শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০৬

0
223

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৬)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” আচ্ছা শুভ্রতা। আমার ভাইটা যে নেশায় জড়িয়ে গিয়েছে। সেটাতো আমরা কেউই জানিনা। কিন্তু তুমিতো জানতে। তার আগেরদিন রাতে তোমাদের মাঝে কি এমন হয়েছে? যার জন্য আমার ভাইটা অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো? পারবে সৎ সাহস নিয়ে আমার মতো সবার সামনে বলতে? ”

শুভ্রতা ভীরুচোখে আয়মানের দিকে ও সবার দিকে তাকালো অপরাধীর মতো। শান্ত দিঘির জলের মতো স্থির রইলো সে ।

” চুপ করে থাকা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারেনা।”
আমার প্রশ্নের জবাব দাও বলছি।

” হ্যাঁ বৌমা আয়মানের কথার জবাব দাও বলছি।”
কড়া আদেশ দিয়ে বলল আয়মানের বাবা।

” বাবা, আপনার ছেলে প্রায় ওসব খেয়ে বাড়ি আসতো। আমি অনেক ফেরাবার চেষ্টা করেছি উনাকে। কিন্তু উনি শুনেনি। বরং তেড়ে এসেছে গায়ের দিকে। কারণ উনি চাইতো আমিও খাই। কিন্তু আমি শুনতাম না উনার কথা। আমাকে অনেক আগেই একরাতে ধমকে বলেছে ,
“এই বিষয়টা আমার পরিবারের কেউই জানেনা তুমি ছাড়া। খবরদার বলছি তারা যেনো কিছুতেই না জানে। বলনা কিন্তু। ”

তাই আমি আপনাদের জানাইয়নি উনার ভয়ে। তবে এর বাইরে আমি আর কিছুই জানিনা। উনি মারা যাওয়ার আগের রাতে ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে আমার সাথে অনেক তর্ক হয়। এক পর্যায়ে আমি নিজের জেদকে দমাতে পারিনি। বলছি,
” আপনি মানুষ হিসেবে তততা ভালো নয়৷ যতটা ভালো সে।”

উনি নাক সিঁটকে বলল,

” এই সে টা কে শুনি? ”
বললাম,
” যে আমাকে ভালোবাসতো। আগলে রাখতে চাইতো। উনাকে বিয়ে করলেই ভালো থাকতাম বেশি।”

” ওহ এই কাহিনি তাহলে!”
বলে আরো তর্ক হয় আমাদের মাঝে। উনি তার নাম ও পরিচয় জানতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু আমি বলিনি। তখন উনি খুউব বাজে ভাষা ইউজ করেছে আমার সাথে। আমার গায়েও হাত তুলেছে তখন। এবং সন্দেহ করেছে যে আমার এখনো রিলেশন আছে তার সাথে। এইই। আমি আর কিছুই জানিনা বাবা।

” ভাবি সে কি বড় ভাইয়া? তুমি যার কথা মিন করছো ছোট ভাইয়াকে?”

শুভ্রতা নিরুত্তর। আয়মানের বুকের ভিতরের দুঃখের পাখিরা সুখে উড়াউড়ি করছে। শিহরিত মনে আপ্লুত হয়ে বলল,

” আমার ভালো থাকার ঔষধ তুমি। তোমাকে সেবন করতে চাই প্রতি দমে দমে।”

আয়মান উপমার দিকে চেয়ে বলল,

এই থাম। এবার আসি, শুভ্রতা যে আমাকে দায়ী করলো তার ক্লেরিফিকেশন করা। আয়মান তার মোবাইলটা বের করে সবাইর দিকে চেয়ে বলল,

এই রেকর্ডগুলো সবাই মন দিয়ে শুনেন। মা, বাবা শুনেন।

রেকর্ড সব শুনে সবাই তাজ্জব হয়ে গেলো। আয়মান বলল,

” সারবিষয় হলো। শুভ্রতার সাথে ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার পর আরহামের মন ভেঙ্গে যায়। সে হতাশ হয়ে পড়ে। সে মারা যাওয়ার দিন রাতে অনেক এলকোহল সেবন করে। রাতে জড়ানো পায়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়। গ্রামের গভীর রাত হওয়ার দরুণ সেই ট্রাকের ড্রাইভারকে ধরা যায়নি। আর এই গ্রুপের সাথে আরহামের সখ্যতা বহুদিন ধরেই। আমি এই কয়মাস এদের খুঁজে বের করেছি , সব জেনেছি বিস্তারিতভাবে,চেনা দুজনকে সঙ্গে নিয়েই। তাদের পুলিশ এরেস্ট করেছে। ওরা জেলখানায় আছে।

আমি বিষয়টা এতদিন লুকিয়ে রেখেছি মা,উপমার চেঁচামেচিতে জানাজানি হয়ে যেতো চারদিকে। এতে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতো। ধরা সম্ভব হতনা। নিষিদ্ধ জিনিস সেবন করানোর জন্য তারাও পরোক্ষভাবে দোষী। কারণ তারা যদি এই আসর প্রায় না জমাতো। তাহলে হয়তো আরহাম নে’শায় নিজেকে জড়ানোর সুযোগ পেতনা। আর শুভ্রতাও একেবারে দায়মুক্ত নয়। রাগের বশে সেদিন ওসব না বললে হয়তো সে বিধবা হতনা। এবার আসি আমি সেই রাতে বাইরে ছিলাম। হ্যাঁ সত্যি এটা। কিন্তু মা জানে আমি কোথায় ছিলাম। আমি ছোট খালার এক বিপদে তার বাড়িতে ছিলাম। ফোন পেয়ে খালাসহ ছুটে আসলাম।

