#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৬
#Ornisha_Sathi
২১ দিন পর। রোদেলা আগের থেকে এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। বাস্তবতা মানতে শিখেছে। সেই ঘটনার চারদিনের মাথাতেই রোদেলা নিজের বাড়ি ফিরে যায়। আবার আগের মতো কলেজ যাওয়া-আসা শুরু করে। আগের মতো হাসি খুশি প্রাণোচ্ছল জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু মাঝেই মাঝেই থেমে যাচ্ছে মন থমকে যাচ্ছে সময়।
আনিতার আব্বু দেশে এসেছেন সপ্তাহ খানেক হবে। দুই দিন বাদেই আনিতার ছোট চাচ্চুর বিয়ে। এখন থেকেই আনিতাদের বাড়িতে মেহমান আসা শুরু করছে। আনিতার মামা মামি আংকেল আন্টি কাজিন জারাফের নানুর বাড়ির লোকজন আরো অনেকেই এসেছে। বাড়িটা মানুষে গমগম করছে। বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে এ টু যেড সব কমপ্লিট। হলুদের ফাংশনে সব ছেলেরা একই রকম পাঞ্জাবি এবং মেয়েরা একই রকম শাড়ি। এটা আনিতার ছোট চাচ্চুর তরফ থেকে সবার জন্য দেওয়া হয়েছে। ছেলেরা কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর মেয়েরা সবুজ পাড়ের কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি।
মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পর গেটের সামনে দিয়ে আনিতা বারবার পায়চারি করছে। আর একটু বাদে বাদেই রাস্তার দিকে উঁকি মারছে। মিনিট পাঁচেক বাদে আনিতা আবারো উঁকি দিতেই দেখে রাতুল তন্ময় ওরা আসছে। খুশিতে আনিতা কিছুটা লাফিয়ে উঠে। রাতুল তন্ময় এসেছে মানে আহিয়ানও আছে ওদের সাথে। ইশ্ আজ কত দিন পর আহিয়ানের সাথে দেখা হবে ভাবতেই আনিতা কিছুটা লজ্জা পায়। গুনে গুনে পাক্কা তেইশ দিন বাদে আজ ওদের দেখা হবে। তন্ময় আনিতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
–“বাহ আমাদের ওয়েলকাম জানানোর জন্য আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছো দেখছি।”
–“হ্যাঁ না মানে__”
আনিতার অবস্থা বুঝতে পেরে রাতুল আর তন্ময় দুজনেই শব্দ করে হেসে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে আরহানও এসে হাজির। মিনিট দুয়েক চারজনে কথা বলল। আনিতা ওদের সাথে কথা বলছে আর বার বার রাস্তায় উঁকি দিচ্ছে। রাতুল হেসে বলে,
–“যাকে খুঁজছো সে আসেনি।”
–“আসেনি মানে?”
–“মানে আহিয়ান আসতে পারেনি। একেবারে পরশু বিয়েতেই এ্যাটেন্ড করবে ও।”
তন্ময়ের কথা শুনে আনিতার মুখটা ফেকাসে হয়ে গেলো। আজ সকালেও আহিয়ান বলেছে যে সন্ধ্যায় আসবে। বাট এখন তন্ময় কি বলছে? আহিয়ান নাকি আসবে না। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন আহিয়ান এলো না আনিতার তখন কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। তন্ময় ওরা তিনজনে মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে গেলো। আনিতা আর একবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে চলে আসতে নিলেই পিছন থেকে আহিয়ান আনিতার হাত টেনে ধরে। হাতে টান পড়াতে থেমে যায় আনিতা। পিছন ঘুরে আহিয়ানকে দেখতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে ওকে নিজের কিছুটা কাছে এনে বলে,
–“কি ভেবেছিলে সত্যিই আসবো না?”
–“আমি জানতাম আপনি আসবেন।”
–“হুম তা তো তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর একটু হলেই কেঁদে দিতে তুমি।”
আনিতা কিছু বলবে তার আগেই ফাইয়াজকে আসতে দেখে দৌড়ে চলে গেলো ওখান থেকে। আহিয়ান মাথা চুলকে আনিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
*
ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স বেজে চলছে আনিতাদের বাসায়। আধ ঘন্টার মাঝেই আনিতারা হলুদের সকল ধরনের ডালা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার মতো বাজে। আনিতা আর ওর সকল ফ্রেন্ডরা সেজেগুজে রেডি। সবাই একই শাড়ি আর একই সাজ সেজে ফটোশুট করছে। স্টেজে উঠে নানান ধরনের স্টাইলে ছবি তুলে ফোনের গ্যালারি লোড করছে। সাথে ফটোগ্রাফার তো আছেই। পুরো বাড়িতে মানুষ ভর্তি। সব মেয়েরা এক রকমের শাড়ি আর সব ছেলেরা একই রকম পাঞ্জাবি পড়েছে। আনিতা ওরা সবাই মিলে নানান ধরনের স্টাইলে ছবি তুলছিলো। তখনই ফাইয়াজ এসে ফটোগ্রাফারকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। ফাইয়াজ যাওয়ার পর আহিয়ান তন্ময় রাতুল আরহান চারজনেই স্টেজে উঠে। আহিয়ান এসে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
–“ডিয়ার সিস্টারস ইন-ল তোমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আমাদের আড়াল করো তো।”
–“কেন ভাই এহন এই পাবলিক প্লেসেও তোদের রোমান্স করতে হবে?”
রাতুলের কথায় সবাই উচ্চস্বরে হেসে দিলো। আনিতা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আনিতা ওখান থেকে চলে আসতে চাইলে রোদেলা ওরা ওকে আটকে দেয়। আহিয়ান রাতুলের পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
–“আরেহ শালা কাপল পিক তুলমু। এত বেশি বুঝোস কেন?”
–“ওওওও কাপল পিক তুলবা নাকি সেই সুযোগে একটু ছোঁয়ার বাহানা?”
আরহানের কথায় আনিতা কাঁশতে শুরু করে। কি সব বলছে এরা? আল্লাহ এদের মুখে কিচ্ছু আটকায় না। আহিয়ান রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
–“আমি চাইলে ওকে যখন তখন ছুঁয়ে দিতে পারি। কোনো বাহানা লাগবে না।”
কথাটা বলেই আহিয়ান আনিতার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আহিয়ানকে আনিতার হাত ধরতে দেখেই ওরা সবাই ওদের দুজনকে আড়াল করে দাঁড়ালো। আহিয়ান আনিতার কোমড় চেপে ধরে দাঁড়াতেই আনিতা কিছুটা কেঁপে উঠলো। আহিয়ান আনিতার দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হেসে বাকীদের উদ্দেশ্যে বলে,
–“তন্ময় ভাই আমার। আমাদের দুজনের কয়েকটা কাপল পিক তুলে দে। হাতে একদম সময় নেই। যে কেউ যখন তখন এসে পড়বে।”
তন্ময় মৃদু হেসে আহিয়ানের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো। তারপর আনিতা আর আহিয়ানের বেশ কয়েকটা কাপল পিক তুলে দিলো। হুট করেই ফাইয়াজের গলা শুনতে পেয়ে ওরা সবাই বেশ চমকে গেলো। ফাইয়াজ স্টেজে ওঠে ওদের সবার কাছে এগিয়ে এসে বলে,
–“কিরে তোরা সবাই মিলে এখানে এভাবে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হলুদ দিতে যাবি না? আনিতা কোথায়?”
