শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০৯

0
204

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৯)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
শুভ্রতা কন্ঠে গভীরতা এনে মেঘমুখে ভাবুকের ন্যায় বলল,
” সত্যিই বলেছেন আয়মান। আমার শাস্তি পাওয়া উচিত আপনার অনুভূতির মূল্যায়ন না করে এতটা নরক যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। আমারই মরে যাওয়া উচিত আপনার আগে। আমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই।”

শুভ্রতা..! বলে আয়মান ধমকে উঠলো। শুভ্রতাকে বুকে লেপ্টে ধরলো নিবিড় আলিঙ্গনে। আয়মানের ঘন ভারী উষ্ণ নিঃস্বাস শুভ্রতার ঘাড়ে গলায় অনুভূত হতে লাগলো। আয়মান শুভ্রতার কপালে, গালে,চোখের পাতায় কোমল চুমু খেলো।গরম চোখে কড়া শাসনের সুরে বলল,
“এমন অলুক্ষণে কুফা লেবেলের কথা জীবনেও যেনো আর না শুনি। ”

শুভ্রতা তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ক্ষীণ স্বরে “আচ্ছা ” বলে কাত হয়ে হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে পড়লো।

” বিয়ের গহনা শাড়ি চেঞ্জ করবেনা? ”

” উমমম! আলসেমি লাগছে। পারবোনা। পরে। এখন ঘুমাবো।”

আহ্লাদী ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলল শুভ্রতা।

ক্ষণসময় পার হতেই শুভ্রতা তলিয়ে গেলো নিদ্রাঘোরে। আয়মান নেশালো রক্তিম চোখে চেয়ে আছে ঘুমন্ত শুভ্রতার দিকে। তার মনে হচ্ছে কোন রূপকথার গল্পের অচিনপুরের রাজকুমারী ভুল করে তার বিছানায় চলে এসেছে। আয়মান অপলক নয়নে শুভ্রতাকে মন ভরে দেখলো দৃষ্টির সমস্ত গভীরতা দিয়ে।আস্তে করে শুভ্রতার খোঁপার বাঁধন খুলে চুলগুলো আলগা করে ছড়িয়ে দিলো পিঠের উপরে। গলা,কান,হাত থেকে গহনাগুলো গুলো খুলে নিলো অতি যতনে। সন্তপর্ণে। শাড়ি কিভাবে চেঞ্জ করবো। এটা থাক ভেবেই আয়মানও শুয়ে পড়লো।

নীল ডিম লাইটের আবছা আলোয় শুভ্রতার কেশতলে মুখ ডুবিয়ে দিলো আয়মান। তার আঁধার কালো চুলের উম্মাতাল করা খুশবু নিতে নিতে নিজেও ঢলে পড়লো নিদ্রাদেবীর কোলে। ঘুমের মাঝেও বিভোর হলো এক অপার্থিব কাল্পনিক সুখসৌরভে।

শুভ্রতার ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠে গেলো প্রভাতকালেই। ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি ব্লাউজ চেঞ্জ করে নতুন আরেকটা সুতী শাড়ি পরে নিলো। ফ্রেস হয়ে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হলো। বুঝে নিলো গহনা, খোঁপা আয়মান খুলে দিলো আরাম করে ঘুমানোর জন্যই। ঘর থেকে বের হয়ে উঠানের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। আগমনী শীতের মৃদু হিমেল বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে শুভ্রতার নিটোল অঙ্গখানি।

শীতের কুয়াশাভেজা ভোর। শিশিরভেজা ঘাস, ফুল,লতাপাতা। গগন বক্ষে উঁকি দিলো সোনালী সূর্যিটা। বুভুক্ষের ন্যায় কা কা রবে ডেকে যাচ্ছে জীবনানন্দ বাবুর ভোরের কালো কাকটা। আতা গাছের ডালে ডালে চিউচিউ রবে কলরব তুললো এক ঝাঁক দুষ্ট চড়ুই। বাহারী রঙের কবুতরগুলো বাক বাকুম কুম ডাকে সারা আঙিনা মাতিয়ে তুলছে।

