শান্তি_সমাবেশ পর্ব-০২

0
424

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২

— আপনি রাজনীতি ছাড়ুন নাহয় আমাকে।

— যদি কোনটাই না ছাড়ি?

— একই হাতে ফুল আর কাঁটা মানাবে না।

— আমি মানিয়ে নিব। সেই কাঁটার আঁচড় আমি আমার ফুলে লাগতে দিব না। কসম আমার সৃষ্টিকর্তার।

— আম…আমি….

কেঁদে ফেললো দূর্বল হৃদয়ের যুবতী। ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো পূর্ন। ধরবে না আজ সে। কঠিন কথা হজম করে উঠতে পারে নি সে এখনও। কিভাবে করবে তার মৃত্ত তাকে রাজনীতি ছাড়তে বলে এটা কি সম্ভব? আবার মৃত্ত’কে ছাড়াও অসম্ভব। তাহলে মধ্যম পন্থা কি?
হাজার চেয়েও নিজেকে দমাতে পারলো না পূর্ণ। পারলো না নরম শ্যামলা রমণীর সামনে নিজেকে কঠর রাখতে। বট গাছের গোড়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাছে এলো কিছুটা। একবার চাইলো হাতটা ধরবে আবার ভাবলো মৃত যদি খারাপ ভাবে? তাই সেই চিন্তা বাদ। দৃঢ় কন্ঠে শুনা গেলো,

— আমি আপনার কান্না শুনতে এসেছি মৃত্ত? নাকি আপনি কান্না শুনাতে এসেছেন?

মৃত্তিকা থামলো যেন কাঁদতেও ভয় পায় সে। পূর্ণ কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলে উঠলো,

— সম্মান আর ভয় আলাদা মৃত্ত। আপনি আমাকে কোনটা করেন?

মৃত্তিকা খুঁজে পেলো না উত্তর। কারণ ও ভয় পায় পূর্ণ’কে। যেই সেই ভয় না হাঁটু কাঁপানো ভয় পায় সে। “সম্মান” এটাও না করে এমন না। পূর্ণ ভাই মানুষটাই এমন। তাকে দেখলেই মন চায় সম্মানের সহিত একটা সালাম দেই। মৃত্তিকা’কে চুপ থাকতে দেখে কিছুটা ধমকে উঠলো পূর্ণ।

— কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে?

— স….সম্মান করি।

মাথা নিচু করে এতটুকুই জানালো মৃত্তিকা। পূর্ণ’র চোয়াল শক্ত হলো। মিথ্যা সহ্য হয় না তার। মনে পরলো গত মাসের কথা। শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,

— গত মাসে ভার্সিটির বাইরে তিনটা হকি ভেঙেছি দুই জনের পিঠে। রাস্তায় সবার সামনে তাদের দিয়ে ঝাড়ু দিয়েছি। কারণ কি জানেন মৃত্ত?

মৃত্তিকা জানে না সেই কারণ। তাই নীচু করা মাথাটা নাড়ালো। গম্ভীর কণ্ঠে পূর্ণ বললো,

— আমার নাম ভাঙিয়ে ফুটপাত থেকে টাকা তুলে। যেই না ধরলাম অস্বীকার করলো। বলুন তো একেতো মিথ্যা সহ্য হয় না আমার। একেবারে বদহজম হয় মিথ্যা কথা। সেখানে দুইজন আমার দেখা সত্যকে মিথ্যা বলে। যদি ঐ দিন সত্যি বলতো তাহলে শুধু ঝাড়ু দেয়াতাম মা’র টা খেয়েছে মিথ্যা বলার জন্য। আই হেট লাই মৃত্ত।

