শুধু তোমারই জন্য পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
906

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৯
#Ornisha_Sathi

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আনিতাও আহিয়ানের পিছু ছুটতে শুরু করে। হুট করেই আনিতার পায়ে একটা তাড় কাটা বিঁধে যায়। পরবর্তীতে পা ধরে চিৎকার করে ওখানেই বসে পরে ও। আনিতার চিৎকারে আহিয়ান এবং তন্ময় রোদেলা ওরা সকলেই ছুটে আসে। আনিতাকে এভাবে ডান পা চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে আহিয়ানও হাটু ভেঙে বসে আনিতার সামনে। যে হাতে আনিতা ডান পায়ের তালু চেপে ধরে রেখেছে সে হাত ভেদ করে রক্ত বের হতে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় আহিয়ান। তন্ময় রোদেলা রাতুল ওরা সকলেই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে এভাবে রক্ত বের হতে দেখে। আহিয়ান আনিতার হাত সরাতেই দেখে ডান পায়ের তালুতে অনেক রক্ত। রক্তে আনিতার হাতও ভিজে গিয়েছে পুরো। আর ডান পায়ের তালুতে তাড়কাটা-টা এখনো বিঁধে আছে। আহিয়ান একবার আনিতার দিকে তাকিয়ে জোরে টান দিয়ে তাড়াকাটা বের করে ফেলে। সাথে সাথেই গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। আনিতা চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। অনবরত ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আহিয়ান অস্থির কন্ঠে বলে,

–“কি করে হলো এটা? দেখে চলতে পারো না? ইশ্ কতটা লেগে গিয়েছে। কে বলেছিলো এভাবে অস্থির হয়ে আমার পিছনে ছুটতে?”

–“আহিয়ান বকাবকি পরে কর। অনেকটা লেগেছে আনিতার পায়ে। এত রাতে তো ডক্টর পাওয়া সম্ভব না। আপাতত ওর রক্ত বের হওয়া বন্ধ করতে হবে।”

তন্ময়ের কথায় সকলেই সহমত জানায়। কিন্তু রক্ত পড়া কিভাবে বন্ধ করবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না ওরা। রোদেলা কিছু একটা ভেবে ছাদের যেখানে আনিতার ফুলগাছের টব রাখা ছিলো সেখানে চলে যায়। সেখান থেকে গাঁধা ফুলের কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আহিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–“এটার রস দিলে আপাতত রক্ত পড়া বন্ধ হবে। এটা দিয়ে দেখতে পারেন।”

আহিয়ান কোনোকিছু না ভেবে রোদেলার হাত থেকে পাতাগুলো হাতের তালুতে নিয়ে অন্য হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ডলে সেটাকে আনিতার পায়ের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়। আনিতা আহিয়ানের এক হাত খামচে ধরে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। আহিয়ান আনিতার হাতের উপর হাত রেখে বলে,

–“ইশ্! ক্ষতটা অনেক গভীর। খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার তাই না?”

আহিয়ানের কথা শুনে আনিতার তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। আনিতার মনে হচ্ছে আহিয়ান ওকে কোনো কৌতুক জিজ্ঞেস করেছে। আনিতা ঠোঁটের কোনে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললো,

–“মনের ভিতররের ক্ষতটা যে আরো বেশি গভীর আহিয়ান। মনের ভিতরে যে ক্ষত হয়েছে তার কাছে বাহ্যিক এই ক্ষতটা অতি তুচ্ছ আহিয়ান। আমার ভিতরটা যে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বাইরের এই ক্ষতটা সারিয়ে তুলতে পারবেন কিন্তু আমার মনের ক্ষতটা কিভাবে সারাবেন আপনি? আপনি আমায় ছেড়ে গেলে যে আমার সেই ক্ষতটা গভীর থেকে গভীরতম হবে আহিয়ান।”

আহিয়ান কিছু না বলে চুপ করে রইলো। এখানে উপস্থিত সকলেরই আহিয়ানের উপর বেশ রাগ হচ্ছে। আহিয়ান আনিতার হাত ছেড়ে দিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। শুভকে উদ্দেশ্য করে আহিয়ান বলে,

–“আনিতাকে নিচে ওর রুমে নিয়ে যাও। ক্ষতটা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিও। আর কাল সকালেই ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবে। নয়তো ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

–“আমাকে যেহেতু আপনি ছেড়েই যাচ্ছেন আহিয়ান তাহলে আমায় নিয়ে আর আপনার ভাবতে হবে না। আমাকে নিয়ে ভাবাটা আপনার জন্য আর শোভা পায় না।”

কথাটা বলে আনিতা উঠে দাঁড়াতে নেয়। পায়ে ব্যাথা পেয়ে পড়ে যেতে নিলেই আহিয়ান ওকে ধরার জন্য হাত বাড়ায়। আনিতা হাত দিয়ে আহিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

–“বাকিটা জীবন আমায় আগলে রাখার জন্য তো আপনি থাকবেন না আহিয়ান। তাহলে এইটুকু সময়ও আমায় আগলে নিতে হবে না। বাকিটা পথ যখন আমার একাই চলতে হবে তাহলে এই পথটুকুও আমি একা চলতে পারবো।”

কথাগুলো বলে আনিতা খোঁড়াতে খোঁড়াতেই সিড়ি বেয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো। বার কয়েক সবাই মিলে ডেকেও কোনো লাভ হলো না। আনিতার পিছু পিছু রোদেলা তাসকিয়াও চলে গেলো। জেরিন আহিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“ফাইয়াজ ভাইয়ার সাথে সাথে তুমিও চরম ভুল করছো আহিয়ান। চরম ভুল করছো।”

কথাটা বলে জেরিন আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে। শুভ একবার আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে এলো। রাতুল আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই আহিয়ান তাকালো ওর দিকে। রাতুল মলিন হেসে বলে,

–“নিচে চল।”

–“তোরা যা আমি এক্ষুনি আসছি।”

রাতুল আর আরহান চলে যেতেই আহিয়ান ছাদের এক কোনে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। দৃষ্টি অন্ধকার ওই দূর আকাশের দিকে। তন্ময় এসে আহিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

–“এখনো সময় আছে আহিয়ান। সবটা ঠিক করে নে। আমরা সবাই মিলে ফাইয়াজকে ম্যানেজ করে নিবো। আমরা বুঝাবো ওকে যে তুই ঠিক কতটা ভালোবাসিস আনিতাকে। তোরা দুজন যে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে ভালো থাকতে পারবি না এটা আমরা ঠিক বুঝাবো ওকে। প্লিজ তুই আনিতার সাথে কথা বলে সবটা ঠিক করে নে।”

–“আর সম্ভব না তন্ময়। আমি ফাইয়াজকে কথা দিয়ে ফেলেছি।”

–“একটা দুটো কথা ব্রেক করলে কিচ্ছু হয় না আহিয়ান। তুই ফাইয়াজের কথায় আনিতার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে না তুই ভালো থাকবি আর না আনিতা ভালো থাকবে। তোদের দুজনের ভালো থাকার জন্য হলেও এই কথাটা ব্রেক কর তুই। তোর জন্য না হলেও অন্তত আনিতার কথা ভেবে? অন্তত আনিতার জন্য? প্লিজ।”

বিনিময়ে আহিয়ান কিছুই বলল না। মলিন হাসলো শুধু। আহিয়ান আবার আগের মতোই দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। তন্ময় আহিয়ানকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে,

–“দেখ আহিয়ান আমি জানি তুইও ভালো থাকতে পারবি না। আনিতা যতটা কষ্ট পাচ্ছে তুইও ঠিক ততটাই কষ্ট পাচ্ছিস। কেন শুধু শুধু আনিতাকে কষ্ট দিচ্ছিস আর নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস? একটা সময় তো খুব কষ্ট পেয়েছিলি। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কতটা সেটা তুই একবার অনুভব করেছিলি আহিয়ান। তাহলে আবারো সেই সেম যন্ত্রণাটা তুই কেন পেতে চাচ্ছিস?”

