শেষ পাতায় তুমি পর্ব-১৮+১৯

0
3421

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৮|

হাতে তালি দেওয়ার শব্দে মেহের পেছনে ঘুরে ঘাবড়ে যায়। ফায়াজ ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে হাতে তালি দিচ্ছে।
“বাহ! তোমাকে তো আমি অবুঝ, ইনোসেন্ট একটা মেয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমিও যে এত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারো, গল্প বানাতে পারো সেটা তো জানতাম না। ইম্প্রেসিভ ব্যাপার স্যাপার। আমি কেন বারবার ভুলে যাই? কেন ভুলে যাই? তুমি মাহির বোন। মাহির বোন কি করে এতটা সরল হতে পারে? তুমি নেকা আর ড্রামাবাজ মেয়ে। এমন ভান করে থাকো যে কিছুই বুঝো না। কিন্তু তুমি সব বুঝো, সব।”

মেহের মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। ভয় লাগছে খুব। ফায়াজ যে চলে আসবে বুঝতে পারে নি। মেহেরের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। কিছু করতে গেলেই ধরা খায়।
মেহের দু’হাতে জামা খামছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ফায়াজ আবারো বলল,
“কি বলেছিলে তুমি? ওহ হ্যা, মনে পড়েছে। তুমি তোমার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিবে না। তুমি মাহির অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছো। ওকে তাহলে তাই হোক। তুমিই প্রায়শ্চিত্ত করো।”

ফায়াজ খপ করে মেহেরের হাত ধরতেই মেহের ভয়ে আঁতকে উঠল। সারা শরীরে কাপুনি অনুভব করছে।

ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে কিচেনে নিয়ে গেল। কিচেনে কেউ সবজি কাটছে, কেউ পেয়াজ কাটছে, কেউ বিফ কাটছে, কেউ মিক্সার করছে।
ফায়াজ যেতেই সবাই কাজ রেখে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ চুটকি বাজিয়ে বলল,
“আউট। আজ মেহের রান্না করবে। সব কাজ মেহের করবে। কাউকে যেন কিচেনের আশেপাশে না দেখি। নাও আউট।”

সবাই জি স্যার বলে দ্রুত বেড়িয়ে গেল।
মেহের হা করে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে।
আমতা আমতা করে বলল,
“কি বলছেন? আমি কি করে রান্না করব? আমি তো কোনো কাজ পারি না। আমি কি করে…?”

ফায়াজ ধমক দিয়ে বলল,
“যা বলেছি তাই করো। নয়তো খারাপ হয়ে যাবে।”

মেহের আবার কিছু বলতে যাবে তখনই ফায়াজ বের হয়ে গেল।
মেহের ফায়াজের এমন বিহেভিয়ার দেখে কাদঁতে ইচ্ছে করছে। কি করে রান্না করবে,কোনো দিন তো রান্না করে নি। অর্ধকাটা পেয়াজ,সবজি,বিফ দেখে কান্না এসে পড়েছে অলরেডি।

.

ফায়াজ কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মেহেরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। পেয়াজ কাটছে। পেয়াজের কি ধক। পেয়াজ কাটছে কিন্তু কুচি হচ্ছে না ঠিক করে। এবড়োথেবড়ো হয়ে আছে।মেহেরের বিরক্ত লাগছে। এত চেষ্টা করার পরেও ঠিক করে কেন কাটতে পারছে না। ফায়াজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর হাসছে।
মেহের ইউটিউব দেখে রান্না করছে কিন্তু খাওয়ার যোগ্য হচ্ছে কি না জানা নেই। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পরে মেহের কিচেন থেকে বের হলো। কি রান্না করেছে জানা নেই।

ক্লান্ত শরীরে রুমে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পুরো রুম এলোমেলো। মনে হচ্ছে ঝড়-তুফান বয়ে গেছে ঘরের উপর। মেহের মেঝেতে বসে পড়ল। ফায়াজ ইচ্ছে করে খাটানোর জন্য করেছে বুঝতে বাকি নেই। মেহের কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে ঘর গোছালো।

🌺🌺
ফায়াজ জানে মেহেরের রান্না খাওয়ার যোগ্য হবে না। তাই নিজে বাইরে থেকে খেয়ে নিয়েছে। মেহের নিজের রান্না করা খাবার মুখে তুলতে পারছে না। তাই না খেয়েই উঠে গেল। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর রাতে ডিমের অমলেট বানিয়ে খেয়ে নিল। মেহেরের ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে বাড়িতে চলে যেতে। ফায়াজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সারাদিন একটু খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না।

.
🥀🥀
মাহি বই খোলে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। পেছনে থেকে তূর্জ ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছুয়ালো। মাহি আচমকা যেন ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত পেছনে ঘুরে তূর্জকে দেখে বলল,
“তুমি? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

তূর্জ মাহির গাল টেনে বলল,
“আমি ছাড়া আমার বউয়ের আশেপাশে আসার সাহস কারো আছে?”

