শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০১

0
476

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ১)
#রেহানা_পুতুল
ক্রমশ ঃ ১

এক নিরালা দুপুরে আমিনা বেগম পুত্রবধূকে ডাক দিলেন। নিস্তেজ মায়াভরা কন্ঠে শুধালেন,

” বৌমা। তুমি কি তোমার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কিছু ভাবলে?”

শুভ্রতা বিমূঢ় হয়ে গেলো শাশুড়ীর মুখে অমন কথাটা শুনে। মনে মনে আওড়ালো,

” কি আশ্চর্য! শোকে তাপে একজন মা মুহ্যমান, কাতর হয়ে আছেন। অথচ বউ তাড়াবার হুঁশটা ঠিকই আছে। হাহ!”

” মা। আমি কি এখন আপনাদের পরিবারে বেশী বোঝা হয়ে গিয়েছি?”

আমিনা বেগম করুণ চওড়া হাসি হাসলেন। শুভ্রতার পিঠের উপর মায়ের পরশ বুলিয়ে কোমল কন্ঠে বললেন,

” বোকা মেয়ে। উল্টো না বুঝলে হতনা? বলছি তুমি কি আবার বিয়ে করতে চাও নাকি? এটা জানতে চাচ্ছি?

” মা আরহাম বিদায় নিলো পঁয়তাল্লিশ দিন ও পেরোয়নি। কিভাবে এসব ভাবি? আপনিই বলেন?”

কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল শুভ্রতা।

” মারে দুই বছর আগে আমার আরহামের জন্য আমরাই তোমাকে ঘরে তুলে আনলাম। আজ আমার আদরের ছেলেটাও নেই। তুমিও রঙিন শাড়ির বদলে সাদা শাড়ি পরে থাকো। মা হয়ে আমি যে আর সহ্য করতে পারছিনা। তাই তোমাকে আদেশ নয়। অনুরোধ করে বলছি, যদি বিয়েই করো তুমি। তবে অন্যকাউকে নয়। এই ঘরেই হোক তোমার আরেকটা নতুন জীবন। এবং তোমার মাঝে যে আরেকটা প্রাণের উপস্থিতি দেখা দিলো। সেটাও ভুলে যেওনা। এতে আমার ছেলেটার আত্মাও যে কিছুটা শান্তি পাবে।”

” মা কি বলছেন! এটা কিভাবে সম্ভব?”
বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে নমনীয় স্বরে বলল সদ্য বিধবা শুভ্রতা।

” বৌমা তোমার পরিবারের সবার সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে। উনাদের আপত্তি নেইতো। তবে তোমার আপত্তি কেনো?”

‘ মা উনি আমার…”

” থামো। ওকথা আর মুখে তুলনা বৌমা। আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখো। এতে তোমার ও তোমার পরিবারের জন্যও কল্যাণ হবে। ”

” মা এটা কি শুধু আপনার চাওয়া?”

” নাহ। তা হবে কেন? একার সিদ্ধান্তে কারো জীবনে কোন সুখকর পরিণতি বয়ে আসেনা। আমাদের পরিবারের এবং তোমাদের পরিবারের সবার খুশিমত রয়েছে এতে।”

” মা আমি যাই। খুউব খারাপ লাগছে।”

শুভ্রতা দুলে দুলে এলোমেলো পা ফেলে শাশুড়ীর সামনে থেকে চলে গেলো। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। উপুড় হয়ে বুক ভাঙ্গা বিলাপ করতে লাগলো চাপা আর্তনাদে।

আয়মান রুমের জানালার ফাঁক দিয়ে শুভ্রতাকে দেখলো এক পলক। কিন্তু মুখটুকু দেখতে পেলনা আজো। বিধবা শুভ্রতার শুভ্র মুখখানি দেখতে ভিতরটা কেমন যেনো পুড়ছে তার। আয়মান চলে গেলো। মায়ের কাছে গিয়ে,

” মা। শুভ্রতাকে কি বলছো? কেঁদেকেটে খু’ন হয়ে যাচ্ছে? ”

” বিয়ের কথা তুললাম। কিছুতেই রাজী নয়।”

” মা। আমি কি একবার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো?”