আহিয়ান এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। তন্ময়ের দিকে ঘুরে শক্ত করে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরলো ও। এতক্ষণের আটকে রাখা অশ্রু গুলো এখন বাঁধ ভেঙে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় আহিয়ান বলে,

–“সব যন্ত্রণা আমাকেই কেন সহ্য করতে হবে বল তো? আমার লাইফেই কেন বার বার বিচ্ছেদ নামক যন্ত্রনাটা আসবে? বিধাতা কেন বার বার আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে আমার থেকে কেড়ে নেয়? আমি কি একটুখানি ভালোবাসার সুখ পেতে পারি না? ষোল বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। আমার লাইফের সবথেকে কাছের সবথেকে বেশি ভালোবাসার মানুষটাকে আমি হারিয়ে ফেললাম। মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকে না ওকে মেনে নিলাম সেটা। কিন্তু এরপর মিলি এসেছিলো আমার লাইফে। প্রচুর ভালোবেসেছিলাম ওকে। কিন্তু মিলি কি করলো? কোনোকালেই ভালোবাসলো না আমায়। দুটো বছর অভিনয় করেই গেলো। অন্যকাউকে বিয়ে করে নিলো। ওর বিয়ের কথাটা আমাকে জানানোর বিন্দু পরিমান প্রয়োজনবোধ করলো না। অথচ আমরা তখন রিলেশনে ছিলাম। ভাগ্যবিধাতা সেখানেও ভুল মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছিলো। তাই একটা সময় আমার সে ভালোবাসার মানুষটাকেও আমি হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আজ? আজ আনিতাকে কেন হারাচ্ছি আমি? ওকে ছেড়ে তো থাকা সম্ভব না আমার। ওই পিচ্চিটাকে সত্যিই প্রচন্ডরকম ভালোবাসি আমি। আমি ওকে যতটা ভালোবাসি তার থেকে অনেক বেশি ও আমাকে ভালোবাসে। সেকেন্ড এন্ড লাস্ট টাইম লাইফে ঠিকঠাক একটা ভালোবাসার মানুষ আমি পেয়েছিলাম তন্ময়। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার এখানেও নিষ্ঠুর হতে হলো। একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছি আমি আমার আনিতাকে।”

–“আহিয়ান সামলা নিজেকে। আনিতা হারাবে না তোর থেকে। ও তোর ছিলো এতদিন আর তোরই থাকবে।”

আহিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে তন্ময় কথাটা বলল। আহিয়ান তন্ময়কে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে আহিয়ান বলে,

–“থাকবে না রে। ও আর আমার থাকবে না। আমি নিজে ওকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। আমি নিজ হাতে আমাদের সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলেছি।”

–“তাতে কি হয়েছে? আনিতা তো সয়ং দেখেছে তুই কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ওর সাথে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিস। ও একটু বাচ্চা আছে বাট আ’ম সিউর ও বুঝবে সবটা।”

–“আচ্ছা ফাইয়াজ হঠাৎ করেই এরকম কেন করছে? ও তো জানে আমাকে। ফাইয়াজ নিশ্চয়ই জানে আমি আর যাই করি না কেন ওর বোনের সাথে কখনো ভালোবাসার নাটকটা করতে পারি না। হ্যাঁ আমি নিজেও মানছি একটা সময় আমি অনেক সম্পর্কে জড়াতাম আবার সম্পর্ক ভেঙেও ফেলতাম তাই বলে আনির সাথে? ফাইয়াজকে এত করে বলার পরও ও বিশ্বাস করলো না আমার কথা। ও বুঝলো না আমি আমার পিচ্চি-পাখিটাকে সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি। দুম করে ও আমাদের এতবছরের বন্ধুত্বের দিব্যি দিয়ে দিলো। এছাড়া আর কি করতাম আমি? বল না কি করতাম? ফাইয়াজ যে আমার লাইফের একটা অংশ। ওকে ছেড়ে কিভাবে আনিতাকে আঁকড়ে ধরি আমি? আর আনিতাকে ছেড়েই বা কিভাবে থাকবো আমি? আম্ আমি সত্যি আর পা্ পারছি না বিশ্বাস কর। এভাবে দ্ দম বন্ধ হয়ে আ্ আসছে আমার।”

–“চিন্তা করিস না। আমরা আছি তো। তোর আনিতাকে তোর থেকে হারাতে দিবো না আমরা। ফাইয়াজের মতামত নিয়েই তোর পিচ্চিকে আবার তোর লাইফে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের যা করতে হয় আমরা তাই করবো। তুই একদম নিশ্চিন্তে থাক। একটু আগে কি হয়েছে না হয়েছে সব ভুলে যা। জাস্ট একটা কথাই মনে রাখ আনিতা তোর ছিলো আর ইন ফিউচার ও তোরই থাকবে।”

আহিয়ান কিছু বলবে তার আগেই আহিয়ানের কাঁধে কেউ একজন হাত রাখে। আহিয়ান পাশ ফিরে ফাইয়াজকে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানিটা মুছে নেয়। তারপর হাসিমুখেই ফাইয়াজের দিকে ঘুরে বলে,

–“ফাইয়াজ তুই? কিছু বলবি?”

–“কাঁদছিলি?”

–“নাহ তো। আমি কাঁদবো কেন?”

–“আমার তো মনে হলো তুই কাঁদছিলি। এখনো তোর চোখে আমি স্পষ্ট পানি দেখতে পাচ্ছি।”

আহিয়ান দুহাত দিয়ে নিজের চোখদুটো ভালো করে ডলে নিয়ে হাসিমুখেই বলে,

–“আরেহ না ভুল দেখেছিস তুই। কাঁদছি না আমি।”

–“মিথ্যে বলছিস না?”

–“একদমই না।”

–“মিথ্যে বললেই বা কি ফাইয়াজ? তোকে তো হাজার বার সত্যিটা বলেও আমরা বিশ্বাস করাতে পারিনি। তুই তো নিজের চোখে সত্যিটা দেখেও না দেখার ভান করে আছিস। আচ্ছা ফাইয়াজ তোর কি মনে হচ্ছে না তুই একটু বেশি বেশিই করছিস? তুই কি সত্যিই বুঝতে পারছিস না আহিয়ান যা বলছে সব সত্যি। আহিয়ান আনিতার জন্য পালটে ফেলেছে নিজেকে ও সত্যি সত্যিই আনিতাকে ভালোবাসে। আচ্ছা তুই তো অনেক বছর ধরে আহিয়ানকে চিনিস। ও তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ফাইয়াজ। আগে না আহিয়ান তোকে কোনো কিছু বলার আগেই তুই সবটা বুঝে ফেলতি? তাহলে আজ আহিয়ান তোকে সবটা বলার পরেও তুই কেন বুঝতে পারছিস না বল তো? আহিয়ানের কষ্টে না তুই নিজেও কষ্ট পেতি? তাহলে আজ তুই নিজেই কি করে ওকে এতটা কষ্ট দিচ্ছিস ফাইয়াজ? শুধুমাত্র তোর সাথে বন্ধুত্ব রক্ষার্থে আহিয়ান নিজের ভালোবাসাকে নিজ হাতে শেষ করে দিলো। শুধুমাত্র তোর জন্য। আর তুই সামান্য আনিতা আর আহিয়ানের সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারছিস না?”

