শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
368

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৪

সময়ের কাটা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সময়টা অতীত করে দিয়ে গেছে কত কি তার হিসেব নেই এখন আর। শিশির বাড়ি ছেড়ে শহরে পড়ে আছে আজ প্রায় আট মাস হতে চলল। এর মাঝে কত ছুটি পেলো সে তবুও বাড়ি এলো না। পড়াশোনা আর টিউশনি নিয়ে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। মাস দেড়েক আগে শরত এসে ঘুরে গেছে দুদিনের জন্য। কোন এক কাজে এসেছে বলে হোটেলে উঠেছিলো। তারপর দুদিন দু ভাই মিলে ভালোই ঘুরে বেড়ালো, আড্ডা দিলো এরপর আবার ফিরে গেল শরত। শিশিরের ব্যস্ততা বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রভোস্ট স্যার শিশিরকে কেন যেন খুব বেশিই স্নেহের ছায়ায় রেখেছেন৷ এ নিয়ে অবশ্য হলের ভেতর নানা গুঞ্জনও ছড়িয়েছে বেশ। প্রথম প্রথম সবাই ভাবতো শিশিরকে স্যার নিজের কোন কাজের জন্য ব্যবহার করবেন। কিন্তু তেমন কিছুই পরবর্তীতে চোখে পড়েনি। যা পড়েছে তা হলো স্যারের আপন ভাগ্নি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী প্রায়ই আসে টিএসসিতে। নানা অজুহাতে শিশিরকে খবর দেয় দেখা করে। এই নিয়েও রটনা কম নয়। মেয়েটি প্রচণ্ডরকম বাজে চরিত্রের তাই শিশিরের সাথে তার লেগে থাকাটা সবাই বাজে ইঙ্গিতই বেশি দেয়। শিশির সেসব কানে তোলে না। তার লক্ষ্য এখানে থেকে ভালো একটা রেজাল্ট করা যা তার বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। তার বাবাকে দশজনের সামনে গর্বিত করবে এমন একটা রেজাল্ট তার মূল লক্ষ্য। অন্যথা সে তো গ্রামেই থাকতে চায় গ্রামের জন্য কিছু করতে চায়। পড়াশোনা শেষ করেই সে বসত গাড়বে আপন ভিটায়। দুপুরের তপ্ত রোদে হলের দক্ষিণের ফুলের বাগানে হাঁটছে শিশির। এলোমেলো কিছু ভাবনায় অস্থির হয়ে শিশির হলে ঢুকলো। গেইটের দারোয়ান তাকে দেখেই বলল, “আপনেরে স্যার খুঁজতাছে। এহনও মনে হয় দোতলায় আছে।”
স্যার বলতে যে দারোয়ান মামা প্রভোস্ট স্যার এর কথা বলছেন তা শিশির জানে। এখানে, সব স্যারকেই নামসহ সম্মোধন করেন ইনি শুধু প্রভোস্ট আশরাফ উদ্দীন ছাড়া। দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠতেই তার পাশের রুমের হাবিব ভাই বলল, “শিশির কই ছিলা, স্যার তোমার রুমে বসে আছে।”

এবার শিশিরের টেনশন বেড়ে গেল। কি এমন হলো যে স্যার তার জন্য অপেক্ষা করছে! মাত্রই তো ঘন্টা চারেক আগে স্যারের সাথে ফোনে কথা হলো নতুন একটা টিউশনি নিয়ে। রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই স্যারকে দেখা গেল তারই বেডে বসে আছে।
সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই স্যার বললেন, “এটা আমার রুলসের বাইরে। আমি একান্তভাবে কোন স্টুডেন্ট এর রুমে এসে বসি না। যে কোন প্রয়োজনে আমি তাদের অফিসে ডাকি, কথা বলি কিন্তু তোমার বেলায় আমাকে অনেক ব্যপারে পরিবর্তন তৈরি করতে হয়েছে। যা সকলের চোখে ইভেন আমার নিজের চোখেও দৃষ্টিকটু।”

“স্যরি স্যা…”

