#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০(বর্ধিতাংশ)
সময় নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔষধ। যত সময় যাবে যত গভীর ঘা ই হোক না কেন তা শুকিয়ে যাবে।কিন্তু সাফারাতের ক্ষেত্রে তা হলো উল্টো। ছেলেটা মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। রাত বিরাতে সেই বিভৎস স্বপ্নটা দেখতো। যেখানে দেখা যেত হিজল গাছটার নিচে তার রুহা শুয়ে আছে। পাগল সাফারাত রাত হলেই পালিয়ে যেত বাসা থেকে। ওর মা ছেলেকে দেখতে রুমে যেতেই দেখেন সাফারাত নেই। বারকয়েক রাত বলে ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। বিচলিত হয়ে যখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন তখনই রুম থেকে শোয়েব মির্জা ও বেরিয়ে এলো। না সাফারাত নেই। সারা বাড়ীতে তার অস্তিত্ব নেই। ভয় পেয়ে যান শোয়েব মির্জা। ছেলেটা তার ঠিক নেই। বড্ড অনুশোচনায় ভুগেন তিনি। সেদিন যখন সাফারাত’কে বাসায় আনা হলো তখন সে পাগলের মতো বাবা’র পা ধরে কাঁদে,
— আব্বু আব্বু আমার বার্ড একা ছিলো না। আমার বাচ্চা ছিলো ওর পেটে। আব্বু আমার সন্তান ছিলো। আমার আর রুহা’র সন্তান ছিলো ওর পেটে। ও কোথায় আব্বু? ওকে এনে দাও।আর কোনদিন কিছু চাইব না। সত্যি বলছি। আমার কলিজাটা’র পেটে আমার বাচ্চা আব্বু। ও আম্মু বলো না আব্বু’কে।
শোয়েব মির্জা থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কি বলে এটা তার ছেলে? ঐ মেয়ের পেটে কি না তার বংশের র*ক্ত? ঢোক গিলেন তিনি। ঐ পেটে লাথি মে’রেই তো তিনি মেয়েটাকে ফেলেছিলেন রাস্তায়। দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না শোয়েব মির্জা। ধপ করে বসে পরেন ছেলের পাশে৷ তার বুকেও খুবই সুক্ষ্ম কিছু একটা বিঁধেছিলো যা ছিলো লোকচক্ষু আড়াল।
সেই থেকে শোয়েব মির্জা কিছুটা বিচলিত ছেলে নিয়ে। ইদানীং পাগলামি বেশি করে। ছেলেকে না পেয়ে তার স্ত্রী জ্ঞান হারায়। শোয়েব মির্জা শক্ত করে তাকে বুকে চেপে ধরে। চোখ তার ও জ্বালা করছে। চিন্তায় ঘাম তার ও ছুটেছে। বুয়াদের কাছে প্রিয়তমা’কে রেখে ছেলের খোঁজে ছুটেন শোয়েব মির্জা।
মানুষ লাগিয়েও যখন কাজ হলো না তখন কিছু একটা ভেবে তিনি যান ঐ জঙ্গলটায়। তার ধারণা ঠিক। ওখানেই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সাফারাত ডাকছে,
— রুহা? জান আমার? বের হও। পালাতে হবে না কলিজা? উঠো। আমার বাবু খাবে। জান না তুমি পালাতে হবে। আব্বু’র লোক এলে আমাকে ধরে ফেলবে তো। বের হও।
শোয়েব মির্জা’র বা চোখ গলিয়ে এক ফোঁটা অনুতাপ পরলো। তার ছেলেটা যে আর সুস্থ নেই তা তিনি বুঝেন। মাটি খুঁড়ে গর্তের ভেতর মুখ দিয়ে ডেকেই চলছে সে।
পা চালিয়ে এসে ছেলেকে ঝাপ্টে ধরেন তিনি। এক পলক বাবা’কে দেখেই জ্ঞান হারায় সাফারাত।
অতঃপর কিছু ঠিক হলো না। সাফারাত হয়ে উঠলো বদ্ধ পাগল। একরাতে মায়ের কাছে এসে চুপ করে ডাকতে লাগলো। ওর মা ধরফরিয়ে উঠতেই সাফারাত বলে,
— আম্মু। আমি পালাচ্ছি তুমি ভয় পেও না তোমাকেও নিয়ে যাব। চলো দরজাটা খুলে দাও।
ফ্যালফ্যাল করে ছেলেকে দেখেন তিনি। আজকাল তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সুঠাম দেহের লম্বাটে, সাস্থবান পুরুষটা তখন পাগল। রাত বিরাতে পালায় সে। সবাই জন্য দিন বদলে ভিন্ন দিনের সূচনা হলেও সাফারাত আটকে ছিলো সেই কালো রাতে।
শিকল পড়ানো অবস্থায়ও শুধু কাঁদতো আর বলতে থাকতো,
— আমাকে ছাড়ো। আম্মু? আম্মু আমি রুহা অপেক্ষা করছে। পালাতে হবে আমাদের।
