শান্তি সমাবেশ পর্ব-০১

0
613

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১

হঠাৎ একটা বল এসে কপালে লাগতেই মাথা চেপে ধরে ক্যাম্পাসের মাঠেই বসে পরলো মৃত্তিকা। ভরা ভার্সিটির মাঠে হঠাৎ এহেন কান্ডে হতবাক সবাই। মৃত্তিকার বন্ধু বান্ধবী’রা ই তারাতাড়ি ওকে ধরলো। ক্যাম্পাসের উত্তর দিকেই খেলার মাঠ। কোন এক সপ্তাহিক ম্যাচ চলছিলো সেখান থেকেই বলটা এসে লেগেছে। মৃত্তিকার কপাল ফেটে ততক্ষণে র*ক্ত বয়ে যাচ্ছে। বন্ধু বান্ধবী’রা ওকে ধরে বসে আছে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না কারণ মৃত্তিকা সেন্স হারা হওয়ার উপক্রম। সিনিয়ররাও দাঁড়িয়ে দেখছে কতজন। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো লম্বা চওড়া এক সুদর্শন যুবক। তীব্র গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। এই যুবকে দেখেই আশে পাশের থেকে আরো বেশ কিছু জন এগুলো। পূর্ণ ভাই এগিয়ে এসেছে তারা যদি না এগিয়ে আসে তাহলে কি হয়? উহু মোটেও না। বর্তমানের ছাত্রলীগের সভাপতি সে। পূর্ণ হাটু গেড়ে ধুলামাখা মাঠে বসে পরলো। অস্থির তার চিত্ত। ব্যাস্ত হাতে নিজের কোলে মাথাটা তুলে নিলো মৃত্তিকার। অস্থির কন্ঠে গালে হাত দিয়ে আলত চাপড় মে’রে ডাকতে লাগলো,

— মৃত্ত! এই মৃত্ত!

মৃত্তিকার চোখ তখন নিভু নিভু। র*ক্ত মেয়েটা সহ্য করতে পারে না। পূর্ণ মৃত্তিকার কপালে নিজের রুমালটা চেপে ধরতেই সেটা রঞ্জিত হয়ে উঠলো লালে। চিৎকার করে পূর্ণ বলে উঠলো,

— ওই পানি দে। পানি আন তারাতাড়ি।

কথাগুলো যেন গলায় আটকে চলছে। কম্পিত হাতে মৃত্তিকার মাথাটা একটু উঁচু করে বুকে চেপে ধরলো। তখনই তড়িঘড়ি করে কয়েকজন পানি আনলো। পূর্ণ ততক্ষণে মৃত্তিকা’কে কোলে তুলে নিয়েছে। অত্যান্ত বিচক্ষণ ছেলেটা যেন এখন অবুঝ হয়ে উঠলো। বাকিদের সাহায্য ধরে ভার্সিটির ডক্টরের চেম্বারে নেয়া হলো। মৃত্তিকা তখন পুরোটাই সেন্সলেস। পূর্ণ তখন পাগল পাগল অবস্থা। সবসময়ের গোছালো, পরিপাটি, বিচক্ষণ আর সল্প ভাসী সিনিয়র ভাইকে এভাবে দেখে আজ সবাই অবাক হলো। পূর্ণর সেদিকে খেয়াল কই? সে তো তার মৃত্ত’র অচেতন চেহারা দেখতে ব্যাস্ত।
.
মৃত্তিকা এবার ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারের মাইক্রোবায়োলজির স্টুডেন্ট। সাদা সিদা একটা মেয়ে। আহামরি সুন্দর করে তার বর্ননা করার মতো কিছুই নেই। না তেমন ফর্সা, না তেমন লম্বা আর নাই একবারে পছন্দ করার মতো। অথচ মায়াবী একটা ভাবখানা সর্বদা চেহারা ঘিরে। এক দেখায় পছন্দ না হলেও একদেখায় তাকে মায়াবীনি উপাধি দিতে কেউ ভুলবে না। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। প্রচন্ড ভীতু স্বভাবের এই মেয়ে যার প্রমাণ সরুপ পূর্ণ নিজে।

