শানুর সংসার পর্ব-০৮

0
223

#শানুর_সংসার (৮) (১৮+)

অসময়ে ছেলের বউ আসায় বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললেন আলেয়া আক্তার। শানুর কোন আক্কেল নেই। পৃথিবীর লোক দুনিয়া চরিয়ে খেয়ে আঁটিখানা শানুর হাতে ধরিয়ে দিলে, শানু তাই খুশী মনে ব্যাগে করে নিয়ে আসবে। তারপর বাড়ি এনে সাবান দিয়ে ধুয়ে ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখবে। দরজা খুলে আলেয়া আক্তার একটা কথাও বলেন না। শানু ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। তারপর, ধপ করে সোফায় বসে পরে। আলেয়া আক্তার ফ্যানের স্পিড বাড়ান। সাধে কি আর বোকা বলেন! শুক্রবারে নিউমার্কেটের বিহারের পয়সা সরাতে উনি কড়া রোদে হেঁটে বাড়ি এসেছেন। রিকসা ভাড়া বাচাতে গিয়ে মাথার ঘিলু গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো,’ গাধা মেয়েছেলে’। শাশুড়ীর কথা শুনতে পেয়ে শানু বলে,

‘আম্মা, গাধা না গাধী৷ আপনি শিক্ষক মানুষ। লিঙ্গ ভুল করলে হবে?’
‘তোমার এর মধ্যে রস কমেনি।’
‘না আম্মা, আপনার দোকান দেখতে যাবো। মিশু স্কুল থেকে ফিরুক। ‘
‘বুয়া কাপড় না ধুয়ে চলে গেল। আবার দুপুরে আসবে।’
‘দুপুরে তো আমরা থাকব না, আম্মা। ‘
‘আসিফ এসে ভাত খাবে। তুমি কোথায় যাবা।’
‘ওকে বলে দেই, অফিসে কোথাও খেয়ে নিতে।’
‘বাসায় এসে খাবে। যাও, তুমি রান্না করো। ‘
‘আম্মা, এই বেলায় রান্না বসালেও হবে না। ‘
‘শানু, আজকে তুমি তর্ক জুড়লা কেনো।’

আলেয়া আক্তারের কথার উত্তর দেয় না শানু। রিমোট টেনে চ্যানেল ঘোরায়। টিভিতে ‘গু ড্ডি ‘ সিরিয়াল চলছে। অসহ্যকর একটা নাটক। বাপ মা অবৈধ সম্পর্কে ছিলো। আবার নায়ক মরে গিয়ে ডুপ্লিকেট ভূত হয়ে এসেছে। নায়িকার ডাবল রোল। মা আস্তে আস্তে কথা বললে, মেয়ে রোলার কোস্টারে চেপে বাক্য শেষ করে। শানুর টিভি দেখতে ভালো লাগছে না। আলেয়া আক্তার সরু চোখে শানুকে মাপছেন। কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। সেটা কি?

‘তোমার শরীর ঠিক আছে, শানু?’
‘আছে, আম্মা।’

শানু সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়। শাশুড়ীর সাথে বেশী কথা বললে সে বেশীক্ষণ মিথ্যে বলতে পারবে না। এর চে’ এখান থেকে চলে যাওয়া ভালো। শানু রান্নাঘরে গিয়ে চুলো ধরায়। বুয়া মাছ ভেজে রেখে গেছে। সবজি গুলো পানিতে ভিজিয়ে কাটতে বসলো শানু। এফ এম এ পুরনো দিনের গান বাজছে। রেজিও জকি অনুরোধের গান পাঠাতে বললে, শানু হাত মুছে এসএম এস করে, হাবিব ওয়াহিদের, ‘স্বপ্ন’ গান। আরজে শানুর প্রিয় গান প্লে করে একটু পরেই। চুলোয় তেল দিয়ে শানু গুনগুন করে গান গায়। আলেয়া আক্তার রান্নাঘরে এসে ঘুরে যান। শানু সকালে নাস্তা করেনি। খাবারের প্লেট এখনো টেবিলে ঢাকা পরে আছে। শানুর জন্যে প্লেট নিয়ে আসেন আলেয়া আক্তার।

‘খায়া নাও। কি বড়ি দিসো পেটে। বেলা কত হয়েছে খেয়াল রাখো?’
‘চা -সিঙারা খেয়েছি, আম্মা। না খাইনি, খাওয়ালো।’
‘কার সাথে খেলা। কই, আমার জন্য আনলানা।’
‘বাবুর সাথে। বিয়ের আগে পরিচিত ছিলাম।’
‘মানে? এই শানু তোমার মাথা ঠিক আছে?’

