শেষটা সুন্দর পর্ব-০৭

0
605

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৭

‘ফোনের সাথে বিয়ে? নির্ঝর ভাই, আপনি অসুস্থ। আপনার মাথা অসুস্থ। এই অবস্থায় মজা করছেন?’

তরীর বিস্মিত মুখের কথা শুনে নির্ঝর কিছুটা কাছ ঘেঁষে এলো তার।ভয়ে সে মাথাটা একটু পিছিয়ে নিল। নির্ঝর সামান্য ঝুঁকে রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘তোমার মনে হয় আমি মজা করছি? গালে দুটো পড়লে মজা টের পাবে। উঠে পড়ো!’

নির্ঝরের ধমক শুনে তরী সুড়সুড় করে উঠে পড়লো। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছে।নির্ঝরের কার্যকলাপ, কথাবার্তা সব খাপছাড়া।কেমন অসংলগ্ন তার ব্যবহার। তার হুট করে ভয় লাগতে শুরু করলো এই ছেলেটিকে!

নির্ঝর অার অপেক্ষা করলো না। হাঁটা শুরু করলো। কিছুদূর যেতে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাকে দাঁড়াতে দেখে তরীও দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো,

‘ কি হলো আবার?থেমে গেলেন যে?’

‘তোমার ঝোলাটা কার আশায় ফেলে রেখে এলে? আশিকের জন্য? অতি উত্তম। আশিকের অন্তত দু বছর আর জামাকাপড় কিনতে হবে না। তোমার ড্রেস গুলো দিয়ে আরামসে চলে যাবে।’

বলে নির্ঝর অপেক্ষা করলো না। আবার হাঁটা শুরু করলো। তরী জিভ কাটলো। এতটা ভুলোমনা হলে চলবে কি করে! সে দৌঁড়ে পেছনে গিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিল। আবার এক দৌঁড়ে এসে নির্ঝরের পিছু ধরলো।

প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে কিছুদূর এগোতে নির্ঝরের হাতে আচমকা টান পড়লো। ঘুরে দাঁড়ানোর আগে তরীর কম্পিত কন্ঠের চিৎকার ভেসে এলো। সে তাকিয়ে দেখলো, তরী দু হাতে তার বাহু আঁকড়ে ধরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।নিচের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে এলো নির্ঝরের। রাস্তায় ধারে শুয়ে থাকা একটা পাগল তরীর বাম পা চেপে ধরেছে।তরী প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু পেরে উঠছে না!

নির্ঝরের বাহু চেপে রাখা তরীর হাতদুটোর দিকে এক পলক তাকাল সে। তারপর তরীর ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে দ্রুত পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো টাকা বের করলো। পাগলটার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় পা ছাড়তে বললো। পাগলটা তরীর পা ছেড়ে লুফে টাকা নিয়ে নিল।খুশিতে তার চোখ দুটো চকচক করছে।

নির্ঝর তরীর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘এই মাঝরাতে আমায় এতটা হেনস্তা করার জন্য তোমায় কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো?’

তরী কাঁদো কাঁদো হয়ে নির্ঝরের বাহু ছেড়ে দিল।মাথা নত করে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল।দুজন স্টেশন পেরিয়ে বড় রাস্তার কিছুদূর আসতে তরী ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘পানি খাব নির্ঝর ভাই।গলা শুকিয়ে গেছে।’

নির্ঝরের পা থেমে গেল ক্ষণিকের জন্য। আড়চোখে আলো অন্ধকারের খেলায় মেতে উঠা মেয়েটির দিকে তাকালো। শুকনো ঢোক গিলে খুব দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। ছোট করে শ্বাস নিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলল,

‘পানি খাব বললেই তো আর পানি পাওয়া যাবে না। প্রথমত আমি ব্রত করেছি তোমার বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত জল স্পর্শ করবো না। দ্বিতীয়ত, চার ঘন্টা যাবত আমার পানি পিপাসা পেয়েছে। তবুও পানি দিয়ে গলা ভেজাচ্ছি না। সো, তুমিও পানি পাবে না।’

‘কো-কোথায় যাচ্ছি এখন আমরা?’

‘কাজি অফিস।নাম শোনোনি কখনো? না শুনলে শুনে নাও। আমরা এখন কাজি অফিসে যাচ্ছি যেখানে বিয়ে পড়ানো হয়। সেখানে তোমার আর মুঠোফোনের বিয়ে হবে। বিয়ে শেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করবো।’

ঢাকার কথা শুনে তরীর পিলে চমকে উঠলো। পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরের পথ আগলে দাঁড়াল।নির্ঝরের আবছা মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘ঢাকাতে কেন যাব নির্ঝর ভাই?’