ফাইয়াজের প্রশ্নে সবাই পিছন ফিরে তাকায়। পিছনে সত্যিই আনিতা নেই। আহিয়ান একা একাই একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। আহিয়ানকে একা দেখে সবাই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সবাই। এই বুঝি ফাইয়াজের কাছে ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু না শেষমেশ সবটা ঠিক আছে। ফাইয়াজ কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। পেছন থেকে আনিতা এসে ফাইয়াজকে বলে,
–“ভাইয়া খুঁজছিলে আমায়?”
–“হ্যাঁ। সবাই এখানে একসাথে আছে তুই কোথায় ছিলি?”
–“ভিতরে গিয়েছিলাম। কেন খুঁজছিলে বলো?”
–“লেট হয়ে যাচ্ছে ওই বাসায় হলুদ নিয়ে যেতে হবে তো। তাড়াতাড়ি চল।”
–“ভাইয়া।”
–“আবার কি?”
–“কিভাবে যাবো আমরা? তোমাকে বলেছিলাম আব্বুকে বলতে যে আমরা বাইকে যাবো।”
–“বড় মামাকে আমি বলেছি এখন চল তো। আমরা সবাই বাইকে করেই যাবো। এলাকার কিছু ছেলেরাও বাইকেই যাবে।”
আনিতা আর কোনো কথা না বলে সবার সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দেখে এখানে পনেরো থেকে বিশটা বাইক। সবগুলো বাইকেই দু/তিনজন করে মানুষ। হলুদের জন্য ভাড়া করা অন্যান্য গাড়ি গুলা আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখানে শুধু বাইক গুলো আছে। সবগুলো বাইক একসাথে যাবে আর তার ভিডিও করা হবে সেইজন্য। জেরিন এবারে রাতুলের বাইকে গিয়ে বসলো। তাসকিয়া ফাইয়াজ, রোদেলা তন্ময় একসাথে। শুভর বাইকে আরোহী বসেছে। জারা আর জয়ও একই বাইকে আছে। এখন ফাঁকা পড়ে আছে শুধু আরহান আর আহিয়ানের বাইক। আনিতার খালাতো ভাই এসে আরহানের বাইকের পিছনে উঠে বসতেই আনিতা খুশি খুশি মনে আহিয়ানের বাইকে চেপে বসলো।
*
রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ বাজে এখন। নয়টার দিকেই মেয়ে পক্ষ থেকে লোকজন এসে আনিতার ছোট চাচ্চুকে হলুদ দিয়ে গিয়েছে। একটু পরেই নাচের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আনিতা শাড়ি পাল্টানোর জন্য স্টেজ ছেড়ে বাসার দিকে আসতে নিলেই হেচকা টানে কেউ একজন আনিতাকে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়। আচমকা এমন ভাবে টান দেওয়াতে আনিতা হুমড়ি খেয়ে লোকটার বুকের উপর গিয়ে পড়ে। আনিতা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আনিতা আহিয়ানকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে,
–“এখানে নিয়ে আসলেন যে? বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হবে।”
–“কেউ যাতে না দেখে সেজন্যই তো এখানে নিয়ে এলাম।”
–“কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।”
–“এত তাড়া কিসের তোমার শুনি?”
–“এভাবে শাড়ি পড়ে কতক্ষণ থাকা যায়? চেঞ্জ করবো তো।”
–“উঁহু আজকে এভাবে থাকো। খুব সুন্দর লাগছে।”
–“তাই?”
–“উমমম তবে একটা কাজ করতে পারো।”
–“কি কাজ শুনি?”
–“এখন কিভাবে শাড়ি পড়ে আছো এটা?”
–“বাঙালি স্টাইলে। কেন বলুন তো?”
–“এখন গিয়ে কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে এসো। সাথে চুলগুলো খোলা রাখবে। আর___”
–“আর কি?”
–“বেলি ফুলের মালা দিবে চুলে। আর বা হাতেও বেলি ফুলের মালা পেচাবে।”
–“এই রাতের বেলা আমি বেলিফুলের মালা কোথায় পাবো?”
–“আচ্ছা আগে তুমি শাড়ি পড়ে এসো মালা আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
–“এখন? আবার আমি শাড়ি অন্যভাবে পড়ে আসবো? কেউ দেখলে কি বলবে বলুন তো?”
–“জানি না। কিন্তু আমার তোমাকে ওভাবে দেখতে খুউব ইচ্ছে করছে।”
আহিয়ানের কথায় আনিতা মুচকি হাসলো। তারপর সম্মতি জানিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। রুমে এসেই শাড়ি চেঞ্জ করে একটা প্লাজো আর টি-শার্ট পড়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো। পাক্কা একটা ঘন্টা অব্দি চুলে শ্যাম্পু করে চুলের জট ছাড়িয়েছে। পার্লারে সাজার এই এক খারাপ দিক। সাজার সময় তো বড্ড ভালোই কিন্তু চুলের জট ছাড়াতে গেলেই এত্ত এত্ত চুল উঠবে। শাওয়ার শেষে রুমে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিলো আগে। তারপর ওর মেজ কাকিমাকে ডেকে তার সাহায্যে কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে নিলো। আঁচল ছেড়ে রেখেছে। পিন আপ করেনি। শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে আনিতার কাকি মা চলে যেতেই আনিতা আহিয়ানকে ম্যাসেজ করে ছাদে আসতে বলল। ডান হাতে কাঁচা হলুদ রঙের চুড়ি গুলো পড়ে নিলো। আর চুলগুলো গুলো কোনোরকমে আচড়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
আনিতা ছাদে গিয়ে দেখলো আহিয়ান রেলিং ধরে নিচে বিয়ের স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের প্যান্ডেল স্টেজ সব নিচে উঠানে করাতে ছাদে এখন কেউ নেই। আনিতা গিয়ে আহিয়ানের পাশে দাঁড়াতেই আহিয়ান ঘুরে তাকালো আনিতার দিকে। ঘন্টা খানেক আগে মুখে যে ভারী মেকআপ ছিলো এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। চোখে শুধু গাড়ো করে কাজল আর ঠোঁটে হালকা ভাবে দেওয়া কমলা রঙের লিপস্টিক। ফর্সা মুখশ্রী তে এই হালকা ভাবে দেওয়া কমলা রঙের লিপস্টিকটা বড্ড ফুটে উঠেছে। আনিতার আগাগোড়া স্ক্যান করে আহিয়ান কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো।
*
আহিয়ান রেলিঙের উপর রাখা ছোট্ট শপিং ব্যাগ থেকে একটা বেলি ফুলের মালা বের করে আনিতার হাতে পেচিয়ে দিলো। তারপর আনিতাকে ওর দিকে পিঠ করে দাঁড় করালো। ব্যাগ থেকে বাকী বেলি ফুলের মালাটা বের করে নিলো। আনিতার হাত থেকে কালো ক্লিপের পাতাটা নিয়ে সেখান থেকে ক্লিপ খুলে নিলো। তারপর বেলি ফুলের মালার এক মাথা আনিতার ডান কানের পিঠে চুলের সাথে ধরে ভালো করে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো। তারপর বেলি ফুলের অপর মাথাটা চুলের উপর দিয়েই কিছুটা ঢিলে ভাবে টেনে নিয়ে আনিতার বা কানের পিঠে ক্লিপ দিয়ে একই ভাবে আটকে দিলো।
চুলে বেলি ফুলের মালা আটকানো শেষে আনিতাকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে দাঁড় করালো আহিয়ান। আনিতার পা থেকে মাথা অব্দি আর একবার স্ক্যান করে নিয়ে আহিয়ান বলে,
–“এখন একদম পারফেক্ট লাগছে। এর আগেও ভালো লেগেছে তবে এখন একটু বেশিই ভালো লাগছে।”
–“তা জনাব আপনি এই রাতে বেলি ফুলের মালা কোথায় পেলেন শুনি?”