“তোমার ফোন কোথায়?” স্যারের কথায় শিশিরের টনক নড়লো। সত্যিই তো ফোন কোথায়। পকেট হাতড়ে দেখলো ফোনটা সঙ্গে নেই। ঘাবড়ে গেল সে এবার৷ ঘন্টা চারেক আগেই তো ফোনে কথা হলো তারপর পকেটেই গুঁজে রেখেছিলো। হতবিহ্বল দেখালো শিশিরকে এখন তো তার মনে হচ্ছে আজ সে সকাল থেকেই ফোন হাতে নেয়নি৷ স্যার শিশিরকে লক্ষ করে বললেন, “তোমাকে এই শহরে পাঠানো হয়েছে পড়াশোনা করার জন্য, বাবার স্বপ্ন ছেলে তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করবে তার সেই পড়াশোনা। সৌভাগ্যক্রমে তুমি হয়েছেও মেধাবী প্রথম দফাতেই এই সিঁড়িতে পা রাখতে পেরেছো। কিন্তু এসবের বিনিময়ে তুমি নিজেকে খুইয়ে দেবে এমনটা তোমার বাবার ইচ্ছে নয়। দীর্ঘ আটমাসে আমি গত চারমাস তোমাকে নজরে রেখেছি, তোমার প্রতিটি কর্মকান্ড অবজার্ভ করেছি। এত সবের মাঝে দুটো জিনিস আমি অন্যসবার চেয়ে ভিন্ন পেয়েছি তোমার মাঝে। এক, তুমি পড়াশোনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ত্যাগী মানুষ৷ দ্বিতীয়, তুমি মানসিক দিক থেকে অসুস্থ। শুনতে আজব লাগলেও কোন এক দিক থেকে তুমি অন্যমনস্ক৷ তুমি কোন এক ব্যপারে প্রচণ্ড অস্থির, ভয়ার্ত আর দুঃখী। এখন সেটা কি তোমার পরিবেশ বদলে শুরু হয়েছে না অন্যকিছু তা যাচাই করা উচিত। আমি কেন তোমাকে এত এত সময় ব্যয় করে সঙ্গ দেই, তোমার জন্য ভালো পথগুলো আলো জ্বেলে দেখাতে চাই তার পেছনে মূল কারণ তুমি নও তোমার বাবা। আহসানুল্লাহ আমার জীবনে বিশেষ এক ব্যক্তি আর তার জন্যই তোমার দিকে আমার বিশেষ নজর। তাই আমি সব খবরাখবর তোমার আগে তোমার বাবাকেই জানিয়েছি। আর এই ধরো এই কার্ড রাখো। এখানে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের এড্রেস আছে সন্ধ্যায় তোমার এপয়েনমেন্ট।” প্রভোস্ট স্যার একাই অনেকগুলো কথা বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। একবারও ফিরে তাকাননি শিশিরের মুখের দিকে। তাকালে দেখতেন হতভম্ব শিশিরের চোখে রাজ্যের বিষ্ময় ঝিলিক দিচ্ছে। সে মানসিক রোগে ভুগছে বলে গেল স্যার! প্রকৃতির বাইরে ইট পাথুরে শহরে তার অসুস্থ হওয়াটা অস্বাভাবিক না কিন্তু সেতো সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো এখানে। এই মুহুর্তে তার ফোনটা খুঁজে পাওয়া জরুরি মনে হচ্ছে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে হবে স্যার তাঁকে কি বলেছে!

সকাল থেকে আলতা বইয়ের ভাজে মুখ গুঁজে আছে। দুপুরে জোর করে নকশি তাকে ভাত খাইয়ে গেছে। আলতার পরীক্ষা চলছে দ্বিতীয় সাময়িক তাই আজ বাড়িতেই সারাদিন। কাল রসায়ন পরীক্ষা তাই আজ পড়া ছেড়ে উঠছেই না। কতগুলো মাস হয়ে গেল আলতা ঠিকমত কথা বলে না কারো সাথে। বাইরে খেলতে যায় না, পাখি মারার গুলতি, মারবেল, লাটিম কিছুতেই হাত লাগায়নি সে। আগে তার পাড়ার পিচ্চি ছেলেপেলে গুলো খেলার সাথী ছিলো আজকাল তার ক্লাসের বান্ধবী অতশী আর শিপ্রা এই দুজনই বান্ধবী। মাঝেমধ্যে অতশী আসে তার সাথে দেখা করতে ফাঁকে অবশ্য সে শরতের খোঁজ নেয় খুব। অনেক দিন হলো জানতে পেরেছে শিশির নয় শরত অলিকে পছন্দ করে। তাই সেদিন ঢাকায় যাওয়ার আগে শিশির ভাই ফুল নিয়ে গিয়ে শরত ভাইয়ের পছন্দের কথা জানিয়েছে অলিকে। শরত পছন্দ করলেও কখনো মুখ ফুটে বলেনি কথাটা। শিশির তার ভাইকে দেখেছে অলির দিকে কেমন করে তাকায়, প্রায়ই তাদের কলেজের কাছে গিয়ে ঘুরে আসতো আর একদিন তো শিশিরকে জিজ্ঞেসই করেছিলো অলির কথা। সেদিনই শিশির নিশ্চিত হলো ভাইটি তার ক্লাসের মোটামুটি রকম সুন্দরী মেয়েটিকে পছন্দ করে। শরতকে না জানিয়েই সে অলিকে দেখা করতে বলেছিলো। শরত যখন শিশিরের ব্যাগপত্র নামিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল তখন শিশির দুটো ফুল কিনে ভাইয়ের মনের খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো ক্লাসের সেই বান্ধবীটিকে৷ আর তাতেই রেগে ফুল ছুড়েছিলো অলি। তার এক কথা, “পছন্দ কি তুমি করো? তুমি কেন ফুল নিয়ে তার মনের কথা বলতে এলে! খবরটা যার সে নিজে দিলেই না হয় ভাবতাম কিছু।”