শানু ওপরে নিচে মাথা নাড়ায়। তার মাথা খুব ভালো করে কাজ করছে৷ পরিচিত লোকের সাথে দেখা হলে চা খেলে ধর্ম নষ্ট হয় না। ধর্ম নষ্ট হয় পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করে শুয়ে বসে এলে। আলোয়া আক্তার উত্তর না পেয়ে চলে যান। রান্না শেষে শানু গাছে পানি দেয়। চুলোয় ভাত টগবগিয়ে ফুটছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে শানু ক্লান্ত শালিক গোনে। এক, দুই, তিন, চার। চার শালিক দেখলে চিঠি আসে। শানুকে চিঠি লেখার কে আছে? কেউ না। দুপুর হয়ে এলে শানু হরিতকি আর আমলা ভেজানো পানিতে চুল ধুয়ে মেহেদী লাগায়। ফ্রিজ খুজে মিশুর জন্যে কিনে রাখা ক্যাডবেরি বের করে খায়। আলেয়া আক্তার আবার এসেছেন। শানুকে মেহেদী দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি আকাশ থেকে পরলেন।

‘এখন শুয়ে থাকার সময়, শানু?’
‘কি করবো, আম্মা। আপনার কিছু লাগলে বলেন। চা বানায় দিবো?’
‘তুমি তো বললা না, বাবু কে।’
‘বলছি আম্মা। পূর্বপরিচিত, জানাশোনা ছিলো। এখন মিশুর স্কুলে বাংলা পড়ায়। খুব সুন্দর ইসলামী বিষয় নিয়ে কথা বলে।’
‘মিশুর স্কুলে বাংলা পড়ানোর টিচার তোমারে কোথায় পেলো।’
‘স্কুলের সামনে, আম্মা। আমাদের পাড়ায় থাকতো। ‘

আলেয়া আক্তার আর কিছু বলার খুঁজে পান না। পাড়ার পরিচিতি ছেলের সাথে এক কাপ চা খাওয়া দোষের না। চাকরী করতে গিয়ে তিনিও কলিগদের সাথে ঘোরাঘুরি করেছেন। এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন।

‘আম্মা, আপনি বসেন। আমি চা করে আনি’।
‘আযান পরে গেছে। মিশু কখন আসবে।’
‘রাজু থাকবে সাথে, আম্মা।’
‘তুমি একগাদা নারকেল দিয়ে বারান্দা গুদাম ঘর বানায় রাখলা। কি করবা ওগুলো দিয়ে।’
‘রেহানা ভাবীর আত্মীয় স্বজন নাড়ুর বায়না দিয়েছে। ‘
‘সংসারের কাজ না করে এগুলা করলে হবে, শানু?’

শাশুড়ীর সাথে শানু কখনো শক্ত কথা বলে না। আজও বলতে পারলো না। নিরুত্তাপে নিরুত্তরে কেটে গেলো বেলা। শানু গোসল শেষে সুন্দর একটা শাড়ি পরলো। মেহেদী দেয়ায় চুল ঝরঝরে লাগছে। চোখে গাঢ় কাজল টেনে ঠোঁট রাঙালো শানু। তারপর ফোন বের করে ছবি তুলে ফেসবুকে আপ্লোড করলো ফেসবুকে। বাবুর সাথে দেখা হয়ে একটা ভালো কাজ হয়েছে৷ বাবু তাকে ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে দিলো। একাউন্টের খুটিনাটি বেশী বোঝাতে পারেনি বাবু, সময় হয়নি। মিশু শানুর মেয়ে জেনে যারপরনাই অবাক হয়েছে। শানুকে কথা দিলো, মিশুর খেয়াল রাখবে।বাবুর পরিবর্তন দেখে শানু আশ্চর্য হয়েছে। সেই দু একটা কথার ফাঁকে আপাদমস্তক চষে বেড়ানো বাবু আর আজকের বাবুর মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই বাবু কৌতুক করতে জানে। এই বাবু শরীরে শরীর না বসিয়ে সম্মানের সাথে মেয়েলোকের সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারে।