লাস্টের কথাটা ছিলো উচ্চ স্বরে। ছিটকে সরে গেল মৃত্তিকা। বুক কাঁপছে তখনও। পূর্ণ সচকিত নয়নে তাকালো। এখানে তার মৃত্ত’র জায়গায় অন্য কেউ হলে এই মিথ্যার জন্য তার কপালে শনি ঘটাতো পূর্ণ। কথা যেখানে তার মৃত্ত’র সেখানে পূর্ণ’কে খু*ন করলেও তা মাফ। পূর্ণ এগিয়ে এসে হাত বাড়াতেই পিছালো মৃত্তিকা। ধমক কাজে লেগেছে। ভয় পেয়েছে এই ভীতু রমণী। পূর্ণ সেটাই চেয়েছিলো। মৃত্তিকা’কে সরতে দেখে বললো,

— ব্যাগ দিন আপনার।

মৃত্তিকা’র মতিভ্রম হলো। ভ্রমের মাঝেই নিজের টোট ব্যাগটা দিয়ে দিলো পূর্ণ’কে। পূর্ণ কোন সংকোচ ছাড়াই ব্যাগ খুলে হাতরিয়ে পানির বোতল বের করে ছিপি খুললো। এক ঢোক নিজে গিলে গলা ভেজালো অতঃপর তা এগিয়ে দিয়ে আদেশ করলো,

— পানি খান। ঘেমে যাচ্ছেন তো মৃত্ত। এদিকে আসুন। গাছের নিচে।

মৃত্তিকা’কে নড়তে না দেখে ধমক দিলো একটা। মৃত্তিকা কিছুটা দৌড়ে এসে বসলো বটগাছের গোড়ায়। পূর্ণ বাঁকা হাসলো। ও জানে ওর হাবাগোবা মৃত্ত কিছুই বুঝে নি। তাই নিজেও দূরত্ব রেখে পাশে বসলো। বোতল এগিয়ে দিতেই এবার গটগট করে পানি পান করছে মৃত্তিকা যেন জন্ম জন্মাতের পিপাসিত সে। পূর্ণ বোতলের ছিপিটা আটকে তা আবারও মৃত্তিকার ব্যাগে ভরে ফেরত দিলো। বুকে ব্যাগ চেপে বসে রইলো মৃত্তিকা। এখনও বুঝে উঠতে পারছে না ধমক খেলো কেন? পূর্ণ বুঝে তার মৃত্ত’র না বলা কথা। তাই সরস গলায় বললো,

— আপনি আমাকে ভয় পান মৃত্ত। সেটা আমি জানি। তাহলে কেন মিথ্যা বললেন যে সম্মান করেন?

মৃত্তিকা জিহ্বায় কাঁমড় দিলো। ইশ! পূর্ণ ভাই যে চালাক আর মৃত্তিকা হলো একটা গাঁধা। নরম গলায় আপরাধের সুর ঢেলে বললো,

— দুটোই করি। সত্যি বলছি।

— সত্যি?

সন্দিহান গলায় বললো পূর্ণ অথচ ঠোঁটের কোণে তার লুকায়িত হাসি যা অগচড়ে মৃত্তিকার। হবেই তো। এই নারী তাকায় নাকি পূর্ণ’র চোখে? মৃত্তিকা চটপটে গলায় বললো,

— তিন সত্যি।

হাসিটা দীর্ঘ হয়েও মিলিয়ে গেলো। পূর্ণ সহজে হাসে না। আজও নাহয় হাসিটা অগচড়ে থাকুক। মৃত্তিকা ওকে বিশ্বাস করানোর জন্য আবারও বলে উঠলো,

— আপনি কি বিশ্বাস করেন নি?

— করেছি মৃত্ত।

মৃত্তিকা শ্বাস নিলো। মহৎ একটা জটিল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পেরেছে সে। পূর্ণ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— মাথায় ব্যাথা আছে এখনও?

— কমেছে।

— এর মানে আছে।

মৃত্তিকা চুপ রইলো। মুহূর্তটাকে অনুভব করার চেষ্টা করলো। এই তো নতুন একটা কাঁচ মিঠা অনুভূতি তার। আয়ু এর দুই দিন। প্রচন্ড সাহস লাগে এই অনুভূতি অনুভব করতে। এতই সোজা বুঝি এই সিনিয়র ভাইয়ের পাশে বসে থাকা।
.