ব্যস, দূর থেকে অতশী যা দেখেছে তাই বলেছিলো আলতাকে৷ পরে সঠিক খবরটা জানতে সময় লাগেনি কিন্তু শরত আর অলির প্রেমটাও ততদিনে হয়ে গেছে৷ আলতার খুব ভালো লাগে শরত ভাই আর অলি আপার কথা ভাবতে। তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। শরত ভাই প্রায় আজকাল ফোনে কথা বলে। আগের মত আর একেবারে চুপচাপটি নেই। প্রেম মানুষকে কতোটা বদলে দেয় তা শরত ভাইকে না দেখলে সে জানতেই পারতো না। পড়ালেখায় মন বসাতে গিয়ে আলতাকে খুব জোর দিতে হয় মনের বিরুদ্ধে। তার ভালো লাগে এক ধ্যানে চুপচাপ বসে থাকতে, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। ঝুম বৃষ্টির রাতে জানালার পাল্লা খুলে হাত বাড়িয়ে আঙ্গুল ভেজাতেও ভালো লাগে শুধু অসহ্য লাগে নিজের চারপাশে অনেক মানুষের আনাগোনা। আর অসহ্য লাগে স্কুল থেকে ফেরার পথে শাওনের অকাট্য কিছু কথা। শিশির ভাইয়ের সাথে মারামারি করে অনেক দিন চুপ ছিলো শয়তান ছেলে। ইদানীং তার পাখ গজিয়েছে তার বাবার কারণেই। তার বাপ এবার পৌরসভা ইলেকশনে নাম লিখিয়েছে। জেতার সম্ভাবনা না থাকলেও আজকাল তাদের আশেপাশে অসংখ্য লোকজন আছে। আর তাতেই শাওন এত সাহস দেখায়। আলতা একবার ভেবেছিলো শরত ভাইকে বলবে পরে মনে হলো শাওন বাড়াবাড়ি করবে না। হয়তো দু চারদিন ঘুরঘুর করে চুপ হবে। কিন্তু কাল তো ভয়ানক এক কথা বলেছে। আলতা পরীক্ষার পর প্রাইভেট পড়ে তারপর বাড়ি ফিরছিলো। সাথে অতশীও ছিলো কিন্তু অতশীর বাড়ি বাজারের দিকেই এজন্য বাকিটা পথ আলতা একা আসছিলো। পাড়ার মাটির রাস্তায় উঠতেই মোড়ে বটগাছ তলায় শাওন আর দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছিলো। কাছাকাছি আসতেই শাওন ডাকলো, “আলতা শোন!”

আলতা থামেনি পা চালাচ্ছিলো তড়িঘড়ি কিন্তু শাওন চেঁচিয়েই বলল, “এত ভাগলে লাভ হইবো না। আমার কাছেই আসতে হইবো তোর। ইলেকশনটা শেষ হইলেই তোরে উঠাইয়া আনমু তখন দেখমু তোর কোন বাপ শহর থেকে আইসা উদ্ধার করে! এবার যারে ধড়মু একদম কব্বরে গাইড়া দিমু।”

শাওনের হুমকিস্বরূপ কথাগুলো আলতা বুঝতে পেরেছে কার উদ্দেশ্যে বলা। সে বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বলেনি। একবার মনে হয়েছে মাকে বলবে পরে মনে হলো এমনিতেই কতরকম চিন্তা নিয়ে থাকে সারাক্ষণ৷ তারপর মনে হলো মামাকে বলবে আবার মন বলল মামাকে আর কত জ্বালাবে৷ যত যা বাড়ির বাইরের দরকার সব তো মামাই দেখেন, পূরণ করেন। মামা নাকি মায়ের খালাতো ভাই অথচ এই মামা সবসময় আপন মামার মত আগলে রেখেছেন৷ খারাপ লাগলো আলতার কেন তার বাবা নেই পাশে৷ বাবা বলতে সে শুধু জানে বাবার দ্বিতীয় একটা সংসার আছে। এর বাইরে কখনো কিছু জানতো না, জানতে চায় নি কিন্তু এখন মনে হয় জানা দরকার বাবা কোথায়, কোথায় বাবার সংসার৷ সে কি বাবার সন্তান না! তাহলে তার প্রতি অবহেলা কেন? কিশোরী মনের কাঁচা বুদ্ধিতে আলতা চেপে গেছে শাওনের হুমকির কথা। এতে পরবর্তীতে কোন বিপদ হতে পারে তা সে ক্ষুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব- ১৫

ঋতুচক্রে এবার শীতের শুরু আলতার মন খারাপ দিয়েই। সেই যে শিশির গেল তার নতুন কুড়ির মতন কচি কিশোরী দেহ ছুঁয়ে এরপর আর সে কচি কিশোরী মন আগের মত রইলো না। দিবানিশি এক ঘোরের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে সে উপলব্ধি করার এক প্রয়াস নিয়ে বেঁচে আছে। সবটা উপলব্ধি শিশিরকে নিয়ে শিশিরের করা সেই দুঃসাহসিক আচরণ ঠিক ছিলো নাকি ভুল তারই এক বিবৃতি খুঁজে বেড়ায় অবুঝ মন৷ অথচ কি পাষাণ সেই ছেলেটা যার জন্য অবাধ্য, অবুঝ আলতা নিজেকে মুঠোবন্দী করে রাখছে। হেমন্তের সকালকে বড় অপেক্ষা নিয়ে কাটিয়ে এবার শীতের রাত গুণছে সে রাতজাগা হুতুমের মত। আগামী সপ্তাহে নির্বাচন আর তার দুদিন পরই শিউলি আপার বিয়ে। বাড়িতে কত কাজকর্ম হট্টগোল বেঁধেই আছে কাল থেকে। কালই বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে আর কালই মামী শিশির ভাইকে বাড়ি আসতে বলেছে। শিশির বাড়ি ছেড়ে গেছে আজ কতগুলো মাস পার হলো কখনো আলতা উদগ্রীব হয় না তাকে একটাবার দেখতে, তার সাথে কথা বলতে৷ অথচ কাল হঠাৎ কি হলো কে জানে! মামীর মুখে শিশির ভাইয়ের আসার কথা শোনার পর থেকেই বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ এক তরঙ্গের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে সে। রাত ভোর হয়ে কখন যে সকাল শুরু হয়েছে দু চোখের জাগ্রত পাতা তার কিছুতেই বুঝতে পারেনি৷ সকালে মা যখন তাকে ডাকতে গায়ে হাত দিলো তখন দেখলো আলতা জেগে আছে। নকশি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “কি রে তুই ঘুমাসনি?”