” উমমম! এত অস্থির হসনা। যাকনা দু চারদিন। দেখি কিভাবে কি হয়। তবে মনে হয়না রাজী হবে। ”

আয়মান একটু অবাক হলো। থতমত স্বরে বলল,

” আচ্ছা মা। তাহলে অপেক্ষা করি।”

সেদিন দুপুরে শুভ্রতা আর ভাত খেলনা। ক্ষুধা নিয়েই তার মাকে ফোন দিলো। শাশুড়ীর বলা কথাগুলো সব জানালো তার মা জহুরাকে। শুনে তার মা বলল,

” তোর শাশুড়ী এক চুলও মিথ্যা বলেনাই। যা বলেছে সত্যি। ”

” মা। আয়মান ভাই আমার ভাসুর। এটা হয়?”

” খুব হয়। তোর গর্ভে তাদের সন্তান। আইনমতে, ধর্মীয়মতে এতে কোন বাধা নেই। তবে ইদ্দতের চারমাস দশদিন শেষ হলে। এবং আরো কোনো নিয়ম আছে কিনা বড় আলেম থেকে জেনে নিতে হবে। যেহেতু তুই মা হতে যাচ্ছিস। আর আয়মান তোর ভাসুর সম্পর্কে। তা ঠিক। কিন্তু সে সিংগেল। অবিবাহিত। তুই হলি বিধবা। তো? অন্যখানে বিয়ে হলে তোর সন্তানকে তারা মেনে নিবে? আর তুই কিভাবে মা হয়ে সন্তান ছাড়া থাকবি? বল? এর চেয়ে আয়মানের সাথে বিয়ে হলে তুই ও স্বামীর ঘরেই রইলি। তোর সন্তানও পিতৃপরিচয় পেলো। পিতা মাতা ছাড়া অন্যের অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠবেনা সে? এমন হোক এটা তুই চাস? আর এজন্যই তোর স্বশুর চায় বিয়েটা দ্রুত হয়ে যাক। মাথায় ঢুকছে কিছু এবার? ”

” মা। কিভাবে ভাসুরকে স্বামী ভাববো? ইয়া আল্লাহ! রহম করো!”

” আমি জানি এটা কষ্টের। কিন্তু তোর সন্তানের ভালো একটা ভবিষ্যতের জন্য তুই মা হয়ে এই ত্যাগ দিতে পারবিনা মা? শুধু এই বিষয়টা একটিবার ভাব। দেখবি একটু শান্তি পাবি মা। ”

আকস্মিক স্বামী হারানোর ব্যথা বেদনা শুভ্রতাকে মাড়িয়ে দিয়েছে। আরহামের সান্নিধ্যে কাটানো সুখের মুহূর্তগুলো শোক স্মৃতি হয়ে বরষার জলের মতো হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে যায় যখন তখন। বিধ্বস্ত শুভ্রতার বেহাল দশা। মায়ের বলা কথাগুলো বারবার ভাবছে তার অনাগত সন্তান নিয়ে। দ্বিধাদ্বন্দে মানসিক সংকট তাকে কাবু করে ফেলছে। ননন উপমা এলো তার সামনে। ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায় শুভ্রতার মুখপানে নিরব চোখে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। ছোট্ট করে শান্ত কন্ঠে বলল,

” ভাবি নিজেকে একটু সামলে নিতে চেষ্টা করনা প্লিজ। আয়নায় মুখ দেখেছো একটিবার? দেখলে বুঝতে। আমরা কেউই তোমাকে হারাতে চাইনা আমাদের জীবন থেকে। বিশেষ করে অনাগত বাবুর কথা ভেবেই আব্বা, আম্মা তোমাকে রেখে দিতে চায়। ”

শুভ্রতা উপমার গলা পেঁচিয়ে ধরলো শক্ত করে। হুহু করে কান্না জুড়ে দিলো। উপমাও কান্না জুড়ে দিলো। তাদের কান্নার ভারী আওয়াজে আয়মানের মা ও বাবা লতিফ খান এগিয়ে এলো। লতিফ খান শুভ্রতার মাথায় হাত রাখতেই,
সে শশুরের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। দু পা পেঁচিয়ে বাবা বলে অঝোরে রোদন করতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বাষ্পরূদ্ধ কন্ঠে বলল,

” বাবা আমি আজো বিশ্বাস করতে পারিনা। আপনার ছেলে এই পৃথিবীতে নেই। আচ্ছা উনার কি কোনো শত্রু ছিলো বাবা? কেউ কি উনাকে মেরে ফেলল নাকি বাবা?”