শানু ছবি দেয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় টুংটাং শব্দে বার্তা আসা শুরু হলো। প্রথমেই অনুরোধ করেছে, স্কুলের বান্ধবী রোজী। শানু তাকে গ্রগণ করতেই রোজীর সাথে সংযুক্ত সকলে শানুর তালিকায় চলে এলো কিছু সময়ের মাঝে। শানু শশা-টমাটো কাটতে কাটতে নীল আলোর দুনিয়ার আজব জগতের সাথে পরিচিত হয়। সেই কত বছর আগের বান্ধবীরা সবাই একে অপরের সাথে মিলমিশ করে আছে। শানুই এত বছর পর যোগ হলো। রোজী উদ্যোগী হয়ে শানুকে স্কুল -কলেজের ব্যাচ গ্রুপ চ্যাটে যোগ করে নিয়েছে। শানু ডাইনিং টেবিলে বসে গ্রুপ ম্যাসেজ পরে। বাবারে বাবা, একেক জনের কত সময়। একজন কিছু লেখার সাথে সাথে অন্যজন উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। শানু এদের ভেতর ক্লাসের সবচে’ সুন্দরী মেয়ে শিলাকে পেলো। বিশাল বড়লোকের বউ। সাউথ বাংলা ব্যাংক শিলার স্বামীর। শানু টেনে টেনে শিলার ছবি দেখে। কী সুখী সুখী মুখ করে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় শিলা। শানু ফোন উল্টে রাখে টেবিলে, তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করে। গ্রীল গলিয়ে দুটো তিনটে চড়ুই এসে বসেছে শিকের ওপর। বাটিতে রাখা চাল খুটে খেয়ে পানি খায়। শানু গাছের পাতার পরে ওদের লেজ তোলা নাচন দেখে। মিশুর এখন পাখির মতো নেচে বেড়াবার বয়স। উড়ে উড়ে আনন্দ নিয়ে বাঁচবার বয়স। আসিফ মেয়ের ভালো চায়। কোন বাবা মেয়ের খারাপ চাইবে না। স্বামীর কথা মনে হতে শানু গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদে। তার ঠিক বিশ্বাস হয় না, আসিফ এত বড় প্রতারণা করতে পারে। আচ্ছা, মেসেজটা আননোন নম্বর থেকে এসে ছিলো। আসিফের জন্য তো নাও হতে পারে। শানু কি আসিফকে মেসেজটা নিয়ে প্রশ্ন করবে? চোখ মুছে নাক টানে শানু। না থাক, এমনো তো হতে পারে, এই মেসেজটা অন্য কারো। ভুল করে আসিফের ফোনে চলে এসেছে।

চার শালিকের দেখা পেয়ে, শানুর কাছে খামবন্দী চিঠি এলো না সত্যি। তবে, ইনবক্স ভরে গেলো নতুন করে ফিরে পাওয়া পুরনো বান্ধবীদের বার্তায়। শানু ওদের এক এক করে উত্তর দেয়। সবার আগে বিয়ে হওয়া শানু এখন কেমন আছে, জানতে সবাই উদগ্রীব। ‘এত্ত এত্ত মনে রেখেছে ক্ষুদ্র শানুকে ওরা!’ মনের মেঘে একটু হলেও ভালো লাগার হাওয়া লাগে শানুর। নাহ, ও একদম ফেলনা, অকর্মন্য নয় তাহলে।

ভাইয়ের সাথে ঘরে ফিরে মিশু মায়ের কাছে চলে যায়। শানুর বুকে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকে। আজ পথে সেই বাজে ছেলেটা আসেনি। রাজু সময় মতো স্কুলের সামনে পৌছেছে। শানু মেয়ের মাথার বেনী খুলে চুলে হাত বোলায়।