মায়ের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় আলতা। আমতা আমতা করে বলল, “একটু আগেই ঘুম ভেঙেছে।”

নকশি কথাটা বিশ্বাস করলো কিনা তার মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ঘুমকাতুরে মেয়ে তার যে কোন অবস্থাতেই সকালের ঘুম থেকে কখনোই ডাক ছাড়া সে উঠতে পারেনি আর আজ বলছে তার নাকি আপনাআপনি ঘুম ভেঙেছে! নকশি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কলপাড়ে যেতে যেতে ভাবছে এতগুলো মাসেও মেয়েটার সমস্যা সে ধরতে পারলো না কেন! আলতাও বিছানা ছেড়ে প্রথমেই ঘরের বেড়ায় লাগানো আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো৷ গভীর মনযোগে একবার তাকালো নিজের মুখটাতে। চোখ দুটো ফোলা, ডান কাতে শুয়ে থাকায় গালটা একদম রক্তরাঙা হয়ে আছে। নাকের ডগায় একপাশে ছোট্ট একটা তিল আছে তার। একটু খুঁটিয়ে সেটাও দেখলো তারপরই চোখ পড়লো রক্তজবার মত লালচে চিকন দুটো ঠোঁট। সাথে সাথে গা শিউরে উঠলো তার। মাস কয়েক আগে এই ওষ্ঠ, অধর পিষ্ট হয়েছিলো শিশিরে ঠোঁটের ভাজে। নিজের অজান্তেই আলতার ভেতর বাহির সবটাতে যেন এক ভীষণ ভয়ানক ঢেউ আছরে পড়লো শিশির নামের। এ যে এক ভালোলাগা না অন্য কিছু কিছুতেই তার মন ঠাওরাতে পারছে না। আজকাল ক্লাসের ফাঁকে প্রায়ই সে শিপ্রার কাছে প্রেমকাহিনী শোনে। রাজ্যের সকল প্রেমিক-প্রেমিকার গল্প যেন শিপ্রাই জানে। নিষিদ্ধ এক ভালো লাগার তৈরি হয় সেই গল্প শুনে আর তৎক্ষনাৎ মনের ভেতর মাথা চাড়া দিয়ে উঠে শিশির বেলা। কোন এক শীত সকালে শিশিরে ভেজা ঘাসের পরে বসে শিশির আর আলতা মন ভোলানো কল্পনা সাজায়। তার বান্ধবী অতশী নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। সেই বান্ধবীও এসে প্রেমিকের গল্প করে। তার মা তাদের সমাজ ক্লাস নেয় সেই ক্লাসেই পড়ার ফাঁকে বয়সের দোষ বলে কিছু কথা জানিয়েছে। মেয়ে নয় শুধু ছেলেদের উদ্দেশ্যেও বলেছিলো কিছু কথা। আবেগী বয়স, রঙিন পাখনা আর জগৎসংসারের আসল রুপ সব কিছুতেই অবগত করানোর এক অনন্য চেষ্টা ছিলো নকশির। তাঁর ধারণা এটাই সঠিক সময় ছেলেমেয়ে গুলোকে সাবধান করার। আলতা তার মায়ের বলা সব কথা মনযোগে শুনেছে মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করেছে সে সতর্ক থাকবে। প্রেম ভালোবাসার মোহে নিজেকে ভাসাবে না। কিন্তু হায়! এ তার কি হলো? এতদিন শিশিরের ওপর আলগা এক অভিমান না রাগ যেন পাতলা আস্তরণের মতো জমেছিলো। কাল থেকে হঠাৎ করেই আর সেই আস্তরণ থাকছে না মনের ওপর। তার অজান্তেই মন শিশিরের অপেক্ষায় জ্বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই এক অদম্য পিপাসা জেগে গেছে শিশিরকে এক পলক দেখার। আচ্ছা, শিশির ভাইও কি ভাবে তাকে একটাবার দেখার কথা! কই এত গুলো দিনে কখনোই তো মা কিংবা মামিকে জিজ্ঞেস করেনি আলতা কেমন আছে? একটাবারও জানতে চায়নি আলতা কি ঠিকমত পড়াশোনা করছে? অভিমানের মেঘ জড়ো হয়ে গেল মনের আঙিনাতে। আলতার মনে হলো আজ দিনটা ভারী অস্থিরতায় কাটবে শিউলি আপার পাশে বসে। দু মাস পরে এইস এস সি ফাইনাল পরীক্ষা দেবে আর ঠিক এসময়েই এসে জুটলো খুব ভালো এক বিয়ের প্রস্তাব। শরত বোনকে আরও পড়াবে বলে প্রথমে বিয়েতে অমত করলেও পরে পাত্রের খোঁজ নিয়ে আর দেরি করেনি। পাত্রের বাড়িঘর দেখতে যাওয়ার দিন কথা ছিলো শিশির আসবে কিন্তু তার কোন ছাত্রীর পরীক্ষার জন্য আসতে পারেনি। আলতা সেদিনও শিশিরকে নিয়ে এতোটা ভাবেনি কিন্তু এখন তার ভাবনা কিছুতেই সরছে না। শিউলি তার ঘরে বসে হাতের নখে মেহেদি দিচ্ছিলো আর আলতাকে ডাকলো চুলে একটু তেল মেখে দিতে। আলতা তেলের বাটি নিয়ে বিছানায় বসতেই শিউলি পিড়ি পেতে নিচে বসলো। আঙ্গুলের ডগায় বাটি থেকে তেল নিয়ে কয়েকবার শিউলির চুলে দেওয়ার পর ঘুমে আর বসতেই পারলো না। প্রচণ্ডরকম বিরক্তিতে তেতো হয়ে ধমকে উঠলো শিউলি, “কি শুরু করলি আলতা? তেল না দিয়ে ঝিমাচ্ছিস কেন? রাতভর কি না ঘুমিয়ে চুরি করেছিলি?”

