শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-২+৩

0
286

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ২ + ৩ )
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল

” আচ্ছা আয়মান ভাই, আরহামকে কেউ সরিয়ে দিলো নাকি আমার জীবন থেকে?”

ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে তীব্র অনুযোগ নিয়ে বলল শুভ্রতা।

আয়মান স্তম্ভিত! নির্বাক! নিমিষেই জমে গেলো বরফখন্ডের ন্যায়। অনিমেষ চেয়ে রইলো শুভ্রতার আঁখিযুগলে। শুভ্রতা মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। আয়মান দুঃখী দুঃখী কন্ঠে জানতে চাইলো,

” আজ হঠাৎ তোমার এমন মনে হলো কেন? কই মা বাবা আমাদের কারো মনেইতো এমন কিছুর উদয় হয়নি?”

” হঠাৎ করে মনে হয়নি। আরো আগে থেকেই মনে হয়েছে। ”

” তাহলে মা বাবাকে জানাও।”

” বলেছি। উনারা বিশ্বাস করেনি। গুরুত্ব দেয়নি আমার কথাকে।”

” তো এবার বুঝো। তুমি আরহামের শোকে ভেঙ্গেচুরে আছো। তাই ভুলভাল ভাবছো। আমার আদরের ছোট ভাইটা কিভাবে সবাইকে ছেড়ে গেলো তা তুমি আমি সবাই জানি শুভ্রতা।”

**” সত্যের ভিতরেও যে নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে থাকে। সেই সত্যের তল আমরা কজন খুঁজে পাই।”**

অবনত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল শুভ্রতা।

” তোমার কাউকে ডাউট হলে বল প্লিজ? আমি তাকে তোমার সামনে এনে হাজির করবো। তারপর প্রমাণ হলে তুমি নিজহাতে তাকে শাস্তি দিও।”

” আমার একজনকে আংশিক সন্দেহ হয়। যদি তা সত্যি হয়। আমার হাতেই বাজবে তার মরণ বিষের বাঁশি।”

আয়মান ফের জানতে চাইলোনা শুভ্রতার কাকে সন্দেহ হয়। কেবল নিরীহ কোমল চোখে শুভ্রতার দিকে চেয়ে বলল,

” আমি তোমার যেকোনো প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করলাম শুভ্রতা। শুধু তোমার ডাকের অপেক্ষা। নিজের যত্ন নিও।”

আয়মান রুম থেকে প্রস্থান নিলো পরাজিত সৈনিকের ন্যায়। এরপর থেকে সে শুভ্রতার সামনে আসার বা তার সাথে কথা বলার চেষ্টাটুকুও করেনা। বরং পারলে লুকিয়ে বাঁচে।

স্নিগ্ধ বাতাসে শিহরণ জাগানো শরতের এক মিষ্টি সকাল। সবুজ প্রকৃতিতে শরৎ তার অনুপম সৌন্দর্য বিলিয়ে রেখেছে। দূর্বাঘাসের উপর ছড়িয়ে আছে শিশির ভেজা মায়াবী চাদর। গাছে গাছে ফুটে আছে চেনা ফুলের বর্ণিল সমারোহ। শাখায় শাখায় পাখিদের মুখরিত কলরব। গ্রামের এত মুগ্ধকর পরিবেশেও শুভ্রতা বিধ্বস্ত পথ হারা পথিকের ন্যায়। থরে থরে নীল বিষাদের ভারী আস্তরণ দানবের ন্যায় তার কোমল হৃদয়টাকে গুড়িয়ে দিচ্ছে বেলা অবেলায়। এই ভার সে নিতে পারছেনা আর।

পরিবারের বাকিরাও তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে নিঃশ্ব! শোকাহত। রাত বিরাতে আয়মানের মা, বাবা বোন ও ডুকরে কেঁদে উঠে। আবার ধৈর্যের কাছে তারা আশ্রয় নেয়। শুকরিয়া জানায় স্রস্টার ইচ্ছা ও হুকুমকে। কিন্তু শুভ্রতার দহন অন্যদের চেয়ে অধিক। কারণ তার অল্প হলেও সন্দেহ হয় যে, রায়হানের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়।

