শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০৭

0
210

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৭)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
ওকে মানলাম শুভ্রতা। আচ্ছা এটা বলতো অনুমান করে। আমাদের দুজনের মধ্যে কে আগে মারা যেতে পারে? ”
ধীর মোলায়েম কন্ঠে বলল আয়মান।

দরজায় টোকা পড়লো আস্তে করে। আয়মান উঠে গিয়ে দরজা খুলল।

” কিরে উপমা? কি হয়েছে?”

” ধরো। এই কাঁথাটা রাখো। এটা ভাবির জন্য মা দিয়েছে। এতদিন তো তুমি সিংগেল কাঁথা গায়ে দিতে। আজ থেকে ডাবল কাঁথা গায়ে দিবে। আর এই ওয়াটার পট তোমার। ভরে দিলাম।”

” আচ্ছা থ্যাঙ্কিউ। যা এবার।”

উপমা শুভ্রতার দিকে চেয়ে মিটমিটিয়ে হেসে ফেলল। বোবা ভাষায় গাইলো, আজ মধুরাত তোমার ফুলওসজ্জা গানটির চরণখানি।

আয়মানের পিসিতেও তার প্রিয় গান বেজে চলছে। আজকাল বেশি এই গানটিই শোনে বেশি সে।

” আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা,
তোমার প্রেমের আবেশে আজ হৃদয় দিশেহারা।
এই জীবনে কখন কবে তুমি দেবে সাড়া।
……………….
ওগো তোমার ছবি আমার মনে যেদিন হলো আঁকা।
সেদিন থেকে আমার আমি নেই যেন আর একা।
জানি চলার পথেই আমার সাথে তোমার হবে দেখা।
দুটি মনের মিলন যদি হয় কপালের লেখা।
তা না হলে ব্যার্থ জীবন তোমাকে ছাড়া।
……………….
তোমার প্রেমের আবেশে আজ হৃদয় দিশেহারা। ”

শুভ্রতা শুকনো মাটিতে হোঁচট খেলো যেনো। অনুভব করতে লাগলো,
বাসররাতে আয়মান এত অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রত্যাশিত কথাটা কেনো বলল। ঠিক বোধগম্য হলোনা। তবে কি আমার উপর ঘোর নিকষ কালো অভিমান থেকেই? উনিতো এত কাটকাট করে নিরস কন্ঠে কখনো কথা বলেনা আমার সাথে। শুভ্রতার বিশেষ হেলদোল না দেখে আয়মান ফের বলল,

” জানি কি ভাবছো। আমাদের দুজনের মধ্যে কার ইহলীলা সাঙ্গ হবে আগে? এভাবে বলিনি কেনো এইতো?”

শুভ্রতা ঘোমটার ভিতর থেকে খানিক মুখ তুলে চাইলো আয়মানের দিকে। আয়মান শুভ্রতার দু’গাল দু’ হাত দিয়ে অসীম আদুরে ছোঁয়ায় চেপে ধরলো। শুভ্রতার আঁখিদুটির মাঝে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। চাপা স্বরে ব্যাকুল হয়ে বলল,

” দিঘির টলটলে জলের মতো তোমার ওই দুটি আঁখি।
নিবেদন করি ভুলেও কভু দিওনা মোরে ফাঁকি।
হারাতে চাই তোমার ওই চোখের অনন্ত মায়ায়।
থাকতে চাই সারাটিক্ষন তোমার অঙ্গ ছায়ায়।
তুমি আমার একলা আকাশ ! শূন্য বিরানভূমি! বুকজুড়ে দীর্ঘশ্বাস!

এই রজনী হোক উতলা মেটাও প্রণয়ের সাধ।”