দুই দিন আগে কপালে ব্যান্ডেজ নিয়েই খড়া কাঠ ফাটা রোদে এই ক্যাম্পাসের মাঠে বটগাছের গোড়ায় হাজির হয়েছিলো মৃত্তিকা। রোজ পূর্ণ ওর আগেই হাজির থাকে এখানে কিন্তু ঐ দিন আসে নি। গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছিলো মৃত্তিকা তবুও অপেক্ষা করেছে।নিশ্চিত পূর্ণ ভাই আসবে। রোজ আসে দেখা দিতে। টুকটাক কথা বলে। মৃত্তিকা শুধু শুনে। কোন এক অদৃশ্য টানেই এসেছিলো সে। আধ ঘন্টা পরও যখন পূর্ণ এলো না তখন ছটফট করেছিলো তার বুকের বা পাশের সেই কালচে খয়রি রঙের হৃদপিণ্ডটা। চোখে জমেছিলো অভিমানের পানি। কিছুটা ভয় কিছুটা জড়তা মেশানো নাম না জানা প্রেমারোগ যখন ওকে হানা দিলো তখন যেন দিক হারালো মেয়েটা। প্রেমত্তাপে পুড়লো বুঝি তার তনু মন। তার সেই হু হু করা খড়া রোদে’র দাবাদাহ কমাতে হাজির হয়েছিলো ওর চক্ষু শীতলকারী। তাপ শোষণকারী। ব্যাথা মোচনকারী। পূর্ণ কিছুটা হাঁপাচ্ছিলো। ও ভেবেছিলো ওর নাজুক মৃত্ত হয়তো এক সপ্তাহ আর আসবে না। কিন্তু কে জানতো পরদিনই আসবে? আসবে তো আসবে পূর্ণ’র জন্য অপেক্ষা করবে? মনের গহীনে লুকিয়ে কেউ যেন খবর দিলো পূর্ণ’কে যে তার মৃত্ত ও গললো। ভালোলাগা থেকেই তো ভালেবাসা। প্রেম থেকেই প্রেমোত্তাপ। তার থেকেই তো জ্বালা। প্রেমের উত্তাপে জ্বালাময়ী জ্বালা।

কেউ একজন পূর্ণ’কে জানিয়েছিলো যে মৃত্তিকা’কে আধ ঘন্টা আগে বট গাছের গোড়ায় দেখেছে সেটা শুনেই ছুটে এসেছিলো পূর্ণ। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিটা তখন পিঠে সেটে ছিলো। কুনুই পর্যন্ত গুটানো থাকায় দৃশ্যমান ছিলো তার লোমশ বাহু। মৃত্তিকা গলেছিলো। একদম ঠান্ডা পানি হয়েছিলো৷ টের পেয়েছিলো পূর্ণ কিছু বলে নি। বুঝুক এই নারী প্রেম কি। জ্বলুক না একটু। মন্দ হবে কি? দোষ হবে তাতে?
পূর্ণ শুধু ব্যাস্ত কন্ঠে বলেছিলো,

— আজ কেন আসলেন মৃত্ত? দেখুন কি অবস্থা গরমে আপনার?

— আর আসব না?

মাথা নিচু করে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই পূর্ণ’র মনে তীব্র গরমে শীতলতা অনুভব হলো। মৃত্ত আসতে চায়? পূর্ণ’র সানিধ্য চায়? হ্যাঁ চায় ই তো নাহলে গতকাল ভালোই ব্যাথা পেয়েছে তাও কেন আজ দেখা করতে এখানে অপেক্ষা করছিলো সে? কিছু প্রেমের অঙ্কুরোদম হয়েছিলো তার মৃত্ত’র যা বুঝতে বেগ পেতে হয় নি পূর্ণ’র। সেদিন ই প্রথম বারের মতো মৃত্তিকা’কে নিয়ে লাঞ্চ করে পূর্ণ কারণ দুপুরের মেসিডিন ছিলো মৃত্তিকার। একপ্রকার জোরই করেছিলো পূর্ণ। মৃত্তিকা আর না করার সাহস যোগাতে পারে নি। মৃত্তিকা যখন আঙুলের মাঝে খাবারের দানা তুলছিলো। যখন মুখ নাড়িয়ে চিবুচ্ছিলো। যখন অবাধ্য চুলগুলো বা হাতে সরিয়ে কেমন গুটিয়ে বসে খাচ্ছিলো তখন তা উপভোগ করেছিলো পূর্ণ। দেখেছিলো প্রাণ ভরে। ইশ! সেই পিপাসা কি এত সহজে মিটে? না মিটে না। পূর্ণ’র ও মিটে নি। মিটবে না। আমৃত্যু থেকে যাবে। কবে নিজের ঘড়ে তুলবে সে তার মৃত্ত’কে? অপেক্ষা টা আর কত হবে? খুব বেশি দীর্ঘ হবে এই অপেক্ষা নাকি মৃত্ত’কে পেয়ে যাবে এক ঝলকায়?