মাহি শুকনো হাসল। তূর্জ মাহির কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সরি। আমার ওভাবে চলে যাওয়া ঠিক হয় নি। আসলে ওর সাথে তোমার ছবি দেখে খারাপ লেগেছিল। কিন্তু মেহেরের সাথে কথা বলার পর সব ঠিক লাগছে।”

মেহেরের সাথে কথা হয়েছে শুনে মাহি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেহের কি বলেছে?”

তূর্জ মেহেরের বলা সব কথা বলল। সবটা শুনে মাহি মুচকি হাসল।
“বোনটা আমার বড় হয়ে গেছে।”

🍁🍁

ফাইজা ভার্সিটি থেকে বাড়িতে ফিরেছে। ওর মা ওর রুমে মন খারাপ করে বসে আছে।
ফাইজা ব্যাগ রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসে বলল,
“মম, কি হয়েছে? এভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেন?”

“ফায়াজের কথা মনে পড়ছে। ওকে কতদিন দেখি না। আর ওর বউয়ের সাথেও তো কথা হলো না। ফায়াজের সাথে কথা হলে বলিস আমি মেহেরের সাথে কথা বলতে চাই।”

“আচ্ছা বলব। তুমি মন খারাপ করো না। ভাইয়ার রাগ একদিন কমে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে করেছে এখন আস্তে আস্তে পালটে যাবে। চিন্তা করো না।”

ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল।

ফায়াজ ভার্সিটিতে যাবে কিন্তু ওর পছন্দের পারফিউম খুঁজে পাচ্ছে না। সব জায়গায় খোঁজেও পেল না। তারপর চিতকার করে মেহেরকে ডাকল।
মেহের ফায়াজের চিতকার চেচামেচি শুনে নিচ থেকে দৌড়ে এল। ফায়াজের সামনে এসে হাপাতে লাগত। ফায়াজ ফ্লোরে এটা সেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।
মেহেরকে দেখতেই চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তুমি আমার জিনিসে হাত দিয়েছো কেন? আমার পারফিউম কই?”

গতকাল যখন ফায়াজ সব এলোমেলো করে রেখেছিল তখন মেহের সব গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কোথায় রেখেছিল মনে করতে পারছে না। নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে।

ফায়াজ মেহেরকে চুপ থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ করে আছো কেন?”

মেহের কেঁপে উঠল। তারপর মনে করার ভঙ্গিতে বলল,
“আমি আসলে মনে করতে পারছি না।”

ফায়াজ মেহেরের হাত মুচড়ে ধরে বলল,
“তোমাকে আমার জিনিসপত্র ধরতে কে বলেছে? আমি নিষেধ করি নি? তোমার জন্য আমার দেরি হয়ে গেল।”

মেহের ব্যথায় কুকড়ে উঠছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
“হাতে ব্যথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ুন প্লিজ।”

ফায়াজ আরো জোরে চেপে ধরল। মেহের ফায়াজের হাত থেকে নিজের হাত সরানোর চেষ্টা করছে। কান্নার গতি বেড়ে গেল। ফায়াজ ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“নিচে চটপট আসো। আমি নাস্তা করব।”

মেহের নিজের হাত ডলছে আর কাঁদছে। ফায়াজ অমানুষের মতো আচরণ করছে। আগে তো এমন করে নি। করলেও কিছুটা রহম করেছে।

মেহের ফায়াজের চায়ের কাপে চা ঢালছে। কিন্তু ডান হাতে কাপ তুলতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে কাপ তুললেও ফায়াজের উপর কাপ পড়ে গেল। ফায়াজ দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়ছে।
মেহের আরো ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ঢোক গিলছে।

ফায়াজ রেগে গিয়ে বলল,
“আর ইউ ব্লাইন্ড? কি করলে এটা?”

মেহের প্রতি উত্তরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল।
মেহের ডান হাত ধরে কেঁদেই যাচ্ছে আর কি যেন বলছে। কান্নার জন্য ফায়াজ কিছুই বুঝতে পারছে না মেহেরের কথা।
ফায়াজ ধমক দিয়ে বলল,
“ভ্যা ভ্যা বন্ধ করো। তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”

মেহের কান্না কিছুটা থামিয়ে বলল,
“আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি। আমার হাতে ব্যথা। তাই কাপ ধরে উঠাতে পারছিলাম না।”

ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“তোমার হাতে আবার কি হলো? কাপ তুলতে পারবে না কেন?”

মেহের অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আপনি আমার হাত ভেঙে ফেলেছেন। আমি হাত নাড়াতে পারছি না।”

তারপর ফায়াজের মনে পড়ল ওর হাত মুচড়ে ধরেছিল কিছুক্ষণ আগে। তাতেই হয়তো ব্যথা পেয়েছে।
ফায়াজ মেহেরের হাতের দিকে হাত বাড়াতেই মেহের চিতকার করে হাত সরিয়ে বলল,
“আমার হাতে আর কিছু করবেন না প্লিজ। অনেক ব্যথা করছে।”

ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“আমি কিছু করব না। শুধু দেখব ট্রাস্ট মি।”

