শান্তি সমাবেশ পর্ব-৪০

0
327

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০
[পর্বটা একটু সেনসেটিভ। বুঝে শুনে পড়বেন।]

রাত তখন তিনটা হবে। বাইরে ঘন কুয়াশাতে আচ্ছন্ন। ঠান্ডায় বাবা’র বুকে বিড়াল সেজে বসেছে মৃত্তিকা। দুইজনই ঘুম। হাতের অল্প ব্যাথায় মৃন্ময় হাওলাদারে ঘুম কিছুটা আলগা হয়ে আসে। এই ঘনঘটা রাতে কলিং বেলের শব্দটা বেশ জোড়ালো শুনালো। কপালে ভাজ পরলেও তা চটজলদিই মিলে গেলো তার। এই সময়ে কলিং বেল বেজেছে। কে এসেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই৷ ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো তা সাইলেন্ট করা তাই হয়তো কল এলেও শব্দ শুনা যায় নি৷ পুণরায় তিনি ব্যাক করলেন। ওমনিই মিঠি’র মা জানালো,

— পূর্ণ আব্বু এসেছে।

— আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। ঠিক আছে তো?

— মনে হচ্ছে না। এক হাতে হয়তো বোঁধ পাচ্ছে না। ড্রয়িং রুমে বসা।

— আচ্ছা পাঠাও রুমে।

ফোনটা কাটার ঠিক মিনিট দুই এক পরই নক না করে পূর্ণ ঢুকলো। অগোছালো সদ্য হওয়া এমপি’র এহেন দশায় করুনা হয় মৃন্ময় হাওলাদারের। উঠে বসতে চাইলেই পূর্ণ’র কাতর কন্ঠ শুনায়,

— আব্বু আমি কাউচে শুই?

কি নিদারুণ আকুলতার মিশ্রণ ঘটিত আবদার। মৃন্ময় হাওলাদার কি তা ফেলতে পারেন? মোটেও না। একবার বলতে চাইলেই, ‘আমি অন্য রুমে যাই তুমি থাকো এখানে’ কিন্তু মেয়ের লোভটা ও ছাড়তে পারলেন না। এখন নড়লেই মৃত্তিকা’র ঘুমটা ভাঙবে। কোনমতেই সেটা মৃন্ময় হাওলাদার হতে দিবেন না৷ তার রাজকন্যা’র ঘুম আজ এমনিতেই দেড়ীতে হয়েছে, এখন উঠলেই মাথা ব্যাথা হবে। অল্প হেসে মৃন্ময় হাওলাদার সম্মতি দিতেই পূর্ণ ধপ করে কাউচে শুয়ে পরে। ছেলেটা নিশ্চিত এত ধকল সামলে আজ ক্লান্ত তাই তো গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে তলালো।
মেয়ে বুকে খাটে বাবা স্বামী তার কাউচে। বড্ড আদুরে এই দৃশ্যটা। কোথায় ই বা দেখা যায় এমন উন্মুক্ত চিন্তাধার ঘেরা দৃশ্য? হোকটা সেটা কৃত্রিম তবুও সুন্দর।
.
সাফারাত আজ ঘুমাতে পারলো না। পূর্ণ’র সাথে আজ প্রায় তিন ঘন্টা ছিলো। ছেলেটা আগের পূর্ণ নেই। সেই নরম মনটা ও নেই। কঠিনতার খোলসে নিজেকে আবৃত করে রাখে এখন অথচ আগে সাফারাত আর পূর্ণ দু’জনই ছিলো দু’জনের নিকট খোলা পুস্তক যাতে আজকাল ধুলা জমেছে। সাফারাতের জানা নেই কিভাবে পরিষ্কার করবে সেই ধুলো।
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ও আজকাল আসে না তার। হাহাকার করে উঠে ওর বুকের ভেতর। যদিও সস্তি সে কিছুটা সময় পায়। ফোনটা বাজতেই সেটা কানে ধরে সাফারাত। ভেসে আসে নারী কন্ঠ। সাফারাত ক্লান্ত স্বরে জানায়,