আকস্মিক ধমকে চমকে তাকালো আলতা। ঘুম তার চোখে আঠার মত লেগে আছে। শিউলির ধমকে সে চমকে গেলেও ঘুম দূর হয়নি এক বিন্দু। কোনমতে বলল, “আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে আপা আমি তেল দিতে পারবো না এখন।”

এ কথার পর আর আলতার হুঁশ নেই। সে বালিশ টেনে সেখানেই শুয়ে পড়লো। বিড় বিড় করে দু চারটা গাল পেড়ে শিউলি তেলের বাটি নিয়ে চলে গেল কাকীর কাছে।

আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে গ্রামের দিকে শহরে এখনো কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। শিশিরের মনে হয়েছিলো এবারের শীতটাকে সে খুব মিস করবে কিন্তু কাল মায়ের কাছে শিউলির বিয়ের কথা শুনে একটু স্বস্তি হলো। আপাতত পড়াশোনাতেও একটু ফাঁক দেওয়ার সুযোগ হয়েছে যদিও তা তাকে ফিরেই একদম নাকানি চুবানি অবস্থায় পড়তে হবে। তবুও এবার একটু ফেরা দরকার আপন সেই পুরনো নীড়ে। দেখা দরকার আপন মানুষগুলোকে কেমন আছে তারা আর তার শাসনের বেরিবাঁধ থেকে ছাড়া পেয়ে কেমন আছে সেই চঞ্চল পাখিটা! আলতার কথা মনে হতেই শিশিরের ঠোঁটে এক চিলতে রহস্যজনক হাসি ফুটলো। যেই হাসির অর্থ তার নিজের কাছেই দূর্ভেদ্য। সময় কত দ্রুত বদলে দিলো তাকে নাকি তাদের! আম্মা ভীষণ পেঁচিয়ে কথা বলে কয়েকমাস ধরে। প্রায় প্রত্যেক কথাতেই আলতাকে টেনে আনে। আলতারও নাকি খুব পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু সেই পরিবর্তন গুলো কি তা খুব সতর্কতার সাথে লুকিয়ে যায় আম্মা। শিশিরের তখন খুব বলতে ইচ্ছে করে, “আম্মা জিলাপির মত এত না পেঁচিয়ে বলেন তো আলতা কি কি করে এখন? সে কেমন বদলেছে!” মন বললেও মুখে বলার সাহসটা কেন জানি হয়ে ওঠে না তার। সাহসের কমতি তার কখনোই ছিলো না কিন্তু আলতার ব্যপারে এত কেন দ্বিধা এলো নাকি সে রাতে করা নিজের অন্যায়টার জন্যই সে এত সংকুচিত হয়ে পড়ে আলতার কথা বলতে! এ সপ্তাহে কলেজের ছাত্রীটার প্র্যাকটিক্যাল আছে একটা তারপরই মোটামুটি স্কুল, কলেজে দু জায়গার ছাত্র-ছাত্রীরই পরীক্ষার সমাপ্তি৷ পাঁচটা স্টুডেন্ট এর মধ্যে তিনটাই মেয়ে আর তাতে দুজনই ক্লাস টেনের। শিশিরের বিরক্তি তুঙ্গে এ দুজনকে পড়াতেই। খুবই বিচ্ছু আর চটপটে স্বভাবের ঠিক যেন আলতার মত৷ কিন্তু বিরক্তির মূল কারণ, দুটো মেয়েই পড়ায় কম তার ওপরই মনযোগ বেশি দেয়। বয়সটা তারও ঠিক ভারী নয়। এ বয়সে মেয়েরা কাছ থেকে যেচে পড়ে যে পাত্তা দেয় তা বোধকরি বেশিরভাগ ছেলের পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল৷ শিশিরেরও তেমনই অবস্থা তবুও মনের খুব গহীনে কোথায় এক চঞ্চল চড়ুইয়ের বসবাস তাকে বেঁধে রেখেছে নিজের মাঝে৷ হাতে গুণে আর মাত্র কয়টা দিন তারপরই দেখা মিলবে তার পাখিটির ভাবতেই হাতটা আপনাআপনি উঠে এলো বুকের বা পাশটায়। চোখ বুঁজে কয়েক পল কেটে গেল সেই মুখটাকে মনে করে। চোখের তারায় ভেসে উঠে সেদিনের মুখচ্ছবি যেদিন অঙ্গে শাড়ি আর খোঁপায় ফুল বেঁধেছিলো মেয়েটা৷ এক মুহূর্তে কত বড় হয়ে গেল সেদিন আলতা! ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হয়ে হাসি ফুটলো শিশিরের অধরে৷ সেই ছোট্ট বেলা থেকে একই বাড়িতে ছিলো কৈশোরেও তার মনে কোন ভাবান্তর ছিলো না আলতাকে নিয়ে না অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে। আর এখন! দিনের আলো ফিকে হয়ে আসছে। সপ্তাহের ছয়দিনে তিন দিন করে ভাগ করা টিউশনিগুলো আর দুটো টিউশনি ছিলো৷ কিন্তু একজন অসুস্থ ফোন করে জানিয়েছে অন্যজন পড়বে সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা। এখনো হাতে অনেকটা সময় আছে ভেবে শিশির প্রভোস্ট স্যারের দেওয়া কার্ডটা খুঁজে বের করলো। পোন করে জানা গেল আজকে কোন সুযোগ নেই দেখা করার। কালকের একটা সময় পাওয়া গেল। স্যার যা বলেছেন প্রথম কিছুদিন শিশির মানতে পারেনি। কিন্তু আজকের ভাবনা অন্যরকম তার মন বলছে সত্যিই যদি অসুস্থ হয়ে থাকে তাহলে সময় থাকতেই তা নিরাময় করা জরুরি। বাড়ি ফিরে মায়ের সব প্রশ্নের উত্তর সে দিবে।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৬