শুভ্রতাকে সঙ্গে নিয়ে সবাই সকালের নাস্তা খেয়ে নিলো। ঠিক তার একটুসময় পরেই শুভ্রতার গা গুলিয়ে আসতে লাগল। তখন তার প্রেগন্যান্সির দুইমাস চলছে। শুভ্রতা লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত ঘরের পিছনের আমগাছের গোড়ায় গিয়ে বসল এবং হড়হড় করে বমি করে দিলো। উপমা ও আমিনা বেগম ছুটে গেলেন শুভ্রতার পিছুপিছু। আমিনা বেগম শুভ্রতার কপালের দুপাশ চেপে ধরলেন। উপমা পানি নিয়ে এলো। তারা মা মেয়ে শুভ্রতাকে সামলে নিলো। আমিনা বেগম শুভ্রতার উদ্দেশ্যে বললেন,

” এ সময় এমন বমি হওয়া, টক খেতে চাওয়া,আরো কত কিছু যে খেতে মন চায়। এসবই স্বাভাবিক বিষয়। আমারতো মনে হলে এখনো হাসি পায়।”

” কি মনে হলে আম্মা?” কৌতুহল চোখে জিজ্ঞেস করলো উপমা।

শুনতে হাস্যকর লাগবে তোদের কাছে হয়তো। আমি শুধু আতপ চালের ঝাউভাত,খুদের ভাত,মুড়ি দিয়ে রং চা,ঝাল চানাচুর,ভর্তা,মরিচ এসব দিয়েই ছয়মাস পার করেছি। এসবের বাইরে কিছুই খেতে পারতামনা।

তাদের কথার মাঝে পাশের বাড়ির বাতাসীর মা এলো। সে বলল,

” ভাবি আমারটাতো আজিব ছিলো। কয়লা খাইতে মন চাইতো আমার। লুকায়া লুকায়া কত কয়লা চিবায়া খাইতাম। আর সব কাঁচা জিনিস খাইতে মজা লাগতো।সবাই কইতো আমার উপর ভুতের আছর পড়ছে।”

উপমা চোখ কপালে তুলল। বলল,

” কাঁচা মানে? ”

” আমপাতা,থানকুনি পাতা,শাকপাতা সব কাঁচা খাইতাম। আর নাকে সব আজিব আজিব জিনিসের গন্ধ ভাললাগতো। এই ধর, কেরোসিন তেলের,সরিষার তেলের,গোবরের,মোটরসাইকেলের,
মশার ঔষধের, কয়েলের, নারে ভাবি?”

” হ্যাঁ। ও ঠিকই বলছে। বাচ্চা পেটে হলে মনে এসব ভৌতিক বাসনা জাগে।”

উপমা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। শুভ্রতা শুকনো হাসি দিলো শুনে। উপমা শুভ্রতাকে নিয়ে তার রুমে শুইয়ে দিলো।

” উপমা কোন টক জাতীয় কিছু আছে?”

দেখছি, বলে উপমা প্রায় দৌড়ে আয়মানের রুমে গেলো।

” এই ভাইয়া। ভাবি অনেক বমি করছে। টক কিছু খেতে চাচ্ছে। তুমি বাজারে গিয়ে আচার নিয়ে আসতে পারবা?”

আয়মান বোনের কথা কানে যাওয়া মাত্রই উঠে দাঁড়ালো। উঠানে গিয়ে বাইকে চড়ে স্পীডে টান দিলো। উপমা উঠানেই হাঁটাহাঁটি করছে। মিনিট দশেক না হতেই ফিরে এলো আয়মান। বাইক থামিয়ে বোনের হাতে আচারের প্যাকেট দিলো।

“থ্যাংক ইউ মাই সুইট ভাইয়া। পরিবারের প্রতি এমন ডেডিকেটেড ভাই কজনের আছে। গেলে আর এলে।”

” শোন,শুভ্রতার হঠাৎ বমি হলো কেন? কি খেয়েছে?”

” ওমা! জাননা?”

” কি জানবো? ”

” ভাবি মা হতে যাচ্ছে। গেলাম। অপেক্ষা করে আছে ভাবি।”

আয়মান খুশী হওয়ার পরিবর্তে অবাক হয়ে গেলো। সাথে অপ্রস্তুত ও। যেনো অপ্রত্যাশিত কিছু শুনলো সে।

” এই ভাবি নাও। খাও। কয়েকরকমের আছে এখানে।”

শুভ্রতা তেঁতুলের প্যাকেট ছিঁড়ে দ্রুত পুরো প্যাকেট আচার খেয়ে ফেলল। উপমা খেলো বরইয়ের শুকনো আচার।

” কই পেলে এত আচার আমার কলিজার ননদী?”