— আই ওয়ান্ট টু ডাই এঞ্জেল।

অপর পাশ থেকে কিছু শুনা যায় এতেই হাসে সাফারাত। ফোনটা কেটে ডুব দেয় অতীতে।

~হাজার চেয়েও যেতে পারে নি সাফারাত পরদিন তার রুহা’র নিকট। তার সন্তানের নিকট। কিন্তু তার মা’র কাছে থেকে জানতে পেরেছিলো রুহা’র সাথে কথা বলেছে ওর বাবা৷

রুহা’কে ফোনে দেখা করতে বলে শোয়েব মির্জা এবং সতর্ক করে যাতে কাউকে না বলা বিষয়টা। সেদিন রাতেই রুহা রাতে হোটেল থেকে বের হয়ে লুকিয়ে একাই দেখা করতে যায় শোয়েব মির্জা’র সাথে। শোয়েব মির্জা প্রথমেই ঠান্ডা মাথায় কথা বলেন,

— দেখো মেয়ে, সরি মাশরুহা ওয়াহাজ। রাইট?

মাথা নিচু করেই রুহা বলে,

— জ্বি স্যার।

— আমার ছেলেকে ভুলে যাও। তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে। কি পাবে আমার ছেলে থেকে। নতুন ভাবে সবটা শুরু করো। আমি হয়তো মেনে নিতাম কিন্তু আমি শাজাহান খান’কে ওয়াদা দিয়েছি তার বড় মেয়ের সাথে সাফারাতে’র বিয়ে আগামী কাল। গতকাল হলুদ হয়েছে। নিশ্চিত আর কিছু বুঝাতে হবে না তোমায়। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী তুমি।

মাশরুহা অবাক হয়ে বলে উঠলো,

— আমি সাফারাত বিবাহিত।

— সেটা কোন বিয়ে নয়।

— কেন নয়। আমরা মসজিদে গিয়ে বিয়ে করেছি। হালল সম্পর্ক আমাদের। আমার মাঝে সাফারাতের…

ওকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই ধমকে উঠে শোয়েব মির্জা,

— চুপ থাকো মেয়ে। টাকা দিয়ে তোমাকে সরানো যাবে না জানি সেটা। কি চাও বলো? আচ্ছা লেটস মেইক এ কনট্যাক্ট। তুমি সাফারাতের বউ রইলে। প্রথম বউ। বছরে এক মাস তোমার কাছে থাকবে ও। বাকি এগারো মাস দেশে। আমার পদটা পরবর্তীতে ও ই সামলাবে। তোমার ভরণ পোষণ দায়িত্ব আমার। কথা হলো ঝামেলা বাধিয়ো না এখন। মাথা গরম আছে। শুধু মাত্র আমার স্ত্রী’র জন্য এইটুকু অধিকার দিলাম তোমায়।

— আপনার ছেলের রক্ষিতা হতে বলছেন? বছরে এক মাস তার সাথে থাকব?

— যেটা ভাব তাই। ওয়ার্ডটা কিন্তু তুমিই উচ্চারণ করলে প্রথম। রক্ষিতাই তো নাহলে কিভাবে অচেনা এক ছেলের সাথে রাত কাটাও বেয়াদব মেয়ে!

হুংকার ছেড়ে কথাগুলো বলেন শোয়েব মির্জা। মাশরুহা থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে। এত ভয়ংকর কারো গর্জন হয়? তবে দৃঢ়তার সাথে জানাতে চায় সে সন্তান সম্ভবা কিন্তু সুযোগ মিলে না। গর্জে উঠে শোয়েব মির্জা,

— হয় মানো নাহয় রাস্তা মাপো। তোমার মতো কিট আসবে যাবে। নেতাদের কাছে এসব কোন ব্যাপার ই না।

— যদি না মানি কেনটাই?

— শেষ পরিণতির জন্য দায়ী তুমি নিজে হবে মাশরুহা ওয়াহাজ।

এবারে বেশ ঠান্ডা গলার স্বর শোয়েব মির্জা’র। মাশরুহা এবার তেঁজী গলায় প্রতিবাদ করে,

— আমি একা কিছু করি নি। রাত লাভস মি। হি ইজ নট এ হাসব্যান্ড নাও। আ’ম প…

এবারেও ওকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে দেয় না শোয়েব মির্জা। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মস্তিষ্ক সাথে জেঁকে ধরা ক্ষমতার লোভ। নেশা চাড়া দেয় তার মাথায়। এমনিতেও আসার আগে শাজাহান খানের সাথে কয়েক প্যাগ গিলা হয়েছিলো। তাতে অবশ্য নেশা হয় নি তার। রাগে চোয়াল চেপে ধরে সে মাশরুহা’র। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