ওর চিন্তার মাঝেই মৃত্তিকা খাওয়া শেষ করে। পূর্ণ মেডিসিন এগিয়ে দিতেই তা খেয়ে নেয়। ঠোঁট কাঁমড়ে মাথা নাড়ায় পূর্ণ। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। এতসব ধরা বাঁধা নিয়মের কি খুব বেশি দরকার ছিলো? একটু ছুঁয়ে দেখাও যেন আকাশ সম চাওয়া হয়ে দাঁড়ায়।
.

সেদিন থেকেই কিছুটা কথা বলে মৃত্তিকা। যেমন আজ বললো। পুরো ভার্সিটি জুড়ে তাদের সমালোচনা চলে তাতে পূর্ণ’র কোন যায় আসে না। পূর্ণ’র সামনে বলার সাধ্য নেই কারো। মৃত্তিকা চুপচাপ শুনে যায়। কাউকে কিছু বলে না। পূর্ণ ভাই নামক সিনিয়র ভাই তার পছন্দ। ভালোলাগে। কিছু প্রজাতির উঁড়ে বেড়ায় পেটে যখন সে গভীর ভাবে ভাবে। সেই দিন শেষে বাঁধা একটাই। “রাজনীতি”। ভয়,জড়তা,কিছুটা বাঁকা চোখে দেখে মৃত্তিকা এই পেশাকে। কেন জানি ভয় হয়। আবার মনে হয় এসব ভালো লোকে করে না তাই তো আজ সারাদিন সাহস জুগিয়ে কথাটা বলেছিলো পূর্ণ’কে। কিন্তু পূর্ণ’র কথায় এটা নিশ্চিত সে রাজনীতি ছাড়বে না। তাহলে কি সে তার মৃত্ত ছেড়ে দিবে? ভাবতেই কান্না পায় মৃত্তিকা’র।

সহসা পাশ থেকে শুনা গেলো পূর্ণ’র আওয়াজ শুনা গেলো। ফোন রেখে ভরা চোখে তাকালো। মৃত্তিকার হাবভাব দেখে বললো,

— রাজনীতি আমার শিরায় উপশিরায় র*ক্তে মিশে আছে মৃত্ত। ছাড়তে পারব না।

— আমাকে? ছেড়ে দিবেন?

— আপনার জান’টা না নিয়ে নিবে এই পূর্ণ। কলিজা ছোট করুণ মৃত্ত। এই কথা যেন দ্বিতীয় বার এই ছোট্ট জিহবা দিয়ে আর বের না হয়।

কথাগুলো ছিলো শান্ত স্বরে অথচ তেঁজ ছিলো ভরপুর। পারলে যে পূর্ণ থাপ্পড়িয়ে দিতো এটা বেশ বুঝতে পারলো মৃত্তিকা। এখন তো মনে হচ্ছে ও ফেঁসে গেলো কোন এক শিকলে। বাঁধা পরলো অদৃশ্য খাঁচায়। মুক্তি কি মিলবে? নাকি এই রাজনৈতিক নেতা’র কবলে নিজেকে সমর্পণ করবে মৃত্তিকা?

#চলবে…..