শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০৪

0
245

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৪ )
কলমে #রেহানা_পুতুল
আরেকজন বলছে,
” তার জন্য মাঝে মাঝে আমাদের অপরাধী মনে হয়রে।”

আয়মান তড়িতেই তার পকেট থেকে সেলফোনটি বের করে নিলো। নিঃশব্দে তিনপা এগিয়ে গেলো। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেকর্ড অপশন অন করে ক্লাবঘরের বন্ধ জানালা ঘেঁষে কাঠের উপর রেখে দিলো। পা পিছিয়ে চলে এলো আগের স্থানে।

রেকর্ডের সঙ্গে সঙ্গে সেও শুনছে তাদের কথা।

” একদম নাহ। তা মনে হবে কেন? তার কারণে সে মারা গেছে। আমরা কি ওরে বলছি নাকি, এতগুলা বোতল খালি করতে হইবো?”

” এই চল আরেকদিন গান আর মদের আসর জমাই। সে কি আমাগো খাইতে মানা করছে নাকি কবরে থেকে? ”

” আরেহ দূর ডরাইছি না। বা * ল। হালায় মনে হয় সেদিন বউর লগে ঝগড়া লাগছে নাকি? সেদিন এত গিললো ক্যান? অন্য সময়তো অত গেলেনা। ”

” হুঁশ ছিলনা বলেই ত চাপা পড়লো। তবে যাই বলি। খারাপ লাগে ওর জন্য।”

” ভাগ্যিস আমরা কোনোভাবে ফেঁসে যাইনি।”

” ফাঁসবো কেনো আমরা নিদোর্ষ হয়ে? পথ পার হতে গিয়ে পথচারীর করুণ মৃত্যু হলো। লা*শ স্বাভাবিক নিয়মে দাফন হলো। কাহিনী খতম।”

আয়মান সবার কন্ঠ চেনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তবে দুটো ছেলের কন্ঠ সে বেশ চিনতে পারলো। তাদের নাম মুখস্থ রাখলো সময়ের জন্য। এই আড্ডা দেয়া গ্রুপটা বাজেভাবে চিহ্নিত এলাকায় মুরুব্বীদের কাছে। তবে যুবক শ্রেণীর পছন্দের এরা। আয়মান সেখানে দাঁড়িয়ে আরেকটু অপেক্ষা করলো। আরো কোনো স্পষ্টতর ক্লু পায় কিনা সে প্রত্যাশায়।

আয়মান অবাক মনে ভাবলো,
এরা কার কথা বলছে? আমার ভাই? নামতো বলেনি। কারণ আরহামের আগে গ্রামে আরেকটা পুরুষ মারা গিয়েছে। সেদিন কি শুভ্রতার সাথে ঝগড়া হলো তার ? কিন্তু ও ম’ দ খায় কবে থেকে? কই আমিতো জানিইনা। আয়মানের মাথা চরকির মতো ঘুরছে৷ নিজের চুলগুলো পিছন দিয়ে খামছি দিয়ে টেনে ধরলো। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

শুভ্রতা তোমার হাতে যেমন আমি খু’ন হতে পারি। তেমনি তোমার জন্য খু’ন করতেও পারি হাসতে হাসতে। আমাকে বুঝতে শিখো শুধু একটিবার। জেনে রাখো।

” আমি তোমার জন্য শত রাত কাঁদবো। কিন্তু তুমি কাঁদবে অনন্তকাল। ”

আয়মান মোবাইলটা নিয়ে সচেতনভাবে রেকর্ডটি সংরক্ষণ করলো। বিমর্ষ চিত্তে বাড়ি চলে গেলো। পা টানটান করে শুয়ে পড়লো। একে একে কয়েকটি সিগারেট ছাইঁ করে ফেলল ক্রোধে, না পাওয়ার শূন্যতায়। ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয় ও কারণ এখন তার কাছে সূর্যের আলোর মতই জ্বলজ্বলে ও প্রখর। কেবল বিষয়টা শুভ্রতার কাছে প্রমাণ করার অপেক্ষা। দ্বিতীয় কান করা যাবেনা এখন। সতর্ক থাকতে হবে।

আয়মান সারাদিন গুমোট ভাব ধরে থাকে আড়ালে আবডালে। মাঝে মাঝে মাথাটা বেশ এলোমেলো হয়ে যায়। খেই হারিয়ে ফেলে। যেনো মহাকালের অতল খাদে সে তলিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাবার কেউই নেই। কেউই না। তার চারপাশে এত শত মানুষের আনাগোনা। কাছের, দূরের চেনা, অচেনা। আত্মীয়, অনাত্মীয়, দূরাত্মীয়। সবার এত হাসি খুশি মুখ। তবুও তার মন ভারাক্রান্ত। মরুভূমি। বুকজুড়ে খাঁ খাঁ শূন্যতা। হৃদয়প্রান্তরে এতটকু সুশীতল ছায়া নেই। নেই প্রিয় মানুষটার মায়া। উল্টো তার উপেক্ষা,রুক্ষ আচরণে আয়মানের হৃৎপিণ্ডটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