গ্রামের মেঠোপথে আর বাজারের প্রতিটি চায়ের দোকানে নির্বাচনের গরম হাওয়া বইছে। শিশির আজ বাসে না এসে ট্রেনে করে এসেছে গ্রামে। রেলস্টেশনে নেমেই সে অটো খোঁজ করলো। গ্রামে এখন তিন চাকার অটো চলে খুব। রেলস্টেশন থেকে তাদের গ্রামে পৌঁছুতে অটোতে কম করে হলেও আধঘন্টা লেগে যাবে। এদিকে নির্বাচনী গরম পরিবেশ স্টেশন এলাকায়ও কম নয়। শরত বলেছিলো শিশিরকে যেদিন আসবি আমায় আগেই জানাবি অটো ঠিক করে পাঠিয়ে দেবো। সে ইচ্ছে করেই জানায়নি৷ বিয়ে বাড়ি হাজারটা কাজ থাকবে সে একাই পৌঁছুতে পারবে৷ নিজের গ্রাম, নিজের বাড়ি বলে কথা৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে এদিক থেকে কোন অটো গ্রামের দিকে যাবে না। ইলেকশনের রমরমা আয়োজনে বাড়ি এসে বিপদে পড়লো যেন। কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে মনে পড়লো সে এখানকারই ছেলে। মেইন রোড ছেড়ে ক্ষেত পেরিয়ে নদী পাড় হয়ে সে গ্রামের ভেতর দিয়েই সহজে যেতে পারে। এতে রাস্তাঘাটের ভীড়, হট্টগোল সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। স্টেশন ছেড়ে সে ক্ষেতের আইলে নামলো। দশ মিনিটে এ গ্রাম পেরিয়ে নদীর পাড় গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। ঘাটে নৌকা থাকলেও মাঝি নেই একজনও। মাথার ওপর সূর্য তেতে উঠেছে। সেই রাত ভোর হবার পরপরই সে হল থেকে বেরিয়েছিলো৷ মাঝে এক স্টেশনে নেমে পাউরুটি দিয়ে চা খেয়েছিলো। চার ঘন্টার পথে সে আর একফোঁটা পানিও পান করেনি। খুব সম্ভব এতগুলো দিন পর বাড়ির ফেরার উত্তেজনায় সে তৃষ্ণা, খিদে সব ভুলে গিয়েছিলো। জীবনে এই প্রথমবার সে সবাইকে ছেড়ে দূরে ছিলো বহুদূরে। আজ কতগুলো দিন পর সামনে থেকে দেখবে প্রিয় মুখগুলো। কিন্তু এই নদী কি করে পাড় হবে এখন! আবার উল্টো ফিরে স্টেশনের দিকে যেতে কতটা মাঠ ঘাট পেরুতে হবে ভাবতেই শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে এলো। কিছু করতে ইচ্ছে হলো না তার আর তাই ব্যাগটা পাশে রেখে নদীর পাড়ে মাটিতেই বসে পড়লো। কয়েক মিনিট মাথাটা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকার পর কানে এলো বাচ্চাদের আওয়াজ। ডান দিকে কাঁধ ফিরিয়ে দেখলো দশ, বারো বছরের তিনটা ছেলে। খুব সম্ভব তারা নির্বাচনের কিছু পোস্টার নিয়ে টানাটানি করছে। শিশির ডাকলো তাদের কিন্তু তিনজনের কেউই তার দিকে ফিরে তাকালো না। নিজেদের কাজেই ব্যস্ত তারা। শিশির আবারও ডাকলো এবার ডেকে বলল, “আজকে ইলেকশনে কে জিতবে?”

এবার যেন তারা উৎসুক হলো। তিনজনেই এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “আমাগো এলাকার মাতবর তমিজউদদীন চেয়ারম্যান হইবো।”

শিশির খুব ভালো করে তাকালো। ছেলে তিনটা কৈশোর ছুঁই ছুঁই অথচ তাদের গলার স্বর আর কথা বলায় এখনি কেমন তেজালো ভাব। সে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ পেয়ে বলল, “তোমাদের মধ্যে নৌকা কে চালাতে পারো মানে একাই নদী পাড় হতে পারো নৌকা নিয়ে?”

তিনজনের মধ্যে একজন দেখতে লম্বা, চওড়া যে জন সে বলল, “আমি পারি ওরাও পারে তয় আপনেরে পাড় করতে পারুম না।”

” আমি তোমাদের নৌকা ভাড়া দেবো।”

“লাগবো না আপনের ভাড়া। এই নৌকা কি আমগো নি?”