শুভ্রতা এই প্রথম কোনো পুরুষের কাব্যিক শব্দমালায় কেঁপে উঠলো। দুলে উঠলো তার সমস্ত অনুভূতির পসরা। যে মানুষটা তাকে বসন্তের পর বসন্ত শুধু একপাক্ষিকভাবে ভালোইবেসে গেলো। বিনিময়ে কিছুই পেলনা তার থেকে। বরং দিনের পর দিন তার উপেক্ষা,অনাদর,রুক্ষতায় যে পুরুষটা রিক্ত নিঃস্ব আজ। ঠিক তার কথা, তার সান্নিধ্য আচমকা এমন লাগছে কেনো আজ। এত শিরশির রোমাঞ্চিত অনুভব হচ্ছে কেনো তার হৃদয়পাড়ে। এত আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে কেনো সে। নাহ কোমল রূপ প্রকাশ করা যাবেনা তার সামনে। ভয়াবহ রকমের সংকোচ, হীনমন্যতা, লাজুকতা শুভ্রতাকে গ্রাস করে ফেললো চন্দ্রগ্রহণের ন্যায়। কিছুটা ভয়ও আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরেছে তাকে অক্টোপাসের মতো। আয়মানের হাতবন্দী হয়ে থাকা তুলতুলে মুখখানি সরিয়ে নিলো শুভ্রতা।

আয়মানের দুঃখের সীমা রইলোনা আর। অসীমে পৌঁছে গেলো ক্ষণিকেই। বুকের ভিতর একশো চুল্লী দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো। যেনো শুভ্রতা খুব যত্ন করে আয়মানের হৃৎপিণ্ডটা থেঁতলে দিয়েছে বিষাক্ত সোনালী ছুরির ফলা দিয়ে। আয়মান শুভ্রতাকে আর স্পর্শ করার চেষ্টা করলনা। শুভ্রতার দিকে চেয়ে ভারকন্ঠে বললো,

” তুমি আমার শ্রেষ্ঠ অনুভূতি! শত বিষাদেও পাই তোমায় ভেবে সুখ! ”

সংরক্ষিত থাকো তুমি। আর তোমার হৃদয়ের অন্তপুরে আশ্রয় চাইবোনা। চাইবোনা কোনোদিন তোমার শহরে ভিজতে। আয়মান উঠে চলে গেলো বারান্দায়। বেতের মোড়াটা টেনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো। সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো দিয়াশলাই দিয়ে। দুই ঠোঁটের মাঝে পুরে দিলো। লম্বা করে সুখটান দিলো। বারান্দার গ্রীলের বড় ফাঁক দিয়ে নিকোটিনের উড়ে যাওয়া ধোঁয়াগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে খোলা হাওয়ায় মাঝে। যন্ত্রণাগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে চিত্তের চিলেকোঠার এককোণে।

বেশ সময় পার হয়ে গেলো। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আয়মানকে না দেখে শুভ্রতা বিছানা থেকে নেমে গেলো। বারান্দায় গেলো শুভ্রতা। আয়মান বাইরের দিকে চেয়ে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। আবছায়া আলোতে শুভ্রতা দেখতে পেলো নিচে পড়ে আছে অনেকগুলো আধপোড়া সিগারেটের বাকি অংশ। আঁৎকে উঠলো শুভ্রতা। আগমনী শীতের মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেলো। শিউরে গেলো এই ভেবে,

যতই হোক আয়মান এখন আমার স্বামী। সে আমার বর্তমান। সে আমার ভবিষ্যৎ। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলেতো রোগ বাসা বাঁধবে শরীরে। আয়মান শুভ্রতাকে দেখেনি। শুভ্রতা দরজায় দাঁড়িয়েছিলো।

” এতগুলো সিগারেট পোড়ানোর নামে নিজের হৃদয়টাকে পোড়ানোর খুউব কি দরকার ছিলো? ঘুমাবেন না? ভিতরে আসুন।”

নিশিরাতে প্রিয় মানুষের মধুর স্বর আয়মানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো বেহালার করুণ রাগিনীর মতো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে শুভ্রতার আপাদমস্তক দেখে নিলো অপলক চোখে। ক্ষণসময় চুপ রইলো। দেখলো শুভ্রতা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নয়নযুগল ঢুলু ঢুলু।

” তারমানে আক্ষেপ, অভিমান জমতে জমতে হৃদয় পোড়ার যে ব্যাপারটা ঘটে,তা তুমি অনুধাবন করতে পারো?”