–“বলতে হবে?”
–“হ্যাঁ অবশ্যই।”
–“কাল বেলি ফুলের মালা অর্ডার দিতে গিয়েই আমার আসতে কিছুটা লেট হয়েছিলো।”
–“মালা দুটো আপনি কাল অর্ডার দিয়েছিলেন? এজন্যই আপনি তন্ময় ভাইয়ারা আসারও কিছুক্ষণ পর এসেছিলেন?”
–“হ্যাঁ।”
–“আচ্ছা মালাটা কাল যদি অর্ডার দিয়ে থাকেন তাহলে ফুলগুলো এতো তাজা লাগছে কেন?”
–“বলেছিলাম আজ রাতে লাগবে মালা দুটো। দেড় ঘন্টা আগে গিয়েই নিয়ে এসেছি আমি। এনে ফ্রিজে রেখেছিলাম।”
–“জানেন খুব পছন্দের ফুল এইটা আমার।”
–“হ্যাঁ জানি তো।”
–“কিভাবে?”
–“সেটা সিক্রেট।”
–“বলবেন না?”
–“উঁহু।”
–“সত্যিই তো.”
–“হ্যাঁ।”
–“আচ্ছা তাহলে আপনি থাকুন এখানে আমি নিচে গেলাম।”
–“এই না না।”
কথাটা বলেই আহিয়ান আনিতার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। পিছন থেকে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে আনিতার পেটে হাত রাখলো আহিয়ান। মূহুর্তেই আনিতা জমে বরফ। বুক ধুকপুক করছে। নিঃশ্বাসটাও প্রচন্ডরকম ভারী হয়ে আসছে। খুব দ্রুতভাবে বুক উঠানামা করছে। আনিতার চুলে আহিয়ান কিছুক্ষণ মুখ গুজে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে আনিতার ঘাড়ে নেমে এলো। আহিয়ান আনিতার ঘাড়ে হালকা ভাবে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে চুমু খেতেই আনিতা কেঁপে উঠলো। আহিয়ানই একমাত্র ছেলে যার এতটা কাছে আনিতা এসেছে। আহিয়ানের স্পর্শ গুলো বারবার আনিতার মনে অন্যরকম শিহরণ জাগাচ্ছে। আহিয়ান আনিতার পেটে কিছুটা খামচে ধরে আনিতার ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো। আনিতা ছাড়া পেতে চাইলে আহিয়ান আরো জোড়ে চেপে ধরছে আনিতাকে। আহিয়ান পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেই আনিতার ঘাড়ে আলতো করে কামোড় বসিয়ে দিলো। আনিতার হৃদপিণ্ড যেন সেখানেই থেমে গেলো। আহিয়ান নিজের মাঝে একদমই নেই। এদিকে আনিতারও নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখাটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। আনিতা ওর পেট থেকে আহিয়ানের হাত ছাড়িয়ে উলটো ঘুরে শক্ত করে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। আহিয়ানের বুকে কান পেতে শুনতে লাগলো আহিয়ানের হৃদপিণ্ডের দ্রুত উঠানামা। আষ্টেপৃষ্টে আহিয়ানের সাথে মিশে গিয়ে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে আহিয়ানের বুকের বা পাশের ধুকপুকানির শব্দ গুলো চুপ করে শুনতে লাগলো আনিতা।
।
।
।
চলবে।
#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৭
#Ornisha_Sathi
আর কিছুক্ষণ আহিয়ানের সাথে ছাদে থেকে নিচে নেমে আসে আনিতা। বিয়ে বাড়ি প্রচুর লোকজন কখন কার চোখে পড়ে যায় ঠিক নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও দুজনে একসাথে বেশি সময় কাটালো না।
সাড়ে বারোটার মতো বাজে তখন। আনিতা নিচে নেমে প্যান্ডেলে যেতেই রোদেলা তন্ময় ওরা সবাই মিলে ঘিরে ধরে আনিতাকে। সবাই মিলে নানান ধরনের প্রশ্ন করে পাগল বানিয়ে ফেলে প্রায়। আনিতা কিছুটা চিৎকার করে সবাইকে থামতে বলে,
–“কি সমস্যা কি? এভাবে আমার পিছু লেগেছিস কেন?”
–“আমাদের প্রথম প্রশ্ন, তুই ভিতরে গেলি শাড়ি চেঞ্জ করতে। কিন্তু তুই শাড়ি চেঞ্জ না করে উলটো কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে আসলি কেন?”
জেরিনের প্রশ্নে আনিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। আনিতা কোনো ভণিতা না করে বলে,
–“ইচ্ছে হলো তাই।”
এবার রাতুল বলে,
–“আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি এই রাতের বেলা বেলি ফুল পেলে কোথায়?”
–“ক্ কোথায় আর পাবো? বেলি ফুলের গাছ আছে আমার সেখান থেকেই ফুল ছিড়ে মালা বানিয়েছি”
–“মিথ্যে বলে লাভ নেই বেবি। আমি জানি তোর বেলি ফুলের গাছ আছে। কিন্তু সেটাতে এখনো ফুল আসেনি। আর আমি যতটুকু জানি আমাদের এখানে সচারাচর বেলি ফুলের মালা পাওয়া যায় না।”
শুভর কথায় সবাই সহমত প্রকাশ করে। ধরা পড়ে গিয়ে চুপসে যায় আনিতা। আনিতা আমতা আমতা করে বলে,
–“অন্ অনলাইনে অর্ডার দিয়েছিলাম আমি।”
আনিতার কথায় সব্বাই মিলে উচ্চস্বরে হেসে দেয়। আনিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজছে। আরোহী কিছু বলবে তার আগেই তাসকিয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“ওক্কেহ জানু মানলাম আমরা তুই ফুলগুলো অনলানে অর্ডার দিয়েছিস। কিন্তু আধ ঘন্টা আগে তো তোকে আমরা খালি হাতে ছাদে যেতে দেখলাম। তখন তো তোর চুলে বা হাতে ফুল ছিলো না। তাহলে ছাদে থেকে নামতেই চুলে ফুল এলো কোত্থেকে?”
–“হ্যাঁ সেই। অনেকটা সময় যাবত আমরা আহিয়ানকেও দেখছি না।”
তন্ময়ের কথায় আনিতার এবার গলা শুকিয়ে এলো। এরা আবার ওর পিছু নিয়ে ছাদে যায়নি তো? কিচ্ছু দেখে ফেলেনি তো সবাই? রোদেলা এগিয়ে এসে আনিতার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
–“তা সোনা তোমার ঘাড়ে এমন লালচে দাগ এলো কোত্থেকে? দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ কামড়ে দিয়েছে।”
রোদেলার কথায় আনিতা চটজলদি ঘাড়ে হাত দিলো। আনিতার কান্ডে সবাই তাল মিলিয়ে হেসে দিলো। আর এদিকে বেচারি আনিতা লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে। আর মনে মনে আহিয়ানকে বকে যাচ্ছে। সেই মূহুর্তেই আনিতার ছোট চাচ্চুর বন্ধুরা আনিতাকে ডেকে বলে,
–“চাচ্চু__”
ডাক শুনে আনিতার মনে পালানোর আশা জেগে উঠলো। মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ জানালো ওর চাচ্চুর বন্ধুদের এই সময় ডাকার জন্য। এখানে আর একটু থাকলে আনিতা বোধহয় লজ্জায় মরেই যেতো। আনিতা লাফিয়ে উঠে বলে,
–“ইয়েস চাচ্চু।”
–“নাচবে না?”