অন্যদিকে পূর্ণ এবার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করছে। লাস্ট ইয়ার। ছাত্রলীগের সভাপতি সে। কলেজ থেকেই নিজেকে রাজনৈতিক কাজে নিয়জিত করেছে সে। সুদর্শন, লম্বাটে এই ছেলেকে কে না পছন্দ করবে। মারাত্মক সুন্দর তার ব্যাবহার অথচ কথা বলে খুবই কম। এত বছরে যেখানে কোন মেয়ের সাথে জরায় নি সেখানে এই বছরের ফাস্ট সেমিস্টারের অন্য ডিপার্টমেন্টের এক মেয়েকে দেখেই বুকের বা পাশে কিছু একটা হয়েছিলো।

প্রথম সামনা সামনি দেখাটা হয়েছিলো লিফ্টে। কোন এক কারণেই মাইক্রো বায়োলজির ডিপার্টমেন্টে আসা হয়েছিলো পূর্ণর। সেখানেই দেখা পায় এই মায়াবী মেয়েটার। অস্থির হয় তার চিত্ত। সবসময়ের শান্ত ছেলেটা যেন বড্ড অশান্ত হয়ে উঠেছিলো। জ্বালাময় এক অনুভূতির ছোঁয়া পেয়েছিলো সে।

জুনিয়র এক ছেলেকে দিয়ে ডাক পাঠায় মৃত্তিকা’কে। সেই ডাক শুনতেই মেয়েটার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কাউকে সাথে নেয়ারও সুযোগ হয় নি কারণ ছেলেটা বলেছিলো একা যেতে। মৃত্তিকার ভয় ছিলো নিশ্চিত সিনিয়র ভাই ওকে রেগ দিবে। ভয়ে ভয়ে বলা জায়গাতে উপস্থিত হয় ও। এদিক ওদিক চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে অথচ ভিতর ভিতর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছিলো ওর৷ ওর হাটু কাঁপার দৃশ্য আজও পূর্ণ’র চোখের কোটরে ভাসে। মিনমিন করে মৃত্তিকা আল্লাহ’কে ডেকেই যাচ্ছিলো। মনে মনে পরছিলো,
” লা ইলাহা ইন্না আনতা সুবহানা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জলিমিন”
ও বিরবির করে পড়লেও পূর্ণ কানে ঠিকই ডুকেছিলো সেই শব্দ। ওকে দেখার আগেই যে মেয়ের এই অবস্থা সে পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলবে কিভাবে?

পূর্ণ দীর্ঘ দৃষ্টি মেলে তাকালো মৃত্তিকার দিকে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে গম্ভীর পুরুষের কন্ঠ কানে এলো মৃত্তিকার।

— কি ব্যাপার মৃত্ত এভাবে কাঁপছেন কেন?

“মৃত্ত” শব্দটা কর্ণে ধাক্কা খেলো বারকয়েক মৃত্তিকার কানে। এভাবে আজ পর্যন্ত কেউ এতটা সম্মোহনী ভাবে ওকে ডাকে নি। ডাকলেও মনে নেই। এই কন্ঠের মালিকের দিকে তাকাতেই মৃত্তিকা যেন শক খেলো। স্বয়ং পূর্ণ দাঁড়িয়ে। মৃত্তিকা জ্ঞান হারানোর উপক্রম। এই গভীর দৃষ্টি’তে সে নিজের জন্য কিছু একটা দেখেছিলো সেদিন। হঠাৎ ই হাটু কাঁপা বেড়েছিলো। পূর্ণ চিন্তিত কন্ঠে বলেছিলো,

— মৃত্ত কুল ডাউন। হোয়াট’স রং ইউথ ইউ?