তন্ময় এইটুকু বলতেই আহিয়ান ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,

–“তন্ময় অফ যা প্লিজ। এসব নিয়ে আর কোনো কথা যাতে না হয়।”

–“এখন আমায় থামাতে আসিস না আহিয়ান। তখন আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু এখন আর পারছি না। বলতে দে আমাকে।”

আহিয়ানকে এসব বলে তন্ময় আবার ফাইয়াজের দিকে ঘুরে বলে,

–“আহিয়ান আগে কেমন ছিলো না ছিলো সেসব ভুলে ওদের ভালোবাসাটাকে মেনে নিতে পারছিস না? আচ্ছা ফাইয়াজ সত্যি করে বলতো গত এক থেকে দেড় বছরে তুই কি আহিয়ানের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখিস নি? যে আহিয়ান আগে সবসময় সিগারেট আর মেয়েদের সাথে সম্পর্কের নেশায় মেতে থাকতো সেই আহিয়ানকে কি তুই গত দেড় বছরে কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াতে দেখেছিস? তেমন ভাবে সিগারেট খেতে দেখেছিস? ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও তুই ওর মাঝে এই পরিবর্তনগুলো খেয়াল করিসনি? যেখানে আহিয়ান তোর জন্য ওর ভালোবাসাকে ছেড়ে দিচ্ছে সেখানে তুই আহিয়ান আর আনিতা দুজনেরই ভালো থাকার জন্য ওদের ভালোবাসাটা মেনে নিতে পারছিস না? তাহলে কেমন বেস্ট ফ্রেন্ড তুই? দেখ ফাইয়াজ এতে আনিতা বা আহিয়ান কেউ-ই ভালো থাকবে না। ওরা দুজন দুজনকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। তাহলে আনিতার ভাই হয়ে, আহিয়ানের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে কেন ওদের দুজনকে আলাদা করে দিচ্ছিস তুই?”

তন্ময়ের বলা প্রত্যেকটা কথা ফাইয়াজের গাঁয়ে গিয়ে তীরের মতো বিঁধছে। ওর কাছে সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ফাইয়াজ ঠিক ভুল কোনোটাই বুঝে উঠতে পারছে না। দোটানার মাঝে পড়ে গেছে। “আচ্ছা ওদের দুজনের ভালো করতে গিয়ে খারাপটা করে ফেলছি না তো আমি?” মনে মনে এসব ভাবছে ফাইয়াজ। এতগুলো মানুষ কি মিথ্যে বলবে? আর আহিয়ান তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। তাহলে কি সবাই ঠিক আর ও ভুল? ফাইয়াজ আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। ওর মাথার ভিতর সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ফাইয়াজ নিজের মাথার চুল টেনে ধরে কিছুটা চিৎকার করে বলে,

–“আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না তন্ময়। আমার যা বলার আমি তা আগেই বলে দিয়েছি।”

–“কিন্তু এসব তো তোকে শুনতে হবে ফাইয়াজ। দুটো ভালোবাসার মানুষকে তুই আলাদা করতে চাইছিস। কিন্তু কেন? বল তো? তুইও তো তাসকিয়াকে ভালোবাসিস। তুই আহিয়ানের সাথে যেরকমটা করছিস এখন ওর ভাইও যদি তোর সাথে সেম কাজটা করে তখন কি করবি? পারবি তো নিজেকে সামলাতে? পারবি তো সবটা এভাবে মুখ বুজে সহ্য করে নিতে? নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ভালো থাকতে পারবি তো তুই?”

–“নাহ এরকমটা হবে না। তাসকিয়া সবসময় আমারই থাকবে। পারবো না আমি ওকে ছাড়া থাকতে।”

–“তাহলে আহিয়ান আনিতা ওরা দুজন কিভাবে থাকবে নিজেদের ভালোবাসা হারিয়ে? তোর ভালোবাসাটা ভালোবাসা। আর ওদের দুজনের ভালোবাসাটা ভালোবাসা না তাই-না? তুই যদি তাসকিয়াকে ছাড়া থাকতে না পারিস তাহলে আহিয়ান কিভাবে পারবে? একবার বোঝার চেষ্টা কর ফাইয়াজ। আহিয়ান আগের মতো নেই। ও সত্যিই আনিতাকে ভালোবাসে। সেটা আর কেউ না জানলেও আমি খুউব ভালো করে জানি। আর আনিতাও আহিয়ানকে বড্ড ভালোবাসে রে। ওদের দুজনের সকল ভালোবাসাময় মূহুর্ত গুলোর একমাত্র সাক্ষী আমি নিজে। আমি ওদের ভালোবাসার প্রত্যেকটা মোমেন্টে ওদের সাথে ছিলাম। আমি নিজের চোখে দেখেছি ওরা দুজন দুজনকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।”

–“এসব কথা এখন থাক। খাবি নিচে চল।”

কথাটা বলে ফাইয়াজ আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে। তন্ময় অবাক হয়ে ফাইয়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ক্ষানিকটা সময়। এত করে বুঝিয়েও এত কিছু বলেও কোনো লাভ হলো না? তবুও ফাইয়াজ বুঝলো না ওদের ভালোবাসাটা? তন্ময় মনে মনে এইসবই ভাবছিলো। আহিয়ান তন্ময়ের কাঁধে হাত রাখে। তন্ময় আহিয়ানের দিকে ফিরে তাকাতেই আহিয়ান মলিন হেসে বলে,

–“বাদ দে। আল্লাহ আনিতাকে আমার জন্য হয়তো লিখেননি তাই এমনটা হচ্ছে।”

–“আমিও দেখি ফাইয়াজ কিভাবে না মেনে থাকে। আমিও তোকে কথা দিচ্ছি তোর আর আনিতার মিল আমি করাবোই। তুই ফাইয়াজকে কথা দিয়েছিস আনিতার সাথে কোনোরকম সম্পর্ক রাখবি না। কিন্তু আমি তো ফাইয়াজকে কথা দেইনি। আমি সবটা ঠিক করে দিবো। ফাইয়াজকে মানিয়ে আবার আনিতাকে তোর লাইফে ফিরিয়ে দিবো আমি। এর জন্য আমাকে যা করতে হয় আমি করবো। তোর আনিতাকে তোর থেকে আমি কিছুতেই হারাতে দিবো না। আই প্রমিস।”



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৩০
#Ornisha_Sathi

পরদিন সকাল আটটা থেকে আনিতার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই ওকে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু আনিতা কিছুতেই সারা দিচ্ছে না। সাড়ে আটটা নাগাদ আনিতা একবার দরজা না খুলেই বলেছে ওকে যাতে কেউ ডাকাডাকি না করে। ঘুমোবে ও। আনিতার আম্মু পা ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার কথা বললে জানায় ও নাকি ব্যান্ডেজ করে নিবে।