একপ্রকার বাধ্য হয়েই ছেলেকে পুণরায় কানাডা পাঠায় শোয়েব মির্জা। দেশে শুধু তাকে শিকল পড়িয়ে রাখা হতো। ওখানেই পরবর্তীতে তার চিকিৎসা চলে। আদৌ সে সম্পূর্ণ সুস্থ কি না জানা নেই কারো।
ছেলের শোকে শোকাহত ওর মা অসুস্থ হয়ে পরেন। শোয়েব মির্জা চেয়েও কিছু করতে পারেন না। তার ভালোবাসার মানুষটা অভিমান করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। কত রাত অসুস্থ স্ত্রী’র পা ধরে শুয়ে থাকতেন তিনি তার ইয়াত্তা নেই। ভালোবাসা তার ছেলের ছিনিয়ে নিলেও নিজ ভালোবাসা, এত বছর যার সাথে সংসার করলেন তার নিকট হতে এহেন আচরণ যখন কুঁড়ে খাচ্ছিলো শোয়েব মির্জা’কে তখনই হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তিটা তিনি পেয়েছিলেন। সাফারাতের মা ছেলের অপেক্ষায় সদর দরজায় বসে থাকতেন। কি মনে করে বারবার ছেলের রুমে যেতেন। গেছানো রুমটা আবার গুছাতেন। কাঁদতেন। বছর গড়াতেই কান্নাটা ও থেমে যায় তার। পাথরে পরিণত হন তিনি।
এমপির বউ যে কিনা স্বামী’র অসুবিধা হবে বলে বাবা’র বাড়ী যেতেন না সেই তখন সংসার নিয়ে উদাসীন। বুয়াদের দখলে তার সখের রান্নাঘর অথচ শোয়েব মির্জা কখনো বউয়ের রান্না খেতে পারেন না। আভিজাত্য তার সর্বাঙ্গে সেই সখের নারীটাই একদিন ছেড়ে চলে গেল শোয়েব মির্জা’কে। মৃত্যুর রাতটায় স্বামী’র বুকেই ছিলেন। সকালে তো শোয়েব মির্জা বুঝলোই না তার প্রিয়তমা যে তাকে ছেড়ে গিয়েছেন। যখন আদর করে ডাকলেন,
— সোনাপাখি উঠবে না? রাতকে আজ ভিডিও কলে দেখা যাবে। পাখি?
তখনই যখন হাতটা গালে রাখেন শোয়েব মির্জা খেয়াল করেন গালটা ঠান্ডা। না শুধু ঠান্ডা না বরং বরফের খন্ড। যা বুঝার তিনি বুঝেন তবে মন মানে না। বুকে চেপে ধরেন প্রাণহীন দেহটাকে। কাঁদেন না। অধিক শোকে তখন পাথর তিনি। সারামুখে চুমু খেয়ে ডাকেন,
— বউ?
সাড়া আসে না। তিনি আদর মিশ্রিত কন্ঠে পুনরায় ডাকেন,
— সোনাপাখি আমি ভয় পাচ্ছি। দেখো তোমার শোয়েব কিন্তু ভয় পাচ্ছে। উঠো না। প্লিজ এমনটা করো না। আমার ভয় হচ্ছে।
তার ভয়টা কমাতে তার প্রিয়তমা তার উষ্ণ বুকে মুখ লাগালো না। না সাড়া দিলো। একসময় যখন তিনি লা*শটা কোলে নিয়ে বের হন তিনি। বুয়ারা সহ সবাই আঁতকে উঠে। শোয়েব মির্জা ধীর কন্ঠে শুধায়,
— ও চলে গিয়েছে। মাহিন?
মাহিন মিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলেন,
— জ..জ্বি স্যার।
— ওকে কি করব? কোথায় রাখব? ও চলে গিয়েছে আমাকে একা রেখে। দেখো কতটা রাগ তার আমার প্রতি। কথা হয়েছিলো গতরাতে। আমি বললাম সব ঠিক করে দিব। সুযোগটাই দিলো না।
তার কাছ থেকে ছাড়ানো গেলো না তার প্রিয়তমা’কে। ডাক্তার আনা হলো। হসপিটালের রিপোর্ট হতে জানা গেলো দীর্ঘ বছর পর পুণরায় সন্তান সম্ভবা ছিলেন শোয়েব মির্জা’র স্ত্রী। এই তো আড়াই মাসের একটা ভ্রুণ ছিলো তার মাঝে। খবরটা যখন শোয়েব মির্জা জানলেন ভাঙলেন ঠিক তখন। প্রকৃতি কি বদলা নিলো? নিলোই তো। ভয়ংকর রকমের প্রতিশোধ নিলো এই প্রকৃতি।
.
বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটিতে খালি পায়ে হেঁটে বাড়ীর পেছন আসেন শোয়েব মির্জা। কবরটার কাছে গিয়ে বসে মাথা এলিয়ে দেন পায়ের দিকে। এরপর মাঝখানে। তার কানে বাজে, কেউ তাকে আদো আদো বলুতে ডাকছে,”আব্বু”। হ্যাঁ তার এবং স্ত্রী’র দ্বিতীয় সন্তান ডাকতো থাকে। কানে শুনেন শোয়েব মির্জা। আচ্ছা তার প্রিয়তমা কি জানতো এই খবর?জানলে না খুশিতে পাগল হয়ে কাঁদতেন? ভেবে পান না শোয়েব মির্জা, দ্বিতীয় বাবা বাবা সুখটা এই মধ্যে বয়সে কেমনটা অনুভূতির জোয়ার আনত।
শাস্তির কি কিছু বাকি ছিলো নাকি সবটা প্রকৃতি ফেরত দিলো?
#চলবে…..