— লাস্ট চান্স মাশরুহা। গো ব্যাক। আ’ম প্রমিসিং ইউ, সব ধরনের সাহায্য পাবে। রাত ও যাবে তোমার কাছে। এখন দূরে থাক।

— থাকব না। রাত আমার হাসব্যান্ড।

কথাটা বলতে দেড়ী গালে থাপ্পড় পরতে দেড়ী হয় না। সব সময়ের এক রোখা, জেদী মেয়েটা যে কিনা সবাই’কে নিজ কথায় রাজি করাতো আজ তার জেদ পাত্তা দেয়া হলো না। মাঝ রাতে খালি রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সে। পেটে চাপ লাগতেই এক হাতে পেট চেপে ধরে। সাড়ে তিনমাস চলে তার। বাচ্চাটা ব্যাথা পেলো বুঝি? শোয়েব মির্জা হুংকার ছেড়ে ডাকে,

— মাহিন!

মাহিন মিয়া দৌড়ে আসেন। শোয়েব মির্জা ঠান্ডা মাথায় বলে,

— এর এমন ব্যাবস্থা করো যাতে ভুলে যায় রাত নামে কেউ ছিলো তার জীবনে।

কথাটা বলতেই দশ এগারো জনের মতো যুবকের আগমন হয়। তাদের দৃষ্টি দেখেই ঘাবড়ে যায় মাশরুহা। তারা যখন রুহা’র দিকে আগাচ্ছিলো ভয়ে শোয়েব মির্জা’র পা ঝাপ্টে ধরে কেঁদে ফেলে মাশরুহা। আকুল আবেদন জানায়,

— আঙ্কেল এমন করবেন না। আমি রাত’কে অনেক ভালোবাসি। ও…ও আমাকে ভালোবাসে। বাঁচবে না আমাকে ছাড়া। প্লিজ!

শোয়েব মির্জা নিজের পা ছাড়াতে লাথি বসায় রুহা’র পেটে। অসহ্য ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে বাবা-মা, ভাইয়ের আদরের বোনটা। শোয়েব মির্জা চলে যান। পেছনে কয়েকজন মিলে ঘন জঙ্গলটাতে টেনে নেয় মাশরুহা’কে। মাহিন মিয়া’র কানে ভেসে আসে বিভৎস চিৎকার। রীতিমতো তার হাতে,পায়ে কাঁপন ধরে যায়। বুঝতে বাকি রয় না কি করা হচ্ছে মেয়েটার সাথে। ঘনঘটা রাতে নিশাচর পাখিগুলো ও যেন ভয় পেলো। এক ঝাপ্টা বাদুর উড়ে গেলো বড় হিজল গাছের উপরে। সেই হিজল গাছটা শুধু রয়ে গেলো সাক্ষী। একজন ভালোবাসার কাঙালীর ভালোবাসা নামক পাপ করার শাস্তি সরুপ পেলো এগারো জন পুরুষের অপবিত্র ছোঁয়া। নিস্তেজ দেহটাকেই একসময় মাটি চাপা দেয়া হলো অথচ স্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দ শুনা যাচ্ছিলো। জীবিত দেহটাকে মাটি চাপা দিয়ে নেশায় বুদ ছেলেগুলো একে একে বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। কতটা বিকৃত মস্তিক! কতটা ভয়ানক এদের চাহিদা। মাহিন মিয়া ওদের সামনে টাকার পাঁচটি বান্ডেল ছুঁড়ে দিয়ে এক দলা থুতু ফেলে চলে যায় গাড়ির নিকট। একসময় জায়গাটা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। একদম শান্ত। অথচ কিছুক্ষণ আগেই এখানে দুটি প্রাণের স্পন্দন বন্ধ করা হয়েছিলো।
.
রোজকার ন্যায় সূর্য উদয় হলো তবে তেজ নেই বললেই হলো। পূর্ণ খাবার হাতে মাশরুহা’র দরজায় নক করতেই দেখলো তা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। এদিক ওদিক খুঁজে ও লাভ হলো না। কোন গতিই পাওয়া গেলো না। ওর মা-বাবা ততক্ষণে ভেঙে পড়েছিলো। সাফারাতের দেয়া লোকশনে পৌঁছানোর প্রায় মিনিট বাদ চাদরে মুড়ে গায়ে শেরওয়ানি পড়া সাফারাত আসে। পূর্ণ’র দিকে তাকিয়েই বলে,