” না পারার কি আছে এখানে। বুঝিতো।”

” তারমানে জেনেশুনে বুঝে ইচ্ছে করেই নিরব ঘাতকের মতো কারো হৃদয়টাকে মরণ কূপে ঠেলে দিচ্ছো? ওয়ান্ডারফুল শুভ্রতা! ওয়ান্ডারফুল! তোমার জবাব নেই।”

শুভ্রতা ঘায়েল হয়ে গেলো আয়মানের কথার তীব্রবাণে। পাল্টা যুক্তি খন্ডন না করে মৌন রইলো।

” ঠান্ডা লাগবে তোমার। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”

” আমার ঠান্ডা লাগবে। আপনার লাগবেনা? এতসময় ধরে খোলা বারান্দায় বসে আছেন কেনো?”

” আমি এখানেই সারারাত কাটিয়ে দিবো।”

” মশা কামড়াবে যে। অনুগ্রহ করে ভিতরে আসুন।”

” বেশ শুভ্রতা। আমি তোমার অনুগ্রহ রাখবো। তুমিও আমার একটা অনুগ্রহ রাখবে?”

” জ্বি রাখবো। আসুন।”

আয়মান উঠে গেলো বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়ে। বিছানায় গিয়ে বসতেই খুকখুক করে তার কাশি আরম্ভ হলো। শুভ্রতা পানি দিলো এক গ্লাস খেতে। পানি খেয়েও কাশি কমছেনা। কাশির মাত্রা বেড়েই চলছে। শুভ্রতা নারভাস হয়ে গেলো আয়মানের চোখমুখের অশোচনীয় অবস্থা দেখে। আয়মান ওয়াশরুমের বেসিনে গেলো। শুভ্রতাও পিছু পিছু গেলো। আয়মান বেসিনে ঝুঁকে কেশেই যাচ্ছে। তার মুখ থেকে কাশির সাথে কফ ও রক্ত গেলো বেশ কিছুটা। শুভ্রতা ঘাবড়ে গেলো। মনে মনে আল্লাহর করুণা প্রার্থনা করলো স্বামীর জন্য।

আয়মান অসুস্থ বোধ করছে। কাঁপছে। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে আয়মানকে ধরলো। নিয়ে এলো বিছানায়। বলল,

” আপনার পুরো শরীর বেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা বাতাসে কেনো বসেছিলেন বারান্দায়? কেনো অতগুলো সিগারেট খেয়েছেন? এমন কি আরো খেয়েছেন? রক্ত গেলো কেনো কাশির সাথে?”

আয়মান প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বলল,

” শুভ্রতা অনুগ্রহ করে বলবে? তুমি আমাকে কেনো ভালোবাসতে পারছনা? এবং কোনোদিন আদৌ ভালোবাসতে পারবে কি? কেনো হাত সরিয়ে নিলে? কেনো মুখ সরিয়ে নিলে?কেনো অধিকার থেকে বঞ্চিত করো?”

শুভ্রতা ভীরু অভিমানী চোখে আদ্র স্বরে বলব,

” বলব প্রমিজ। আপনি শান্ত হোন একটু। সবর করুন। আপনার এই করুণ পরিণতি কি করে হলো। কেমন করে? ”

” যদি বলি #শুভ্রতা_তোমার_জন্য। মানবে? আমাকে তোমার বুকে একটু ঠাঁই দিবে? কিংবা তোমার কোলে? ”

কাতর স্বরে অনুনয় করে বলল আয়মান।
” হুম দিবো। আচ্ছা মা বাবা সবাইকে ডাকবো?”

” একদম নাহ। তারা এসে কিছুই করতে পারবেনা।”

” তাহলে কে পারবে?”

” তুমিই। কেবল তুমিই পারবে আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালো রাখতে। ”

নিস্তব্দ নিশুতি রাত। রাতের নির্জনতার কলরব গা ছমছম করা। দূর হতে ভেসে আসছে দুঃখিনী কানাকূয়োর কলিজা ছেঁড়া ডাক। এ যেনো অতল স্বর্গের ডাক। আয়মান শুভ্রতার কোলে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে। শুভ্রতা আয়মানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই মধুর রাতকেও শুভ্রতার কাছে এতো ব্যথাতুর বিরহের রাত মনে হচ্ছে কেনো বারবার। কেনো না পেতেই হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে শুভ্রতা। তার চোখ গড়িয়ে শিশিরের মতন টপটপ করে কফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো আয়মানের মুখের উপরে।

চলবে…৭