শুধু তোমারই জন্য পর্ব-৫০+৫১+৫২

0
821

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৫০
#Ornisha_Sathi

এর মাঝেই কেটে যায় আরো বেশ কয়েকটা দিন। আনিতার চাচ্চুও বাহিরে চলে গিয়েছেন। আনিতা ঢাকায় এসেছে দুদিন হলো। আহিয়ান নিজে গিয়েই নিয়ে এসেছে আনিতাকে। আনিতা ফাইয়াজ রোদেলা শুভর সাথে আগের ফ্ল্যাটেই উঠেছে। অন্য একটা বাসা খুঁজছে ফাইয়াজ। ভাংতি মাস বলে এখনো পায়নি। সামনের মাসেই একটা বাসা দেখে এই বাসা ছেড়ে দিবে ওরা। বলা তো যায় না রিদমান আবার কখন কি করে বসে। এর আশেপাশে যেকোনো একটা বিল্ডিং হলেই হবে। কিন্তু এই বিল্ডিংয়ে ওরা কেউ-ই আনিতাকে রাখতে চাচ্ছে না। এই বিল্ডিংয়ে থাকলে রিদমান যখন তখন আনিতাকে যা কিছু করতে পারবে। কিন্তু অন্য বিল্ডিংয়ে ঢুকে গিয়ে এসব সম্ভব না।

রাতে ডিনার শেষে সোফায় বসে আহিয়ান ফাইয়াজ শুভ তিনজনে কথা বলছিলো। আনিতা কফি বানাচ্ছে সকলের জন্য। আর রোদেলা সব কিছু গোছগাছ করে রাখছে। সবকিছু গুছিয়ে রোদেলা গিয়ে শুভর পাশে বসলো। মিনিট দুয়েক বাদে আনিতা কফি নিয়ে সবার সামনে রাখলো। সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো আর কফি খাচ্ছিলো। আনিতা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে মগটা টি-টেবিলের উপর রাখলো। হাত নাড়িয়ে একের পর এক কথা বলছে ও। আহিয়ান একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে আনিতার কফির মগটা হাতে নিয়ে ওরটা আনিতার জায়গায় রেখে দিলো। বিষয়টি আর কারো চোখে না পড়লেও রোদেলার চোখ এড়ায়নি। আনিতা মগের যেখানটায় ঠোঁট লাগিয়ে খাচ্ছিলো আহিয়ানও ঠিক সেখানটাতেই ঠোঁট লাগালো। আহিয়ানের কান্ডে মুচকি হাসলো রোদেলা। আনিতা কফির মগে আবার চুমুক দিতেই বুঝে ফেলল এটা ওর কফির মগ না। কেননা আনিতা ওর আর রোদেলার কফিতে দুধ বেশি করে মিশিয়েছিলো। আর বাকী তিন মগে দুধ কম মিশিয়েছে। ফাইয়াজ আর শুভ তো মগ চেঞ্জ করবে না। তার মানে এটা আহিয়ানের কাজ। চট জলদি আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকালো। কিন্তু আহিয়ান এমন একটা ভাব নিচ্ছে যে ওদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মৃদু হেসে আহিয়ানের খাওয়া কফিটাই খেতে শুরু করলো।

কফি খাওয়ার শেষে আনিতা মগ গুলো নিয়ে ধুয়ে জায়গামতো রেখে এলো। ফাইয়াজ আর আহিয়ান নতুন বাসা খোঁজা নিয়ে কথা বলছিলো। এক পর্যায়ে আনিতা বলে,

–“আমি একটা কথা বলবো?”

–“তুই আবার অনুমতি নিচ্ছিস কবে থেকে?”

–“আহ শুভ! বলতে দে ওকে।”

ফাইয়াজ বলল শুভকে। ফাইয়াজ আনিতাকে ইশারা করলো বলার জন্য। কিন্তু আনিতা এখন কিছুটা ভয় পাচ্ছে কথাগুলো বলতে। আহিয়ান মানবে তো? ওর যে রাগ না জানি আবার রেগে বম হয়ে যায়। আনিতাকে চুপ থাকতে দেখে আহিয়ান বলে,

–“কি হলো? বলো কি বলবে।”

–“বলছিলাম বড় বাসা খুঁজতে হবে না। ছোট একটা বাসা খুঁজে ফাইয়াজ ভাইয়া আর শুভ সেই বাসাতে উঠে পড়ুক।”

–“আর তোরা দুজন কোথায় থাকবি?”

–“আমি আর রোদেলা হোস্টেলে থেকে___”

–“কি বললে?”

–“না মানে___”

–“খুঁজলে বাসার অভাব হবে না৷ তাছাড়া আমাদের বাসা আছে এখানে। আর তুমি কিনা হোস্টেলে থাকবে? দরকার নেই। আমাদের বাসায় চলো তুমি। রোদেলাও থাকবে সমস্যা নেই।”

–“ন্ না।”

–“এই নিয়ে আর একটাও কথা শুনতে চাচ্ছি না আমি।”

–“কিন্তু___”

–“বললাম তো চুপ থাকতে?”

আনিতা আর কিছু বলল না। চুপচাপ ওখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। আহিয়ান আনিতাকে ডাকতে চেয়েও আর ডাকলো না। রোদেলা আহিয়ানকে বলে,

–“ভাইয়া আনিতার কথাটা একবার ভালো করে ভেবে দেখুন। ও ভুল কিছু বলেনি।”

–“রোদেলা প্লিজ তুমিও ওর মতো বাচ্চামো করো না। জানোই তো ও কেমন।”

–“আপনি একবার শুনুন আমার কথাটা।”

–“আচ্ছা বলো কি বলবে?”

–“আমাদের ভার্সিটি আর হোস্টেলটা কিন্তু একই জায়গায়। পায়ে হেটে দুই মিনিটের রাস্তাও নেই। আর হোস্টেলের ভিতর থাকলে রিদমান ওকে কোনোভাবে বিরক্ত করতে পারবে না৷ আর এখান থেকে আমাদের ভার্সিটিতে যাওয়া-আসার রাস্তাটা কিন্তু বড়। রিদমান একবার যখন বিল্ডিংয়ের ভিতরেই আনিতার গায়ে হাত দিতে পেরেছে তখন কি ভার্সিটিতে যাওয়া-আসার সময় এরকমটা করতে পারবে না? হোস্টেলে থাকলে সব দিক দিয়েই ভালো হয়। আপনি ভালো করে একবার ভেবে দেখুন।”

–“আমি একা ছাড়ছি না ওকে।”