প্রসন্ন হেসে বলল শুভ্রতা।

” বারে। কে আবার। তোমার ভাসুর। থুক্কু। হবু বর তোমার। ভাইয়া বাইক নিয়ে হাওয়ার বেগে গেলো আর এলো।”

শুভ্রতার শুভ্র মুখখানি মলিন হয়ে গেলো। কিন্তু উপমাকে কিছুই বললনা। শুধ বলল,

” ওহ আচ্ছা। বুঝলাম।”

” আমি গেলাম ভাবি। আর শোন। তুমি সাবধানে থেকো। আচার সব তোমার কাছেই রাখ। মন চাইলেই খেও। ভার্সিটিতে আমার ক্লাস খোলা আজ থেকে। যেতে হবে। নয়ত রেজাল্ট খারাপ হবে।”

” তুমিও সাবধানে যেও উপমা মনি।”

তার দুইদিন পরের এক মধ্য দুপুরের দিকে মন কেমন করা বৃষ্টি শুরু হলো। শুভ্রতা দরজায় দাঁড়িয়ে মোহনীয় চোখে বৃষ্টির পানে চেয়ে রইলো। ভাবলো পৃথিবীর মানুষগুলো কতটা ব্যথা বেদনায় ডুবে থাকলে ওই শরতের আকাশটাও বুক ভেঙ্গে অমন হুহু করে কাঁদতে পারে।

বেশ সময় পরে বৃষ্টি থামলো। শুভ্রতা শেষ দুপুরের দিকে গোসল করতে গেলো পুকুর ঘাটে। ঘন শৈবালে মাখামাখি পাকা সিঁড়িটায় পা রাখতেই পিছলে চিৎ হয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো। দূর্বল কন্ঠে মাগো বলে কুঁকিয়ে উঠলো শুভ্রতা। ওভাবেই পড়ে রইলো। উঠতেও পারছেনা। পুকুরের ভিতরে নিরাপত্তার জন্য সিমেন্টের দেয়াল তিনপাশেই। তাই অন্যঘাট থেকেও কেউ দেখার সুযোগ নেই।

শুভ্রতা আজ এতসময় ধরে কিসের গোসল করে বুঝলামনা। কাপড়চোপড়তো ধোয় সকিনা। বিড়বিড় করতে বলতে বলতে আমিনা বেগম পুকুর ঘাটে গেলেন। শুভ্রতাকে দেখেই ওমাগো! বলে হাউমাউ করতে করতে আয়মানকে ডাক দিলেন।

আয়মান মায়ের আগে দৌড়ে গেলো পুকুর ঘাটে। পিছন দিয়ে তার বাবা ও বোন আসলো।

” মা রক্তে কিসের ওর পায়ের কাছে? আমি কি ওকে ধরবো এখন?”

অস্থির গলায় বলল আয়মান।

” ওরে হারামী। কোলে তুলে ঘরে আন। উপমা একলা পারবে নাকি? বিপদের সময় অত ভাবাভাবির টাইম নাই।”

উপমা শুভ্রতার মাথা নেড়েচেড়ে ভাবি ভাবি বলতে ডাকতে লাগল।

“দেখি তুই সর। আমিই নিচ্ছি ওকে। ”

আয়মান শুভ্রতাকে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো। তৎক্ষনাৎ বের হয়ে গিয়ে সিএনজি নিয়ে এলো। আমিনা বেগম হায় হুতাশ করছেন। আল্লাহ। রক্ত জমাট বেঁধে গেলো। বাচ্চা নেই আর। বাত্তি নিভে গেলো।আহারে!

তারা সবাই মিলে নিকটস্থ একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেলো শুভ্রতাকে। পরিক্ষা শেষে ডাক্তার এসে জানালো,

” উনার গর্ভপাত হয়েছে। আর জ্ঞান ও ফিরেছে। কাল বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। যেহেতু প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই উনি দুইমাস রেস্টে থাকতে হবে। আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। নিয়ম করে খাওয়াবেন। আর ডিম,কলা,দুধ,মুরগীর বাচ্চা, ছোট শিং মাছ খেতে হবে। আশাকরি সেরে উঠবেন। ”

” জি। থ্যাংক ইউ ”

উপমার চোখ ভিজে উঠলো শুনে। তার বাবা হতাশ হলেন। তার মা কেঁদে ফেলল। আয়মান তাদের বলল,