সে আপন মনে চিন্তা করতে লাগলো,
এসবই তার অতি চেনা পরিবেশ। এই ঘর,বাড়ি,আসবাবপত্র, মানুষ, পুকুর,বাগান,ক্ষেত,সারিসারি গাছগাছালী। তবুও তার কাছে সব নতুন লাগছে। রোমাঞ্চকর লাগছে। অদ্ভুত লাগছে। এক আশ্চর্য মিশ্র অনুভূতির শিহরণ তার হৃৎপিণ্ডের মাঝ বরাবর দিয়ে বয়ে গেলো সর্পিল গতিতে। জীবনের এত বাঁক কেনো? বাঁকগুলো কণ্টকাকীর্ণ কেনো? কখনো বা এত মসৃণ কেনো? শুভ্রতার ভাবনার সূতো কেটে গেলো শাশুড়ীর দরদ গলার স্বরে।

“বৌমা এত জলদি উঠে গেলে কেনো?”

” ঘুম ফুরিয়ে গেলো মা।”

” ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? অমন করে কি দেখছ? মনে হয় আজই নতুন এলে এ বাড়িতে বউ হয়ে?”

শাশুড়ীর কথায় হুঁশ ফিরলো শুভ্রতার। নিজেকে দেখেই মিটমিটিয়ে হেসে ফেলল গাল টিপে টিপে।

” না মা। কিছুনা। এমনি। সকালে নাস্তা কি বানাবো?”

” আজব মেয়েতো তুমি। তোমার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু আয়মানেরতো নতুন বিয়ে। তো তাকে নতুন বউ সময় দিবেনা?একদিন আমিওতো নতুন বউ এসেছি তার বাবার কাছে। পুরুষদের এই অনুভূতিগুলো আমিও বুঝতে পারি। কোনো কাজ করতে হবেনা। তোমার রুমে যাও বলছি।”

” মা উনিতো ঘুমায়। আমি গিয়ে কি করবো?”

” তুমি চাল ডাল মিশিয়ে নিয়ে যাও। রুমের ভিতরে বসে বসে বেছে ফেলবে।”

বলে আমিনা বেগম ও শুভ্রতা একসঙ্গে হেসে ফেললো। আমিনা বেগমের কাছে গিয়ে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো শুভ্রতা।

আমিনা বেগম চঞ্চল কন্ঠে শুভ্রতাকে বলল,
” আমার এক পুত্র নাই। বাকি আছে একটা। আয়মান তোমাকে কতটা ভালোবাসে,চায় তা তুমি যেমন বুঝো।।আমিও বুঝি। কথা হলো ভালোবাসার অমর্যাদা করোনা ভুলেও কোনদিন। পায়ে ঠেলে দিওনা। ও এখন তোমার স্বামী। স্বামীর সমস্ত হক আদায় করা স্ত্রীর কতর্ব্য ও উচিত। পৃথিবীর কোনো মা তার সন্তানকে অসুখী দেখতে চায়না নিজে অসুখী হলেও। ”

শুভ্রতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আমিনা বেগমের কথায়। আড়ষ্ট হয়ে নিচু গলায় বলল,

” মা বুঝতে পারলাম না ঠিক। বিয়ে হলো চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয়নি। আমি এমন কি আচরণ করেছি উনার সাথে?”

” সব খুলে বলা যায়না। তুমি নিজেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর বের করো। আমি রসুই ঘরে গেলাম। পিঠা বানাবো। উপলা উঠলো কিনা গিয়ে দেখো।”

শুভ্রতা উপলার রুমে গেলো।

” হাই গুড মর্নিং সুইট ভাবি।”

” মর্নিং হানি।”

মা বলল তোমাকে ডেকে দিতে। এবং শুভ্রতা আমিনা বেগমের বলা কথাগুলো উপলার সাথে শেয়ার করলো। উপমা পিটপিট নজরে শুভ্রতাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো।

ইয়েস। ইউরেকা।

” কিইই।”

” তোমার উসকোখুসকো শুকনো চুলে জানান দিচ্ছে তোমাদের বাসর হয়নি
এম আই রাইট?”

“হুম।”

” এজন্যই আমার মা জননী ওকথাগুলো তোমায় পরোক্ষভাবে বলেছে ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণে। তার যেই ছেলেটা শুভ্রতা নামের বালিকাটির জন্য জন্য তামাম বিশ্ব কাঁপিয়ে দিতে পারে। তাদের বাসর হয়নি বিয়ের রাতে। এটা অকল্পনীয়! অবিশ্বাস্য!”