এই বলে আহিয়ান আনিতার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে গিয়ে দেখে আনিতা বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে। আহিয়ান কিছু না বলে সরাসরি ওর পাশে শুয়ে পড়লো। আনিতা উল্টোদিকে ঘুরে ফোন টেপায় মনোযোগ দেয়। আহিয়ান পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে। আনিতা বার কয়েক আহিয়ানের হাত সরিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ অব্দি আর পাড়েনি। কেননা আহিয়ান জাপ্টে ধরে আছে আনিতাকে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে আহিয়ান আনিতার অভিমান ভাঙায়। সেবারে আনিতার জেদের কাছে হার মেনে আহিয়ান রাজি হয় আনিতাকে হোস্টেলে রাখতে।

এভাবেই ঝগড়া অভিমান খুনশুটি করে অনার্সের প্রথম বর্ষ কেটে যায়। যত দিন যাচ্ছে দুজনের ভালোবাসা তত গভীর হচ্ছে। রোদেলা আজ গ্রামে যাচ্ছে। অনেকদিন যাবত বাসায় যাচ্ছে না বলে বাসার সবাই খুউব বিরক্ত ওর উপর। তাই আজ বাধ্য হয়েই গ্রামে যাচ্ছে। আনিতা আর শুভ রোদেলাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে গেলো। বাস ছাড়বে আরো মিনিট দশেক বাদে৷ বাস ছাড়া অব্দি আনিতারা বাস স্টপেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাস ছাড়তেই ওরা দুজন উল্টোদিকের পথ ধরলো। শুভ নিজের বাসায় যাবে আর আনিতা আহিয়ানদের বাসায়। ভার্সিটি বন্ধ হওয়াতে হোস্টেল প্রায় ফাঁকা সবাই নিজের বাসায় চলে গিয়েছে ছুটি কাটাতে। আর রোদেলাও আজ চলে গিয়েছে তাই আহিয়ানের আর ওর আম্মুর করা আদেশ এখন একা হোস্টেলে থাকা যাবে না। গ্রামে যাওয়ার আগ অব্দি উনাদের সাথে উনাদের বাসাতেই থাকতে হবে। আনিতাও বাধ্য মেয়ের মতো স্বামী আর শাশুড়ী মায়ের কথা মেনে নেয়। আনিতাও অবশ্য যাবে তবে দু/একদিন বাদে। আহিয়ানের অফিসে কাজের চাপটা একটু কমলেই যাবে। শুভও তাই এখন ফিরলো না। শুভ যদিওবা যেতে চেয়েছিলো রোদেলার সাথে কিন্তু রোদেলা বলেছে ও একাই যেতে পারবে৷ তা ছাড়া অভ্যেস করতে হবে তো। একা পথ চলতে শিখতে হবে।

হঠাৎই শুভর ফোন বেজে উঠে। বাসা থেকে ফোন এসেছে। ওর আম্মুর শরীরটা বেশি ভালো নেই। কয়েকদিন যাবত অসুস্থ তিনি। আজই হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে উনাকে। তাই শুভ আনিতাকে একটা রিকশা ঠিক করে তাতে উঠিয়ে দিয়ে বলে,

–“আহিয়ান ভাইকে টেক্সট করে দিয়েছি উনি এক্ষুনি অফিস থেকে বেরোচ্ছে তুই সামনের চৌরাস্তায় গিয়ে ওয়েট কর ভাইয়ার জন্য। বাইক চালিয়ে আসতে মিনিট দশেকের মতো লাগবে ততক্ষণে তুই ওখানে পৌঁছে যাবি। আহিয়ান ভাই না আসা অব্দি কিন্তু ওখান থেকে এক পাও নড়বি না।”

–“আচ্ছা। তুই সাবধানে যাস। আর হসপিটালে পৌঁছে ফোন দিস। আন্টির কি অবস্থা জানাস সেটা আমাকে।”

–“হুম।”

শুভ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অন্য একটা চলতি বাসে উঠে পড়লো। রিকশা তার নিজ গন্তব্যে চলছে। মাঝ রাস্তায় রিদমান আর দুজন ছেলে আনিতার রিকশা থামায়। ভয় পেয়ে যায় আনিতা। এমন একটা দিনেরই বুঝি সুযোগ খুঁজছিলো রিদমান। আর আজকে সেই সুযোগটা পেয়েও গেলো। কি হবে এবার? আনিতা ভয়ে ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এখান থেকে বেশ ক্ষানিকটা দূরেই চৌরাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। যেখানে আহিয়ান আসবে ওকে নিতে। তাই আনিতা আহিয়ানকে খুঁজার চেষ্টা করছিলো। রিদমান আনিতার পাশে রিকশার সিটে হাত দিয়ে বলে,

–“যাকে তুমি খুঁজছো সে আজ আসবে না। তুমি কেন আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারছো না আনিতা বলো তো?”

–“পথ ছাড়ুন।”

–“উঁহু আজ তো তোমায় ছাড়ছি না। আজকে তোমায় আমি সারাজীবনের জন্য আমার করে নিবো। আর তোমায় বিএফ আহিয়ান তোমাকে আমার হওয়া থেকে আটকাতে পারবে না আজ।”

–“আহিয়ান বিএফ না আমার। হাজবেন্ড হোন উনি আমার।”

–“আহিয়ান তোমার বিএফ বা হাজবেন্ড হোক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার জাস্ট তোমাকে লাগবে।”

এই বলে রিদমান আনিতার হাত টেনে ধরে রিকশায় থেকে নামায়। ভয়ে এবার কেঁদে ফেলে আনিতা। একহাতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে লুকিয়ে আহিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করে।

চৌরাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছিলো আহিয়ান। তখনই ওর ফোন বেজে উঠে। বাইক এক পাশে সাইড করে থামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে আনিতার ফোন। আহিয়ান সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ করে কানে নেয়। ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে আনিতার কান্নার শব্দ শুনতে পায়। আনিতা কাঁদতে কাঁদতে কাউকে কিছু বলছে। কান্না করার ফলে কথা গুলো আহিয়ান স্পষ্ট শুনতে পেলো না। আহিয়ানের ভয় হচ্ছে কিছুটা৷ আনিতার কিছু হলো না তো? আহিয়ান ফোন কেটে আনিতার লোকেশন ট্র‍্যাক করে। আহিয়ান দেখলো লোকেশন অনুযায়ী আনিতা চৌরাস্তা ছাড়িয়ে কিছুটা সামনের দিকে আছে। আহিয়ান ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে সেদিকেই গেলো৷ বিশ ত্রিশ হাত দূর থেকেই আহিয়ান দেখে একটা মেয়েকে কেউ জোর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটা উঠতে রাজি নয়। উলটোদিক থেকে দেখার ফলে আহিয়ান ওখানে থাকা মেয়েটা আর ছেলেগুলোর মুখ দেখতে পেলো না। জায়গাটা ক্রশ করে সামনের দিকে এগুতেই কিছুটা একটা ভেবে আহিয়ান বাইক ঘোরালো। গাড়ি থেকে তিন চার হাত দূরত্বে বাইক পার্ক করে সামনে এগিয়ে গেলো। এবার আহিয়ানের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না ওটা আনিতা৷ আর রিদমান ওকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আহিয়ানের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রিদমানের পিছনে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত দিতেই রিদমান প্রথমে হাত সরিয়ে দেয়। আহিয়ান আবারো ওর কাঁধে হাত রাখে। রিদমান এবার বিরক্ত হয়ে পিছন ঘুরতেই আহিয়ানকে দেখতে পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। আহিয়ান সজোরে রিদমানের মুখে একটা পাঞ্চ মারে। রিদমান আনিতার হাত ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে যায়। আনিতা শক্ত করে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ান আনিতাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“প্রথম বারে তোর শিক্ষা হয়নি না? তাই দ্বিতীয় বার আবার একই ভুল করার সাহস দেখিয়েছিস তুই।”

রিদমান আহিয়ানের এসে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে বলে,

–“দেখ আহিয়ান আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি। প্লিজ ওকে আমার হাত তুলে দে তুই। প্রমিস করছি তোকে আনিতাকে আমি অনেক ভালো রাখবো ট্রাস্ট মি। ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না আমি। অনেক অনেক ভালোবাসবো। প্লিজ আমাদের দুজনকে এক হতে দে৷ আমাদের মাঝ থেকে সরে যা তুই।”

আহিয়ান রিদমানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“আনিতা যদি শুধুমাত্র আমার গার্লফ্রেন্ডও হতো না? তারপরও ওকে আমি তোর হাতে তুলে দিতাম না। কয আমি আনিতাকে ভালোবাসি। আর সবথেকে বড় কথা আনিতা আমাকে ভালোবাসে। আর এখন তো আইনত আর ইসলামিক দুই ভাবেই ও আমার বিয়ে করা বউ। সুতরাং আনিতাকে ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না।”

রিদমান কিছু বলার আগেই সেখানে পুলিশ এসে হাজির হয়। দুজন কন্সটেবল রিদমানকে ধরে সাথে বাকী দুজনকেও। আহিয়ান পুলিশকে সব ঘটনা খুলে বললে পুলিশ ওদের তিনজনকে নিয়ে চলে যায়। আনিতা তখনো আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। আহিয়ান আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে বাইকের সামনে যায়। আনিতা বাইকে উঠে বসতেই আহিয়ান বাইক চালায়।

এর মাঝে আরো কটা দিন পার হয়। সেদিন রোদেলা বাসায় ফেরার পরদিনই তন্ময় ওর বাসার সবাইকে নিয়ে রোদেলাদের বাসায় যায় বিয়ের প্রপোজাল দিতে। রোদেলার বাসার সবার কোনো অমত ছিলো না এতে কিন্তু রোদেলা বেঁকে বসে। ও বিয়ে করবে না। ভয় হয় ওর। তন্ময়ও যদি ফারদিনের মতো করে তাহলে? তাহলে তো রোদেলা আর বাঁচতে পারবে না। এতদিনে অন্তত রোদেলা এটা বুঝেছিলো যে তন্ময় ওকে ভালোবাসে। রোদেলার মনেও তন্ময়ের জন্য একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বারও একই ভাবে ভেঙে গুড়িয়ে যেতে চায় না ও। ও যদি তন্ময়কেও হারিয়ে ফেলে আবার? তাহলে এটা সহ্য করতে পারবে না রোদেলা। তাই সেদিন ওদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তন্ময় হাল ছাড়েনি। বহু কষ্টে রোদেলাকে রাজি করায় ও। তন্ময়ের ভালোবাসা পাগলামির কাছে হার মেনে রোদেলা রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। রোদেলার মনে যেহেতু ফারদিনের মতোই তন্ময়কে হারানোর ভয় তাই তন্ময় খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের ডেট ফিক্সড করে। রোদেলা রাজি হওয়ার পর তন্ময়ের আম্মু আর বড় বোন গিয়ে রোদেলাকে আংটি পড়িয়ে আসে। মাস খানেক বাদেই ওদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়।

আংটি পড়ানোর দুদিন বাদেই রোদেলা ঢাকায় এসে পড়ে। ভার্সিটি খুলেছে তাই। আনিতা তো প্রচুর এক্সাইটেড রোদেলার বিয়ে নিয়ে। আনিতা যেমন খুশি হয়েছে তেমন মন খারাপও করেছে খুব। রোদেলা ওর থেকে দূরে চলে যাবে তাই। রোদেলা আসার পর পাক্কা দু ঘন্টা আনিতা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো। আর কিছুক্ষণ বাদে বাদেই ডুঁকরে কেঁদে উঠতো। বহু কষ্টে রোদেলা আনিতাকে শান্ত করে। রোদেলার বিয়ের সপ্তাহ দুই আগে রোদেলা বাড়ি ফিরে যায়। আনিতা শুভ ওরা আরো সপ্তাহ খানেক পর যাবে। রোদেলা যাওয়ার পর আনিতা আবারো আহিয়ানদের বাসায় চলে যায়।

কাল আনিতা ফাইয়াজ শুভ তিনজনেই বাসায় ফিরবে। তাই আজ আহিয়ান একপ্রকার জোড় করেই আনিতাকে নিয়ে শপিংয়ে গেলো। রোদেলার বিয়ের জন্য কেনাকাটা করার জন্যে। যদিও আনিতা বলেছিলো ও বাসায় গিয়ে কিনে নিবে। কিন্তু আহিয়ান শুনেনি৷ আনিতা বাধ্য হয়েই আহিয়ানের সাথে বের হলো আজ বিকেলে। রাত নয়টা নাগাদ ওদের শপিং শেষ হয়। রোদেলার হলুদে পড়ার জন্য একটা জামদানী, একটা গাউন, আর দুটো কূর্তি কিনে দেয় আহিয়ান। সবগুলো আহিয়ান নিজেই পছন্দ করে আনিতার জন্য। সাথে আহিয়ান নিজের জন্যেও কিছু কেনা করে নেয়। শপিং শেষে দুজন একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে ডিনারের জন্য।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৫১
#Ornisha_Sathi