সাড়ে দশটা নাগাদ আনিতা দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়। ফাইয়াজ আনিতাকে দেখেই চমকে উঠে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে চোখমুখের কি হাল করেছে মেয়েটা। আনিতার তন্ময়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। আনিতা এলোমেলো পায়ে গিয়ে সোফায় বসে। কিছুক্ষণ বাদে আনিতার দাদু সোফায় এসে বসতেই আনিতা তার কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। আনিতার দাদু আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য কপালে হাত রাখতেই তিনি চমকে উঠেন। জ্বরে মেয়েটার গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। আনিতার দাদু জারাফের আম্মুকে ডেকে একটা বাটিতে করে পানি আর রুমাল আনতে বললেন। আনিতার আম্মু আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“জ্বর এলো কিভাবে? বলেছিলাম কাল এত রাত করে গোসল করিস না। তবুও শুনলি না আমার কথা। ঠিকই গোসল করে জ্বর বাধিয়ে ফেললি। ইশ্ জ্বরে শরীর হাত পা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে।”

–“আহ! আম্মু এত চিন্তা করছো কেন? ওই পায়ের ব্যাথা থেকেই ভোররাতে জ্বর এসেছে। একটু পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবো।”

–“চুপ আর একটাও কথা বলবি না।”

আনিতার আম্মু ফাস্ট এইড বক্স এনে ওর পায়ের ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আনিতার দাদু ওর মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছেন। এভাবে বেশ ক্ষানিকটা সময় পানি পট্টি দেওয়ার ফলে আনিতার শরীরের জ্বর কিছুটা হালকা হয়। এখন কিছুটা ভালো লাগায় আনিতা উঠে বসলো। আনিতার আম্মু কিচেনে গিয়ে প্লেটে করে খাবার এনে আনিতার পাশে বসলো। আনিতা খাবারের দিকে তাকিয়ে দেখে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত আর ঝাল ঝাল কষা গরুর মাংস। এটা আনিতার বেশ পছন্দের খাবার। আনিতার আম্মু ভাত লোকমা করে কয়েক বার খাইয়ে দেয় আনিতাকে। এরপর অনেক জোরাজোরি করলেও আনিতা খায়নি। তাই প্লেট হাতে কিচেনে চলে গেলেন উনি। আনিতার দাদুও ততক্ষণে চলে গিয়েছেন বিয়ে বাড়ি বলে কথা কাজ তো আর কম নয়। আনিতা সোফায় একা একাই বসে ছিলো। কিছুক্ষণ বাদে ফাইয়াজ এসে আনিতার পাশে বসে বলে,

–“চল ডক্টর এর কাছে যাবি আমার সাথে।”

আনিতা একপলক ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে দিকে মুখ সরিয়ে নিলো। আনিতার কাজে ফাইয়াজের খারাপ লাগলো কিছুটা। ফাইয়াজ আবারো আনিতাকে ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা বললেই আনিতা বলে,

–“অনেক ভেবেছো আমায় নিয়ে। আর ভাবতে হবে না প্লিজ।”

–“এভাবে কথা বলছিস কেন আনি বুড়ি?”

–“ঠিক ভাবেই তো কথা বলছি।”

পরবর্তীতে ফাইয়াজ কিছু বলার আগেই আনিতা ওখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। ফাইয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো ক্ষানিকটা সময়। সেখানেই থম মেরে বসে থেকে তন্ময় আহিয়ান আনিতার বলা কথাগুলো নিয়ে বেশ ভাবলো ফাইয়াজ। কাল সবাই মিলে ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ও কিছুতেই শোনেনি কারো কথা।

–“আচ্ছা আমি অন্যায় করছি না তো আহিয়ান আর আনিতার সাথে? ওরা দুজনেই আমার লাইফের একটা পার্ট। আমি চাই ওরা দুজন সারাজীবন ভালো থাকুক। কিন্তু আমিই কি ওদের ভালো থাকায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম? আহিয়ান আর আনিতা কি একসাথেই ভালো থাকবে? কিন্তু আহিয়ান যদি অন্য সব মেয়েদের মতো করে আনিতাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেয় তখন? না না এ আমি কি ভাবছি? আহিয়ান আনিতার সাথে এমনটা করতে পারে না। ওকে খুব ভালো করে চিনি আমি। এই দেড় বছরে আমিও বেশ পরিবর্তন দেখেছি ওর মাঝে। আর আহিয়ানকেও দেখে মনে হচ্ছে ও আনিতাকে সত্যিই ভালোবাসে। তাহলে কেন আমি ওদের সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারছি না? কি কারনে আমি ওদের দুজনকে আলদা করে দিতে চাচ্ছি? আহিয়ান এখন না হয় পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ও যদি আবার আগের মতো হয়ে যায়? তখন? তখন কি হবে আনিতার? ও যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখনও তো ভালো নেই আনিতা। না আনিতা ভালো আছে আর না আহিয়ান। কেন করছি আমি ওদের সাথে এমনটা? কেন?”

নিজেকেই নিজে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে ফাইয়াজ। কিন্তু সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না ও। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আনিতার রুমে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ফাইয়াজ। আনিতা একটা শার্ট বুকে জড়িয়ে কান্না করছে। ফাইয়াজের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না ওটা আহিয়ানের শার্ট। নিঃশব্দে দরজার সামনে থেকে সরে গেলো ফাইয়াজ। তন্ময়ের সাথে দেখা হতেই তন্ময় ফাইয়াজকে দাঁড় করিয়ে ওর ফোন থেকে কিছু ছবি দেখালো ও। ফাইয়াজ তন্ময়ের ফোন হাতে নিয়ে একের পর এক ছবিগুলো দেখে গেলো। আহিয়ানের রুমে বেডের উপর দেয়ালে বেশ বড়সড় ভাবে আনিতার একটা ছবি ঝুলানো। আহিয়ানের ওয়ালপেপার এমনকি ওয়ালেটেও আনিতার ছবি। ফাইয়াজ ছবি গুলো দেখে ফোনটা তন্ময়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো। তন্ময় নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,

–“আহিয়ান যে সত্যিই আনিতাকে ভালোবাসে এই কথাটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তোর? ওয়েট আরো একটা জিনিস দেখাচ্ছি তোকে।”