” তোমরা থাক। আমি কিছু খাবার কিনে আনি।”

“আমার জন্য খিলি পান আনিস বাবা। পান না চিবোতে পারলে আমার মাথা ধরে যায়।”

” আচ্ছা মা আনবো।”

আয়মান মা, বাবা,ও বোনকে রেখে ক্লিনিকের বাইরে নিচে গেলো। আকাশের দিকে মাথা তুলে চাইলো। তার ঠোঁটজুড়ে বিস্তৃত হলো বিশ্ব জয়ের হাসি। শব্দ করেই বলল,

” শুভ্রতা তোমার জন্য আয়মান পৃথিবী লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। মৃত্যুর গিরিখাদে পা রেখেও চাইবো তোমাকে।”

চলবে…২

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৩ )
কলমে #রেহানা_পুতুল

শুভ্রতা, তোমার জন্য এই আয়মান পৃথিবী লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। মৃত্যুর গিরিখাদে পা রেখেও চাইবো তোমাকে।
________

আয়মান শুভ্রতার মাকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানালো। তারা আসতে চাইলে মানা করলো। বলল,
আন্টি কাল আসবেন আমাদের বাড়ি। এখানে ঝামেলা করে আসতে হবেনা। তারপর সে আস্তে ধীরে কিছু খাবার কিনল সবার জন্য। উপরে উঠে এলো। দেখল শুভ্রতাকে সিটে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুভ্রতার বন্ধ আঁখিযুগলে আয়মান একপলক চাইলো অসহায়ের মতো। আমিনা বেগম ব্যাগ থেকে তার পান বের করলেন।

আয়মান হেয়ালী করে মাকে বলল,

” কি পানখোর তুমি। মন খারাপ। কিন্তু পান না খেয়ে থাকতে পারনা।”

আমিনা বেগম আস্ত একটা খিলি পান মুখে পুরে দিলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন,

” পান আমার নেশার মতরে বাপ। ভাত না খেয়ে থাকা যায়। কিন্তু পান না হলে মনে হয় সারাদিন আমি উপোস। কিছুই খাইনি। তুই বুঝবিনা এটা। তোর বাপের কাছেও আমার পান খাওয়ার মর্যাদা পেলাম না কোনদিন। আমার পানের পিছনেই নাকি সব টাকা শেষ। ”

” মা আমার নেশা যে কোথায়। কিসে।একবার যদি জানতে।”
কথাটি গোপনে বলেই ছোট্ট একটি পরিতাপের নিঃশ্বাস ছাড়ল আয়মান।

লতিফ খান শক্ত চোয়ালে স্ত্রীর দিকে নিরস ভঙ্গিতে তাকালেন। বললেন,

” স্ত্রী লোকের বদস্বভাব! কবরে গেলেও স্বামীর নামে নালিশ করবে মনে হয়।”

” এই আপনি কি বললেন? আমি কবরে গেলেও আপনার নামে নালিশ করবো?”

মুখ গোঁজ করে বললেন আমিনা বেগম।

” তো নয়তো কি? যে হাসপাতালে এসে বলতে পারে। সে শুধু কবরে নয়, জেলখানায়, পাগলা গারদে বসেও স্বামীর নামে অভিযোগ তুলবে।”

ফোঁড়ন কেটে বলল লতিফ খান।

” আহ! বাবা থামতো। কি শুরু করছ তোমরা?” আদেশের সুরে বলল আয়মান।

” এই ব্রো! তুমি স্টপ। আম্মা আব্বার এটা ঝগড়া নয়। নয় কোনো ভুল বুঝাবুঝি। ইহা উনাদের হানি হানি কেমিস্ট্রি। বুঝলে।”

আয়মান কপাল কুঁচকে বোনের দিকে তাকালো। বলল,

” কিরেএএ? তোর কাহিনী কি? শুরু করছিস নাকি? ঝগড়াতেও কেমিস্ট্রি খুঁজে পাস? হু?”