‘তোমার আর তোমার মুঠোফোন স্বামীর বাসর হবে ঢাকায়। আমার বাসায়। সিম্পল!’

নির্ঝর নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিয়ে তরীকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড তরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। নির্ঝরের ভাবভঙ্গি দেখে একবার মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি তাকে মুঠোফোনের সাথে বিয়ে দিবে। তৎক্ষনাৎ মনে হলো এটা নিছক মজা বৈকি কিছুই নয়!

মজা ভেবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিল তরী। আর এ বিষয়ে ভাববে না সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সে ঘুরে আবার নির্ঝরকে অনুসরণ করলো।

___________

মিনিট দশেক হলো নির্ঝর আর তরী একটা রুমে বসে আছে। টিনশেড বিল্ডিং। মোটামুটি ছিমছাম রুম। রুমে আসবাবপত্র বলতে একটা খাট আর একটা টেবিল। টেবিলে বেশকিছু পুরনো কাগজ আর নথিপত্র। দেয়ালের সাথে গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে।

রুমের মাঝামাঝি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে নির্ঝর আর তরী। তরী কাপড়ের তৈরি ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে উদগ্রীব হয়ে আছে। ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে সে একবার বহির্গমন গেটের দরজার দিকে তাকাচ্ছে, একবার নির্ঝরের দিকে তাকাচ্ছে! নির্ঝর চুপচাপ। পায়ের উপর পা তুলে নির্বিকার ভাবে বসে আছে।চেয়ারের সাথে পিঠ লাগিয়ে সে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে। কোনো কথাই বোধ হয় বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। অথচ তরীর অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। অনেক কিছু জানার আছে!

সে কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে ফেলল,

‘আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো?’

‘যতক্ষণ না কাজি আসছে!’

ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই নির্ঝর চটপট উত্তর দিল।তরী সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেল। শেষমেষ তার মান সম্মান কিছুই রইল না। ফোনের সাথে এত ঘটা করে তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে নির্ঝর তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সে অনুনয়ের সুরে বলল,

‘আমার ভুল হয়ে গেছে নির্ঝর ভাই।মাফ করে দিন!প্লিজ মাফ করে দিন!’

নির্ঝর চোখ তুলে তাকালো।তরীর অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে চোখ পড়তে একটু নড়ে উঠলো। খোলা দরজা দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে বাইরের পরিস্থিতি ঠাওর করার চেষ্টা করলো। ওপাশে নিস্তব্ধ দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ছোঁ মেরে অহির হাতের ফোনটা ছিনিয়ে নিল সে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘কাজি সাহেব যেহেতু আসতে একটু লেট করছে, সেহেতু আমিই বিয়ে পড়ানো শুরু করি। কি বলো?’

‘না!’

‘চুপচাপ যা যা করতে বলবো সেটা করবে!’

তরীর ভয়াতুর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নির্ঝর বলা শুরু করলো,

‘তোমার আশিকের ফুল নেইম যেন কি?আচ্ছা, বাদ দাও!আমিই বলছি।সিলেটের হবিগঞ্জ নিবাসী জনাব আশিক কান্টুর একমাত্র প্রিয় বস্তু মোবাইল ফোন,একটা জলজ্যান্ত সুদর্শন পুরুষ নির্ঝর শাহরিয়ারকে দেহমোহর রেখে একই এলাকার তোফাজ্জল হোসেনের একমাত্র কন্যা মিস তাহনুভা মেহের তরীকে বিবাহ করিতে আসিয়াছে। মনে প্রাণে তাহাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিলে বলো মা, স্যরি বলো তরী কবুল।’

তরী হাঁ হয়ে নির্ঝরের মুখপানে চেয়ে আছে। নিজেকে তার কেমন অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে। কোলের উপরের ব্যাগটা অনেক আগে খসে পড়েছে। সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আপনি পাগল হয়ে গেছেন!’

নির্ঝরের কান অবধি সে কথা পৌঁছাল কি না কে জানে!সে আগের থেকে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘তিনবার কবুল বলো। বলছো না কেন?’

‘বলবো না!’

তরীর স্পষ্ট সুর শুনে মুহূর্তে নির্ঝরের মুখোভঙ্গি পাল্টে গেল।চোখে মুখে এসে ভর করলো রাজ্যের সমস্ত রাগ। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল,

‘থাপ্পড় খাবে নাকি কবুল বলবে?’