“আমি তোমাদেরও দিবো সাথে নৌকা যার তারটাও দিয়ে যাবো তোমরা দিয়ে দিও নৌকার মালিককে। খুব বিপদে পড়ে গেছি আমি। আমার বাড়ি পদ্মাদিঘি গ্রামে।”

শিশিরের কথা শুনতেই ছেলে তিনটা হেসে উঠলো যেন পদ্মাদিঘি নামটাতে হাস্যকর কিছু লোগে আছে। হাস্যকরই বটে! আজকের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী এ গ্রামের একজন আর পদ্মাদিঘি গ্রামের একজন। পদ্মাদিঘির প্রতিদ্বন্দ্বী হারবে তা নিশ্চিত আগে থেকেই তা জানে বলেই হয়তো ছেলেগুলো এত হাসছে। শিশির হাল ছাড়লো না সে আরও কিছু কথা বলে রাজী করালো। তিনজনই একসাথে নৌকায় উঠে শিশিরকে নদী পাড় করলো। শিশিরও উপকারটুকু পেয়ে তিনজনেই পঞ্চাশটি করে টাকা দিলো। তিনজনের কাছেই পঞ্চাশটি টাকা পরিমাণে অনেক বেশি। নৌকাওয়ালার টাকা আর তারা নিলো না নিজেদের লাভেই মহাখুশি। তাদের কথা তখন, “যার নৌকা হে তো জানবোই না।”

শিশির অবাক হয় বাচ্চাগুলোর কথা শুনে। আর মনে পড়ে আলতার কথা। সেও এমনসব কত যে কান্ড করতো! নিজের বুঝটুকু বুঝে অন্যেরটা ফেলেই চলে আসতো৷ হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল শিশির বাড়ির পথে। নদী পেরিয়ে ক্ষেত তারপর মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে একেবারে বাড়ি এসে পৌঁছুলো। দুদিন পর বাড়িতে বিয়ে অথচ কোন হৈ চৈ নেই দেখে কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল শিশিরের। শিউলির বিয়ে অথচ বাড়ি ফাঁকা! গেইট খোলাই ছিলো সে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলো উঠোনে তাদের ঘরের সামনে যে কামিনি ফুল গাছটা তার গোঁড়ায় বসে আলতা তার পায়ে আলতা দিচ্ছে। মাথার ওপর থাকা সূর্যের তেজটা হঠাৎ করেই যেন বরফশীতল হয়ে শীতল করে দিলো শিশিরের গা। তার পায়ের গতি ধীর হয়ে এলো আপনাআপনি। আলতা তখনো দেখেনি শিশিরকে সে নিচু হয়ে আলতা লাগানোতে ব্যস্ত।

“কেমন আছিস?”

শিশিরের হঠাৎ প্রশ্নে গেল আলতা। হাতে থাকা আলতার তুলিটা ছলকে পড়লো মাটিতে সাথে আলতা ভরা বোতলটাও। ভীতু হরিণীর ন্যায় চোখ দুটো ভয়ে ছোটো ছোটো হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। এত ভয় কিসে পেল ভেবে পায় না শিশির। সে আবারও কথা বলল, “কি হয়েছে? ভয় পেয়ে গেলি কেন! আর বাড়ির সকলেই’বা কোথায় গেছে?”

আলতা মুখ তুলে এখনো তাকালো না। সাহসই হচ্ছে না মাথা তুলে তার মুখটা দেখে। গত চারটা দিন কি যে অসহনীয় লজ্জা আর ভয় মিশ্রিত হাজারটা কল্পনা কল্পিত হয়েছে তার মনোরাজ্যে শিশিরকে নিয়ে। আজ হয়তো তাকে সামনে দেখে সেসবই আড়ষ্ট করে দিলো। কি যন্ত্রণা! এমন কেন হচ্ছে । কানের ভেতর শো শো আওয়াজ আর বুকের ভেতর দামামা বাজছে কেন শিশির ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে! এদিকে শিশির অপেক্ষা করছে তার প্রশ্নের জবাবের।

“কথা বলিস না ক্যান?”

“ভোট দিতে গেছে। মামা, মামীরা। শরত ভাই, শিউলি আপা আর আম্মায় শহরে গেছে মার্কেট করতে।”

এইটুকু বলতেই হাফ ধরে গেল আলতার। বুক শুকিয়ে চৌচির হয়ে এলো। মনে হলো মরুভূমির মাঝে প্রচণ্ড খরতাপে তার ভেতরটা পানিশূণ্য। কেউ যদি এক ফোঁটা পানি দেয় তবে এই মুহুর্তে তার প্রাণটা বেঁচে যাবে। তার পনেরো বছরের জীবনে এত ভিন্ন অনুভূতি সে আগে কখনো টের পায়নি। এই অনুভূতিতে পিষ্ট হয়ে চোখ ছলছলে হয়ে উঠেছে। শিশিরের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকালো না অথচ শিশির অপেক্ষা করছিলো আলতা তাকে একটিবার তাকিয়ে দেখুক। তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। চুলায় কিছু পুড়ছে কথাটা বলেই সে উঠে চলে গেল। আর হতভম্ব শিশির সেই রাতের কথা ভেবে অপরাধবোধে নুয়ে পড়লো। মন বলল অযাচিত হলেও সেদিন সে অন্যায় করেছে।