শুভ্রতার কথা শুনে ওরা বিস্মিত হয়ে গেলো। আমিনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে শুভ্রতাকে টেনে দাঁড় করালেন।

ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরে বললেন,

” আমাদের কারোর সঙ্গেই কোনো শত্রুতা নেই মা। তুমি অস্বাভাবিক আছো, তাই আরহামের স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছনা। এভাবে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলে তুমি বাঁচবে?”

” আমি বাঁচতে চাইনা মা। বাঁচতে চাইনা।”

” নাহ। তোমাকে বাঁচতেই হবে তোমার সন্তানের জন্য। তুমি এ ঘরের বউ ছিলে। চিরটাকাল এই ঘরের বউ হয়েই বেঁচে রবে। আমরা সেই ব্যবস্থা করছি।”

তারা দুজন রুম থেকে চলে গেলো বেরিয়ে। উপমা শুভ্রতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

” প্লিজ ভাবি। সামনে যা ঘটবে। তা ইজিলি মানিয়ে নিও। মেনে নিও। এতে তোমার জন্যও ভীষণ ভালো হবে।”

উপমার মেলানো দুঠোঁট মেলানোই রইলো। কেবল উদাস চোখে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।

দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ দিন শেষ হয়ে গেলো। আয়মান সহ সবাই বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে আস্তে আস্তে। ইদ্দতের চারমাস দশদিনের অপেক্ষা এখন।

আয়মানকে তার বোন ডেকে বলল,

” ভাইয়া শোন, আব্বা আম্মা আমাকে বলছে যেনো তোমাকে বলি, এবার তুমি ভাবির সাথে কথা বলতে পারো। এটা দরকার। আগে থেকে একটু ইজি না করলে হুট করে বাসর ঘরে উটকো ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে তার দিক থেকে। ”

” রাইট বলছিস। আমি আজকেই কথা বলব শুভ্রতার সাথে। ”

মা বাবার অনুমতি পেয়ে আয়মান উল্লসিত হয়ে উঠলো। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে শুভ্রতার মুখোমুখি দাঁড়াবার।

পল্লীর গৌধূলি ঝরা কোলাহলমুখর বিকেল। শুভ্রতা তার রুমে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। বিপন্ন মুখ। দৃষ্টি আনমনা। খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলো। শরতের শুভ্র আকাশটা আজ বর্ণিল সাজে সেজেছে। যেনো মহা আয়োজনের ধুম লেগেছে তার বিশাল হৃদয়ে। আয়মান শুভ্রতার রুমের পর্দা ফাঁক করে গলা খাঁকারি দিলো।

” আসতে পারি শুভ্রতা?”

শুভ্রতা ঘাড় বাঁকিয়ে চকিতে চাইলো আয়মানের পদক্ষেপের দিকে মুখপানে না চেয়ে। আয়মান অনুমতির অপেক্ষা না করে রুমের ভিতরে চলে গেলো। শুভ্রতার আরক্ত দুটি নয়নপানে বিবশ হয়ে চেয়ে রইলো। মনে মনে বলল,

” তুমি বিলের জলে ফোটা সদ্য প্রষ্ফুটিত রক্তকমল। তুমি ভোরের বাতাসের মতই প্রশান্তিময়। আমার সকল মুগ্ধতা তোমায় ঘিরে।”

” শুভ্রতা মন খুব বেশী খারাপ নাহ?”

শুভ্রতা মৌন রইলো দৃষ্টি অন্যদিকে দিয়ে। প্রতিউত্তর দিলনা।

আয়মান কন্ঠে ভালোবাসার সুধা ঢেলে বলল,

” দুইদিন পরেই আমরা দু’জন দুজনের অভ্যাস হয়ে যাবো। তাই অনুরোধ করছি। একটু ইজি হও এবার। দোহাই শুভ্রতা।”

” আচ্ছা আয়মান ভাই, আরহামকে কেউ সরিয়ে দিলো নাকি আমার জীবন থেকে?”

ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে তীব্র অনুযোগ নিয়ে বলল শুভ্রতা।

চলবে।