‘বলবো না কবুল। আপনি একটা মানসিক রোগী।’

নির্ঝর আর কথা বাড়াল না।সটান উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। দাঁত চেপে তরীর দিকে কষে হাত উঠাল থাপ্পড় মারার জন্য। শেষ মুহূর্তে তরী মাথা সামান্য ঘুরিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। একটুর জন্য তার গালে থাপ্পড় পড়লো না। ভয় পেয়ে সে কেঁদে দিয়েছে অলরেডি। কাঁদতে কাঁদতে নির্ঝরের দিকে চেয়ে সে পরপর তিনবার বলল,

‘ কবুল, কবুল কবুল।’

নির্ঝরের ঠোঁটের কোণে বরাবরের মতো স্মিত হাসি ফুটে উঠলো।ফিচেল হেসে ফের চেয়ার টেনে বসে পড়লো।ফোনটা নেড়েচেড়ে বলল,

‘তোমার বর তো বোবা। এ-তো কবুল বলতে পারবে না।এর হয়ে আমি বলে দিচ্ছি।আর দেনমোহর হিসেবে আস্তো আমি আছি। তোমার বর মারা গেলে বা তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলে দেনমোহর হিসেবে আমাকে পাচ্ছো তুমি।কত লাকি তুমি,দেখেছ? ‘

এটুকু বলে মেকি হাসলো নির্ঝর। গলার টোন পাল্টে তরীর দিকে চেয়ে তিনবার কবুল বললো। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে ফোনটা তরীর সামনে মেলে ধরে বলল,

‘আজ থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু তোমার বড়ই দূভার্গ্য তরী। মাত্র বিয়ে হলো। অথচ এখনই তোমার এতপ্রিয় স্বামীকে হারাতে হবে। বিধবা হয়ে যাবে তুমি।আহারে!’

তরীর কথার ঝুলি যেন শূন্য হয়ে গেছে।সে শুধু অবাক হয়ে নির্ঝরের কর্মকান্ড দেখছে। নির্ঝর তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের সিম খুলে ফেলল। সিমের এপিঠ ওপিঠ দেখে হঠাৎ করে অল্প একটু চাপে ভেঙে তিন টুকরো করে ফেলল। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি ধরে রেখে বলল,

‘ বড়ই দুঃখজনক ব্যাপার! বিয়ের প্রথম রাতে তোমার স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল।এবার সে মারা যাবে। তুমি বিধবা হবে।চিন্তা কোরো না!তখন তোমায় আমি বিয়ে করবো। বিধবা বিয়ে করা পূন্যের কাজ!’

বলে নির্ঝর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না। ফোনটা সর্বশক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। এক ঢিলে সেটার পার্টসগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। ভয়ে তরীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হতে সে দ্রুত মুখ চেপে ধরলো। নির্ঝরের মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেছে।সমস্ত মুখজুড়ে কেমন চাপা রাগ ফুটে উঠেছে। চোখ জোড়া ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে যেন! তরী আর কিছু বলার ফুরসত পেল না।

বাহির থেকে মিলিত পদধ্বনির আওয়াজ আসছে।নির্ঝর গলার স্বর উঁচু করে ডাকলো,

‘ আঙ্কেল ভেতরে আসুন। আর তাড়াতাড়ি করে সব প্রসেস কমপ্লিট করুন।’

ধবধবে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরিহিত মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন। মুচকি হেসে তিনি দাঁড়িতে বার কয়েক হাত বুলিয়ে মাথার টুপি ঠিক করলেন।এগিয়ে গিয়ে টেবিলে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনজন লোক এলো।এসে নির্ঝরের সাথে কুশল বিনিময় করলো। এদের মধ্যে দুজনকে তরী চিনে।ফুপির বাসায় একবার দেখেছিল।

তার কৌতূহল ভাব কাটতে না কাটতে টুপি পরিহিত কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।

_____________

বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে এগোতে নির্ঝরের ভেতর বড়োসড়ো পরিবর্তন ঘটলো। যে অনুভূতি গুলো এতদিন নিজের মনের গহীনে চেপে রেখেছিল সেগুলো যেন একের পর এক বের হয়ে আসছে।বন্দী দশা থেকে একের পর এক ডানা মেলে ছুটছে!সে যেন হাওয়ায় ভাসছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হচ্ছে। তার জীবন সার্থক। সার্থক তার বেঁচে থাকা। পাশের এই তরুণীটি যে এখন তার বউ। তার বউ! নির্ঝর শাহরিয়ারের বউ!