মৃত্তিকার কাঁপুনি বুঝি থামে? চঞ্চল পায়ে ঔ জায়গা ত্যাগ করতে গিয়ে ধাম করে হোচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পূর্ণ এতসবে আশ্চর্যজনক ভাবে তাকিয়ে। এই মেয়ে একা একাই সব করলো। পরক্ষণেই মৃত্তিকার কান্নার শব্দে পূর্ণ তারাতাড়ি ওকে ধরলো। উঠাতেই দেখলো দাঁতের মাড়ি দিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বট গাছের ওখানক বাঁধাই করা জায়গায় ওকে বসালো। এতক্ষণ যেই মেয়ে ওর কন্ঠ শুনেই পগারপার হয়ে গিয়েছিলো এখন সে তার ছোঁয়াতেও খেয়াল করলো না। নিজের মতো কাঁদছে। পূর্ণ ইশারায় কাউকে পানি আনতে বললেই একজন দৌড়ে এসে পানি দিয়ে যায়। সেটা দিয়েই পূর্ণ ওকে কুলি করিয়ে ব্যাস্ত হাতে অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে মৃত্তিকার কানে গুজে দিয়ে বলেছিলো,

— চুলগুলো আটকে রাখা যায় না মৃত্ত। আই ডোন্ট লাইক ইট। চুল যেন এরপর থেকে বাঁধা পাই। ওকে?

মৃত্তিকা কি আর তা শুনে? কেঁদেছে আধ ঘন্টা অথচ ব্যাথা কমেছে তার দশ মিনিটেই। ঐ যে বলে না মনের সুখে কান্না সেটাই কেঁদেছিলো মেয়েটা।
.
ঐ ঘটনার পর প্রায় সপ্তাহখানিক ভার্সিটিতে নিজের পদ ধুলি দেয় নি মৃত্তিকা। ভেবেছে এতে হয়তো পূর্ণ ভাই নামক সেই লোক ওকে ভুলে যাবে অথচ হলো পুরো উল্টোটা। এই এক সপ্তাহ পূর্ণ মৃত্তিকার ক্লাসের দুই সি.আর’কে প্রায় নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। কেন তার মৃত্ত আসছে না? তাদের দিয়ে দিনে পাঁচ ছয় বার করে কল করাতো। মৃত্তিকা প্রায় বাধ্য হয়েই ভার্সিটি এসেছিলো অথচ জানতোই না কে তাদের দিয়ে কল করাতো।
.
ব্রেক টাইমে লাইব্রেরি’তে বসে নোটস করছিলো মৃত্তিকা। এক সপ্তাহে যা যা মিস গিয়েছিলো সেগুলো। হঠাৎ খেয়াল করলো একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরি থেকে। মৃত্তিকা অবাক হলেও তেমন ভাবলো না। ও ভাবতে বাধ্য হলো যখন পেছনে তাকালো কারণ পুরোটা লাইব্রেরি ফাঁকা। আশ্চর্যে ভ্রু কুচকে উঠলো ওর। বুকে হাতে গুজে বুক টান টান করে বড় একটা সেল্ফে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণ। ছেলেটা আজকে হালকা মিন্ট রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে সাথে হোয়াইট জিন্স। সবসময়ের মতো গোছালো চুল আর খাড়া নাক। এত সুন্দর পুরুষকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো করে চমকালো মৃত্তিকা। ঝটপট নিজের ব্যাগে ভরতে লাগলো কলম আর নোট খাতাগুলো। এখানে থাকা আর জমের সামনে থাকা একই কথা। তারাহুরোতে মেয়েটা নিজের পানির বোতল ফেলে দিলো। ঝুঁকে যে উঠাবে সেই সাহসটুকুর ও বড্ড অভাব। পানির বোতল থেকে অবশ্যই জান প্রিয় তার। উঠে যেতে নিলেই গম্ভীর কণ্ঠে হুমকি শুনা ছিলো। রাশ ভারী গলায় পূর্ণ বলে উঠলো,

— নিজের জায়গায় বসুন মৃত্ত।

ইশ! এই ডাক। “মৃত্ত”! কে বলেছে এভাবে ডাকতে? কি দরকার এই নামে ডাকার? মৃত্তিকা’র রুহ কাঁপে এমন ডাকে। দিক হারা হয় সে। ভয়ে কম্পন ধরে বক্ষপটে। কথা আটকে আসে কন্ঠনালীতে। নিজের ব্যাগটা বুকে চেপে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো ও। পূর্ণ’র সরু কপালে তখন ভাজ দেখা গেলো। দৃশ্যমান হলো কপালের রগ। এই মেয়ে এতটা সাহস কোথায় পেলো যে পূর্ণ’র কথায় এখনও না বসে দাঁড়িয়ে আছে? রাশ ভারী গলায় দ্বিতীয় বারের মতো আবারও শুনা গেলো,