এই বলে তন্ময় ওর বা হাতে রাখা ডাইরিটা ফাইয়জের হাতে দিলো। ফাইয়াজ দেখলো ওটা আহিয়ানের ডাইরি। অনেক আগে থেকেই আহিয়ানের ডাইরি লিখার অভ্যেস। প্রতিদিনের স্পেশাল স্পেশাল মূহুর্তগুলো আহিয়ান ডাইরিতে লিখে রাখে। কখনো খুব বেশি কষ্ট পেলে বা কখনো খুব বেশি খুশি হলে প্রত্যেকটা মোমেন্ট ও ডাইরিতে লিখে রাখবে। ফাইয়াজ ডাইরিটা খুলে সবগুলো পাতা পড়ে দেখলো। সেখানে আনিতার সাথে পরিচয় হওয়া থেকে শুরু করে পরশু অব্দি সকল স্পেশাল মোমেন্টগুলোর কথা আহিয়ান ডাইরি তে লিখে রেখেছে। ডাইরির শুরুতে আহিয়ানের বাবাকে নিয়ে কিছু পেজ লিখা ছিলো মাঝে কয়েকটা কথা মিলিকে নিয়েও লিখা হয়েছে। কিন্তু তারপর পুরো পেজ জুড়ে আনিতার কথাই লিখা আছে। আনিতার সাথে কাটানো ওর স্পেশাল মোমেন্ট গুলো লিখে রেখেছে ও। একটা মানুষ তার কাছের মানুষগুলোকে নিয়েই ডাইরি লিখে। আহিয়ানও তাই করেছে। ফাইয়াজের আর কিছু বুঝার বাকি রইলো না। ডাইরিটা তন্ময়ের হাতে দিয়ে দিলো। তন্ময়েরও আর কিছু বুঝার বাকি রইলো না ফাইয়াজের ফেস এক্সপ্রেশন দেখে। তন্ময় মৃদু হেসে বলে,

–“এখন বিশ্বাস হলো তো? নাকি আরো কিছু বলতে বা করতে হবে?”

–“আহিয়ান কোথায়?”

–“ঘন্টা খানেক আগে একবার দেখেছিলাম। এরপর আর দেখিনি। কোথায় আছে সেটাও জানিনা।”

–“আমিই খুঁজে নিচ্ছি।”

কথাটা বলেই ফাইয়াজ চলে এলো ওখান থেকে। ফাইয়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তন্ময় মুচকি হাসলো। ফাইয়াজ এদিক ওদিক তাকিয়ে আহিয়ানকে খুঁজে চলছে। অনেকটা সময় যাবত আহিয়ানের দেখা পাচ্ছে না ও। তাই আহিয়ানকে খুঁজতে খুঁজতে ওদের বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক দূরত্বে বড় সেই পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালো ফাইয়াজ। সিড়ি বাধাই করা বড় পুকুর। পানি থেকে উপরের তিন নাম্বার সিড়িতে বসে আছে আহিয়ান। ফাইয়াজ গিয়ে নিঃশব্দে আহিয়ানের পাশে দাঁড়ালো। আহিয়ান খেয়াল করেনি যে ওর পাশে কেউ আছে। ফাইয়াজ দেখে আহিয়ান ফোনের স্ক্রিনে আনিতার আর ওর দুজনেরই হাসিমাখা একটা কাপল পিক দেখছে। কালকে হলুদের পিক এটা। নিশ্চয়ই তন্ময় তুলে দিয়েছে। কেননা ও অনেক ভালো ছবি তুলতে পারে। হঠাৎই ফোনের স্ক্রিনে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো। আহিয়ান কাঁদছে। বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করলো ফাইয়াজ। ওর জন্য ওরই কাছের দুটো মানুষ এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। ভাবতেই নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে ফাইয়াজের। ফাইয়াজ আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই আহিয়ান চোখের পানি মুছে পাশে ফিরে তাকায়। ফাইয়াজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহিয়ানও উঠে দাঁড়ায়। ফাইয়াজ আহিয়ানের দু কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“আ’ম সরি ভাই। আমার জন্য আজ তোদের এতটা কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমি সত্যি বুঝে উঠতে পারিনি তোরা দুজন দুজনকে এতটা ভালোবাসিস। যদি আগেই বুঝতাম তাহলে আমার দ্বারা এই ভুলটা হতো না। তোর আনিতা তোরই থাকবে। ফ্যামিলির কেউ যদি তোদের সম্পর্কে রাজি না থাকে আমি রাজি করাবো। যেভাবেই হোক তোদের দুজনকে আমি এক করবো।”

–“ফাইয়াজ কি বলছিস?”

–“একদম ঠিক বলছি আমি। কাল থেকে এই অব্দি অনেক ভুল করেছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোদের দুজনকে। কিন্তু আর না। আনিতা বা তুই তোরা কেউ-ই আলাদা হয়ে গেলে ভালো থাকবি না। তা আমি এই কয়েক ঘন্টায় বেশ বুঝতে পেরেছি। ওদিকে আনিতা তোকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডুকরে কাঁদছে আর এদিকে তুই এখানে একা বসে বসে আনিতার ছবি দেখছিস আর কাঁদছিস। আম আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছিলাম তোদের আলাদা করে দিয়ে। কিন্তু আর না। প্লিজ মাফ করে দে আমায়।”

এইগুলো বলেই ফাইয়াজ আহিয়ানের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। আহিয়ান দুহাতে আহিয়ানের হাতজোরা নিজের মুঠোয় নিয়ে তাতে কপাল ঠেকায়। ফাইয়াজ খুব শক্তপোক্ত ভাবে আহিয়ানকে জাপটে ধরে। আহিয়ানও ফাইয়াজকে জড়িয়ে নেয় দুই হাতে। এতক্ষণ একে অপরের প্রতি যে রাগ অভিমান ভুল বুঝাবুঝি ছিলো সব এই মূহুর্তে নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। তন্ময় এগিয়ে এসে বলে,

–“বাহ আমে দুধে মিলেমিশে একাকার আর এইদিকে আমি আঠি হয়ে বাইরে গড়াগড়ি খাচ্ছি।”

তন্ময়ের কথায় ওরা দুজন দুজনকে ছেড়ে দিলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তিনজনেই ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর তিনজনে মিলে একটা গ্রুপ হাগ করে। ফাইয়াজ ওদের ছেড়ে দিয়ে আহিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“চল।”

–“কোথায়?”

–“আনিতার কাছে। আনি বুড়ির রাগটাও তো ভাঙাতে হবে নাকি?”

–“এখন আমি কিছু বলতে গেলে তোর বোন আমাকে লবন মশলা ছাড়াই কাঁচা চিবিয়ে খাবে। মেয়ে তো নয় পুরাই ধানী লঙ্কা।”

–“ওয়েট আমি কিউটিপাইকে গিয়ে বলছি তুই ওরে আবার ধানী লঙ্কা বলছিস।”

তন্ময়ের কথায় আহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়। আহিয়ান কিছু বলবে তার আগেই ফাইয়াজ বলে,

–“তোরা দুজনে পরে ঝগড়া মারামারি যা ইচ্ছে করিস। আপাতত আমার সাথে চল।”

ওরা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাসায় দিকে রওয়ানা দিলো। বিয়ে বাড়ি প্রচুর হই হুল্লোড়। তার উপর ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স তো সাথে আছেই। বাসায় পৌছাঁতেই দেখলো বিয়ের গাড়ি ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করে এখানে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো আনিতার আম্মু কাকিরা মিলে ওর ছোট চাচ্চুকে গোসল করাচ্ছে৷ ওরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা আনিতার রুমে চলে গেলো। সেখানে রোদেলা আরোহী তাসকিয়া জেরিন শুভ আরহান রাতুল সকলেই আছে। আনিতা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ওরা সকলেই আনিতাকে বলছে উঠে রেডি হয়ে নিতে বরযাত্রীর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আনিতা উঠছে না। ফাইয়াজ গিয়ে আনিতার মাথার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

–“আনি বুড়ি কথা বলবি না আমার সাথে?”