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আনিতা আর আহিয়ান বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরে দুজনের শপিং সবাইকে দেখায়। আনিতা নুজাইরাহ আর অদ্রির জন্য আনা জামাগুলো ওদের দুজনের হাতে দেয়। জামা পেয়ে দুজনে বেশ খুশি হয়৷ আনিতা সবাইকে বলে নিজের রুমে চলে যায়৷ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়েই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুটা সময় বাদেই আহিয়ান রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। আহিয়ান সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। মিনিট দশেক বাদে ফ্রেস হয়ে রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে আনিতার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আহিয়ান শুতেই আনিতা আহিয়ানের দিকে ঘুরে ওর বুকে মাথা রেখে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ানের গাল আর চাপ দাড়িতে আনিতা বেশ ক্ষানিকটা সময় ওর নাক ঘঁষে। আনিতার কাজে মৃদু হাসে আহিয়ান। মেয়েটার নাকি আহিয়ানের গাল আর চাপ দাড়ির স্মেল খুউব ভালো লাগে।

আহিয়ান আনিতার মাথায় একটা চুমু খায়। তারপর আনিতার চুলে বিলি কেটে দেয়। আনিতা তখনও আহিয়ানকে জাপ্টে ধরে ওর গালের সাথে আনিতার নাক লাগিয়ে শুয়ে আছে৷ আহিয়ান আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“কাল সকালে আবার উঠতে হবে তো। ঘুমাও এখন।”

–“উহু। এভাবেই থাকি না কিছুটা সময়।”

–“কেন?”

–“ভালো লাগছে খুউব।”

আহিয়ান কিছু বলল না। এক হাতে ভালো করে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে। অন্য হাত দিয়ে আগের মতোই চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে৷ এভাবে মিনিট পনেরো কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই আনিতা বলে,

–“শুনুন না।”

–“বলো।”

–“আদর করবেন একটু?”

আনিতার কথায় আহিয়ান থতমত খেয়ে যায়। বেশ অবাক হয় ও। যে মেয়ে কিনা লজ্জায় মাঝে মাঝে ওর দিকে চোখ তুলে তাকায় না সেই মেয়ে আজ নিজে থেকে আদর করতে বলছে? ভাবা যায় এসব? আহিয়ান অবাকের রেশ কাটিয়ে বলে,

–“আমি ঠিক শুনলাম তো?”

–“হ্যাঁ একদম।”

আহিয়ান আনিতার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। তারপর আনিতার কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,

–“এই যে আদর করে দিলাম৷ এখন ঘুমাও।”

–“উঁহু এই আদর না। আমার অন্য আদর লাগবে। গভীর ভাবে আপনার স্পর্শ লাগবে৷”

–“পরে হবে এখন ঘুমাও।”

আনিতা বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে বলে,

–“নাহ আমার এখন লাগবে৷ মানে এখনই।”

–“আচ্ছা কাল আদর করবো প্রমিস। এবার ঘুমাও।”

–“কে বলতে পারে কাল যদি না থাকলাম আমি?”

–“আনিইইতা।”

কিছুটা রেগেই আহিয়ান আনিতার নাম ধরে ডাকে। আনিতা আহিয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

–“আহা! রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো এমনি বললাম।”

–“এই কথাটা শুনতে চাই না আমি। তোমাকে হারাতে পারবো না। খুব খুউব বেশি ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে হারিয়ে বাঁচতে পারবো না আমি। কেননা আমি #শুধু_তোমারই_জন্য বেঁচে আছি। #শুধু_তোমারই_জন্য আমার শ্বাস চলছে। #শুধু_তোমারই_জন্য আমার হৃদস্পন্দন চলছে #শুধু_তোমারই_জন্য। তোমাকে হারালে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো।”

আনিতা আহিয়ানের হাত দুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

–“যাবো না। কোত্থাও যাবো না আপনাকে ছেড়ে। এই দেহে যতক্ষণ প্রান আছে আমি ততক্ষন অব্দি আপনাকে ছেড়ে একচুলও কোথাও যাবো না।”

আহিয়ান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আনিতাকে। আনিতা আহিয়ানের বুকে মাথা রেখে কেঁদে দেয়। আনিতার মনটা হঠাৎ করেই কেমন যেন ছটফট করছে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। অস্থির লাগছে সবকিছু। আনিতাকে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে যায় আহিয়ান। আনিতাকে আহিয়ানের বুক থেকে সরিয়ে ওর দু গালে হাত রেখে আহিয়ান বলে,

–“আনি? এই আনি কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন এভাবে? আমি কি কোনো ভুল করেছি? হার্ট করেছি তোমাকে?”

–“ভালো লাগছে না আমার।”

–“কেন কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে তোমার?”

–“উঁহু এমনিই মন ভালো নেই।”

–“ছাদে যাবে? আকাশে বড় চাঁদ উঠেছে। মন ভালো হয়ে যাবে তোমার।”

এই বলে আনিতার উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর হাত ধরে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়৷ ছাদে গিয়ে সত্যি সত্যি আনিতার মন ভালো হয়ে যায়। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ উঠেছে। চারিপাশ চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। হাজারো তারার মেলা বসেছে আকাশ জুড়ে। মৃদু বাতাস বইছে। সব মিলিয়ে এখনকার পরিবেশটা বেশ লাগছে আনিতার কাছে৷ ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁই ছুঁই।

আনিতা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো গিয়ে। দুদিকে দুই হাত মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে মন খুলে শ্বাস নিলো। আনিতার পরনে ঢিলেঢালা একটা টি-শার্ট আর প্লাজু। কোমড় সমান খোলা চুলগুলো মাঝে মধ্যে মৃদু বাতাসে উড়ছে। দুদিকে দুই হাত মেলে রাখায় পেটের দিক থেকে টি-শার্ট অনেকটা উপরে উঠে আছে। ফলে আনিতার পেটের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে। আনিতার উম্মুক্ত পেটের দিকেই নেশাক্ত দৃষ্টিতে আহিয়ান তাকিয়ে আছে। এরকম একটা পরিবেশে আনিতাকে এভাবে দেখে আহিয়ানের নিজেকে সামলে নেওয়া বেশ কষ্টের ব্যাপার। তবুও আহিয়ান বার কয়েক চেষ্টা করলো নিজেকে সামলে নেওয়ার। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ধীর পায়ে আহিয়ান আনিতার দিকে এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে আনিতার খোলা পেটে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে৷ আহিয়ানের এমন স্পর্শে আনিতা হাত নামিয়ে নিলো। আহিয়ানের দিকে ঘুরতে গেলে আহিয়ান খামচে ধরে আনিতার পেট। মুখ গুজে আনিতার ঘাড়ে। সেখানেই থমকে যায় আনিতা৷ থমকে যায় সময়। এভাবে ওরা ঠিক কতক্ষণ ছিলো জানা নেই।