— আপনাকে বসতে বলেছি আমি মৃত্ত। এক কথা বারবার বলাটা পছন্দ নয় আমার।

ধপ করে বসে পরলো মৃত্তিকা। শক্ত হয়ে ছিলো একদম। না মাথা ঘুরালো আর নাই নজর তুলে তাকালো। পূর্ণ পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে সেটাতে বসলো। দূরত্ব রাখলো বটে। একেবারে কাছাকাছি বসলে এই মেয়ে আবার কাঁপা-কাঁপি শুরু করবে। মৃত্তিকা’র দিকে একবার গভীর চাহনি দিয়ে কিছুটা নরম কন্ঠে ডাকলো,

— মৃত্ত?

মৃত্তিকা ভয় পেলো। এতটা নরম স্বরে ডাকার কারণ কি? ঢোক গিললো বারকয়েক। সাহসে তখনও কুলায় নি যে তাকিয়ে একপলক দেখবে মানুষটাকে। আদ্র গলায় আবারও ডাক পরলো,

— তাকাবেন না মৃত্ত?

এবার আর মুখ না তুলে পারলো না মৃত্তিকা। কতক্ষণ এভাবে থাকবে? এই সিনিয়র ভাই’য়ের ডাক যে কেন উপেক্ষা করতে পারে না তা ও নিজেই বুঝতে অক্ষম। মাথা তুলে একপলক দেখেই আবার তা নামিয়ে নিলো। পূর্ণ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— এতদিন না আসার কারণ কি? অসুস্থ তো ছিলেন না মৃত্ত। তাহলে?

গেলো তো ফেঁসে মৃত্তিকা। কি বলবে এখন যে আপনার জন্যই আসিনি? এটা বললে আবার থাপ্পড় টাপ্পড় না মে’রে দেয়? মৃত্তিকা’কে চুপ করে হাত মুচড়াতে দেখেই পূর্ণ বুঝলো কিছুটা। কারণ টা নিশ্চিত সে নিজেই। এবার কিছুটা শরীর ঝাঁকালো পূর্ণ। একহাত দিয়ে টেনে আনলো মৃত্তিকা সমেত চেয়ার। রাখলো নিজের কাছাকাছি। মৃত্তিকা ভয়ে সিটিয়ে গেলো। তাকালো ভীতু নজরে। সেই ভীতু চাহনী দেখেই যেন গলে যায় পূর্ণ। রাগটা সহজেই গিলে ফেলে। নিজের উপরই অবাক হলো সে রাগ তো এত সহজে গলবার নয়? তাহলে আজ কেন? এই মৃত্ত’র জন্য? হবে হয় তো।
সকল ভাবনা বাদ দিয়ে পূর্ণ বলে উঠলো,

— আপনি তো অবুঝ নয় মৃত্ত। কিছুটা হলেও আন্দাজ করার বোঁধশক্তি আছে আপনার। আমার থেকে লুকিয়ে ছিলেন? সেটা কি সম্ভব? না আপনি এই ভার্সিটি ছাড়তে পারবেন আর না এখান থেকে যাচ্ছি। তাই ঐ সকল চিন্তা বাদ দিন।

মৃত্তিকা মাথা দুলালো। মানে সে ঐ সকল চিন্তা বাদ দিয়েছে। পূর্ণ হাসলো অধর কাঁমড়ে। তার মৃত্ত বুঝেছে। ভেঙে না বললে এই নারী বুঝতে পারে না। পূর্ণ এবার মোলায়েম স্বরে বললো,

— আমি আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছি না মৃত্ত। আমি বিয়ে করব আপনাকে। ভালোলাগে আপনাকে। বলতে পারেন ভালেবাসি। আশা করি আপনিও বাসবেন। আমি তো দেখতে খারাপ না। আর বলবেন বেকার? সেটাও নয়। মাস শেষে দলের থেকে প্লাস কোচিং সেন্টার মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো ইনকাম করি। বউ পালতে পারব। চিন্তা নেই মাস্টার্স শেষেই চাকরিতে জয়ন হব। এই ভার্সিটিতেই ট্রেইনার হিসেবে চেয়ারম্যান স্যার জয়েন হতে বলেছিলেন। পরে অন্য জবে ডুকব। আর কি কিছু জানার আছে মৃত্ত?