আনিতা কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলো। ফাইয়াজ আরো কয়েকবার ডাকলো আনিতাকে। কিন্তু আনিতা সারা দিলো না। ফাইয়াজ আহিয়ানকে ইশারা করে উঠে গেলো ওখান থেকে। আহিয়ান গিয়ে আনিতার মাথার কাছে বসে পড়লো। রোদেলা ওরা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকালো ফাইয়াজ আর আহিয়ানের দিকে। ওদের এভাবে অবাক চোখে একবার আহিয়ান তো একবার ফাইয়াজের দিকে তাকাতে দেখে তন্ময় ওদের কাছে গিয়ে বলে,

–“ফাইয়াজ বুঝতে পেরেছে ও ভুল করেছিলো। আনিতা আহিয়ান আলাদা হয়ে ভালো থাকতে পারবে না এটা বুঝতে পেরেই ও সবটা ঠিক করে নিয়েছে। এবং এও বলেছে যে ফ্যামিলির কেউ যদি ওদের সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে তবে ও তাকে রাজি করাবে।”

তন্ময়ের কথায় সবাই খুব খুশি হয়ে গেলো। রোদেলা খুশিতে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতে গেলেই তন্ময় ওর মুখ চেপে ধরে। ইশারায় চিৎকার করতে বারন করে। রোদেলাও ইশারায় হ্যাঁ বলে। তাসকিয়া গিয়ে ফাইয়াজের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই ফাইয়াজ বলে,

–“কি ম্যাডাম এবার হ্যাপি তো?”

–“খুউউব।”

–“আপনার বেস্টুর রিলেশনশিপ মেনে নেইনি বলে তো আপনি আমার সাথে কথা বলাই অফ করে দিয়েছিলেন।”

–“যতদিন না মেনে নিতে কথা বলা অফই রাখতাম। তবে এখন যেহেতু মেনে নিয়েছো তাহলে আবার আমরাও চুটিয়ে প্রেম করবো কেমন?”

বিনিময়ে ফাইয়াজ কিছু না বলে মুচকি হেসে তাসকিয়াকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো। আহিয়ান আনিতার পাশে বসে আছে বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারছে না। ফাইয়াজ ওকে ইশারা করছে আনিতাকে ডাকার জন্য। কিন্তু ও বসেই আছে। আহিয়ান মনে মনে ভাবছে, সবার সামনে যদি দু/একটা ঝাড়ি মেরে বসে তাহলে তো প্রেস্টিজের আর কিছু থাকবে না। আর ওর যে বন্ধুরা লেগপুল করতে একচুলও ছাড় দিবে না। ফাইয়াজের দিকে তাকালো আহিয়ান। ফাইয়াজ চোখ গরম করে তাকাতেই আহিয়ান চোখ সরিয়ে নিলো। আহিয়ান আনিতার দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে বলে,

–“ভালোবাসি পিচ্চি-পাখি।”

কথাটা বলে আহিয়ান ঠিক হয়ে বসলো। আর অন্যদিকে কথাটা শোনার সাথে সাথেই আনিতার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আহিয়ান যখন এখানে এসে বসেছিলো আনিতা তখনই বুঝতে পেরেছে যে ও আহিয়ান। খুউব অভিমান জমা হয়ে আছে ওর উপর। বন্ধুর কথা রাখার জন্য ওকে ছেড়ে দিয়েছিলো কিনা তাই। সেজন্য আনিতা ভাবলো একটুও কথা বলবে না আর আহিয়ানের সাথে। তাই চুপ করে ছিলো। কিন্তু আহিয়ানের ফিসফিস করে বলা, “ভালোবাসি পিচ্চি-পাখি” কথাটাই যথেষ্ট ছিলো আনিতার রাগ অভিমান সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য। কথাটা শুনতেই আনিতার সারা শরীরের শিহরণ বয়ে গেলো। মনের ভিতর প্রশান্তিতে ভরে গেলো। বসন্তের মতো নতুন গাছ ফুল পাখির মতো আনন্দে নেচে উঠে আনিতার মন। নতুন উদ্যমে নতুন ভাবে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছে করছে আহিয়ানের ভালোবাসার রঙে।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৩১
#Ornisha_Sathi

আনিতা দুম করে উঠে বসলো। সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আনিতা সেদিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাবার্ড থেকে একটা ড্রেস নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আহিয়ান কিছুক্ষণ আনিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ফাইয়াজকে বলে,

–“দেখলি তো তোর বোনের কান্ড? দোষ করলি তুই আর তেজ দেখাচ্ছে আমার উপর।”

–“বাহ রে! আমি আবার কি করলাম? সব দোষ তো তোরই। তুই তো ওর সাথে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলি। তাহলে তেজ তোর উপর দেখাবে না তো আমার উপর দেখাবে?”

–“কেন ভেঙেছিলাম আমি? তুই তো মাঝখান থেকে আমায় বন্ধুত্বের দিব্যি দিয়ে দিলি। তাহলে আর কি করতাম আমি?”

–“আমি তোকে দিব্যি দিয়েছি বলেই তুই সম্পর্ক ভেঙে দিবি? কেমন ভালোবাসলি তাহলে আমার বোনকে?”

–“ফাইয়াজ তো ঠিকই বলেছে আহিয়ান। ও তোকে দিব্যি দিলো আর তুইও সবকিছু শেষ করে দিলি। তাহলে এখন আনিতার তেজ তো তোকে সহ্য করতেই হবে।”

ফাইয়াজের সাথে সহমত প্রকাশ করে তন্ময় কথাটি বলে। আহিয়ান চোখ বড় বড় করে তন্ময়ের দিকে তাকালো। আহিয়ানের তাকানো দেখে তন্ময় আর ফাইয়াজ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আহিয়ান তন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“ফাইয়াজের মতো করে এখন আপনিও দেখছি দল বদল করলেন।”

এভাবে একের পর এক বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো ওদের মাঝে। তারপর সবাই চলে গেলো গোসল করে রেডি হতে। বারোটার উপরে বাজে আবার বরযাত্রী যেতে হবে তো। কিছুক্ষণ বাদে আনিতা বের হয় রুম থেকে। তন্ময় ফাইয়াজ আহিয়ান ওরা সকলেই সোফায় বসে কথা বলছিলো। রোদেলা তাসকিয়া জেরিন আনিতা আরোহী পাঁচজনেই এখন পার্লারে সাজতে যাবে। ফাইয়াজকে আগে থেকেই বলে রাখা হয়েছিলো ওদের নিয়ে যেতে। তাই ওরা বের হতেই ফাইয়াজ ওরা ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় গিয়ে যথারীতি ফাইয়াজের পিছনে তাসকিয়া, তন্ময়ের পিছনে রোদেলা, রাতুলের সাথে জেরিন আর শুভর সাথে আরোহী বসলো। আনিতা বাইকে না উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। তা দেখে আহিয়ান বলে,

–“তা ম্যাডাম আপনাকে কি এখন বাইকে উঠে বসার জন্য ইনভাইটেশন কার্ড দিতে হবে?”

তবুও আনিতা বাইকে উঠলো না। এমন ভাব নিয়ে দাঁড়ালো যেন ও কিছু শুনতেই পাইনি। তখনই আনিতার সামনে ওর আব্বুর বন্ধুর ছেলে তুষার বাইক থামালো। আনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“কোথাও যাবে তুমি?”

