেন। সঞ্চয়পত্র কেনার বুদ্ধি তাকে অনেকে দিলেও তার মনে ধরেনি। আলেয়া আক্তার চিকন বোধের মানুষ। সহজে কারো কথা কানে তোলেন না। সঞ্চয় পত্র কেনার বুদ্ধিদাতার মূলে আছে আসিফ। তিনি ছেলেকে ধমক মারলেন, ‘ টাকা আামার, কি করব না করব আমি বুঝি। তোমারে পজিশন দেখে আসতে বলছি। না পারলে জানায় দেও পারবা না। ‘ রাগের ঠেলায় আসিফ পজিশন দেখতে যায়নি।

আলেয়া আক্তার ঠিক বিকাল বেলা শাড়ি পাল্টে শানুর রুমে এলেন। শানু তখন সুনীলের ‘প্রথম আলো’ নিয়ে পড়তে বসেছে। রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীর শরীরে ডুব দিয়েছেন। শাড়ি খুলে সামনো এগোবেন। মৃনালিনীর দেবর নাকে ঘাম জমেছে৷ শানুর নাকে ও বিন্দু বিন্দু ঘাম। শানুর ভীষণ অন্যরকম লাগছে। নিজের বাসরঘরের কথা মনে পরছে। এ সময় আলেয়া আক্তার এসে ডাকলেন, ‘এই শানু, ঠ্যাং কচলাচ্ছো কেনো। চুলকানী হয়েছে?’ শানু ভূত দেখে ভয় পাবার মতো চমকে উঠলো। ভয় পায়নি, অপ্রস্তুত হয়েছে৷ আলেয়া আক্তরের হুকুমে শানুকে আবার উঠে শাড়ি পরতে হলো। রাজুর ডেকে আনা রিক্সা চেপে বউ শাশুড়ী দোকানের পজিশন দেখে আসলেন।

বাজারের একদম ফ্রন্ট পজিশনে দুটো দোকান পাওয়া গেছে৷ দোকানের মালিক হিন্দু দেখে আলেয়া আক্তার দোকানে ঢুকলেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেন। শানু বোকার মতো দোকানের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান। লাল-নীল ছোট ছোট নিমা, টপস, ফ্রক। শানু নেড়েচেড়ে দেখে। মিশুর যখন তিন মাস, শানু হোপের গলিতে আসতো কাপড় কিনতে। কি যে ভালো লাগতো। একটা ফ্রক দুইশ টাকা দাম চাইলে, শানু বলতো একশ টাকা। শেষে একশ বিশ টাকায় দফারফা। শানুকে আলেয়া বেগম বাইরে থেকে ডাকেন,
‘এখন দোকান থেকে বাহির হও। ‘
‘জি আম্মা, বলেন’।

শানুর হাতে একগাদা ছোট জামাকাপড়। দারোয়ানের বউয়ের বাচ্চা হবে। আল্টাসনোগ্রাফিতে দেখা গেছে মেয়ে বাবু। শানু তার জন্য কাপড় নিলো।

‘হিন্দুর দোকানে ঘুরতেসো কেনো। তুমি জানো না, ওরা মুই তা পানি নেয় না।’
‘ছিঃ, আম্মা কি যে বলেন। আমরা মিষ্টি কিনি ওদের থেকে।
‘খাবারের মধ্যে দেয় না। ‘
‘আম্মা আপনার না কত হিন্দু ছাত্র-ছাত্রী আছে। ‘
আলেয়া আক্তার চুপ মেরে গেছেন। ছেলের বউয়ের কেনাকাটার বাতিক আছে৷ তাকে থামাতে তিনি ঐ কথাটা বলেছেন। কিন্তু, শানু আবার সরলমনে ঠাস ঠাস কথা বলে দিচ্ছে। কথার পিঠে কথা ভাঁজতে আলেয়া আক্তারের ভালো লাগলো না।
‘হইছে থামো। কাপড় রেখে আসো, বাড়ি যাই। ‘
‘দোকান পছন্দ হইছে, আম্মা?’

আলেয়া আক্তার বিসর বদনে দোকান দেখেন। দোকানদার তার কাছে আরো বিশ হাজার টাকা বেশী চাইছে। ঐ বিশ হাজার দিলে চালের আড়তে তিনি এক লাখ পুঁজি খাটাতে পারবেন না। ছেলেদের কাছে চাইতে হবে।
‘বাসায় গিয়ে বলবো। আযান দিয়ে দেবে। ‘
‘আম্মা, টাকা কয়টা বেশী চাইলেও নিয়ে নেন। দোকানের পজিশন দেখেছেন। ভাড়া হয়ে যাবে। ‘

আলেয়া আক্তার রিকশা দামাদামি করে উঠেন। সবাই পাঁচ-দশ টাকা বেশী হাতাবার তালে আছে। শানু রিক্সায় চড়লে কিশোরী মেয়ে হয়ে যায়। ডানে বামে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। আলেয়া আক্তার বউয়ের কচকচানিতে ত্যক্ত হয়ে ধমক দিলেন।
‘এত ঝাপাচ্ছো কেনো। সোজা হয়ে বসতে পারো না ‘।
‘মুড়ি মাখা খাবেন, আম্মা?’
‘না, পেটে ঝামেলা করবে।’।
‘একদিন খান, আম্মা ‘ শানু শাশুড়ীর কাছে আসে, ‘ আমি মিশুরে স্কুলে নিতে আসলে খাই। খুব মজা।’