মাস্টার বাড়িতে অনুষ্ঠানের আমেজ শুরু হয়ে গেল সন্ধ্যার পরপরই। এলাকায় শোরগোল বন্ধ হয়ে গেল নির্বাচনের। শাওনের বাবা হেরে গেছে বলেই এলাকার উত্তেজনা, মিছিল সব বন্ধ হলো কিন্তু এলাকার স্তব্ধতা ছাপিয়ে মাস্টার বাড়ির হট্টগোল সবাইকে খুশির জোয়ারে ভাসালো। আজকে রাতটা পার হলেই কাল গায়ে হলুদ। বাড়িতে প্রথম বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন অনেক করা হচ্ছে। সময় কম দিয়েছে পাত্র পক্ষ তবুও শরত নিজের সবটা দিয়ে বোনের জন্য অনুষ্ঠান করছে। সন্ধ্যার পরই ডেকোরেশনের লোক এলো। ছোট বড় কয়েকরকম মরিচা বাতি লাগিয়ে দিচ্ছে আজ সারারাত জ্বলবে এই আলো। শিউলির খুব শখ তার বিয়েতে গান- বাজনা হবে। তাই সন্ধ্যার পরই শিশিরকে পাঠানো হলো সেই ব্যবস্থা করতে। রাত ভোর হলো নানা কাজকর্মে। সকালে সূর্য ওঠার আগেই আজ আলতার ঘুম ভাঙলো। শীত এখনো জাঁকিয়ে আসেনি তবুও ভোর বেলাটায় ঘাসের ওপর শিশির জমে। আবছা কুয়াশায় বাড়ির আঙিনার ছবিটাও অস্পষ্ট লাগে। কালকে পায়ে দেয়া আলতা ধুঁয়েমুছে গেছে রাতে পা ধোঁয়ার সময়। এখনো সেই আলতার ছাপ পায়ে লেগে আছে৷ খালি পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো সে তার মায়ের লার রঙা চাদরটা গায়ে পেঁচিয়ে । শিশিরদের ঘরের পেছনে ঘাস থাকে সবসময়ই। সে ঘাসে এখন শিশির জমেছে বিন্দু বিন্দু। কিশোরী মনটা আবারও চঞ্চল হয়ে উঠছে আলতার। ঘোর লাগছে মনের কোণে এই শীতেও বাসন্তি হাওয়ার মত। আলতার বোতলটা নিয়েই সে বেরিয়েছে। রান্নাঘরের পিড়িটা এনে বসে পড়লো ঘরের পেছনে। পা ফেলে সে আলতা আঁকলো পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত। পা দুটো তার ঘাসের ওপর রাখা বলেই শিশির ফোঁটা আলতায় মিশে গড়িয়ে পড়ছে ঘাসের ওপর। আর এই শিশিরে ভেজা আলতা মুগ্ধ চোখে দেখছে কেউ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। আলতার খেয়াল নেই সেদিকটায় সে একমনে ভারী মিষ্টি হেসে আলতায় পা রাঙালো আর মনে মনে ভালো তার সামনে বসে শিশির ভাই তাকে ঠিক এমন করেই আলতায় রাঙিয়ে দেবে। নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠলো আলতা। কাল রাতে সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে শিশিরকে। অনেক বদলে গেছে শিশির ভাই। আগে তার মুখে দাঁড়ি গোফ কখনো চোখে পড়েনি কিন্তু কাল দেখলো গালভর্তি ছোট দাঁড়ি আর মাথার চুল আগের চেয়েও ঝাঁকড়া। গায়ের রঙটাও কি বদলে গেছে কিছুটা! এমনই মনে হলো। আগের শিশির ভাইয়ের শ্যামলা চেহারায় কেমন এক রাগী ভাব স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু এবার তার রঙ বদলে একটু ফর্সা ফর্সা লাগলো। আচ্ছা শিশির ভাইও কি মেয়েদের মত মুখে মেকাপ করেছিলো কাল! নাকি সত্যিই সে অমন ফর্সা হয়ে গেছে!

“এত সকালে আলতা পরিস কি জন্য রে!”

জানালা থেকে শিফা কথাটা বলেই একগাল হাসলো। সেই হাসিতে দুষ্টুমি ভাসছিলো। মামী প্রায়ই কেমন যেন প্রায়ই তার সাথে রহস্যমাখা কথা বলে। আগে এমন ছিলো না তো! সে মামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না লজ্জা লাগছে খুব। শিফা আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি আহসানুল্লাহও জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো।

“তোরা মামী -ভাগ্নি এত সকালে কিসের গল্প জুড়ে দিলি? আমাকে এক কাপ চা খাওয়ালেও তো পারিস?” আদুরে গলায় বলল আহসানুল্লাহ। শিফা বলে উঠলো, “রাখো তা তোমার চা। মেয়েটা কত বড় হয়েছে দেখছো? ভাবছি বড় মেয়ে বিদেয় হতেই নকশিকে বলে এরও একটা ব্যবস্থা করে রাখবো।”

আহসানুল্লাহ হায় হায় করে উঠলো কথাটা শুনতেই।
“খবরদার, শিউলিটাকে তো কলেজও শেষ করতে দিলে না বাড়িতে। কালই পরের ঘরে চলে যাবে মেয়েটা। ”

আহসানুল্লাহর মুখের কথা শেষ হতেই শিফা বলে উঠলো, “এজন্যই একে আর পরের ঘরে দিবো না।”

আহসানুল্লাহ বোকার মত তাকালো শিফার কথায়। কি বলল সে!

চলবে