–“হ্যাঁ ভাইয়া৷ একটু পার্লারে যেতাম এই আরকি।”

–“ওহহ! তাহলে চলো আমি তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি।”

আনিতা কিছু না বলে আহিয়ানের দিকে তাকালো। আনিতা তুষারকে না বলতেই যাচ্ছিলো কিন্তু আহিয়ানের ফেস এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো বেশ চঁটে আছে। তাই ওকে আরো রাগানোর জন্য আনিতা ঠিক করলো তুষারের বাইকেই যাবে।

–“বন্ধুর কথায় আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া তাই না? এখন আমার কাছে এসে যতই ভালোবাসি বলুন না কেন? এত সহজে তো মানবো না আমি। এখন দেখুন আপনার সামনে আমি কি করে তুষার ভাইয়ার সাথে ভাব নেই। একটুও পাত্তা দিবো না আপনাকে আমি। জাস্ট একটুও না। হুহ! আপনি শুধু দেখে যান আমি কি কি করি। আমাকে কষ্ট দেওয়া তাই না? আমি আজ সারাটা সময় আপনাকে ইগনোর করবো আহিয়ান। আমিও দেখি কতক্ষণ সহ্য করতে পারেন আপনি। একটু তো জ্বলতে আপনাকেও হবে মিস্টার আহিয়ান আদৃত। বি রেডি।”

মনে মনে এসব ভেবে আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। আহিয়ান রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে আনিতার দিকে। আবার তুষারের দিকেও তাকাচ্ছে। আনিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজ বলে,

–“আর কতক্ষণ এভাবে সঙের দাঁড়িয়ে থাকবি? আহিয়ান ওয়েট করছে তো। বাইকে উঠ।”

–“আমি তুষার ভাইয়ার সাথে যাচ্ছি। আহিয়ান ভাইয়াকে আমায় নিয়ে যেতে হবে না।”

এইটুকু বলে আনিতা তুষারের বাইকে উঠে বসলো। মাঝে বেশ দূরত্ব রেখেই বসেছে আনিতা। লেহেঙ্গা আর গহনার ব্যাগটা আনিতা ওর আর তুষারের মাঝে রেখেছে। আহিয়ান চোখ লাল করে আনিতার দিকে তাকিয়ে আছে। আনিতা উঠে বসতেই তুষার বাইক চালিয়ে চলে গেলো। ফাইয়াজ ওরা সকলেই অসহায় ফেস করে আহিয়ানের দিকে তাকালো। আহিয়ানের হাতে থাকা ফোনটা আহিয়ান ফাইয়াজের দিকে ছুড়ে মেরে বলে,

–“সব তোর জন্য হলো। মেনেই যখন নিবি তাহলে কে বলেছিলো কয়েক ঘন্টার জন্য এমন নাটক করতে? কাল যখন এত করে সবাই বুঝালাম তখন বুঝলি না। এখন সবকিছু গোলমাল করে দিয়ে বুঝে লাভ হলো কি? দেখলি তোর বোন এখন আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। অন্য ছেলের বাইকে উঠে দিব্যি চলে গেলো সে। ওর সাহস হলো কি করে ওই ছেলের বাইকে উঠার? আই উইল কিল হার।”

তন্ময় আহিয়ানের ফোনটা আগেই ধরে নেয়। আহিয়ানের কথা শেষ হতেই ফাইয়াজ তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলে,

–“একদম না। আমার আনি বুড়ির কিচ্ছু হলে তোকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিবো?”

–“তাহলে তোর আনি বুড়ির সাহস কি করে অন্য ছেলের বাইকে উঠার?”

–“তাতে তোর কি? তুই নিজেই তো সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলি।”

–“তোর বোনের সাথে সাথে আমি তোকেও খুন করবো। তারপর নিজেও মরবো। তাহলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে।”

–“তোমরা দুজনে মারামারি খুনাখুনি পরে করো প্লিজ। এখন চলো। লেট হয়ে যাবে তো আমাদের।”

জেরিনের কথায় সবাই বাইক স্টার্ট করে। ফাইয়াজ বাইক স্টার্ট করার আগে আহিয়ানের দিকে ওর ফোন এগিয়ে দিলে আহিয়ান বলে,

–“রাখ তোর কাছে। পরে নিয়ে নিবো।”

এই বলেই আহিয়ান বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। ফাইয়াজও বাইক স্টার্ট দেয়।

ওরা সবাই পার্লারে গিয়ে দেখে আনিতা অলরেডি সাজার জন্য বসে পড়েছে। আনিতাদের পরিচিত পার্লার এইটা। ওরা আসবে আগেই জানিয়ে রেখেছিলো তাই এখন অন্যকোনো মানুষ সাজতে আসেনি। আরো দুটো চেয়ার খালি থাকায় রোদেলা আর আরোহী বসে পড়ে। জেরিনের কাছে একটা ম্যাসেজ আসাতে ও বের হয়ে গেলো পার্লার থেকে। জেরিন নিচে নামতেই আহিয়ান এগিয়ে এসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

–“এটা আনিতাকে দিয়ে দিও।”

–“কি আছে এতে?”

–“বেলি ফুলের মালা। খোঁপায় লাগাতে বলো।”

–“বাব্বাহ! ওর জন্য একাই নিয়ে এলে। আর আমাদেরটা কোথায় হুম?”

–“সবার জন্যই আছে।”

–“তোমার তরফ থেকে?”

–“অবশ্যই। তাছাড়া এখন তো সে আমার উপর রেগে আছে। একা ওকে দিলে নিতো না। তাই সবার জন্যই নিয়ে এলাম। আর বউকে যখন দিবো তাহলে শালীকাদের আর কেন বাদ রাখবো বলো?”

–“আচ্ছা বুঝলাম। এখন তাহলে আসি।”

আহিয়ান মুচকি হেসে মাথা ঝাকালো। জেরিন ব্যাগ হাতে নিয়ে উপরে চলে গেলো।

পৌনে তিনটার দিকে ওদের সকলের সাজ শেষ হয়। একসাথে সবাই পার্লার থেকে বের হয়ে আসে। আহিয়ান তো আনিতাকে দেখে পুরো হা হয়ে আছে। ডার্ক মেরুন লেহেঙ্গা পড়েছে আনিতা। গলায় জাস্ট একটা সিম্পল লকেট সহ চেইন। আর কানে বড় ঝুমকো। ঝুমকোর সাথে মিলিয়ে কপালে টিকলি। আর চুলগুলো খোঁপা করে তাতে বেলি ফুলের গাজরা লাগানো। আহিয়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনিতা ঠোঁট চেপে হাসলো। ফাইয়াজ আহিয়ানের কাঁধে ধাক্কা মেরে বলে,

–“এমনি দেখিস না ভাই। নজর লেগে যাবে তো।”

–“লাগবে না আমারই তো।”

আনিতা নিচে এসে আহিয়ানের পাশ কাটিয়ে গিয়ে তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“তুষার ভাইয়া আপনি এখনো এখানে? কখন এলেন?”

–“আর যাইনি। ভাবলাম একেবারে তোমাকে নিয়েই যাই।”

–“ওহ আচ্ছা।”

আনিতা তুষারের বাইকে উঠতে গেলে আরোহী আনিতার হাত টেনে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে যায়। আনিতাকে আরোহী বলে,

–“কেন শুধু শুধু আহিয়ানকে রাগাচ্ছিস এভাবে?”