–“অবশ্যই।”
–“তো চলো। শুরু করা যাক।”
–“তোমরা স্টেজে উঠো আমি এক্ষুনি আসছি।”
–“ওক্কেহ।”
আনিতা দৌড়ে ওখান থেকে চলে এলো। স্টেজের সামনে এসে দু হাটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। এতক্ষণে যেন আনিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। স্টেজের সামনে সাজানো সাড়ি সাড়ি চেয়ার গুলোর সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। আনিতার চাচ্চুর বন্ধুরা সাউন্ড বক্সে নিজেদের পছন্দের মতো গান চালিয়ে একেক জন স্টেজে উঠে গেলো। পুরো উঠোন জুড়ে মানুষ। সবাই নাচ দেখতে এসেছে। নাচের ছেলে-মেয়েরা কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। এখন রেডি হচ্ছে তারা। তাই এখন আনিতার চাচ্চুর বন্ধুরা স্টেজ কাঁপানোর জন্য উঠেছে। ডিজে গান ছেড়ে একেকজন উড়া ধুরা নাচ শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ বাদেই আনিতার সব বন্ধুরা ফাইয়াজের বন্ধুরা আনিতার পাশে এসে বসে পড়লো। আনিতার ডান পাশের চেয়ারটা খালি পড়ে আছে। মনে হয় আহিয়ানের জন্যই এখানে ওরা কেউ বসেনি। মিনিট দুয়েক বাদে আহিয়ানও এসে বসে পড়লো। সবাই মিলে আনিতার চাচ্চুর বন্ধুদের পাগলা ডান্স দেখছে আর হাসছে। হুট করেই আনিতার চাচ্চুর বেস্ট ফ্রেন্ড সৈকত স্টেজ থেকে নেমে এসে আনিতার সামনে দাঁড়িয়ে একহাত বাড়িয়ে বলে,
–“আম্মু চলো__”
আনিতাও মুচকি হেসে সৈকয়ের হাত ধরে স্টেজে উঠে যায়। আহিয়ান আনিতার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। স্টেজে এতগুলো ছেলে আছে সেখানে আনিতার যাওয়ার দরকার কি? আহিয়ান মানছে ওখানে ওর চাচ্চুর ফ্রেন্ডরা আছে বাট আরো অন্যান্য ছেলেও তো আছে। ও কেন যাবে সেখানে সবার সাথে নাচ করতে? রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে আহিয়ান। নাচতে নাচতে হঠাৎই করেই আহিয়ানের উপর চোখ যায় আনিতার। সাথে সাথেই থেমে যায় ও। আহিয়ানের এভাবে রেগে যাওয়ার কারনটা প্রথমে বোধগম্য না হলেও কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছে আনিতা। একটা ছেলে হঠাৎই আনিতার দিকে এগোতে থাকে। আনিতা বিষয়টা প্রথমে খেয়াল করেনি। ছেলেটা আনিতাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়াতেই আহিয়ান ছেলেটার হাত ধরে ফেলে। ছেলেটাকে আনিতার দিকে এগোতে দেখেই আহিয়ান বুঝেছিলো এর মতলব বেশি ভালো না। তাই দেরী না করে সাথে সাথেই স্টেজে উঠে যায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আঁতকে উঠে আনিতা। পিছিয়ে যায় কয়েক পা। আমোদ ফুর্তিতে থাকায় অন্য কেউ বিষয়টা খেয়াল না করলেও আহিয়ানের চোখে পড়ে গিয়েছিলো ছেলেটা। আহিয়ান শুরু থেকেই লক্ষ্য করছিলো ছেলেটাকে। আনিতা স্টেজে উঠার পর থেকেই বাজে ভাবে তাকাচ্ছিলো আনিতার দিকে। আনিতা ছেলেটার থেকে বেশ কয়েক পা সরে গিয়ে ভয় ভয় চেহারায় আহিয়ানের দিকে তাকাতেই আহিয়ান ঝামটা মেরে ছেলেটার হাত ছেড়ে দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যায়। দ্রুত পা ফেলে এখান থেকে চলে যায় ও। আনিতাও তড়িঘড়ি করে স্টেজ থেকে নেমে আহিয়ানের পিছু নেয়। আহিয়ানের পিছু নিয়ে আনিতাও ছাদে উঠে যায়। আহিয়ান ততক্ষণে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েছে। আকাশের দিকে ভাবলেসহীন ভাবে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আনিতা দ্রুত পায়ে আহিয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
–“আ্ আহিয়ান__”
–“____”
–“কথা বলবেন না আমার সাথে? আমি বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হতে পারে। আমি না বুঝেই___”
–“গেট আউট।”
–“আমার কথাটা__”
–“বললাম না এখান থেকে যেতে?”
–“নাহ যা্ যাবো না আমি।”
–“ওকে ডান। তোমার যেতে হবে না আমিই চলে যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই আহিয়ান হাতের জলন্ত সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দেয়। ওখান থেকে চলে আসতে নিলেই আনিতা ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে,
–“আমার কথা না শুনে যেতে পারবেন না আপনি।”
–“এখন তুমি ঠিক করে দিবে আমি কি করবো আর কি করবো না?”
–“না মানে___”
–“প্লিজ লিভ এলোন। আমি একা থাকতে চাই কিছুটা সময়। তুমি বরং নিচে যাও সবাই ওয়েট করছে তো তোমার জন্য। নিচে গিয়ে স্টেজে উঠে পড়ো যাও। ছেলেটাকে আবার তোমায় ছোঁয়ার সুযোগ করে দাও।”
–“আহিয়ান__”
আহিয়ান রেগে গিয়ে আনিতার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
–“কি আহিয়ান হ্যাঁ? এতগুলো ছেলের সাথে তোর নাচতে কেন হবে? মানলাম ওরা তোর চাচ্চুর ফ্রেন্ড তাই বলে নাচতে চলে যাবি? এখনকার যুগে সুযোগ পেলে কিছু কিছু ভাই তার বোনকে ছাড়ছে না। বাবা তার মেয়েকে ছাড়ছে না। আর ওরা তো তোর চাচ্চুর ফ্রেন্ড।”
কথাটা বলেই আহিয়ান আনিতাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আচমকা এভাবে ধাক্কা দেওয়াতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো আনিতা। ব্যালেন্স সামলাতে ছাদের রেলিং চেপে ধরলো। রডের সাথে লেগে আনিতার বা হাতের কুনই কিছুটা কেটেও গিয়েছে। রক্ত ঝড়ছে কিছুটা। কিন্তু আনিতা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবারো আহিয়ানের দিকে এগিয়ে গেলো। আহিয়ানের দু গালে হাত রেখে বলে,
–“আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আপনার রাগ করাটা অহেতুক নয়। কিন্তু সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হতে পারে।”
আহিয়ান আনিতার হাত দুটো সরিয়ে দেয় ওর গাল থেকে। আনিতার দুই কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে বলে,
–“ছেলেটা যদি টাচ করে ফেলতো তোকে? তখন কি হতো হ্যাঁ? কি হতো তখন? জানিস ছেলেটার নজর খুব বাজে ছিলো। খুব বাজে ভাবে দেখছিলো তোকে। এদিকে একটা ছেলে তোকে দূর থেকে বাজে নজরে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আর সেদিকে তোর কোনো হেলদোলই নেই? কিচ্ছু টের পেলি না তুই? একটা ছেলের নজর ঠিক কতটা বাজে হলে সে স্পর্শ করতে যায় জানিস তুই? বুঝিস এসব?”