— বার্ড কোথায়? গাড়িতে? চল তারাতাড়ি। পালিয়ে এসেছি আমি।

— আপি’কে পাচ্ছি না রাত।

সাফারাতের কপালে ভাজ দেখা গেলো। পূর্ণ সিরিয়াস মুহুর্তেও রুহা’কে আপি ডাকে না। আজ কি হলো? পূর্ণ ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রুহা’কে অথচ তাদের রাস্তার পাশে জঙ্গলের ভেতর হিজল গাছটার নিচেই চাপা আছে মাশরুহা। এতটা নিকট হয়েও আজ সে বহুদূর।
.
কেটে যায় দুই দিন। পাগল সবাই। এমনকি শোয়েব মির্জা নিজেও। সাফারাত পাগল হয়ে গিয়েছে দুই দিনে। বিয়ে সে করে নি বরং বিয়ের আসরে বাবা’র উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো। পায়ে ধরে কেঁদেছিলো। লাভ হয় নি। বিয়েটাও হয় নি। টানা দুই দিন পর মাশরুহা’র লোকেশন ট্রেস করা হয়৷ তার পকেটেই তার ফোনটা ছিলো৷ রাত তখন নয়টা হবে। একদিকে ছুটে পূর্ণ অন্যদিকে সাফারাত। সাফারাত পৌছালো আগেই। লোকেশন কাছে অথচ নেই তার রুহা’র অস্তিত্ব। একসময় হিজল গাছটার নিচে ফোনটা পাওয়া গেলো। সাফারাত গলা ফাটিয়ে ডাকে,

— জান! রুহা! কলিজা বেরিয়ে এসো। আমি এসেছি। বার্ড!!

কোন রেসপন্স নেই। মাটিতে বসে পরে সাফারাত। হাত থাবড়ায় মাটিতে। তখনই একটা কাপড়ের টুকরো হাতে উঠে। অন্ধকারে হাতরায় সাফারাত। ফ্লাস অন করতেই দেখে কাপড়ের কিছুটা মাটির নীচে। সাফারাত চিনে এই কাপড়ের টুকরোটাকে। তার অচল মস্তিষ্ক জানান দেয় ভয়ংকর কিছুর। পাগলের মতো খুঁড়ে সাফারাত। এই তো একহাত ও খুঁড়তে হয় না। বেরিয়ে আসে তার রুহার হাত। সাফারাত উন্মাদ হয়ে উঠে৷ পাগলের ন্যায় খুঁড়ে যাচ্ছে তখনই পূর্ণ আসে। ধপ করে পাশের গাছটার গুড়িতে বসে পরে। অর্ধ গলিত কিছুটা পঁচা দেহটাকে বুকে চেপে আত্নচিৎকার করে উঠে পুরুষটা। তার স্ত্রী সেটা। পূর্ণ অবাক চোখে তাকিয়ে। কি হয়েছে বা হচ্ছে তা তার মস্তিষ্ক তখমও ধরতেই পারে নি অথচ চোখ দুটো দেখছে সবটা।
সাফারাত সেই লা*শটাকে আঁকড়ে ধরে। কাঁদে পাগল হয়ে,

— এই জান উঠো। পালাব আমরা। কলিজা আমার।

চুলগুলোতে হাত বুলায় সে যেন গুছিয়ে দিচ্ছে। পরক্ষণেই মনে পরে কিছু। জোরে চিৎকার করে রুহা’র পেট হাতরায়,

— হায় আল্লাহ! আমার বাচ্চা। বার্ড আমাদের বাচ্চা। তুমি উঠো না। জেদী মেয়ে উঠো। পালাব আমরা। কানাডা চলে যাব। এই দেশ ছাড়তেই হবে। জান!!

উঠে না কেউ। পুলিশ হাজির হয় সেখানে। দূর থেকেই মুখে রুমাল চেপেছে সবাই অথচ কি সুন্দর দুটো পুরুষ নারীটার শিওরে বসে আছে।

#চলবে….