আশাকরি কারো আর কোনো অভিযোগ থাকবেনা কারো।

আমিনা বেগম ধার কন্ঠে বললেন,

” ছেলে আমাদের। আমাদের যদি কোনো অভিযোগ না থাকে আয়মানের উপর। অন্যদের অভিযোগে আমাদের কিচ্ছু যায় আসেনা।”

শুভ্রতার মা মেয়ের দিকে গরম চোখে চাইলেন। রুক্ষ মেজাজে বললেন,

” উপযুক্ত প্রমাণ না পেয়ে ধারণা করে কাউকে ভুল বোঝা উচিত নহে। ”

একদম তাই। আম্মা ঠিকই বলছেন। বলল শিউলির স্বামী জুনায়েদ।

” তুই আয়মান বাবাজির পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নে বলছি।”

” মা…”

” আন্টি থাক। লাগবেনা।” সৌহার্দপূর্ণ স্বরে বলল আয়মান।

“বৌমা তুমি কি এবার আয়মানকে বিয়ে করতে রাজী আছো?”

শাশুড়ীর কথায় শুভ্রতা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। পা ঘুরিয়ে চলে গেলো রুমের বাইরে।

” আয়মান তুই কি রাজী এখন?”

তাহলে কাজী ডেকে এনে বিয়েটা এখুনি হয়ে যাক।

” জোর করে সব হয়। সংসার হয়না বাবা। একসাথে চলাও যায়না। ”

শুভ্রতার মা বলল,

” কিসের জোর। হয়তো লজ্জায় বলেনি। তুমি এখন আর ভাব নিওনা বাবা।”

” আন্টি আমি কোনো ভাব নিইনি। কেবল আপনার মেয়ের স্বভাবটা তুলে ধরলাম।”

“বাবা ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিও। ”

” আপনার কথার ফুলচন্দন ফুটুক
আন্টি।”

সবাই মিলে দৌড়ঝাঁপ করে বিয়ের আয়োজন করলো। আয়মান ছোটবোনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো মা বাবার আদেশে। বাসর সাজানোর জন্য চাচাতো ভাবিদের দায়িত্ব দিলো। বিয়ের জন্য প্রাথমিক কিছু কেনাকাটা করে আনলো। গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এলো।
শিউলি শুভ্রতাকে আড়ালে জিজ্ঞেস করলো,

” কিরে তুই রাজী বিয়েতে? আম্মা, আব্বা, তারাতো সব প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

” সে রাজী নাকি আপা?”

” আবার জিগায়। পারেতো তোরে কোলে নিয়া নাচে। এরেই কয় পিউর লাভ। নাই কোনো লস। হিহিহিঃ।”

” আপা হেসোনা। আমার খুউব খারাপ লাগছে। লাভ না লস সেটা আমি এখন জানি।”

” ফালতু কোথাকার। এত নেগেটিভিটি নিয়া থাকিস কিভাবে তুই? গেলাম। ”

ভুল বোঝাবুঝি, রাগ,অনুযোগ, পাল্টা প্রশ্ন, ক্ষোভ, সংকোচ,বিরক্তি, সবমিলিয়ে মিশ্র অনুভূতির দোলাচলে দোদুল্যমান শুভ্রতার অন্তরখানি। আনন্দমুখর স্বল্প পরিবেশে ঘরোয়া আয়োজনে আয়মান ও শুভ্রতার বিয়ে সম্পন্ন হলো পল্লীর রাতের আঁধার ও নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে। শুভ্রতাকে বধু করে বর আয়মান ও তার পরিবার বাড়ি চলে এলো।

রজনী গাঢ় হচ্ছে। পুষ্পসজ্জিত বিছানায় শুভ্রতা বসে আছে বধূবেশে। মেরুন রঙের কারুকাজ খচিত ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা। আয়মান রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেলে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হয়। এই ঘোর নিশিতে মধুর ক্ষণে তার কাছে মনে হচ্ছে পুরো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি এখন সে। জীবন বড়ই সুন্দর। বলে আয়মান মনে মনে স্রস্টার নিকট অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো।

এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার পাশ ঘেঁষে বসলো। শুভ্রতার হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে সে এই মুহুর্তেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবে৷ শুভ্রতার হাতের পিঠে যত্ন করে উষ্ণ চুমু খেলো আয়মান। এবং ঠোঁটজোড়াকে আলতো করে ডানে বামে বোলাতে লাগলো।

শুভ্রতা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। আয়মানের পোড়া হৃদয়ের চারণভূমিটা বেদনার ঝড়ে ডুবে গেলো।

আয়মান নিবেদিত কন্ঠে আকূল হয়ে বলল,
” আশাকরি আমার প্রাপ্য ভালোবাসা পেতে আর কোনো বাধা রইলোনা শুভ্রতা। এটলাস্ট আমি নিজেকে নিদোর্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হলাম। তবুও যদি তুমি বলো আমি দোষী।
মাথা পেতে নিব তোমার হাতে মরণও ফাঁসী।”

শুভ্রতা অভিমানী স্বরে বলল,
” আমি জানি আপনি এখন কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে।”

” কেনো বলো?” কৌতুহলী চোখে জানতে চাইলো আয়মান।

” প্রতিশোধ নিতে। কারণ আমি আপনার সাথে যেই মিস বিহেভিয়ার করছি, এতে আর ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকার কথা নয় আমার জন্য।”

” তো বিয়ে বসলে কেনো?”

” দুই পরিবারের কথা ভেবে।”

” ওকে মানলাম শুভ্রতা। আচ্ছা এটা বলতো অনুমান করে। আমাদের দুজনের মধ্যে কে আগে মারা যেতে পারে? ”

ধীর মোলায়েম কন্ঠে বলল আয়মান।

চলবে…৬