শানুর সংসার পর্ব-০৩

0
237

#শানুর_সংসার (৩)

একটা বাজে সময়ে শানুর সাথে প্রতিবেশী রেহানা ভাবী গল্প করতে এসেছে। শানু সবে মাত্র চুলোয় কচুশাক ভাপে বসিয়েছে৷ কোথাকার কোন ইন্দুবালা নামের এক মহিলা কয়েটা পদ কি রাঁধলো না বাড়লো তা নিয়ে চারপাশে মাতামাতি। এ দেশের নারীরা যে হাজার বছর ধরে এসব পদ রেঁধে চলেছে, তার কোন খাতির নেই। শানু চুলোয় খুচুন দিয়ে শাক গুতোগুতি করে রাগ ঝাড়ে। ‘এই কচুবাটা আগে খাইনি? খেয়েছি তো। সেদ্ধ করে ভাজা চিংড়ি দিয়ে বেটে খেয়েছি, নয়ত তেলে ভুনেছি। ‘ ডালের পদ শানু রান্না করতে জানে কয়েক শ’ রকম। কই তাকে নিয়ে কেউ বই লিখবে কোনদিন? কেউ না। সেও তো বাপের বাড়ি যায়নি আজ কতটা বছর হয়ে গেলো। তার দুঃখ নিয়ে কেউ সিনেমা বানাবে? বানাবে না। শানুর কথাও কেউ জানবে না। শানু গজগজ করে কচুর পানি ফেলে চুলো বন্ধ করে৷ তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। আসিফ নাস্তা খেতে বসে বলেছে, ‘কচু এনেছি, ‘ইন্দু বালার মতো কচু রান্না করবে। কি এক জাতের রাঁধো ভালো লাগে না।’ শানু তার জীবন রান্নাঘরে দিয়ে দিক, চুলোর পাশে বেয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়ে শুটকী হয়ে যাক, কেউ দেখার নেই।

মিশু এসে মায়ের কাছে ঘুরে গেলো। আজ তার স্কুল যেতে ইচ্ছে করছে না। বাংলা পরীক্ষার পড়া হয়নি। নতুন বাংলা স্যার খুব কড়া। বানানে ণত্ববিধান -ষত্ববিধান মেনে চলেন। মিশুর ন্যায় মিডিওকার স্টুডেন্টরা পরেছে বিপদে। প্রশ্নপত্রও কেমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন সাজায়। চুলোর পাশে ডালের বড়া ভেজে রাখা দেখে মিশু একটা মুখে দেয়।

‘অনেক ঝাল, মা, আমার গুলো মরিচ বাদে বানাও।’
‘বানানো শেষ। আজকে বায়না দিবি না, মিশু।’
‘কেনো, কি হয়েছে আজ।’

শানু ঠাস করে মরিচের ডিব্বা খুলতে গিয়ে ফেলে দেয়। রান্নাঘরের মেঝেতে লাল রঙের গুড়ো ছড়িয়ে একাকার। শানুর কান্না পায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরো কাজ বাড়লো। মিশু ভেজা কাপড় দিয়ে ফ্লোর মুছে দেয়।

‘রাজু কৈ রে। কয়েকটা ডিম আনতে পাঠালাম। ছেলের খবর নেই’।
‘ভাইয়া বললো কলেজ থেকে এসে এনে দেবে।’

মিশু ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুচ্ছে। মরিচের গুড়োয় হাত জ্বলে যাচ্ছে। মা এসবের ভেতর থাকে কেমন করে।

‘দেখলি, মাষকলাইয়ের ডালে ডিম না দিলে তোর দাদী খাবে না।’
‘আমি নিয়ে আসি মা?’ মিশু আগ্রহ করে বলে। মায়ের কাজ করে দিয়ে মন খুশী করার চেষ্টা।

‘টাকা দিয়ে গেছে? রাজুর পড়ার টেবিলে গিয়ে দেখ বক্স চাপা দিয়ে রেখে ছিলাম। ‘
‘মা, আমার জমানো টাকা আছে। ওখান থেকে নিয়ে আসি। ‘
‘পারবি? বাসার সামনের রাস্তা খুব ব্যস্ত। সাবধানে পার হোস।’

মিশু ছুটে গেলো। ডিম আনতে গিয়ে দোকানে দশ পাঁচ টাকার চকলেট কিনে নেয়া যাবে। স্কুলের জন্য তৈরী হবার সময় কমে গেলে মা আর তাড়া দেবে না।