বেশ ক্ষানিকটা সময় পরে হুট করেই আহিয়ান আনিতাকে কোলে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। লিফটে করে ফোর্থ ফ্লোরে নেমে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে আহিয়ান একহাতে সদর দরজা বন্ধ করে সোজা নিজেদের রুমে চলে যায়। আনিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুমের দরজা লক করে আনিতার পাশে গিয়ে শুইয়ে পড়ে আহিয়ান। আনিতা তখন দ্রুত শ্বাস নিচ্ছিলো। বুক উঠানামা করছে দ্রুত। আহিয়ান আনিতার গলায় মুখ গুজে। কিছুটা সময় বাদে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আনিতার ঠোঁটের দিকে৷ দুটি দেহ আবার এক হয়ে যায়। মিলে যায় দুটি মানুষ। দুজনেই ভালোবাসার এক অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। অন্যরকম এক ভালোলাগার সাগরে ডুব দেয় দুজনে।

ঘড়ির কাটায় নয়টা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ করেই আনিতার ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে কপালে হাত চলে গেলো আনিতার। ভোরবেলা উঠে নামায পড়ে আবার ঘুমিয়েছিলো। আর অনেক রাত করে ঘুমানোর ফলে সকালে আর ঘুমটা ভাঙেনি। আনিতা আহিয়ানকে ডেকে তুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে। ফ্রেস হয়ে এসে আনিতা রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে গেলো। রুহি তখন প্লেটে করে খাবার সাজাচ্ছিলো। আনিতা রুহির সাথে নিজেও খাবার সাজিয়ে সবগুলো প্লেট ডাইনিংয়ে এনে রাখলো। একে একে সবাই ডাইনিংয়ে এসে বসে পড়লো নাস্তা করার জন্য। নাস্তা শেষে রুহি আর আনিতা মিলে সবকিছু গোছগাছ করে নিলো। আনিতা নিজের রুমে চলে যায় ব্যাগ গোছাতে। কাল রাতে ব্যাগ গোছানোর কথা ও একদমই ভুলে গিয়েছিলো। সাড়ে দশটা নাগাদ আহিয়ান আনিতাকে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। বাস স্টপে এসে দুটো টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলো। মিনিট দশেক বাদে বাস ছাড়বে। আহিয়ান কানে ইয়ারফোন গুজে গান ছাড়লো৷ আনিতাও আহিয়ানের কান থেকে ইয়ারফোনের একটা তাড় খুলে নিজের কানে গুজে নিলো। আনিতা আহিয়ানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে মনোযোগ সহকারে গান শুনছিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই বাস ছেড়ে দিলো।

এক ঘন্টার মতো রাস্তা পেরিয়ে হঠাৎ করেই বাস হাইওয়েতে এসে থেমে গেলো। ড্রাইভার অনেক বার বাস স্টার্ট করতে চাইলেও স্টার্ট হলো না। বাসের হেলপার বাস থেকে নেমে দেখলো গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গিয়েছে। টায়ার পাল্টাতে কিছুটা সময় লাগবে। তাই অনেক যাত্রী বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালো। আনিতা আর আহিয়ানও নেমে পড়লো। দুজনে বাকী যাত্রীদের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। হাইওয়ের এক ধারে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। একের পর এক গাড়ি দ্রুত গতিতে নিজ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছে। আহিয়ানের ফোন আসায় আহিয়ান ফোন রিসিভ করে কথা বলছিলো। আনিতা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে দূরে সরে গেলো৷ রাস্তার ধারে একটা লজ্জাবতী গাছ দেখতে পেয়ে গাছটার সামনে বসলো। লজ্জাবতী গাছের একটা ডালে টোকা দিতেই ওই ডালের সবগুলো পাতা মিইয়ে গেলো। এভাবে গাছের সবগুলো ডালে টোকা দিচ্ছিলো আনিতা। আহিয়ানের দিকে আনিতার চোখ পড়তে দেখে ও এখনো ফোনে কথা বলছে। হটাৎই আহিয়ানের থেকে চার পাঁচ হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের উপর আনিতার চোখ পড়ে। মেয়েটা চোখ দিয়ে আহিয়ানকে গিলে খাচ্ছে। কেমন ড্যাবড্যাব করে অন্যের জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সাহস কত বড় মেয়েটার। এসব ভেবে আনিতা উঠে দাঁড়ালো। তখনই মেয়েটা আহিয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহিয়ান ততক্ষণে কথা বলা শেষ করে ফোন পকেটে রেখে দিয়েছে। আনিতা দ্রুত পায়ে গিয়ে আহিয়ানের পাশে দাঁড়ালো। আনিতা আহিয়ানকে টেনে নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো৷ মেয়েটা অবাক হয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে আছে। আনিতা মুখ বাঁকালো মেয়েটার চাহনী দেখে৷ আনিতা আহিয়ানের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

–“এত সুন্দর হতে হবে কেন আপনাকে? যেখানেই যান আপনাকে নিয়ে আমার মনে ভয় একটা থাকেই। কে বলেছিলো আপনাকে এত সুন্দর হতে?”

–“আরেহ হঠাৎ করে হলো কি তোমার? রেগে আছো কেন?”

–“রাগবো না তো কি করবো? ওই মেয়েটা কিভাবে দেখছিলো আপনাকে। একদম চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিলো। আর আপনার তো কোনোদিকে ধ্যান নেই। অন্ধ তো আপনি তাই দেখতে পাননি।”

–“আমি তো তাকাই নি। তাহলে আমার উপর কেন রাগ ঝাড়ছো এভাবে?”

আনিতা মেয়েটাকে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বলে,

–“দেখুন এখনো কেমন নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। ওই দেখুন আবার মুচকি হাসছে।”

–“আনি বাদ দাও না। আচ্ছা চলো অন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়াই।”

আহিয়ান আনিতাকে নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনেই একটা আইসক্রিমের দোকান দেখতে পেলো আনিতা৷ তাই আহিয়ানের কাছে বায়না ধরলো আইসক্রিম খাবে ও। আহিয়ান বলে,

–“তুমি দাঁড়াও এখানেই। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”

–“আমি তাহলে বাসে গিয়ে বসি। আপনি আসুন।”

–“আচ্ছা যাও।”