‘সব লেখাপড়া হয়েছে?’
‘হুম’। ছোট্ট করে উত্তর করে মিশু।
‘তোদের যে নতুন স্যার এসেছে, বাংলা পড়ায়। কেমন উনি?’
‘ফারুক স্যার! খুউউউব ভালো। জানো মা! স্যারের না বাবা মা কেউ নেই। সবাই এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর স্যার ঐ রকম হয়ে গেছে।’
‘কি রকম হয়ে গেছে।’

শানু হেসে উঠে মেয়েকে প্রশ্ন করে। মিশু ও খুব হাসছে। মায়ের কোলে সব থেকে শান্তির স্থানে মিশুর নির্ভয় ও নির্ভার লাগে।

‘মা, তোমরা কি সত্যি বিশ্বাস করেছো, আমি কারো সাথে প্রেম করি না?’ মিশু মায়ের দুই হাতের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে জানতে চায়। শানু মিশুকে শক্ত করে বুকের মধ্যে টানে। মেয়েটা গায়ে বেড়ে উঠেছে, বয়সে ও মনে এখনো শিশুসুলভ আচরণে রয়ে গেছে। মিশু মায়ের গায়ের গন্ধ নেয়। আজকে মায়ের শরীর থেকে মিষ্টি মিষ্টি সুবাস আসছে।
‘তোকে আমি বিশ্বাস করি। রাজু করে, তোর দাদুও করে।’
‘বাবা করে না, তাই না?’

শানু থেমে যায়। আসিফকে সেই তো বিশ্বাস করতে পারছে না। মন দুলছে ঝড়ের আগে থম মেরে থাকা নদীর ওপর কোষা নৌকার ন্যায়। বাতাস ঘুরপাক খেয়ে নদীর বুকে ঝড় ঘণিয়ে তুলছে, আবার গুটিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল। মিশুকে হাসি মুখে কাপড় ছাড়তে বলে শানু। মিশুর মনে আসিফের প্রতি জমে ওঠা অভিমান শানু কাটাতে পারবে না। পিতা হয়ে তাকে এগিয়ে আসতে হবে, সন্তানের কাছে। শানু ঠিক করে, মিশুর বিষয়টা নিয়ে সে আসিফের সাথে কথা বলবে। দুপুরে আসিফ খেতে এলো না। শানু স্বামীর জন্যে টেবিলে খাবার গুছিয়ে শাশুড়ীর ঘরে যায়।

‘আম্মা, দোকানের কি হলো।’
‘কাশিফ ঠিক করে দিয়েছে। আগামী শুক্রবার মিলাদ পরায়ে দোকান চালু করবে।’
‘কিসের দোকান হবে আম্মা?’
‘কনফেকশনারি আর ঐ যে খাবার বেঁচে। কাশিফ বললো, এসব দোকানে ভাড়া বেশী উঠে। ‘
‘আপনি এত টাকা দিয়ে কি করবেন, আম্মা? বিদেশ ঘুরতে যাবেন?’

আলেয়া আক্তার শানুর কথার জবাব দেন না। শেষ বয়সে তার মাকে রাস্তায় বসে থাকতেন। আলেয়া আক্তার অফিস শেষে মায়ের বাসায় গিয়ে রান্না করে মাকে খাইয়ে তারপর বাড়ি ফিরতেন। এই নিয়েও আসিফের বাবার রাগের অন্ত ছিলো না। কৈফিয়ত দিতে দিতে আলেয়া আক্তার এক সময় বোবা হয়ে গেলেন। তবু, বুড়ো মাকে নিজের কাছে আনতে পারেননি। নিজের বৃদ্ধ বয়সকে তাই ভয় পান আলেয়া। কে জানে, তাকে ও যদি পথের লোকের কাছে হাত পাততে হয়। অমন অবস্থায় পৌছার আগে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। নিজের টাকা থাকা মানে খুঁটিতে জোর থাকা।