” ভাইয়া যে কি বলনা।”
বলেই অবনত মস্তকে লাজুক হাসলো উপমা।

” হয়েছে। কাম সারছে। বুঝিতে সক্ষম হইলাম। কুচ কুচ হোতা হে।”

এই চুপ কর দুই ভাইবোন। সারাদিন সাপে নেউলের মতো লেগেই থাকিস। আচ্ছা আমি ও আয়মান চলে যাই। তুমি, উপমা বৌমার কাছে থাকো। কাল বারোটায়তো রিলিজ হয়েই যাচ্ছে।

উপমা বলল,

” আব্বা। আম্মাকেও নিয়ে যাও। ওয়ার্ডে দুজন থাকবো কিভাবে। আম্মা অসুস্থ হয়ে যাবে। এখানে আম্মার থেকে কোনো কাজই নেই। আমি এই যে সিটের নিচে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে যাবো। ”

” ভালো বলছিস মা। তুই পারবিতো একা। সমস্যা হবেনাতো?”

” আব্বা। আমি কি তোমাদের সেই ছোট্ট খুকি এখন? অনার্স পড়ুয়া মেয়ে আমি। খুউব পারবো। তোমরা তিনজনই চলে যাও। ভাবির জন্য আমি একাই এনাফ।”

ওকে থাক, বলে আয়মান বোনের মাথায় হাত রাখলো। এবং কিছুক্ষণ বাদেই তারা তিনজন চলে আসলো।

পুরো হাসপাতাল জুড়ে মাঝরাতেও দিনের মতো কলরব। নেই কোন প্রগাঢ় নৈঃশব্দতা। কেউ স্বজন হারিয়ে আছাড়ি পিছাড়ি করে দুনিয়া কাঁপিয়ে ফেলছে। কেউ রোগ যন্ত্রণায় প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কেউ উহু! আহ!মাগো! বলে আল্লাহকে স্মরণ করছে নাক মুখ খিঁচিয়ে। কেউ তার প্রিয়জনকে বাঁচাবার জন্য স্রস্টার নিকট প্রার্থনার দুহাত তুলেছে। কেউ উম্মাদের মতন দিগ্বিদিক ছুটছে হাতে জিনিসপত্র নিয়ে।

শুভ্রতা নেত্রপল্লব মেলে ধরলো। পিটপিট করে নজর বুলিয়ে চাইলো ওয়ার্ডের প্রতিটি সিটের উপরে। দীর্ঘসময় চোখ বুঁজে ছিলো, তাই হালকা আলোটুকুও সয়ে নিতে একটুখানি সময় লাগলো। ঘাড় কাত করে উপমার দিকে চাইলো। উপমা সিটের মধ্যে শুভ্রতার মাথার কাছে এসে বসলো। নিজের পাঁচ আঙ্গুল শুভ্রতার চুলের ভিতর গলিয়ে দিলো। যত্ন করে বিলি কেটে দিচ্ছে। শুভ্রতা উপমার দুই উরুর উপরে নিজের একহাত এলিয়ে দিলো।

দূর্বল স্বরে টেনে টেনে বলল,

” যদি কোনো ব্যক্তি শারিরীকভাবে সুস্থ থাকে,তাহলে স্রস্টার নিকট তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।”

এই মুহূর্তে আমার ঠিক একথাটাই মনে হচ্ছেরে।

উপমা বিস্মিত চোখে চাইলো শুভ্রতার দিকে। আকূল কন্ঠে বলল,

” তুমি মাঝে মাঝে জ্ঞানীজনের মতো এত শক্তিশালী কথা বলতে পারো ভাবি। তোমার সাবজেক্ট ফিলোসোফি বলেই পারো। ”

” ঠিক ধরেছিস পাখি। এটা নিয়ে তোর ভাই কত যে ক্ষেপাতো। বলতো, যারা দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়ে। এদের সাথে চলা একটু মুশকিল। আমি যে কি নগন্য! অপয়া! তার ভালোবাসার স্বর্গীয় উপহারটাও যে রাখতে পারলানা আর।

শুভ্রতার দুচোখ জলে টইটুম্বুর হয়ে গেলো বর্ষার ভরা বিলের মতন। তার দুগালের উপর দিয়ে কলকল করে অশ্রুধারা বয়ে গেলে নদীর স্রোতধারার ন্যায়।

ভাবি কেঁদনা। তাহলে আমিও কেঁদে ফেলব বলছি। কাল সকালে ভাইয়া আসবে তোমাকে রিলিজ নিতে৷ কথাগুলো বলেই প্রসঙ্গক্রমে উপমা বলল,
আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে সেরা হলো বড় ভাইয়া। তবে কি, অভিমান, রাগটা ভাইয়ার একটু বেশি। তখন মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে ফেলে। এটা করবে। ওটা করবে। দেখিয়ে দিবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুইনা। পুরাই শুভংকরের ফাঁকির মতো। ওই বলা অবধিই। বুঝলে ভাবি। ভাইয়ার মুখেই যত বিষ। অন্তরখানি মধুতে মাখামাখি।