শানু চুলোর ভাত নামিয়ে চায়ের পানি দেয়। আসিফকে চা দিয়ে ছিলো। সেই চা এক দুই চুমুক খেয়ে আসিফ রেখে গেছে। শানুর আর নতুন চা খাওয়া হয়নি। শাশুড়ীও এ সময় চা খান৷ কচুশাক নেড়ে শানু চায়ে পাতা দেয়। পানিতে আগে ছেড়ে দিয়েছে লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা। এলাচের কৌটা উপরে তোলা। নামাতে হলে পিড়ি পাততে হবে। শানুর গরমে প্রাণ আইঢাই করছে। কলবেল বাজায় চুলো কমিয়ে শানু ড্রইং রুমে আসে। পিপহোলে চোখ রেখে শানু প্রমাদ গোনে। প্রতিবেশী ভাবী রেহানা এসে উপস্থিত। শানু ড্রয়িংরুমের দিকে তাকায়। আসিফের খুলে রাখা লুঙ্গি ঝুলছে। মেঝেতে রাজু শার্ট ফেলে গেছে। মিশুর বাসার স্যান্ডেল দুই পাটি দু’দিকে। শানু একবার ভাবলো, দরজা খুলবে না। আবার কি ভেবে খুলে দিলো।

‘ভাবী, চিনি নিতে আসলাম। পায়েস বসিয়েছি বুঝলেন। আপনার ভাই আবার আমার হাতের পায়েস ছাড়া খায় না।’

রেহানা সোফায় বসতে গিয়ে আঁতকে ওঠে। ড্রয়িংরুমের এই হাল কেনো। শানু কি ঘরদোর একদম গুছিয়ে রাখে না। যখনি আসে, হয় লুঙ্গি দেখে, নয়তো শানুর শাড়িতে হলুদের দাগ ছোপ ভরে আছে। শানু দ্রুত হাতে কাপড় সরিয়ে জুতো সাজিয়ে রাখে। রেহানা ভাবীর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে ও লজ্জায় পরে গেছে। ছবির মতো টিপটপ গোছানো সুন্দর বাসা। কোথাও একটা আলপিন পরলেও দেখা যাবে।

‘ভাবী মনে হয় সময় পান না, না। সকাল থেকে খুব ব্যস্ত’।

রেহানা চোখের কোনে দরজার ঝুল, জানালার ধুলো মাপে। শানুর বড় লজ্জা লাগে। খালাকে রোজ পরিষ্কার করতে বলে। সে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।

‘ভাবী, অনেক পদ রান্নার বায়না আজকে।’
‘নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন, ভাবী।’
‘রাখি তো ভাবী।’

শানু হড়বড়িয়ে কবে পার্লারে গেছে তার ফিরিস্তি দেয়। রেহানা ঘুরে ঘুরে শানুর কুশিকাটার ফুল তোলা কাপড় দেখে। সাইড টেবিলের চেহারা বদলে গেছে। রেহানাকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে শানু খুশী হয়। একটা কিছুতে রেহানার মন ভরেছে।

‘আমি করেছি ভাবী। সুন্দর হয়েছে?’
‘খুব সুন্দর। আমাকে কয়েকটা করে দিয়েন তো ভাবী।’
‘ভাবী, এটাই নিয়ে যান। আবার বানিয়ে নিব।’

রেহানা সাথে সাথে কাপড়টা ভাঁজ করে ফেলে। শানুর কাছে চিনি চাইতে এসে লাভ হয়ে গেলো।
‘চা খেয়ে যান ভাবী। মশলা চা বানিয়েছি’।
‘নারে ভাবী, চিনি দেন। আমার তিন কেজি দুধের পায়েস পুড়ে ছাই হবে। ‘

রেহানা শানুর গা ঘেষে বলে, ‘আপনার ভাই আজকে অফিস যায়নি, বুঝলেন। বাসায় আছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে। এমন সুযোগ সবসময় আসে বলেন?’ শানু একটু অবাক হয়। স্বামী বাসায় এতে সুযোগের কি আছে। শানুর শূন্যদৃষ্টি দেখে রেহানা বোঝে, বোকা মহিলা কিছুই ধরতে পারেনি।

‘আপনার ছেলেপেলেরা বাতাসে বাড়ি খেয়ে হয়েছে নাকি ভাবী, কিছুই বোঝেন না দেখি। কাল রাতে আপনার ভাইকে সময় দিতে পারিনি। তাই, আজ অফিস কামাই করে রয়ে গেছে।’ রেহানা মুচকি মুচকি হাসে। ‘সুদে আসলে আদায় করে নেবে। যা সুন্দর একটা লাল নাইটি এনেছে না ভাবী! ওটা পরতে হবে। ওনার মন খুশী হবে না নইলে’।