মৃত্তিকা কি বলবে? কাকে বলবে? এই লোক তো প্রেম না বিয়ে’র প্রস্তাব দিলো। কাজ কর্ম, টাকাপয়সা, ফিউচার প্ল্যান সব বললো। মৃত্তিকা কি বলবে? বলবে যে আপনার এই রাজনীতি ই আমার পছন্দ নয়? চাইলো বলতে কিন্তু পূর্ণ’র সেই সুশ্রী চেহারার দিকে তাকিয়ে আর বলা হয় নি।
.
এই তো সেই থেকে কিছুটা আড়ালে থাকে মৃত্তিকা। আর পূর্ণ সেও কম কিসের? একদম লোক পাঠিয়ে ডেকে পাঠায় তার মৃত্ত। ভীতু মৃত্তিকাও গরমে ঘামতে ঘামতে বুকে বই নিয়ে হাজির হয় পূর্ণ’র সামনে। পূর্ণ নিজের মতো কথা বলে অথচ ছেলেটা ছিলো সর্বদা সল্প ভাষী। এই মেয়ে’র সানিধ্য পেয়েই সে এখন কথা বলে এতটা। হাজার ব্যাস্ততার ভীরে সময় বের করে দেখা করে তার মৃত্ত’র সাথে। মৃত্তিকা শুধু হু হা করেই শেষ। নিজ থেকে একটা শব্দ ও সে ব্যায় করে না।

আজও দেখা করতেই যাচ্ছিলো পথিমধ্যে এই দুর্ঘটনা হলো। মাথায় আঘাতটা হয়তো ভালোই পেয়েছে।
মৃত্তিকার চোখের পাতা নড়ছে। জ্ঞান ফিরছে বোঁধহয়। বিধ্বস্ত পূর্ণের তখন রক্তজবার ন্যায় চোখজোড়া। কি নিদারুণ কম্পন তার বলিষ্ঠ পেশিতে। আশে পাশের মানুষ টের পেল বুঝি। এমন শক্ত পোক্ত পেটানো শরীর ওয়ালা পূর্ণ ভাইকে এভাবে কি আগে কখনো দেখেছে কেউ? সবাই তো তাকে দেখেছে ডান্ডা হাতে লোক পিটাতে। মিছিল, সমাবেশে হকি স্টিল ভাঙতে মানুষের পিঠে। কিন্তু কখনো কেউ বলতে পারবে না পূর্ণ ভাই খারাপ পথে চলে বা খারাপ কাজে জড়িত। ছেলেটা নিতান্ত ভদ্র। চোখ তুলে খুব কমই তাকাবে সে। লোকে বলে রাজনীতি করা নেতারা চরিত্রহীন থাকে। নারীবাজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন নারী স্বাদে নিজেকে মাতিয়ে রাখে। প্রত্যেক রজনীতে তাদের নতুন সঙ্গ চাই। নতুন চাহিদা পূরণের জন্য নতুন নতুন ভোগ পন্য চাই। এমনটা বলার ও যথাসাধ্য কারণ আছে। লোকে যা দেখে তা ই বলে। কিন্তু পূর্ণ’কে আজ পর্যন্ত সেসব কোন স্থানে দেখা যায় নি। ছেলেটা আসলেই ভিন্ন। ফকফকা উপন্যাসের পাতার ন্যায় খোলা জীবনি তার। কোন লুকোচুরি নেই। নারী ঘটিত কোন ব্যাপার নেই।
কিন্তু ইতিহাস আজ বদলালো বলে। এক কান দুই কান হতে হতে ছড়িয়েই গেলো ব্যাপারটা।
“পূর্ন ভাই ফাস্ট ইয়ারের মেয়ে ধরেছে।” নারী ঘটিত ব্যাপার স্যাপার। ছড়িয়ে গেলো বাতাসের বেগে। এতদিন আগে পড়ে দেখলেও কেউ বলার সাহস পায় নি। আজ পেয়েই গেলো যেন। হাতে নাতে ধরেছে সবাই। ফাঁটা চোখে দেখেছে কীভাবে এত বড় সিনিয়র ভাই ফাস্ট ইয়ারের এক মেয়ের জন্য উতলা হয়ে ছিলো। কিভাবে বুকে চেপে পাগল পাগল আচরণ করছিলো।