নিয়ম করে সময় গড়িয়ে যায়। বেলা ফুরোয়। দেখতে দেখতে চারমাস ফুরিয়ে পাঁচমাসে পা দিলো। শুভ্রতা তার প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। ভগ্নস্তূপ অঙ্গখানি তার চেনা মুগ্ধরূপে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আয়মান ছাড়া পরিবারের বাকিরা মন চাইলেই শুভ্রতার সাথে অডিও ভিডিও কলে কথা বলছে। এমনকি তাদের কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ও কথা বলে।

শুভ্রতাও সবার সাথেই দরদ কন্ঠেই কথা বলে। আয়মান ছাড়া শশুর বাড়ির কারো উপরেই শুভ্রতার কোনো অনুযোগ ও খেদ নেই। আয়মান শুভ্রতার একটু কন্ঠ শোনার জন্য পরোক্ষভাবে চেষ্টা করেও বিফল হলো।

আয়মানের রুমে তার বাবা মা উপমা এলো। তার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

” আচ্ছা আমরা আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছি উপযুক্ত কারণে। তুইও রাজী হয়েছিস সেই একই কারণে। এখন যেহেতু সেটা নেই,তো তুই কি বলিস এই বিষয়ে?”

” আমি তোমাদের মত জানতে চাই। ”

” ভাইয়া আমি চাই তুমি ভাবিকে বিয়ে করো। অন্যকাউকে ভাবি হিসেবে চাইনা। ভাবির সাথে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আদারওয়াইজ এখন তাদের মুখের উপর মানা করলে,ভাববে আমরা সুবিধাবাদী। সেলফিশ। আমাদের বাচ্চার জন্যই তাদের মেয়েকে রাখতে চেয়েছি। তাকে ভালোবেসে নয়।”

মেয়ের কথা সুর মেলালেন আমিনা বেগম। মোলায়েম কন্ঠে বললেন,

” তোর বোন ঠিকই বলছে। তোর আপত্তি না থাকলে আমরা সবাই তাকেই এই ঘরে আবার বউ হিসেবে দেখতে চাই।”

” সে যদি রাজী থাকে এখন। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমিও তাকে অনেক পছন্দ করি ব্যক্তি হিসেবে।”

উৎফুল্ল হয়ে বাকিরা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল সমস্বরে। আয়মানের মুখে এক চিলতে হাসির আভা ফুটে উঠলো ভোরের ঝলমলে রোদ্দুরের মতো।

” ঠিক আছে। আমি ফোনে আলাপ করছি তাদের সাথে। ”

সেদিন শেষ দুপুরে শুভ্রতার বাবা শফিককে, আয়মানের বাবা ফোন করলো। সালাম দিয়ে বলল,

” বেয়াই যেহেতু বৌমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাহলে এখনতো ইদ্দতের সময়কাল চারমাস দশদিন। যেটা ইতঃমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। আমরা ঘরোয়া আয়োজনেই আপনার মেয়েকে আবার আমাদের ঘরে তুলে আনতে চাই। আপনি দয়া করে আমাকে জানান সময় নিয়ে। আমি চাই বিয়েটা এই শুক্রবারেই বাদ জুম্মা সম্পন্ন হোক।”

” আলহামদুলিল্লাহ ভাইজান। আমার মেয়ের রিজিকে যদি আপনার ঘরের অন্ন থেকে থাকে। তাহলে বিয়ে হবেই। একদিন আমিই বলছি আপনাকে ‘ আত্মার মিল না থাকলে আত্মীয় হয়না।’ মিল হয়েছে। বিয়ে হয়েছে। এখন আবারো হবে।”

” আলহামদুলিল্লাহ ভাইজান। সন্তুষ্ট হলাম আপনার কথায়।আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।”

ফোন কেটে দিয়ে শুভ্রতার বাবা তার স্ত্রীকে সব জানালো। তারা বলাবলি করতে লাগল শুভ্রতার সামনে গিয়ে।

” দেখলি কি নিঃস্বার্থ সোনার মানুষ এরা। আমরা আরো হতাশ হয়ে গেলাম। ভাবলাম তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো। এখন দেখি তার বিপরীত। কথায় আছেনা,
” মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।” ঠিক সেটাই। শুক্রবারে বিয়ে। আয়মান দুলা সেজে আসবে।