শানুর আগ্রহে আলেয়া আক্তার রিকশা থামান। রিক্সা ওয়ালাকে বলা হলো, এই দুই তিন মিনিটের দেরীতে সে যেনো রাজার ভান্ডার সমান টাকা না চেয়ে বসে৷ এক টাকাও বেশী দেয়া হবে না৷ রিক্সা ওয়ালা গামছা দিয়ে মুখ মুছে বললো,’ ইনসাফের মালিক আল্লাহ, সে দেলে দেবে না দিলে নাই।’ শানুর কথাটা খুব ভালো লেগেছে৷

মুড়ি মামার নাম সজীব। লাল পোটলায় গরম চানাচুর আর হাতে ভাজা মুড়ি তার স্পেশালিটি। চিকন করে মরিচ পেঁয়াজ কেটে একদম শেষে মুড়িতে ঘুঘনি, সরিষার তেল, আর বাদাম ভাজা মেশায়৷ এটা তার সিক্রেট রেসিপি, জানে কেবল শানু। শানুকে দেখে সজীব মামা হাসলো।
‘আপনে আসা মানে পূন্য আসা। আপনে যেদিন খান, বেইচা কুলাইতে পারি না। ‘
‘দূর, আজকে বিক্রি কেমন।’

শানু বাদাম ভাজা খাচ্ছে। আলেয়া আক্তার শানুর হাতে চাপড়ে দিলেন। গাধাটার কাছ থেকে এই বাদামের জন্য আবার পয়সা চাবে।

‘আছে, চলে। কি খাইবেন। মুরুব্বিরে কি দিব।’
‘আমার শাশুড়ী, সালাম দেন’।

সজীব মামা লম্বা করে সালাম দেয়। আলেয়া আক্তারের গরম লাগছে। তিনি সিমেন্টের বাধানো পাটাতনের ওপর বসে পরেছেন৷ শানু ব্যাগ থেকে পাখা বের করে বাতাস করে। মুড়ি মাখা খেয়ে আলেয়া আক্তার মুগ্ধ। ছেলের হাতে জাদু আছে। প্যাকট করে মিশুর জন্য নিয়ে নিলেন। শানু ঝাল দিয়ে মুড়ি খেয়ে একটা টোকাইয়ের কাছ থেকে চকলেট কিনে খেলো। রিক্সায় ওঠার সময় আলেয়া আক্তার দেখলেন, শানু রিক্সা ওয়ালার জন্য বাদাম মাখা নিয়ে এসেছে৷ শাশুড়ীর মুখের দিকে চেয়ে শানু হাসলো। আলেয়া আক্তার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। শানুর সরলতা তার ভালো ও লাগে, খারাপ ও লাগে।

স্বামী ফিরলে শানু দোকান দেখে আসার গল্প করে। আসিফের স্ত্রীর হাত পা নেড়ে গল্প করার ভঙিমায় আগ্রহ নেই। বারবার ফোন দেখছে। একসময় হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ আসলে আসিফ রিপ্লাই দিয়ে বারান্দায় উঠে গেলো। শানু জানে, এখন আসিফ সিগারেট খাবে। আজকে বৃহস্পতিবার, তাদের ভালোবাসা-বাসি দিবস। আসিফ কোন কোন বৃহস্পতিবারে শানুকে কাছে ডাকে। ঠিক কবে ডাকে তার নির্দিষ্ট দিন নেই। আসিফের মর্জি হলে ডাকবে, তবে শানুকে তৈরী থাকতে হয়।

শানু শরীর ধুয়ে চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপগ্লস। প্যারিস থেকে বড়’পা শ্যানেল সেন্ট পাঠিয়েছেন। শানু ওটা শুধুমাত্র এই রকম বিশেষ রাতে খরচ করে। একটু সেন্ট তুলোতে চেপে দুই বগল মুছে নেয়৷ গলায়, বুকের ভাঁজে, স্তনের মধ্যে লাগায়। নিপলের আগায় মধু দেবার বিষয়টা একটা বইয়ে পড়েছে। শানু অতদূর ভাবতে পারে না। তার লজ্জা পায়।

শাড়ি ছেড়ে শানু লাল রঙের ম্যাক্সি পরেছে। খুব নুপুর পরতে মন চাইলেও পরে না। বড়বড় বাচ্চার মায়ের পায়ে নুপুর দিয়ে বিছানায় যেতে শরম লাগে। সাজ শেষে শানু বিছানায় শুয়ে ইউটিউবে ‘সাথ নিভানা সাথিয়া ‘ সিরিয়ালের পর্ব দেখে৷ এই সিরিয়ালটা খুব ভালো। বোকা গোপী বহু, তার দুঃখে শানুর কান্না পায়। কোকিলা মোদী খালি গোপীকে বকে।

শানু বারান্দার দিকে আকুল নয়নে চেয়ে থাকে। আসিফের আসার সময় হয় না। অপেক্ষা করতে করতে শানু এক সময় ঘুমিয়ে পরে। আসিফ শুতে এসে দেখে শানুর মুখে কাজল, লিপগ্লস লেপ্টে আছে। স্ত্রীকে অন্যপাশে ঠেলে আসিফ শুয়ে পরে। আগামীকাল, অফিসে পুরনো বন্ধু আসছে। তার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে আসিফের চিত্ত চাঞ্চল্য হচ্ছে। শানু ওপাশে হাত- পা গুটিয়ে ঘুমায়। আসিফের প্রবল আনন্দ তাকে স্পর্শ করার সুযোগ নেই। আসিফ তাকে সে অধিকার কখনো দেয়নি।

(চলবে)