–“____”
–“কি হলো? এখন চুপ করে আছিস কেন? এতক্ষণ তো খুব কথা বলছিলি তাহলে এখন চুপ কেন? আন্সার মি।”
আনিতা কিছু না বলে আহিয়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। শক্ত করে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“ভালোবাসি আপনাকে।”
আহিয়ানের রাগ তখনো কমেনি। আহিয়ান আনিতার দু হাত ধরে ওকে নিজের থেকে সরাতে গেলেই আনিতার বা হাতের কুনোইটা ভেজা ভেজা লাগে ওর। তড়িৎ গতিতে আহিয়ান আনিতার বা হাত উঁচু করে ধরে কুনোই এর দিকে তাকায়। বিয়ে উপলক্ষে সারা বাড়ি লাইটিং করা ছিলো। আনিতা আর ফাইয়াজদের দুটো বিল্ডিংই মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। লাল নিল কালারিং বাতিতে আহিয়ান স্পষ্ট দেখতে পেলো আনিতার হাত কেটে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। হঠাৎ রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলো আহিয়ান। কিভাবে কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। পরক্ষণেই মনে পড়লো একটু আগে বেশ জোড়েই ধাক্কা মেরেছিলো ও আনিতাকে। তখনই হয়তোবা কোথাও একটা লেগে গিয়ে এভাবে__। নিজের উপর এবার বেশ রাগ হলো আহিয়ানের। কেন যে নিজের রাগটাকে সামলাতে পারে না ও। ওর ভুলের জন্য আজ কতটা লেগে গেলো আনিতার। ইশ্। এসব ভেবেই ছাদের রেলিঙে সজোরে পাঞ্চ মারে একটা। ঘটনার আকস্মিকতায় আনিতা চমকে উঠে। আহিয়ানের হাত চেপে ধরে বলে,
–“পাগল হয়েছেন? কি করছেন এসব?”
আহিয়ান আনিতার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আনিতার হাত ধরে বলে,
–“খুব লেগেছে তোমার তাই না? এতক্ষণ বলোনি কেন আমাকে? কিভাবে রক্ত বের হচ্ছে দেখেছো?”
–“তেমন কিছুই হয়নি।”
–“তেমন কিছু না হলে রক্ত বের হতো না আনি। আমার জন্য তুমি এতটা ব্যাথা পেলে।”
–“আরেহ বললাম তো তেমন কিছু হয়নি।”
আহিয়ান ওর পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে আনিতার কুনোই তে বেধে দিলো। আনিতাকে দু হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“আ’ম সরি আনি। আমি আসলে___মানে তখন মাথা কাজ করছিলো না আমার। জাস্ট একটা কথায় বার বার মনে পড়েছে ওই ছেলেটা তোমাকে বাজে নজরে দেখছিলো তোমাকে বাজে ভাবে টাচ করতে চাইছিলো।”
–“ইট’স ওকে। আমারই ভুল ছিলো। নেক্সট টাইম থেকে খুব কেয়ারফুলি থাকবো।”
–“তোমার পাশে আমি কাউকে জাস্ট সহ্য করতে পারি না। মানতে পারি না তোমার পাশে আমি অন্য কাউকে। আর সেখানে ওই ছেলেটা তোমায় টাচ করতে চেয়েছিলো। আমার তো ইচ্ছে করছিলো ওকে ওখানেই শেষ করে দিতে। নেহাৎ এটা বিয়ে বাড়ি বলে। আর আমাদের সম্পর্কটা কেউ জানে না। আমাদের সম্পর্কটা এসময় সবার সামনে এলে পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যাবে বলে চুপ থাকতে হলো আমায়। নয়তো___”
–“হয়েছে তো। এবার মাথাটা ঠান্ডা করুন প্লিজ।”
–“হুম।”
আহিয়ান আর আনিতা দুজনে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়েই রাজ্যের গল্প জুড়ে বসেছে। আশেপাশের কোনোদিকে ধ্যান নেই। আনিতা এক মনে হাত নাড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। আর আহিয়ান মুগ্ধ হয়ে শুনছে। আহিয়ান কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে আনিতার অগোচরেই বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। আনিতা কথা বলাতে এতটাই মগ্ন ছিলো যে ও জানতেই পারলো না আহিয়ান ওর বেশ কিছু ছবি তুলেছে। আনিতার কথা বলার ধরন দেখে আহিয়ান মুচকি হাসছে। আনিতা কখনো বেশ উৎফুল্ল মনে কথা বলছে তো কখনো মুখটাকে একদম গোমড়া করে ফেলছে। নানান ধরনের অঙ্গভঙ্গির সাথে কথা বলে যাচ্ছে আনিতা। একেক সময় মুখের একেক রকমের এক্সপ্রেশন করছে। আর খুব মনোযোগ সহকারেই আহিয়ান সেসব শুনছে। আর মাঝে মাঝে আনিতার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠছে।
হঠাৎ করেই আহিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর এক পা দুপা করে আনিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আনিতা তখনো কথা বলাতেই ব্যাস্ত। আহিয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আনিতার পিছনে গিয়ে আনিতাকে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। আলতো ভাবে আহিয়ানের হাত জোড়া আনিতার ফরসা উম্মুক্ত পেট স্পর্শ করতেই আনিতা থেমে গেলো। গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বের হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আনিতার অবস্থা বুঝতে পেরে আহিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হেসে দিলো। আনিতার ঘাড়ে আহিয়ান থুতনি রেখে বলে,
–“কি হলো চুপ করে গেলে যে? আর কিছু বলবে না?”
–“আ্ আপনি কিছুটা স্ সরে দাঁড়ান প্লিজ।”
–“তা তো হচ্ছে না। আমি এভাবেই আমার পিচ্চিটাকে জড়িয়ে ধরে রাখবো।”
–“কিন্তু___”
–“হুশ কোনো কিন্তু না।”
এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়। আনিতাও এখন নিজেকে সহজ করে নিয়েছে। এখন আগের মতো অতটা অস্বস্তি হচ্ছে না ওর। আহিয়ান পিছন থেকে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে এখন অব্দি। আহিয়ান এখনো আগের মতোই আনিতার কাঁধে থুতনি রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আর দু-হাতে পেট জড়িয়ে রাখা। আনিতাও আহিয়ানের হাতের উপর হাত রেখে আহিয়ানের বুকের সাথে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়ান একেক সময় একেক কথা বলছে আর তাতে আনিতা খিলখিল করে হেসে উঠছে।
হঠাৎ করেই ছাদের দরজার সামনে কেউ একজন এসে দাঁড়ায়। আনিতা আর আহিয়ানকে এই অবস্থায় দেখে ওই মানুষটা নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষটা অবাক চোখে দেখছে ওদের দুজনকে। আনিতা বা আহিয়ান কেউ খেয়াল করেনি যে ছাদে ওরা দুজন ব্যাতিত আরো একজন উপস্থিত আছে এখন।
–“আনিতা আহিয়ান___তোরা দুজন এখানে একসাথে এই অবস্থায়?”
কারো গলার স্বর পেয়ে আহিয়ান আর আনিতা উভয়ই ছাদের দরজার দিকে তাকায়। ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে ওরা চমকে দুজন দুজনকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। ওরা ভাবতে পারেনি এসময় নাচ গানের আসর ছেড়ে কেউ ছাদে আসতে পারে। আনিতা এক কোনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে আনিতার হাত-পা জমে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
।
।
।
চলবে।
#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৮
#Ornisha_Sathi
–“কি হলো? উত্তর দিচ্ছিস না কেন আনি বুড়ি? তুই এই অবস্থায় আহিয়ানের সাথে কি করছিস?”