মৃত্তিকা চোখ খুলেতেই দেখলো পূর্ণ’কে। পূর্ণ চোখ ঘুরালো। ইশারায় জায়গা খালি করতে বললো। সবাই যেতেই এতক্ষণে শান্ত ছেলেটা অশান্ত হলো। খসখসা হাতের তালু দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তার মৃত্ত’র নরম নরম গাল। এই প্রথম এমন স্পর্শ পেলো মৃত্তিকা। রুহে কাঁপন ধরেছে তার। ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। পূর্ণ ব্যাস্ত হলো। নিশ্চিত ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার মৃত্ত। ভাঙা গলায় শব্দ টেনে বের করলো,

— মৃত্ত? অনেক কষ্ট হচ্ছে?

— ছাড়ুন।

ঝট করে হাত সরিয়ে ফেললো পূর্ণ। এতটা কাছে কখন এলো সে? মৃত্ত কি তাকে খারাপ ভাবলো? সে তো নিজেও জানে না এতটা কাছে কখন এলো সে। ঢোক গিলে ধাতস্থ করলো নিজেকে। কন্ঠে দৃঢ়তা ঢেলে বললো,

— আপনি জ্ঞান হারিয়েছিলে মৃত্ত। তাই এতটা কাছে আসা। নিজেও বুঝতে পারি নি। দুঃখীত। খারাপ ভাববেন না দয়াকরে মৃত্ত। দুনিয়া আমাকে খারাপ ভাবলেও আমার যায় আসে না। শুধু আপনি খারাপ ভাববেন না দয়াকরে।

মৃত্তিকা ভাবুক হয়ে পরে। এত কেন আকুল হয়ে যায় পূর্ণ ভাই? কি আছে মৃত্তিকার? এই শ্যামলা রঙের দেহ। কিছু ছোট বড় কোঁকড়া চুল। আর কি? বিশেষ তো কিছুই নেই। তাহলে কোথা থেকে আসে পূর্ণের এতটা আকর্ষণ তার প্রতি?
পূর্ণ’র কথাতে মৃত্তিকার ধ্যান ভাঙলো। পূর্ণ মৃত্তিকার বান্ধবী’কে ডাকলো। তার মেডিসিনের প্রেসক্রিপশনটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো,

— আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি। ওনার কাছে থাক।

মেয়েটা শুধু মাথা নাড়ালো। ভয় পায় কেন জানি। সবাই অবশ্য এই ভয়টা পায় অথচ পূর্ণ কারো সাথে উচ্চবাক্য ব্যবহার করে না।পূর্ণ যেতে নিলেই দুর্বল কন্ঠে মৃত্তিকা বলে উঠলো,

— লাগবে না মেডিসিন। আমি বাসায় যেয়ে পেইন কিলার নিয়ে নিব।

পূর্ণ শান্ত চাহনি দিলো। ব্যাস মৃত্তিকা চুপ। এই সিনিয়ন ভাইয়ের চাহনি যে ওর সহ্য হয় না। বুক কাঁপানো চাহনী তার। পাঁজরের হাড়ে ব্যাথা ধরানো চাহনী। মিঠা মিঠা অনুভূতি হলো মৃত্তিকার। তবে কি মৃত্তিকা ও ভালেবাসায় পা পিছলে পড়লো? কিছু কি তারও হলো? নাকি বসন্তের বাতাসের ন্যায় একবার ধরা দিয়েই লুপ্ত হবে এই অনুভূতি?

চলবে।