শানুর নিয়ে আসার চিনির কৌটা উপুড় করে ঢেলে নেয় রেহানা। শানু বলতে চায়, একটু চিনি রাখেন ভাবী, চা খাবো। সেও বলতে পারে না। ‘ইয়ে ভাবী গুড়ো দুধ আছে নাকি?’ রেহানার সাথে এবার মিথ্যে বলে শানু। ‘ না ভাবী, শেষ’। গুড়ো দুধ ও যদি নিয়ে যায়, আবার আসিফের কাছে টাকা চাইতে হবে। বয়ামে বয়ামে খুঁজলে চিনি কোথাও মিলতে পারে। গুড়ো দুধ পাবে না। রেহানা চলে গেলে শানু আগে বসার ঘর গোছায়। গুছাতে লাগে দশ মিনিট। খুব বেশী সময় নয়। তবু, শানুর মনটা খারাপ হয়ে থাকে। রেহানা ভাবী অগোছালো ঘর দেখে গেলো। ওরাও বা কেমন! কাপড় গুলো জায়গা মতো রাখলে কি হয়। শানুর কি কষ্ট লাগে না? শানুর মনটা সত্যি সত্যি বেশ খারাপ হয়ে রইলো।

চা বানিয়ে চিনি খুঁজছে শানু। আতিপাতি দিয়েও কোন বয়ামে সামান্য একটু চিনি পাওয়া গেলো না। গুড় দিয়ে চা খেতে ইচ্ছে করছে না। আলেয়া আক্তারকে আসতে দেখে শানু পিড়ি গুছিয়ে ফেলে। শাশুড়ীর কাছে বকা খেতে চায় না। আলেয়া আক্তার আঁচলের নিচ থেকে একটা কাঁচের বয়াম শানুর দিকে এগিয়ে দেন।

‘ধরো। চিনি আছে। এটাও ঐ বাটপারটা আসলে দিয়ে দিও না। ‘
‘আম্মা, বাটপার কে?’
‘আর কে? তোমার চালাকের ঘরের অতি চালাক রেহানা বেগম। তোমাকে পেয়েছে একজন। যখন যা নাই, তাই এসে চাই।

শানু চিনি পেয়ে খুশী হয়ে গেছে। চায়ে চিনি মিশিয়ে আলেয়া আক্তারকে সাধতে গিয়ে জিভ কেটে ফেলে। চিনি সহ চা পেলে শাশুড়ী মজা করে খেয়ে নেবেন। তারপর, ডায়বেটিস বেড়ে বিছানায় পরে থাকবেন। শাশুড়ীর জন্য জিরোক্যাল দিয়ে আরেক কাপ চা বানায় শানু।

‘চা খান আম্মা। বেলা বিস্কুট দেই?’
‘আম ক’টা দাও। আম খাই। পরের সিজনে বাঁচি না মরি, ঠিক নাই।’

শানু হাসে। শাশুড়ী প্রতি আমের সিজনে এই কথা বলে আম খাবেন। কয়েকটা দিন ওনাকে নিয়ে নানা হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে৷ এই পরিবারের সব কাজ করতে কে আর আছে, শানু ছাড়া। কাশিফের বউ বিলের তিন ভাগের একভাগ দেবে। শানুর সে ক্ষমতা নাই। তার কাজ ঘর পরিষ্কার করা, সবার জন্য খাবার বানানো, সন্তান লালন -পালন করা, অসুখে বিসুখে সেবা যত্ন করা, সন্তানের পড়াশোনা করানো, বাড়ির বৃদ্ধদের যত্ন-আত্তি করা। এর বাদে শানুর আর কোন কাজ করার যোগ্যতা নেই।

গৃহিনী পরিচয় এমন কোন পরিচয় নয়। সে নামে স্বাধীন, কাজে পরাধীন। পরিবারের সবার চোখে যেটা প্রতিদিনের দরকারী তাই সকল সময়ের চরম অকার্যকর কাজ বলে বিবেচিত হওয়াটাই গৃহিনী জনমের মূল চর্চা। শানুর মাঝে মধ্যে মনে হয়, গৃহিনীদের অনেক দিক দিয়ে ছোট হয়ে থাকতে হয়। চা খেতে খেতে শানু চোখের কোনে জমে ওঠা চিকচিক বালুকণা জল লুকোয়। চা’টা খেতে ফার্স্ট ক্লাস হয়েছে। আলেয়া আক্তার শানুকে আরো একপ্রস্থ বকেন। মিশুটা এখনো আসেনি। আলেয়া বেগমের দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

শানু কচু বাটতে বসে। তার মনে হলো, কচু বাটার চেয়ে চাকরী করা সহজ। শানুর একটা চাকরী থাকলে সেও রোজ সুন্দর করে সেজেগুজে, লিপস্টিক মেখে গাড়ি চড়ে অফিস করতে পারতো।

(চলবে)