নির্ঝরের বুকের ভেতর চাপা আনন্দ খেলে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সে প্রবল উত্তেজিত। খুশির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে তার মুখ দেখে বিন্দুমাত্র কেউ আঁচ করতে পারবে না যে সে এতটা খুশি। যেমনটা তরী পারছে না। সে এক পা দু পা করে হাঁটছে আর ভীত সন্ত্রস্থ চোখে নির্ঝরের দিকে তাকাচ্ছে।

বাস কাউন্টারে পৌঁছানোর পর তরী হাঁসফাঁস করে বলল,

‘ইয়ে মানে বলছিলাম কি! আজ ঢাকা না গেলে হবে না?আমি ঢাকা যেতে চাই না।’

‘তাহলে কোথায় যেতে চাও?ফুপির বাড়ি তোমার বাবা লাঠি নিয়ে বসে আছেন পিটিয়ে তোমার গায়ের চামড়া তুলবে। আর তোমার বাপের বাড়ি তোমার চাচারা দা, কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গেলেই কেটে পিস পিস করে ফেলবে।কোন বাড়ি যেতে চাও বলো?’

নির্ঝরের গলার স্বর কিছুটা উঁচু ছিল। বদৌলতে বেশকিছু কৌতূহলী মুখ তাদের দিকে তাকালো।সবাই রাতের সফরকারী। নির্ঝর চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে গলার স্বর নিচু করলো।চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

‘বলো কোথায় যাবে?লাঠির আঘাত খাবে নাকি চাচাদের হাতের মাইর?’

তরীর চোখ ফেটে জল বের হলো এবং প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করলো সে কতবড় ভুল কাজ করেছে। আজ যদি সময় মতো নির্ঝর না আসতো তাহলে কি যে হতো ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে গেল। সে চোখের জল মুছে বলল,

‘আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন!’

নির্ঝরের মুখে হাসি বিস্তৃত হলো। তরীর চোখে ধরা পরবার ভয়ে খুব দ্রুত হাসিটুকু হজম করে নিল।তরীকে কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে সে লোকাল বাসের দুটো টিকেট কেটে আনলো।

বাস যখন ছাড়লো তখন ঘড়িতে রাত ২ টা বেজে ৪৮ মিনিট। জানালা ঘেঁষে তরীকে বসিয়ে তার পাশে নির্ঝর বসে পড়লো। বাসের শেষ যাত্রী তারা। একদম পেছনের সিট দুটো তারা পেয়েছে। নির্ঝরের এভাবে যাতায়াত করে অভ্যাস নেই। বাবার ব্যক্তিগত গাড়িতেই যাতায়াত করে অভ্যস্ত সে। কদাচিৎ বাসে উঠেছে বন্ধুদের সাথে। কিন্তু সেগুলো ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। আজ লং জার্নিতে তার প্রচন্ড ভয় করছে। নিজেকে নিয়ে নয়! তরীকে নিয়ে। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তরীকে সামলাবে কে? তার জানামতে তরীর এটা প্রথম ঢাকার জার্নি!

সিটে গা এলিয়ে দেওয়ার পর নির্ঝর বুঝতে পারলো সে বেশ অসুস্থ। মাথার আঘাতের জায়গা ব্যথায় টনটনে। প্রচন্ড ভার হয়ে আছে সেই সাথে। সে চোখ ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকালো। বাসের ক্ষীণ লাইটের আলোতে দেখলো তরীর মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। বরং সে কৌতূহল নিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা একের পর এক বহির্গমন দৃশ্যের দিকে চেয়ে আছে।

নির্ঝর তরীর দিকে চেয়ে থেকেই ক্লান্ত চোখ জোড়া বন্ধ করলো। কিছু সময় কেটে যেতেই আচমকা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করলে সে। বাসের একদম পিছনে হওয়ায় ঝাঁকুনিটা যেন কয়েকগুণ বেশি হয়ে এলো। ডান হাত দিয়ে সিটের হাতল চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েক সেকেন্ডের বিনিময়ে তৃতীয় ঝাঁকি খেল নির্ঝর। সঙ্গে সঙ্গে ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খুলল সে। তাকিয়ে দেখলো তরী হুমড়ি খেয়ে তার কোলের উপর আছড়ে পড়েছে! ভয়ার্ত মুখে তার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে আছে।

নির্ঝর এক হাতে তাকে জড়িয়ে বলল,

‘আর একটু চিকন হওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে প্রথম ঝাঁকুনি খেয়েই সরাসরি বুকে এসে পড়তে!কয়েক সেকেন্ড কষ্ট কম হতো আমার!’

(চলবে)