‘আমার বান্ধবীরা সব বিদেশ ঘুরতে যায় আম্মা। আমি যদি অনেক টাকা পেতাম, বেশী দূর না। নীলগিরি ঘুরতে যেতাম। তারপর যেতাম, কাশ্মির। আমি কোন দিন বরফ দেখিনি আম্মা। বরফের ওপর গড়িয়ে পরতে পরতে মুখের মধ্যে বরফ খেতাম। অত ঠান্ডায় মন শীতল হয়ে যেতো।’
‘তোমার মন ঠিক কি নিয়া অস্থির হয়ে আছে, বলো তো শানু?’
‘কিছু হয়নি, আম্মা। আমি ভালো আছি। ‘
‘শুক্রবারে কাশিফরা আসবে৷ আসিফরে বইলো ভালো বাজার করতে। ‘
‘ওর কি সময় হবে, আম্মা। কি কি রান্না হবে বলেন, আমি করে আনব।’
‘ভাইয়ে ভাইয়ে মিল নাই। আমি মরলে ঠিক খাটিয়া কাঁধে নেবে। দোকান নিয়া কুত্তা কামড়ায়া নিজেরা শহীদ হবে। তুমি দেখবা। বেশী ঝামেলা কে করবে জানো? তোমার স্বামী। পেটের ছেলেকে যদি চিনতে না পারি, আর কে পারবে।’

শানু আলেয়া আক্তারের কাছে এসে বসে। তার শাশুড়ী নিঃশব্দে কাঁদছে। শানুর খুব খারাপ লাগে। এই মুহূর্তে আলেয়া আক্তারের মন ভালো করার ক্ষমতা তার নেই। শানুর নিজেরই মন খাদে পরে আছে। ঐ অতল থেকে মন টেনে তুলে এনে তারে ভালো করার দায় কেউ নেবে না।
বিকেলে মেয়ে আর শাশুড়ীকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয় শানু। বিকেলের সবজীরা পড়ন্ত রোদের মতো নেতানো ও কমদামী। পেট ভরলেও মন ভরায় না৷ শানু বেছে বেছে দরদাম করে পেঁপে কেনে। আজ পেঁপের দর কম।
মিশু মাকে তাড়া দেয়। তার একগাদা হোমওয়ার্ক করা বাকি। শানু দেখে আলেয়া আক্তার কুশির কাজ করা বালিশ কভার দাম করছেন। শানু ওসব বুনতে পারে। আলেয়া আক্তারকে সে কথা বলতেই, তিনি সাফ না করেন,’সংসারের কাজ রেখে এত কিছু করার দরকার নেই।’ শানু একটা বালিশ কভার কিনে নেয়। স্যাম্পল থাকলো, অলস দুপুরে ভাত ঘুম বাদিয়ে কোন দিন করে নেয়া যাবে।

মিশু একটু এগিয়ে হাঁটছিলো। মিশু স্তনের ওপর ওড়না টেনে নামায়। আশপাশের পুরুষেরা জামার ফাঁক দিয়েই জেগে ওঠা সুপুরির মাঝে রস ছানতে ব্যস্ত। এদের কেউ সুযোগ পেলে মিশুর নরম স্তন চেপে তার সুখ নেবে। কচি শরীররে প্রতি নোংরা পুরুষের আকর্ষণ যুগের পর যুগ ধরে প্রমাণিত। মিশুর নিতম্বের দোলে, স্তনের গাঢ় অংশে কল্পনায় কলুষিত মস্তিষ্কের পথচারীরা হাতড়ে বেরায়। মিশু সব বোঝে। শরীরটাকে তার অচেনা ঠেকে, নিজেকে অশুচী লাগে। এই শরীরের পরিবর্তন না হলেই ভালো ছিলো।

মোটরসাইকেল নিয়ে দুটো উঠতি বয়সী কিশোর মিশুর পাশে পাশে চলছে। মিশুর অস্বস্তি হয়। পরক্ষণেই শানুকে ফিরে দেখে নেয় মিশু। মা ঠিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিশু সামনে ফিরে,তার চোখে আকাশ ঘণিয়ে নামা মেঘের ন্যায় একরাশ জল জমেছে। মা তাকে ভুল বুঝলো। মিশু এদের চেনে না। শানু মেয়ের কাছে এলে, সাইকেলটা সরে যায়। শানু দেখে মিশু উদগ্রীব হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে। মিশুর চেহারা বলে, সে ভয় পেয়েছে৷ শানু রাস্তার ওপর সবার সামনে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাঁটে। আলেয়া আক্তার পেছন থেকে একবার ডাকতে গিয়ে থেমে যান। ভাবেন, মা- মেয়ে চলছে, চলুক। আসিফকে তার কিছু বলতে ভয় লাগে। ছেলের কোথাও পরিবর্তন ঘটেছে। মায়ের চোখে ঠিক ধরা পরেও পরে না।