লাস্টের কথাগুলো ফাইয়াজ বেশ জোরে ধমক দিয়েই আনিতা কে জিজ্ঞেস করে। ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠে। ভয় পেয়ে আনিতা নিজের শাড়ি খামচে ধরে। আনিতা বা আহিয়ান কেউ-ই কথা বলছে না। ওদেরকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে ফাইয়াজের মাথা আরো গরম হচ্ছে। ফাইয়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে তন্ময় আর তাসকিয়া দুজনকেই ম্যাসেজ করে ছাদে আসতে বলে। মিনিট তিনেকের ব্যবধানে সকলেই ছাদে এসে উপস্থিত হয়। তন্ময় ফাইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–“কিরে এত জরুরি তলব? সবাইকে নিয়ে দ্রুত ছাদে আসতে বললি কেন? কিছু বল____”
পুরো কথা শেষ করার আগেই তন্ময়ের চোখ যায় ওদের থেকে কিছুটা দূরত্বে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা আনিতা আর আহিয়ানের দিকে। তন্ময়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই সামনে তাকাতেই ওদের দুজনকে দেখতে পায়। তন্ময় ফাইয়াজের দিকে তাকাতে দেখে ফাইয়াজ থমথমে মুখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে কারোরই বেশি বেগ পেতে হলো না। তাসকিয়া ভয়ে একটা ঢোক গিললো। সবাই মনে মনে একই কথা ভেবে চলছে, ‘কি হবে এবার?’
তন্ময় আহিয়ান ওদের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
–“ফাইয়াজ বল কি বলবি? আমরা সকলেই তো এখানে উপস্থিত আছি।”
ফাইয়াজ ঘুরে তন্ময়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–“আহিয়ান আর আনিতা একা একা এখানে কি করছিলো তন্ময়? তোদের সবার তো একসাথে নিচে থাকার কথা। তাহলে ওরা দুজন তোদের থেকে আলাদা হয়ে একান্তে এখানে কি করছে?”
–“ক্ কি আর করবে বল? ক্ কথা ব্ বলছিলো মেবি।”
–“কেন তোদের সামনে কথা বলা যেতো না? নিচে কথা বললে কি এমন সমস্যা হতো শুনি? এত রাতে ছাদে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কি এমনি এমনি কথা বলতে এসেছে বলে তোর মনে হয়?”
–“তা্ তাছাড়া আর কি হবে বল?”
রাতুলের কথায় ফাইয়াজ ওর দিকে তাকায় একবার। তারপর আবার আহিয়ান আনিতার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
–“বাচ্চা পাইছিস আমাকে? তোরা যা বুঝাবি আমি তাই বুঝে নিবো? আমার কি কোনো কমনসেন্স নেই? আমি বুঝি না এত রাতে একা একটা ছেলে আর মেয়ে সবার আড়ালে ছাদে দাঁড়িয়ে কিসের কথা বলতে পারে? কি সম্পর্ক থাকতে পারে তাদের মাঝে।”
–“ত্ তুমি ভ্ ভুল ভাবছো ফাইয়াজ। তুমি যা ভা্ ভাবছো সেরকম ক্ কিচ্ছু না।”
তাসকিয়ার কথা শুনে ফাইয়াজ এবার বড় বড় পা ফেলে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাসকিয়ার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কিছুটা চিৎকার করে বলে,
–“সেরকম কোনো সম্পর্ক না হলে ওরা পারসোনালি দুজনে এখানে কি করছিলো? আহিয়ান কেন আনিতাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো বলো আমায়?”
ফাইয়াজের প্রশ্নে এবার সবাই চুপসে গেলো। এখন তো কোনোমতেই সত্যিটা ওর থেকে লুকানো যাবে না। তন্ময় মনে মনে নিজেকে নিজেই বেশ কয়েকটা গালি দিলো। তখন স্টেজে হওয়া সকল ঘটনাই তন্ময় নোটিশ করেছিলো। আহিয়ানের পিছু পিছু আনিতাও যে ছুটে ছাদে এসেছে তন্ময় সেটাও দেখেছে। তন্ময় একবার ভেবেছিলো যে ও গিয়ে ওদের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো ওরা দুজনে যখনই দেখা করেছে সবসময়ই সাথে ও ছিলো ওদের দুজনেরও তো ইচ্ছে হয় আলাদা কিছুটা টাইম স্পেন্ড করার। আর তাছাড়া এখন তো সবাই বিজি আর সবকিছুর ব্যবস্থা নিচেই করেছে এসময় কেউ ছাদে যাবে না। এসব ভেবেই পরবর্তীতে তন্ময় আর এখানে আসেনি। কিন্তু কে জানতো? ফাইয়াজ এসময় ছাদে চলে আসবে। আর ওর এই না আসাটাই সবথেকে বড় ভুল হয়েছে। মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছে তন্ময়। সবাইকে মাথা নিচু করে চুপ থাকতে দেখে ফাইয়াজ কিছুটা চিৎকার করে বলে,
–“এতক্ষণ তো সবাই খুব করে বলছিলি ওদের মাঝে সেরকম কিছু নেই আমি ভুল ভাবছি। তাহলে এখন সবাই মুখে তালা দিয়ে আছিস কেন? হুয়াই? আন্সার মি।”
ফাইয়াজের চিৎকারে আনিতা শক্ত করে শাড়ি খামচে ধরে নিঃশব্দে কান্না করে দিলো। আহিয়ান আনিতার একহাত ধরে আনিতাকে আস্বস্ত করে চোখের ইশারায় বুঝালো,
–“আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না।”
বিনিময়ে আনিতা করুন চোখে তাকালো। আরহান কিছুটা এগিয়ে এসে আমতা আমতা করে ফাইয়াজকে বলে,
–“তোর ম্ মনে হয় দ্ দেখতে কোথাও একটা ভ্ ভুল___”
আহিয়ান আরহানকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“ফাইয়াজ সবটা দেখেছে আরহান। তোরা চাইলেও আর কিচ্ছু লুকোতে পারবি না। আর সত্যি কতদিন লুকিয়ে রাখা যায় বল? একদিন না একদিন তো এই সত্যিটা সবার সামনে আসতোই। আজ ফাইয়াজ জেনেছে কাল পুরো পরিবার জানবে। আর আমিও চাইছি না এভাবে আর লুকোচুরি করতে।”
আহিয়ানের কথায় এবার সবাই চুপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো বলেছে আহিয়ান সত্যি কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না। সেটা আজ হোক বা কাল সবার সামনে আসবেই। আর ফাইয়াজও তো আহিয়ানের বাহুডোরে আনিতাকে বন্দি অবস্থায় দেখেছে। কি মিথ্যে বলে কাটাবে ফাইয়াজকে? আহিয়ান ছোট ছোট কদম ফেলে ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে একটা শ্বাস নিলো। ফাইয়াজের চোখে চোখ রেখেই আহিয়ান বলে,
–“ফাইয়াজ তোর বোনকে ভালোবাসি আমি। শুধু আমি একা না ও ভালোবাসে আমায়। আর আমি তোর বোনকে ভালোবাসি এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমার।”
–“মানে?”
–“তুই যা শুনেছিস একদম ঠিকই শুনেছিস। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি আজ থেকে না। গত দেড় বছর যাবত আমরা সম্পর্কে আছি। বিশ্বাস কর সত্যিই তোর এই পিচ্চি বোনটাকেই আমি ভালোবাসি।”
কথাগুলো বলে আহিয়ান ফাইয়াজের হাত ধরতেই ফাইয়াজ ঝামটা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ফাইয়াজের কান্ডে অবাক চোখে আহিয়ান তাকায় ওর দিকে। আহিয়ানের মতো করে সেখানে উপস্থিত সকলেই বেশ অবাক হয়েছে ফাইয়াজ এভাবে হাত সরিয়ে নেওয়াতে। ফাইয়াজ আহিয়ানকে পাশ কেটে আনিতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
–“আহিয়ান এসব কি বলছে আনি বুড়ি? তুই ভালোবাসিস ওকে?”