আহিয়ান আইসক্রিমের দোকানে গেলো আইসক্রিম কিনতে। আর আনিতা বাসে গিয়ে বসলো। বাসে দশ বারো জন যাত্রী ছাড়া সবাই বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসের টায়ার পালটানো শেষ। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাস হাইওয়ে তে তুলল। হেলপার হাঁক ছেড়ে সকল যাত্রীকে বাসে এসে বসতে বলল। হঠাৎ করেই উলটো দিক থেকে একটা ব্রেক ফেল ট্রাক এগিয়ে আসতে লাগলো আনিতাদের বাসের দিকে। ড্রাইভার কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই বাস আর ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। গাড়ি দুটোর সংঘর্ষে বিকট আওয়াজ তুলে স্তব্ধ হয়ে গেলো সবকিছু। থমকে গেলো সময় থমকে গেলো মানুষজন। আশেপাশের যাত্রীরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো৷ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়লো বাসের মধ্যে নিজেদের লোক থাকায়৷ আহিয়ান আইসক্রিম কিনে আসছিলো। তখনই খুব বাজে ভাবে বাস আর ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়৷ আহিয়ানের হাত থেকে আইসক্রিম দুটো পড়ে গেলো৷ নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ও। আহিয়ানের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু সেকেন্ড আহিয়ান ওভাবেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। যখন শিরায় শিরায় হানা দিলো, নিউরনে নিউরনে বাড়ি খেলো, মস্তিষ্ক সচল হলো, মন জানা দিলো বাসে আনিতা ছিলো তখনই আহিয়ান চিৎকার করে উঠে। চিৎকার করে ডেকে উঠে,

–“আনিইইইতায়ায়ায়া_____”



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৫২
#Ornisha_Sathi

–“তারপর? তারপর কি হয়েছিলো? আনিতা বেঁচে ফিরতে পেরেছিলো? নাকি গল্প ওখানেই শেষ?”

আরাধ্যার কথায় বছর ছয়েক আগের অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে শুভ। চোখের কোনের জমা পানিটুকু মুছে নেয় শুভ। টলমলে চোখেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে,

–“গল্প সেখানেই শেষ। সেখানেই শেষ হয়ে যায় একটা ভালোবাসার গল্প। দুটো ভালোবাসার মানুষের অকাল মৃত্যু সেদিনই হয়।”

–“ম্ মানে? আনিতা কি সেদিন বেঁচে ফিরতে পারেনি?”

–“নাহ ভাগ্য সহায় ছিলো না। তাই তো সব মায়া ছিন্ন করে আহিয়ানের এত্ত এত্ত ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে উপরওয়ালার ডাকে সেদিন সারা দিয়েছিলো ও। ওর যত পিছুটান ছিলো সবকিছুকে ছেড়ে গিয়েছিলো ও। সব থেকে বড় কথা ওর আহিয়ানকে ছেড়ে গিয়েছিলো ও। যে কিনা ওর সব থেকে বড় পিছুটান ছিলো____”

অতীত___

মূহুর্তের মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় পুলিশ এম্বুল্যান্স নার্স। আহিয়ান গুটিগুটি পায়ে বাসটার দিকে এগিয়ে যায়। যতটা বাসের দিকে এগোচ্ছে আহিয়ানের বুক ততটা কেঁপে উঠছে। আহিয়ান বাসের ভিতর ঢুকতে গেলে দুজন কন্সটেবল এসে আহিয়ানকে আটকে দেয়। আহিয়ান ছাড়া পাওয়ার জন্য আপ্রান চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। আহিয়ানের পাগলামোর মাত্রা বেড়ে চলছে। চিৎকার করে বলছে,

–“ছাড়ুন আমাকে। ওখানে আমার আনিতা আছে। ওর কাছে যেতে দিন আমাকে। ও ডাকছে আমায়। ওর যে বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে ওখানে। প্লিজ আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। ও আমার কাছে আইসক্রিম খেতে চেয়েছিলো। এই যে দেখুন আমি আইসক্রিম নিয়ে এসেছি ওর জন্য। এখন যদি ওকে গিয়ে আইসক্রিম না দেই তাহলে ও আবার রাগ করবে। রাগ করে কথা বলবে না আমার সাথে। ও আমার সাথে কথা না বললে যে আমার একদম ভালো লাগে না।”

–“প্লিজ শান্ত হোন আপনি। ভিতরে যারা যারা আছে সকলকে আমরা বের করছি তো। আপনি নিজেকে শান্ত করুন। কন্সটেবল ওনাকে অন্যপাশে নিয়ে যান।”

শেষ কথাটা ইন্সপেক্টর আহিয়ানকে ধরে রাখা কন্সটেবল দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল। ইন্সপেক্টর এর কথায় সায় দিয়ে কন্সটেবল দুজন আহিয়ানকে ধরে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখনই দুজন ওয়ার্ডবয় স্ট্রেকচারে করে একটা মেয়ের বডি নিয়ে বাস থেকে নেমে আসে। মেয়েটাকে দেখে আর একবার আহিয়ানের চারিপাশটা স্তব্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় সবকিছু। আহিয়ান অস্পষ্ট সুরে বলে,

–“আ্ আনিতা।”

ওয়ার্ডবয় দুজন আনিতাকে নিয়ে এম্বুল্যান্স এর দিকে যাচ্ছিলো। আহিয়ান তখন ঝামটা মেরে নিজেকে কন্সটেবল দের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আনিতার দিকে দৌড়ে যায়৷ আহিয়ান ওয়ার্ডবয় দুজনকে থামিয়ে দিয়ে স্ট্রেকচারের সামনে হাটু গেড়ে বসে আনিতার একটা হাত ধরে বলে,

–“এই আনিতা? আনিতা উঠো না। কথা বলবে না আমার সাথে? এই যে দেখো তোমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছি। খাবে না তুমি? আনিতা উঠো না। আইসক্রিম আনতে লেট হয়েছে বলে কি রাগ করেছো আমার উপর? এই যে দেখো কানে ধরেছি আমি। আর এমন হবে না। প্লিজ এখন তো কথা বলো। একটা বার কথা বলো না আমার সাথে।”

একজন ডক্টর এসে আনিতাকে চেইক করে ওয়ার্ডবয় দুজনকে ইশারা করলো এম্বুল্যান্স এ তুলতে। ওয়ার্ডবয় দুজন যেতে চাইলে আহিয়ান আরো জোরে আনিতার হাত চেপে ধরে। ডক্টর তখন আহিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“মেয়েটা কি হয় আপনার?”