শুভ্রতা লজ্জায় মিইয়ে গেলো লাজুকলতার মতো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। উপলা শুভ্রতার দুহাত আলগা করে কুটকুট করে হেসে ফেলল। বলল,

” রমণী আমাকে নয়। আমি তোমার জামাই নাকি। তোমার প্রাণাধিকের সম্মুখপানে গিয়ে এমন লজ্জাবনত বদনখানি উম্মুক্ত করো। যাও এক্ষুনি বলছি। ”

পরে যাবো, বলে শুভ্রতা রান্নাঘরে চলে গেলো। আমিনা বেগমের সাথে সাথে নিজেও একাজ ওকাজ করতে লাগলো। আয়মান ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিলো। সবাই রান্নাঘরের পাতানো কাঠের বড় চৌকিতে একসঙ্গে বসে নাস্তা করলো শখ করেই। আয়মান লুকানো চোখে শুভ্রতাকে দেখছে। শুভ্রতা অন্যদিকে মুখ করে আছে জলচৌকিতে বসে। আয়মান তার বাবাকে বলল,

” বাবা শুভ্রতাকে নিয়ে একটু কক্সবাজার ঘুরতে যেতে যাচ্ছি। কি বল?”

” কি বলব। অবশ্যই যাবি। পরিবেশ বদল হলে তোদের দুজনেরই ভালো লাগবে। কবে যেতে চাচ্ছিস?”

” পরশু যেতে চাচ্ছি বাবা। অনলাইনে হোটেল বুক দিয়ে রাখবো আজই।”

” তাই কর। ঘুরে আসলে মন মেজাজ ফুরফুরে হবে। চাঙ্গা হবে। ”
বলল আমিনা বেগম।

” উপলা তুই যাবিনা?”

” মাফ ও চাই। দোয়াও চাই। কাবাব মে হাড্ডি হতে চাইনা ব্রো।”

যেহেতু ঘরোয়া বিয়ে হয়েছে। তাই নিকটজন ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন নেই আয়মানদের ঘরে। শুভ্রতা সারাদিন রুমে যায়নি। সবাইর সাথে গল্পগুজবে সময় পার করেছে। থেমে থেমে প্রথম বিয়ের পুরনো স্মৃতিগুলো পুঞ্জীভূত বেদনা হয়ে তার অন্তরটাকে চুরমার করে দিচ্ছে। আয়মান অনেক ছোঁকছোঁক করলো বিড়ালের মতো শুভ্রতাকে দিনের আলোতেও একটু কাছে পাওয়ার। তার মনটা খুউব আকুলিবিকুলি করলো শুভ্রতার একটু হাতখানি ধরার। কিন্তু অচেনা আগুন্তকের মতন শুভ্রতাকে কেবল দেখেই যেতে হলো। যেনো দূরবনের কোনো মায়া হরিনী এই শুভ্রতা।

সন্ধ্যায় আয়মান ঘরের বাইরে গেলো। তখন শুভ্রতা রুমে গেলো দরকার হলো বলে। বেড সাইড টেবিলের উপরে থাকা আয়মানের মুঠোফোনে মেসেজের শব্দ হলো। শুভ্রতা হাতে নিলো হেয়ালীকরেই। দেখলো হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এলো।

” কিরে বেঈমানের বাচ্চা বেঈমান। তুই না বললি জীবনে বিয়ে করবিনা আর। চিরকুমার থাকবি। বিয়ে করলে আমাকেই করবি। কালপিট, সেলফিশ কোথাকার। সুদে আসলে নগদে সব উসুল করবো। মাইন্ড ইট!”

শুভ্রতা বেকুবের মতো বোকা বোকা চাহনিতে মেসেজটি বার দুয়েক পড়লো। তার মনে হলো সাঁই সাঁই করে একটা রকেট তার মাথায় উপর দিয়ে চলে গেলো বাজখাঁই শব্দ করে।

আয়মান আসার আগেই মুঠোফোনটি পূর্বের স্থানে রেখে শুভ্রতা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো উপলার রুমে।

চলবে…৯