শুভ্রতা তব্দা খেয়ে গেলো শুনে। মনে মনে,
কি বলে এসব উপমা। নাকি বোন হয়ে ভাইয়ের সাফাই গাইছে আমার কাছে। অবশ্য সচক্ষে আমিও আয়মানের নেগেটিভ কিছু প্রত্যক্ষ করিনি কখনো।

“আমাকে পুকুর ঘাট থেকে কে তুলেছেরে ? ”

” কে আবার?তোমার হবু বর।মিস্টার আয়মান।”

শুভ্রতা সংকোচবোধ করলো। ঠোঁট মিলিয়ে চুপ রইলো।

পরেরদিন আয়মান হাসপাতালে গেলো। তখন উপমা ওয়াশরুমে ছিলো। আয়মান শুভ্রতাকে আস্তে করে বলল,

” আমি কখনো তোমাকে জোর করিনি শুভ্রতা। কেবল অর্জন করতে চেয়েছি। আজও তাই চাই। তুমি যা চাও তাই হবে। ”

শুভ্রতা নিরুত্তর রইলো অন্যদিকে চেয়ে। তাকে রিলিজ নিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো। সিএনজিতে মাঝখানে উপমা বসেছে। তার দুপাশে আয়মান ও শুভ্রতা ছিলো। সারাপথ শুভ্রতার মাথা উপমার কাঁধে হেলান দেয়া ছিলো। সেদিন বিকেলে শুভ্রতার মা, বাবা ও বড়বোন এলো তাকে দেখতে। তারা রাতে থেকে গেলো আমিনা বেগমের জোর অনুরোধে। এবং শুভ্রতার বাবা বলল,

” আপা পঁয়তাল্লিশ দিন শেষ হলেতো এমনিতেই নিয়ম বাবার বাড়ি ঘুরে আসতে হয় মেয়েদের। এখন বলি কি,যেহেতু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তো আমরা একবারেই শুভ্রতাকে নিয়ে যেতে চাই। ও সুস্থ হোক। বাকি আলাপ আমরা পরে করবো। আপনারাও আসেন। গা জুড়িয়ে আসবেন।”

” ঠিক আছে ভাইজান। আমি আপত্তি করছিনা। নিয়ে যান। আমরা এখন যাবনা। পরে সবাই আসব। ইনশাআল্লাহ। ”

পরেরদিন উপমা শুভ্রতার সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিলো মনমরা হয়ে। আয়মান শুভ্রতার সব মেডিসিন এনে দিলো। এবং উপমার কাছে শুভ্রতার জন্য কিছু টাকা দিলো। শুভ্রতা তা ফিরিয়ে দিলো। আয়মান উপমার হাত থেকে টাকাগুলো নিতে নিতে মনে মনে শপথ করলো,

“শুভ্রতা এ জীবনটা দিয়ে হলেও প্রমাণ করবো তোমার স্বামীর মৃত্যুর পিছনে আমার কোনো হাত নেই। ওই খোদা সাক্ষী। ”

শুভ্রতাকে নিয়ে তার পরিবার চলে গেলো। আয়মানের মৌনাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। নিরবে কাঁদতে লাগলো। ভাবনার অথই সমুদ্রে নিমজ্জিত ডুবুরির মতো ডুবে গেলো।

আমি কি সত্যিই শুভ্রতাকে পাবনা? খোদার এই পৃথিবীতে কি পবিত্র ভালোবাসার,অনুভূতির,চাওয়ার কোনো মূল্য নেই? খোদা এত নিষ্ঠুর কেনো!

সেদিন বিকেলে আয়মান তাদের স্থানীয় বড় বাজারে গেলো চা খেতে। বাজারের ধানের মিলের পিছনে গেলো সে এক নাম্বার সারতে। এপাশটা নিরব থাকে প্রায়। হঠাৎ পাশের ক্লাবঘর থেকে তার কানে ভেসে এলো দু চারটি বাক্য।

” শালা কতদিন ডাইল খাওয়া ছাড়ছি। ওই এক হালায় মইরা আমাদের ডাইল খাওয়া বন্ধ হইছে। ”

আরেকজন বলছে,
” তার জন্য মাঝে মাঝে আমাদের অপরাধী মনে হয়রে।”

চলবে..৩