–“ব্ বউ। বউ হয় ও আমার।”

–“আপনার ওয়াইফের শ্বাস চলছে এখনো। উনাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিতে দিন। নয়তো খুব বেশি লেট হিয়ে যাবে।”

আহিয়ান স্ট্রেকচার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। লোক দুটো আনিতাকে নিয়ে এম্বুল্যান্সে গেলো। আহিয়ানকে ইশারা করলো এম্বুল্যান্সে উঠে বসতে। আহিয়ান এম্বুল্যান্সে উঠে বসতেই এম্বুল্যান্স চলতে শুরু করলো।

এক ঘন্টা হলো আনিতাকে অটিতে নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই নার্স দৌড়ে এইটা ওটা নিয়ে অটিতে ঢুকছে। মিনিট দশেক বাদেই আনিতার দাদু কাকিরা আম্মু ফুপ্পি আংকেল ফাইয়াজ ওরা সবাই চলে আসে। আহিয়ানদের বাসার সকলেও উপস্থিত হয় কিছুক্ষণের মাঝেই। শুভ রোদেলা তন্ময় রাতুল জেরিন তাসকিয়া মোটকথা আনিতা আর আহিয়ান দুজনের বন্ধুই হসপিটালে চলে এসেছে। আহিয়ান অটির সামনের বেঞ্চির এক কোনে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। তন্ময় গিয়ে আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই আহিয়ান ওকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। তন্ময় রাতুল ওরা সবাই আহিয়ানকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

ঘন্টা খানেক বাদে ডক্টর অটি থেকে বের হয়ে আসে। আহিয়ান পাগলের মতো ছুটে যায় ডক্টরের কাছে। ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে আহিয়ান বলে,

–“ডক্টর, ডক্টর আমার আনিতা?”

–“উনাকে কেবিনে শিফট করা হচ্ছে আপনি গিয়ে দেখা করে নিবেন।”

এইটুকু বলেই ডক্টর ওখান থেকে নিজের কেবিনে চলে যান। কিছুক্ষণ বাদেই ডক্টর আহিয়ানকে বাদে আনিতার বাড়ির লোককে ডেকে পাঠান। ফাইয়াজ, নাহিয়ান আর তন্ময় ডক্টরের কেবিনে যায়। ডক্টর ওদের তিনজনকে যা বলে তা শোনার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ডক্টর জানায় আনিতা ওদের মাঝে আর কিছু সময়ের অতিথি মাত্র। আর এক থেকে দেড় ঘন্টা আনিতার আয়ুকাল। ছোট ছোট কদম ফেলে ডক্টরের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে ওরা তিনজন। ওখানে উপস্থিত সকলকে কথাটা জানাতেই সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আনিতার দাদু বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন।

মিনিট পাঁচেক বাদে একজন নার্স এসে জানালেন আনিতা ওর দুই আম্মু আর কাকিমাদের সাথে দেখা করতে চান। নার্সের পিছু পিছু আনিতা আর আহিয়ানের আম্মু আনিতার দুই কাকি কেবিনে প্রবেশ করেন। ওনাদেরকে দেখে আনিতা মলিন হাসে। আনিতা ওর আম্মুকে ইশারায় কাছে ডাকে। আনিতার আম্মু আনিতার কাছে গিয়ে বসে। আনিতা ওর আম্মুর হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিতেই আনিতার আম্মু হাউমাউ করে কেঁদে দেন। আনিতা ওর আম্মুর হাতে চুমু খেয়ে বলে,

–“কেঁদো না আম্মু। তুমি এভাবে কাঁদলে আমার কষ্ট হয় না বলো? তুমি প্লিজ একদম কাঁদবা না। আমি সবসময় তোমার এই হাসিখুশি মুখটা দেখতে চাই আম্মু। তোমাদের সবার মাঝে থেকে না হোক ওই দূর আকাশ থেকে আমি সবসময় তোমাদের দেখবো।”

–“তোর কিচ্ছু হবে না মা। তুই সবসময় আমাদের সাথে থাকবি। তুই একদম সুস্থ হয়ে যাবি দেখিস।”

–“কেন মিথ্যে শান্তনা দিচ্ছো আম্মু? আমি জানি আমি আর বাঁচবো না। আমি না থাকাতে কিন্তু তুমি একদম কান্না করবা না আম্মু। আমি সবসময়ই তোমার মনে থাকবো তো। প্লিজ কান্না করো না৷ আর দাদুকে সামলে নিও প্লিজ। নিজের খেয়াল রেখো কেমন?”

আনিতার আম্মু আচঁলে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলেন। আনিতা মলিন হেসে বলে,

–“শেষ বারের মতো আমায় আদর করবে না আম্মু?”

আনিতার আম্মু আনিতার কপালে একটা চুমু খেয়ে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে ওকে। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে আঁচলে মুখ গুজে কান্না করতে করতে চলে যান রুম থেকে। আনিতা ওর দুই কাকীমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“কোনো ভুল করে থাকলে প্লিজ মাফ করে দিও আমায়। আর আমার আম্মু ছোট্ট বোনটা আর দাদুকে দেখে রেখো প্লিজ। চাচ্চুদের বলো আমার আব্বুকে সামলাতে।”

আনিতার মেজো কাকিমা আনিতার হাত ধরে বলে,

–“কিচ্ছু হবে না তোমার। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। এসব কথা কেন বলছো তুমি? দেখো তুমি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

–“কিচ্ছু ঠিক হবে না কাকিমা। তুমি সবাইকে সামলে রেখো প্লিজ। আর জারাফকে কিন্তু একদম মেরো না কেমন?”

আনিতা এবার আহিয়ানের আম্মুকে ইশারায় নিজের কাছে ডাকলেন। আহিয়ানের আম্মুকে নিজের পাশে বসিয়ে বলেন,

–“তোমার ছেলেটাকে দেখে রেখো মা। উনি যে বড্ড পাগলাটে টাইপের। উনাকে বুঝতে দিও না যে আমি আর নেই। খুউব ভালো একটা মেয়ে দেখে তোমার ছেলের আবার বিয়ে দিও কেমন? আর হ্যাঁ কেউ কিন্তু একদম কাঁদবে না আমার জন্য। তোমরা কাঁদলে যে আমার বড্ড কষ্ট হবে। তোমাদের ছেড়ে ওপারে যে একা একা থাকতে পারবো না আমি।”

আহিয়ানের আম্মু কোনো কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে যান। উনারা বের হতেই আনিতার দাদু ফুপ্পি আর অনিমা ঢুকে কেবিনে। আনিতার দাদু গিয়েই আনিতাকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আনিতা মলিন হেসে ওর দাদুকে বলে,

–“তোমরা এভাবে কাঁদলে আমি তোমাদের ছেড়ে কিভাবে যাই বলো তো? আমার কি কষ্ট হচ্ছে না তোমাদের ছেড়ে যেতে বলো?”