আনিতা কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলো। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে আনিতা। ওকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে ফাইয়াজ ধমকে বলে,
–“কি হলো কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
–“ভা্ ভালোবাসি আমি উ্ উনাকে।”
ফাইয়াজের ধমকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আনিতা। হেঁচকি তুলতে তুলতেই উপরের কথাটা বললো আনিতা। ফাইয়াজ পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। আহিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
–“ও ছোট আহিয়ান। ওর লাইফ নিয়ে এভাবে খেলিস না তুই। আমি জানি তুই কাউকে ভালোবাসতে পারিস না। অনেক মেয়ের সাথে তুই সম্পর্কে জড়াস শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্য। এমন অনেক মেয়ে তোর লাইফে এসেছে আহিয়ান। আবার তোর যখন ইচ্ছে হয়েছে তখন তুই সেসব মেয়েদের ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দু বার ভাবতি না। মেয়েদের ইমোশনস ভালোবাসা ভালোলাগা এসব নিয়ে তুই খেলতে ভালোবাসিস। কিন্তু আমার বোনটা ওরকম না। ওর বয়সই বা কত বল? ও্ ওর সাথে এরকমটা করিস না আহিয়ান।”
–“ফাইয়াজ আমি খেলছি না ওর সাথে। ট্রাস্ট মি। আমি সত্যিই আনিতাকে ভালোবাসি।”
–“এসব তুই সব্বাইকেই বলতি। তুই ভালোবাসিস না ওকে। কেন শুধু শুধু ওর লাইফে এসেছিস বল?”
তন্ময় এগিয়ে এসে ফাইয়াজকে বলে,
–“ফাইয়াজ তুই কেন বুঝতে চাইছিস না? আহিয়ান সত্যিই আনিতাকে ভালোবাসে।”
–“না না ওর এখন মনে হতে পারে যে ও আনিতাকে ভালোবাসে কিন্তু একটা সময় ও অন্যসব মেয়েদের মতো করেই আমার বোনটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিবে। আর আমি ভাই হয়ে এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। আর আমারই বেস্ট ফ্রেন্ড আমার বোনের লাইফ নষ্ট করবে এটা আমি মানতে পারবো না। আমি চাই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কোনোদিনও আমার চোখে খারাপ হোক। আমি চাই তুই সারাজীবন আমার বেস্ট ফ্রেন্ডই থাক। তোর জায়গাটা আমার লাইফে সারাজীবন থাকুক আহিয়ান। কিন্তু আনিতার সাথে তোর সব সম্পর্ক শেষ করে দিতে হবে। কিছু মাস বা কিছু বছর পর সম্পর্ক ভাঙার যে কষ্টটা পাবে তার থেকে এখন পাওয়াই ভালো। আনিতার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবি না আহিয়ান।”
আনিতা এগিয়ে এসে ফাইয়াজের হাত ধরে বলে,
–“ভাইয়া ভুল ভাবছো তুমি। হ্যাঁ আমিও জানি উনি একসময় অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাস করো এখন উনি নিজেকে পালটে নিয়েছে। উনার লাইফে এখন আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে নেই।”
–“আনি বুড়ি তুই খুব ছোট। দুনিয়ার কিচ্ছু এখনো দেখিসনি তুই। আর আহিয়ানকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি। ও কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তোর মতো এমন অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে ও।”
–“ভাইয়া আমার কথাটা___”
–“আনিতা আমি চাই না তুই এর মাঝে আর একটাও কথা বলিস।”
রোদেলা এসে আনিতাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। তাসকিয়া ফাইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
–“ভুল করছো ফাইয়াজ। খুব বড় ভুল কর___”
–“আমি তোমার থেকে কিছু শুনতে চাইনি তাসকিয়া।”
তাসকিয়া কিছু না বলে আনিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শুভ রাতুল তন্ময় আরহান সবাই মিলে ফাইয়াজকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ফাইয়াজ কারো কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না। আহিয়ান ফাইয়াজকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আচ্ছা ফাইয়াজ কোনো মেয়ের সাথে আমাকে দু/তিন মাসের বেশি সময় ধরে সম্পর্কে জড়াতে দেখেছিস কখনো? দেখিসনি তো। তোরা তো জানতিস আমি একটা মেয়ের সাথে দু/তিন মাসের বেশি সম্পর্ক রাখতাম না। আর সেখানে আনিতার সাথে আমার দেড় বছরের সম্পর্ক। অন্যান্য সব মেয়েদের মতো করেই যদি আনিতার সাথে সময় কাটানোর জন্যই আমি সম্পর্ক করে থাকি তাহলে আনিতার সাথে কেন দু/তিন মাসের মাথাতেই সম্পর্ক শেষ করে দিলাম না? কেন আনিতার সাথে দেড় বছর ধরে সম্পর্কে আছি আমি? বলতে পারিস ফাইয়াজ?”
–“জানি না আমি।”
–“আর তুই আমাকে আনিতার যতটা কাছে দেখেছিস আমি কিন্তু আর কোনো মেয়ের এতটা কাছে যাইনি। ওদের হাত অব্দিও আমি ধরিনি কখনো। আর তোরা কিন্তু খুব ভালো করেই জানিস আমি ভালো না বাসলে কারো এতটা কাছে যাই না। আর কাউকে আমার কাছে আসতেও দেই না।”
এইটুকু বলে আহিয়ান থামলো। ফাইয়াজ তখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়ান একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলে,
–“আমার লাইফে আমি প্রথম মিলির কাছে গিয়েছিলাম। মিলি আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলো। ওকেই প্রথম স্পর্শ করেছিলাম ওর হাত ধরেছিলাম হাগ করেছিলাম কপালে চুমু খেয়েছিলাম। মিলিকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম একসময় তাই ওর কিছুটা কাছে গিয়েছিলাম আমি। আর সেকেন্ড এন্ড লাস্ট টাইম আমি আনিতার এতটা কাছে এসেছি। আনিতাকে যদি ভালো না বাসতাম ওর এতটা কাছে আমি আসতাম না। সবার লাইফেই শেষ ভালোবাসা আসে। আর আনিতা হচ্ছে আমার শেষ ভালোবাসা। মিলির পরে আনিতাকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি। কিন্তু আনিতার পরে আর কাউকে আমি ভালোবাসতে পারবো না। আমি আগের আহিয়ান নেই ফাইয়াজ। আনিতার জন্য আমি নিজেকে পালটে নিয়েছি। আমি আনিতাকে সত্যিই ভালোবাসি ফাইয়াজ। বিশ্বাস কর অনেক বেশিই ভালোবাসি ওকে আমি।”
–“আমি এত কিছু শুনতে চাই না আহিয়ান। তোর কারনে আমি আমার বোনকে কষ্ট পেয়ে কাঁদতে দেখতে পারবো না। আর তোকে আমার চোখে খারাপ হওয়াটাও দেখতে পারবো না। আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে হারাতে পারবো না। আমি চাইনা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য আমার বোন কাঁদুক। আমি চাইনা আমার বেস্ট কোনোদিনও আমার চোখে খারাপ হোক।”
–“ফাইয়াজ___”
–“তুই আনিতার সাথে আর কোনোরকম সম্পর্ক রাখবি না। ব্যাস এতটুকুই।”
–“বোঝার চেষ্টা কর আনিতাকে ভালোবাসি আমি। আর আনিতাও ভালোবাসে আমায়।”
–“আমাদের এতবছরের বন্ধুত্বের দিব্যি আহিয়ান। আনিতার সাথে সব সম্পর্ক তুই এখানেই শেষ করে দে। কোনোরকম সম্পর্ক রাখবি না ওর সাথে।”
ফাইয়াজের কথায় আহিয়ান দু পা পিছিয়ে যায়। ও ঠিক কথাটা হজম করতে পারছে না। ওদের এতবছরের বন্ধুত্বকে টেনে আনলো ফাইয়াজ? রাতুল এগিয়ে এসে ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা চিৎকার করেই বলে,
–“কি বলছিস কি তুই এসব? পাগল হয়ে গেছিস নাকি?”