” মা আমি এতটা পঁচে যাইনি। তোমাদের বোঝাও হয়ে যাইনি। যে ভাসুরকে বিয়ে করবো। তখন কারণ ছিলো। তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজী হয়েছি। এখন আমার পথ রুদ্ধ নয়। তারা আমাদের আত্নীয়। ছেলে মারা যাওয়ার পর এখনো তারা আসেনি আমাদের বাড়ি। শুক্রবারে আসুক। আয়োজন করো রান্নার। খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে যাক। ঘুরে যাক। কিন্তু বিয়ে হবেনা। ”

কাঠ কাঠ গলায় মা বাবার মুখের উপর শুভ্রতা সাফ জানিয়ে দিলো তার মতামত। জহুরা ও শফিক তব্দা খেয়ে গেলো শুনে। ঘোর চিন্তায় পড়ে গেলো। কোন মুখে মানা করবে। হায় খোদা! না করেওতো উপায় নেই। তবুও নিরুপায় হয়ে তারা বিনীতভাবে আয়মানের বাবাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলল এবং দাওয়াত দিলো শুক্রবারে যাওয়ার জন্য। আয়মানের বাবার মুখ দিয়ে আর কোনো কথায় বের হলনা। বিদায় নিলো দাওয়াত কবুল বলে।

আয়মানের বাবা তার মাকে সব বলল। তার মা ও উপমা গিয়ে আয়মানকে সব জানালো। বলল,

” আমরা শুক্রবারে দাওয়াতে যাই আগে। তারপর উপমা ও আমি রাজী করিয়ে ফেলব। ”

আয়মান কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলনা। কেবল গোপনে প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়া ব্যর্থ নাবিকের মতো দিশেহারা হয়ে পড়লো।

আজ শুক্রবার। জহুরা বড় মেয়ে শিউলি ও শুভ্রতার সাহায্য নিয়ে আয়োজনের কমতি রাখলনা। সব আয়োজন শেষ। সবাই অপেক্ষায় অতিথিদের জন্য। বিলম্ব হলো অতিথিরা আসতে। তারাও হাতভরে ভরপুর জিনিসপত্র আনলো। সবাই ড্রয়িংরুমে বসল। সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। কুশলাদি বিনিময় করলো। আমিনা বেগম জহুরাকে ধরে অঝোরে কাঁদল। যে ছেলের উপলক্ষে এ বাড়ি আসলো। আজ তার সেই ছেলে এই দুনিয়াতে বেঁচে নেই। চিন্তা করতেই তার বুকটা ভার হয়ে এলো। শুভ্রতা মাথায় ওড়না দিয়ে শশুর শ্বাশুড়িকে পা ধরে সালাম দিলো। আয়মানকে মুখে সালাম দিলো। আমিনা বেগম ও উপমা শুভ্রতাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। উপমার চোখ ভিজে গেলো শুভ্রতাকে দেখেই। আয়মান সেন্টার টেবিলের উপরে থাকা একটি ম্যাগাজিন বই নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলো। আড়চোখে শুভ্রতাকে দেখছে। শুভ্রতা আয়মানের দিকে ফিরেও চাইলোনা। আয়মানের চোখেমুখে গাম্ভীর্যতার ছাপ। বসে আছে গুরুগম্ভীরভাবে।

সবাই একসাথে বসে নানান গল্পগুজবে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলো। ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশন হলো ঘরে পাতা দই ও রসগোল্লা। শুভ্রতাদের সবাই আয়মানের মাকে পুত্রশোক ভুলার জন্য একথা ওকথা বলতে লাগলো।
খাওয়া শেষে রেস্ট নিয়ে সবাই ভিতরের একটি অতিথি রুমে জড়ো হলো। উদ্দেশ্যে আয়মান ও শুভ্রতার শুভ বিবাহ নিয়ে আলাপ। জহুরা,শফিক,শিউলি, তার স্বামী জুনায়েদ, আয়মান,তার বাবা,মা,বোন উপমাও উপস্থিত রয়েছে। এক দুই কথায় বিয়ের আলাপ তুলল লতিফ খান। শুভ্রতাকে ডাকা হলে সে গেলো রুমে। দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে রইলো। লতিফ খান শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করলনা,

” মা তোমার আপত্তি কেনো আমাদের কাছে চিরদিন থাকতে?”

” বাবা, আমি আমার স্বামীর খুনিকে বিয়ে করতে পারবোনা।”

বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল শুভ্রতা।

বাজ পড়া পাখির মতো উপস্থিত সবাই পাথরচোখে শুভ্রতার পানে চাইলো।

চলবে…৪