আনিতার দাদু কিছু না বলে শুধু কেঁদেই যাচ্ছেন। আনিতা অনিমা ওর কাছে ডেকে বলে,

–“ভালো থাকিস বইন। এখন থেকে তো তুই খুব খুশি তোকে আর কেউ জ্বালাবে না। আব্বু আম্মু বাড়ির সকলের আদর তুই একা একা পাবি। আর কেউ ভাগ বসাতে আসবে না। তোর সাথে আর কেউ অকারনে ঝগড়া মারামারি করবে না।”

–“আমার কিচ্ছু চাই না আপু। শুধু তুই সুস্থ হয়ে যা। তুই না থাকলে আমি ঝগড়া মারামারি করবো কার সাথে? কে আমার সব বায়না পূরন করবে আপু? আমার আর কিচ্ছু চাই না। শুধু তুই আমাদের সাথে থেকে যা প্লিজ।”

–“সেটা আর সম্ভব না রে পাগলী। আমি চলে গেলে যে আব্বু আম্মুর তুই ছাড়া আর কেউ থাকবে না। আব্বু আম্মু আর দাদুকে দেখিস প্লিজ। ওদের কষ্ট পেতে দিস না একদম।”

আনিতা একে একে ওর ফুপ্পি আংকেল অদ্রি রুহি নুজাইরাহ নাহিয়ান সকলের সাথে কথা বলে নেয়। সবাই কাঁদছে। আজ কারো মুখে হাসি নেই। সবাই বের হওয়ার পরও রুমের এক কোনে অনিমা দাঁড়িয়ে থাকে। আনিতা অনিমাকে ডেকে বলে,

–“তোকে খুউব ভালোবাসি বইন।”

অনিমা দৌড়ে গিয়ে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। দুই বোন একে অপরের গলা জড়িয়ে কাঁদছে। অনিমাও কাঁদতে কাঁদতে বলে,

–“আমিও তোকে খুউব ভালোবাসি আপু। প্লিজ থেকে যা না। এভাবে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাস না তুই।”

তখনই ফাইয়াজ তন্ময় রাতুল আরহান কেবিনে যায়। ওদের সাথেও শেষ বারের মতো কথা বলে নেয় আনিতা। একে একে রুম থেকে সবাই বের হয়ে যায়। শুধু ফাইয়াজ আর অনিমা আছে। ফাইয়াজ ভিডিও কলে ওর আব্বু আর দুই চাচ্চুকে দেখায়। আনিতার আব্বু আর চাচ্চুদের দেখে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আনিতার আব্বু আর চাচ্চুরাও কাঁদছে। আনিতা ওর চাচ্চুদের বলে ওর আব্বুর খেয়াল রাখতে। প্রথম এবং শেষ বারের মতো আনিতা ওর আব্বুকে বলে,

–“আব্বু তোমাকে কখনো বলা হয়নি। আজই প্রথম এবং শেষ বারের মতো বলছি, তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি আমি।”

মেয়ের কথায় আনিতার আব্বু আরো বেশ কাঁদতে শুরু করেন।

–“ভালো থেকো আব্বু। আর কোনো ভুল করে থাকলে তোমার এই মেয়েটাকে মাফ করে দিও প্লিজ। নিজের খেয়াল্ রেখো। আর একদম কাঁদবে না কিন্তু।”

আনিতা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ফাইয়াজ কল কেটে দেয়। ফাইয়াজ আনিতার হাত ধরে বলে,

–“তোর কিচ্ছু হবে না আনিবুড়ি। আমরা সবাই আছি তো। তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি।”

–“ভালো থেকো ভাইয়া৷ আর তোমার বন্ধুকে সামলে রেখো প্লিজ। আর তাসকিয়াকে কষ্ট দিও না কিন্তু। খুব তাড়াতাড়ি দুজনে বিয়ে করে নিও।”

ফাইয়াজ কিছু না বলে চোখের পানিটুকু মুছে অনিমাকে নিয়ে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। কিই বা বলবে? কারো তো আর কিছু বলার মতো ভাষা নেই। ফাইয়াজ বের হতেই আনিতার সব বন্ধুরা কেবিনে যায়। আরোহী গিয়েই আনিতাকে ধরে কেঁদে দেয়। ওরা সবাই কাঁদছে। আনিতা আরোহীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“কিরে এখন তো তোদের খুশি হওয়ার কথা। তাহলে সবাই মিলে কাঁদছিস কেন? তোরা এতদিন বলেছিস আমি মরে গেলে চল্লিশার দাওয়াত খাবি? এখন তো তোদের সেই সুযোগটা আমি করে দিলাম।”

–“সেগুলা তো আমরা মজা করে বলতাম। তাই বলে তুই সত্যি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? তোকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো থাকবো না রে আনিতা। তুই ছাড়া আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটা অপূর্ণ রয়ে যাবে।”

শুভর কথায় আনিতা মুচকি হেসে বলে,

–“আমি না থাকলে কি হবে? তোরা তো আছিস। আর একজনের না থাকায় কোনোকিছু অপূর্ণ থাকে না।”

–“এই আনি তোর না খুব ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়েতে অনেক আনন্দ করবি হই হুল্লোড় করবি? তাহলে চারদিন পর যেখানে আমার বিয়ে সেখানে তুই কিভাবে স্বার্থপরের মতো আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস বল না?”

রোদেলার কথায় এবার ডুঁকরে কেঁদে উঠে আনিতা। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। সব্বাইকে ছেড়ে যেতে ওর কি ভালো লাগছে? আরোহীরা সকলে আনিতার সাথে কথা বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে। ওরা বের হওয়ার কিছুটা সময় বাদেই আহিয়ান যায় রুমে। এতক্ষণ অনেক কষ্টে ওকে আটকে রাখা হয়েছিলো৷ সবাই জানে আহিয়ানকে যদি শুরুতেই আনিতার সাথে দেখা করতে পাঠাতো তাহলে আহিয়ান কিছুতেই আনিতাকে ছাড়তো না। তাই এতক্ষণ বহু কষ্টে আহিয়ানকে সামলিয়ে আগে বাকী সবাই দেখা করে আসে আনিতার সাথে।

আহিয়ান দ্রুত আনিতার কেবিনের দরজা খুলে রুমে ঢুকে। আনিতাকে দেখেই আহিয়ানের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করা। সাথে এক হাত আর এক পাও ব্যান্ডেজ করা। আহিয়ানের পিচ্চিপাখিটা আজ নিস্তেজ হয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। আহিয়ানকে একপলক দেখলো আনিতা। উসকোখুসকো চুল। চোখগুলো ফোলা ফোলা। একদম এলোমেলো অবস্থায় আছে আহিয়ান। চোখের কোনে এখনও পানি চিকচিক করছে। আহিয়ানকে দেখেই আনিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো। ওর ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে এই মানুষটাকে ছেড়ে ও চলে যাবে।



চলবে।