–“আমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি। এতেই ওদের দুজনের জন্য ভালো হবে। এতে আহিয়ান আনিতা দুজনেই ভালো থাকবে। আর আমাদের ফ্রেন্ডশিপও আগের মতোই থাকবে।”
–“এতে ওরা কেউ-ই ভালো থাকবে না ফাইয়াজ ভাইয়া। ওরা দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আপনি ঠিক করছেন না এসব।”
কথাগুলো বলে রোদেলা থামতেই তন্ময় এসে ফাইয়াজের দু কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে রাগী স্বরে চিৎকার করে বলে,
–“তুই যে দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছিস সেটা তুই কি বুঝতে পারছিস না ফাইয়াজ? এতে আনিতা বা আহিয়ান কেউ-ই ভালো থাকবে না। তুই আনিতার ভালো করতে গিয়ে উলটো আনিতার খারাপ করছিস। আনিতার থেকে আহিয়ানকে সরিয়ে তুই ওকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছিস। কেন তুই এটা বুঝতে পার___”
–“তুই যা বলবি ত্ তাই হবে ফাইয়াজ। শেষ করে দিলাম আ্ আনিতার সাথে সব স্ সম্পর্ক। আর কোনোদিনই ওকে ব্ বলবো না ভা্ ভালোবাসি। আজকের পর থেকে ওর সাথে আ্ আমার আর কোনো সম্পর্ক থা্ থাকবে না।”
আহিয়ানের কথা শুনে আনিতা ধপ করে ছাদের ফ্লোরে বসে পড়লো৷ তন্ময় রাতুল রোদেলা ওরা সবাই অবাক চোখে আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইয়াজ খুব খুশি হয় আহিয়ানের কথা শুনে। ফাইয়াজ এগিয়ে এসে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলতে পারবি না। আমি তোর, আনিতার দুজনেরই ভালো চাই। আমি চাই না তুই কোনোদিন আমার চোখে বা আনিতার চোখে খারাপ হোস। আর আমি এটাও চাই না তোর দ্বারা আনিতা কষ্ট পাক। আমি সত্যিই আজ খুব খুশি হয়েছি। আমি জানতাম তুই আমাদের বন্ধুত্ব কিছুতেই নষ্ট হতে দিবি না।”
কথাগুলো বলে ফাইয়াজ আহিয়ানকে ছেড়ে দিলো। নিচে থেকে বেশ কয়েবার ফাইয়াজের ডাক আসাতে ফাইয়াজ ওদের সবাইকে নিচে আসতে বলে নেমে গেলো ছাদ থেকে। জেরিন আহিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
–“কি করলে তুমি এটা? শেষ করে দিলে সবকিছু? একবার আনিতার কথাটাও ভাবলে না?”
–“এছাড়া আর কি করতাম আমি? তোমরাই বলো না আর কি করার আছে আমার?”
–আমরা সবাই ছিলাম আহিয়ান। ঠিক কোনো না কোনো ভাবে ফাইয়াজকে মানিয়ে নিতাম। তুই হুট করে কেন ওকে কথা দিতে গেলি?
তন্ময়ের কথায় আয়াহিয়ান জবাবে কিছুই বলল না। শুভ এগিয়ে এসে আহিয়ানকে বলে,
–“আপনি এটা ঠিক করলেন না আহিয়ান ভাই। আপনার আর ফাইয়াজ ভাইয়ের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য আপনি আনিতার সাথে সব শেষ করে দিলেন? ফাইয়াজ ভাইকে কথা দেওয়ার আগে একবারের জন্যও আনিতার কথা ভাবলেন না আপনি?
শুভর কথায় আহিয়ান চুপ করে রইলো। কোনো উত্তরই দিলো না। কি জবাব দিবে? আর সত্যিই তো আহিয়ান ওদের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য নিজের ভালোবাসাকে শেষ করে দিলো। একটাবারের জন্যও আনিতার কথা ভাবলো না। মেয়েটা যে বড্ড বেশি ভালোবাসে ওকে। আহিয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে আরহান বলে,
–“আমরা সবটা ম্যানেজ করে নিতাম আহিয়ান। তুই কেন ফাইয়াজকে কথা দিতে গেলি? আনিতার মনের অবস্থাটা একবার ভেবে দেখেছিস?”
আরহানের কথায় আহিয়ান আনিতার দিকে তাকালো। মেয়েটা পাথরের মূর্তির ন্যায় মেঝেতে বসে আছে। অনবরত চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর। আহিয়ান গিয়ে আনিতার দুই বাহু ধরে ওকে বসা থেকে দাঁড় করায়। তারপর আনিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
–“একদম কাঁদবে না বলে দিলাম। সবসময় হাসতে হবে তোমাকে। হাসলে খুব সুন্দর লাগে তোমায় দেখতে বুঝলে? এরপর থেকে আর নো কান্নাকাটি অনলি স্মাইলিং ওকে?”
–“একটু আগে কি বললেন ওসব আপনি ফাইয়াজ ভাইয়াকে? ওসব মিথ্যে বলেছেন তাই না? বলুন না যা বলেছেন সব মিথ্যে ছিলো।”
আহিয়ান আনিতার গাল দুটো ধরে বলে,
–“কিচ্ছু মিথ্যে ছিলো না। সবটাই সত্যিই ছিলো। কথা দিয়েছি আমি ফাইয়াজকে। আর আজকের পর থেকে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই।”
ঝামটা মেরে আনিতা আহিয়ানের হাত সরিয়ে নেয় নিজের গাল থেকে। আহিয়ানের পাঞ্জাবির কর্লার শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
–“নাহ। সব মিথ্যে ছিলো। আপনি এমনটা করতে পারেন না আমার সাথে। আপনি আমাদের সম্পর্ক এভাবে ভেঙে দিতে পারেন না। আপনার কাছে কি শুধুমাত্র আপনার বন্ধুত্বেরই মূল্য আছে? আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? আমার কোনো মূল্য নেই আপনার লাইফে?”
আহিয়ান নিজের পাঞ্জাবির কর্লার থেকে আনিতার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“এভাবে কেঁদো না প্লিজ। আসতে আসতে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরেই সবটা মেনে নিতে শিখবে তুমি। আসছি।”
কথাটা বলে আহিয়ান চলে আসতে নিলেই আনিতা সবার সামনেই আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে রেখেই চিৎকার করে বলে,
–“নাহ আপনি যাবেন না। আপনি কোত্থাও যাবেন না আমাকে ছেড়ে। আমি যেতে দিবো না আপনাকে। খুব খুব ভালোবাসি আমি আপনাকে। আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। এভাবে থাকতে পারবো না আমি। আমায় একা করে দিয়ে চলে যাবেন না আপনি প্লিজ।”
কথাগুলো বলেই আনিতা জোরে জোরেই কাঁদতে শুরু করে দিলো। নিচে ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স বাজার কারনে এখানকার কথা কেউ-ই শুনতে পাচ্ছে না। আনিতার এভাবে চিৎকার করে কান্না করা এমন আহাজারি কারো কানেই যাচ্ছে না। আহিয়ান আনিতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উলটো ঘুরে নিজের চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিয়ে দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।”
।
।
।
চলবে