রাতে ফিরে আসিফ সোজা চলে আসে মায়ের রুমে। আলেয়া আক্তার খেয়ে শুয়ে পরেছেন। মিশু আজ দাদুর রুমে পড়তে বসেছে। আসিফ ঢুকতেই মিশু বই খাতা গুটিয়ে নিজের রুমে যেতে উদ্যত হলো।
‘স্কুলে গিয়েছো, মিশু’।
‘জি বাবা।’ মেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আসিফের মেজাজ চরম খারাপ হলো। বেয়াদব মেয়ে বাপের মুখের দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আসিফ বাজখাঁই গলায় শানুকে ডাকে৷ শানু বসে নারকেল কুরছিলো। চার দিন বাদেই একটা মুখে ভাতের অনুষ্ঠানের অর্ডার পেয়েছে, শানুর কুঁচো সন্দেশ আর তিলের নাড়ু। এই প্রথম এত বড় অর্ডার। রেহানা ভাবীর কাছ থেকে সময় নিয়েছে শানু। আগে এটা দিতে হবে। হাত মুছে শানু শাশুড়ীর রুমে যায়। আসিফ মিশুকে ধমকাচ্ছে। মিশু মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের মুঠো বন্ধ। পা দুটো একেরপর এক কেঁপে উঠছে। শক্ত শরীর নিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। শানু ঢুকে মিশুকে বলে,
‘তুই ঘরে যা।’
‘ঘরে যাবে মানে? আমি কথা বলছি, তুমি দেখতে পাও না? চোখ নষ্ট হয়ে গেছে?’

স্বামীর ধমক গায়ে মাখে না শানু। মেয়েকে আবার বলে,
‘ কি হলো? আমি যেতে বল্লাম না, যা! ‘

মিশু চলে যাবার সময় ঘরের দরজা দড়াম করে বাড়ি দিয়ে গেলো। আসিফ মারমুখো হয়ে উঠে দাঁড়ায়,
‘কত বড় সাহস, বদমায়েশ মেয়ে। বাপের মুখের ওপর আওয়াজ তুলে যায়। আজকে হাড় মাংস এক করে দেব৷ ‘
‘ বাবা হয়ে হাত তুলতে লজ্জা লাগা উচিত। বউকে যা মন চায় বলো। বালেগ মেয়ের শরীরে আমি আর একটা টোকাও তোমাকে দিতে দেবো না।’

রাজু এসে দাদুর রুমের দরজায় দাঁড়ালে আসিফ চুপ হয়ে যায়। এরা সবাই এক জোট হয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ করলো। শানু এত সাহস পেলো কোথা থেকে। ওর গলা আটকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মা শাসনে থাকলে ছেলে মেয়ের মনে ভয় থাকে। আসিফ শানুর রুমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

‘তুমি আমাকে অপমান করেছো, শানু।’
‘আমি অত ভয়শূন্য হলে কত কিছু করতে পারতাম। তোমাকে অপমান করিনি। মেয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। এভাবে চললে লেখাপড়া করতে পারবে না। ‘
‘না পারলে সমস্যা কি? তোমার বাবার মতো একটা ছেলের গলায় বোকা হাঁদা ঝুলিয়ে দেব। জিন্দেগীর মতো চিন্তা শেষ। খাবে আর ঘুমাবে। ‘

আসিফ কথা গুলো বলে পেছন ফিরে শুয়ে পরলো। মনে মনে যুৎসই জবাব দিতে পেরে সে দারুন খুশী। শানুর জগত খানখান হয়ে গুড়িয়ে দিতে পেরে আসিফ যারপরনাই আনন্দিত। মেয়েলোকের দম্ভ তার সংসার। যে সংসারে তার নূন্যতম দাম নেই, সেখানে সে এখন একদম চুপ করে যাবে। শানু আর কখনো গলা তুলে মুখ উঁচিয়ে আসিফের সাথে কথা বলতে পারবে না।

(চলবে)