–“কই আমি তো কাউকে রাগাচ্ছি না।”

–“আনিতা তুই নিজেই কিন্তু আমাকে একদিন বলেছিলি আহিয়ান ভালো তো খুব ভালো। কিন্তু একবার রেগে গেলে আর রক্ষা নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু ওকে রাগিয়ে নিজের বিপদ আনছিস?”

–“ভয় পাই নাকি আমি ওকে? ও যে আমায় কষ্ট দিলো সে বেলায় কিছু না তাই না?”

–“কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ও সম্পর্ক শেষ করেছিলো সেটা কিন্তু তুই জানিস।”

–“হ্যাঁ জানি। আর সেটাই আমার সমস্যা। ও কেন ফাইয়াজ ভাইয়ার কথায় আমার সাথে সব শেষ করে দিলো? ওর লাইফে ওর বন্ধুর মূল্য আছে আর আমার নেই তাই না? ফাইয়াজ ভাইয়া আজ সবটা মেনে না নিলে তো মনে হয় ও আজও আসতো না আমার কাছে।”

–“তাহলে তুই কি চাচ্ছিস এখন?”

–“তেমন কিছুই না। শুধু বিয়ের এই ক’দিন একটু জ্বলুক এটাই।”

–“ফল কিন্তু ভালো হবে না। ঘুমন্ত বাঘকে জাগাস না। আহিয়ান যদি একবার রেগে যায় না রক্ষা থাকবে না কিন্তু।”

–“ইশ্ ওর রাগ দুঃখ কষ্ট আছে আর আমার নেই? আমার সবকিছুও ওকে সহ্য করতে হবে।”

–“যা ভালো বুঝিস কর। পরে আবার আমার কাছে এসে কাঁদতে পারবি না বলে দিলাম।”

–“ওকে।”

আরোহী চলে গেলো। আর আনিতাও তুষারের বাইকে করেই বাসায় ফিরলো। আহিয়ানের মেজাজ তুঙ্গে উঠেছে। বেশ রাগ হচ্ছে ওর তুষার আর আনিতার উপর।

মেয়ের বাসায় যাওয়ার সময়ও আনিতা আহিয়ানের বাইকে উঠেনি। সবাই বেশ করে বললেও শুনেনি ও। তুষার এবারও বলেছিলো ওর বাইকে উঠতে। কিন্তু আনিতা উঠেনি। আহিয়ান যেভাবে তাকিয়ে ছিলো। এবার বেশ ভয় কাজ করছে ওর। একবার আনিতাকে একা পেলে নিশ্চিত খুন করে ফেলবে। এই ভয়ে ভয়ে আনিতা আর তুষারের বাইকে গেলো না। আহিয়ানের বাইকেও গেলো না। কারন আহিয়ান এখন ওকে পেলেই মাথায় তুলে একটা আছাড় মারবে। তাই আনিতা ওর ছোট চাচ্চুর সাথে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়িতে বসে আনিতার খেয়াল হলো ও রুমে ফোন ফেলে এসেছে। তাই আবার ওর চাচ্চুকে বলে বের হয়ে গেলো। আনিতা ফোন নিয়ে আবারো গাড়ির দিকে এগুতে গেলেই আহিয়ান বাইক এনে থামালো ওর সামনে। আহিয়ানকে দেখেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলো আনিতা। আহিয়ান আনিতার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,

–“বাইকে উঠো।”

–“চা্ চাচ্চুর সাথে গাড়িতে করে যাবো আমি।”

–“বললাম না বাইকে উঠতে?”

–“দ্ দেখুন__”

–“বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি কিন্তু। আমাকে আর রাগিয়ে দিও না আনি। তাই যা বলছি চুপচাপ শুনো।”

ফাইয়াজ এসে আনিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“আমি মামাকে বলে দিয়েছি। তুই আমাদের সাথে যাবি। এখন চুপচাপ আহিয়ানের সাথেই যা বইন। লেট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু অনেক।”

–“তোমার বন্ধু আমাকে একা পেলেই জানে মেরে দিবে। যাবো না আমি উনার সাথে।”

–“আর তুমি যদি এখন বাইকে না উঠো তাহলেও কিন্তু জানেই মেরে দিবো।”

আহিয়ানের কথায় আনিতা ফাইয়াজকে বলে,

–“দেখছো তোমার সামনেই কেমন থ্রেট করছে আমায়।”

ফাইয়াজ কিছু না বলে দুহাতে আনিতার কোমড় চেপে ধরে উঁচু করে ওকে আহিয়ানের বাইকের পিছনে বসে দিয়ে বলে,

–“তোদের ঝগড়াঝাটি খুনাখুনি যা করার বাসায় ফিরে করিস? আর একটু হলে কিন্তু ছোট মামা আবার কেঁদে দিবে। বেচারা তোদের জন্য এখনো বউ আনতে যেতে পারলো না।”

আনিতা ফাইয়াজের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বাইক থেকে নেমে যেতে নিলেই ফাইয়াজ আটকে দেয় ওকে। আহিয়ান পিছন ঘুরে আনিতার দিকে চাইতেই আনিতা মাথা নিচু করে ফেলে। আহিয়ানের দিকে আবারো ভয়ে ভয়ে একপলক তাকিয়ে আনিতা ফাইয়াজকে বলে,

–“আমি যদি আজ মার্ডার হই না তাহলে তোমার বন্ধুর সাথে সাথে তুমিও সমান ভাবে দোষী থাকবে। কাগজে কলমে স্টাম্প করে যাবো আমি।”

–“হ করিস।”

এই বলে ফাইয়াজ নিজের বাইকে উঠে বসলো। ফাইয়াজ বাইকে বসতেই তাসকিয়া বসে ওর পিছে। জয় আর জারাও চলে এসেছে। বরের গাড়ি চলতে শুরু করে। বরের গাড়ির কিছুটা সামনে একটা বাইকে ভিডিওম্যান উলটো ভাবে বসে পিছনের সবটা ভিডিও করছে। আগে বরের গাড়ি চলছে তার পিছনেই ফাইয়াজ ওরা তেরো/চৌদ্দটা বাইক নিয়ে আসছে।

বউ নিয়ে আনিতারা প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ ওদের বাড়ি চলে আসে। ও বাড়িতে গিয়ে আনিতা সবসময় ওর মেজো কাকিমার সাথে সাথে থেকেছে। একদমই আহিয়ানের সামনে পড়েনি। সারাটা সময় আনিতা ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে এই বুঝি আহিয়ানের সামনে পড়ে গেলো। “যাক বাবা ওখানে একা পায়নি এখন একটু সাবধানে থাকলেই হবে। কোনো ভাবেই উনার সামনে একা পড়া যাবে না।” এইসব ভেবে আনিতা নিজের রুমে যেতে নিচ্ছিলো। তখনই আহিয়ান ওর হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে আসে। এইসময় সবাই বউ নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় এদিকটা তেমন মানুষজন ছিলো না। আর তারই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আহিয়ান আনিতাকে টেনে নিয়ে ছাদে চলে এলো। ছাদে এসে আহিয়ান আগে ছাদের দরজা আটকে দিলো। তারপর আনিতার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আনিতাও ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।



চলবে