মেহের তবুও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরতেই মেহের চিতকার করল। ফায়াজ সার্ভেন্টকে পেইন কিলার স্পে
আনতে পাঠাল।
ফায়াজ মেহেরকে সোফায় নিয়ে বসাল। মেহের যেন হটাৎ আহ্লাদী হয়ে উঠল।
ফায়াজ আস্তে আস্তে অতি সাবধানে মেহেরের হাত ধরে স্পে করে দিল। কিন্তু মেহেরের ব্যথা কমছে না৷

ফায়াজ গিলটি ফিল করছে। বুঝতে পারে নি এতটা ব্যথা পাবে।
“মেহের কান্না থামাও।”

মেহের ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার হাত হয়তো ভেঙে গেছে।”

ফায়াজেরও কেমন লাগছে৷ যদি তাই হয় তাহলে?
ফায়াজ মেহেরকে আস্বস্ত করে বলল,
“কিছু হয়নি। রেডি হয়ে নেও। আমরা হসপিটালে যাব।”

ফায়াজের কথা শুনে মেহেরের মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই হাত ভেঙে গেছে।
মেহের রেডি হয়ে এলো। এক মহিলা সার্ভেন্টের সাহায্য নিয়ে হিজাব পড়ে নিল।

বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন নিয়ে মেহের আর ফায়াজ ফিরছে। বিকেলে রিপোর্ট আসবে। এখনকার মতো কিছু মেডিসিন দিয়েছে। মেহের আগে আগে হাটছে। আর ফায়াজ পেছনে মেডিসিনগুলো দেখছে।

হটাৎ ফায়াজের চোখ গেল সামনে। মেহের গাড়ির কাছে যাচ্ছে। আর পার্ক করা একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে একটা ছেলে শিষ বাজাচ্ছে মেহেরের দিকে চেয়ে। মেহের কিছুই খেয়াল করে নি। বেচারি তো হাতের চিন্তায় পাগল। শিষ বাজানো দেখে ফায়াজের মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। ফায়াজ মেহেরের কাছে গিয়ে ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরে বলল,
“বিবাহিত মেয়েদেরও ছাড় দিস না? ওর পোশাক যথেষ্ট মার্জিত। হিজাব পরা। তবুও? তোর মতো কিছু ছেলের জন্য সব ছেলের বদনাম হয়।”

ওই ছেলেটা কটাক্ষ করে বলল,
“কে রে তুই? আমার কলার ছাড়।”

ফায়াজ কলার আরো চেপে ধরে বলল,
“ফায়াজ নওয়াজ খান। লিখে রাখিস।”
বলেই ছেলেটাকে মারতে লাগল। মেহেরের হাত-পা কাপছে। ফায়াজের সামনে গিয়ে ছাড়ানোর সাহসও নেই। কেউ আসছেও না ছাড়াতে।
ফায়াজ মারামারির এক পর্যায়ে ছেলেটাকে গাড়ির উপর ধাক্কা মারল। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মাথাও ফেটে গেছে।

ফায়াজ ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আমার সাথে গুন্ডামী করতে আসিস না। আমি তোর এক ধাপ উপরে। আর কোনো দিন কোনো মেয়েকে দেখে শিষ বাজানোর আগে দশবার ভাববি। যা হসপিটাল থেকে ট্রিটমেন্ট করে নিস।”
(ওর হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে)

মেহের পুরো রাস্তা চুপ করে ছিল। বাড়িতে গিয়েও ভয়ে কথা বলে নি। বিকেল দিকে ফায়াজ রিপোর্ট আনতে যাবে তখনই মেহের কাঁদতে কাঁদতে ফায়াজের সামনে দৌড়ে এল। ফায়াজ মেহেরের কান্নার কারণ উদঘাটন করতে পারছে না।
“এই আবার ভ্যা ভ্যা শুরু করলে? আবার কি হলো? আমি তো তোমাকে কিছু বলি নি তাহলে কাঁদছ কেন?”

মেহেরের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“পুলিশ এসেছে। আপনাকে খুজছে। বলছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে আপনার নামে।”
মেহের আবার কাঁদতে লাগল।

ফায়াজ হটাৎ চোখ মুখ শক্ত করে নিল।

চলবে…..!

#শেষ_পাতায়_তুমি (Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৯|

“আপনি আজ একটা ছেলের মাথা ফাটিয়েছেন না আমার মনে হচ্ছে সেই ছেলে কমপ্লেইন করেছে।” মেহের ঠোঁট কামড়ে বলল।

ফায়াজেরও তাই মনে হচ্ছে। কেননা এই কয়দিনে ফায়াজ কোথাও কোনো ঝামেলা করে নি তাই পুলিশ আসার কথা না।
ফায়াজ পকেটে হাত গুঁজে বলল,
“নিচে গিয়ে দেখা যাক।”

মেহের চোখ বড়বড় করে বলল,
“আপনি নিচে যাবেন?”

ফায়াজ হালকা হেসে বলল,
“তো কি করব? সিনেমার মতো জানালা দিয়ে পালিয়ে যাব?”

মেহের মাথা নিচু করে নিল ফায়াজের কথা শুনে। তাই তো কি করবে? কিন্তু ফায়াজকে যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ফায়াজ ঘর থেকে বের হতেই মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে গেল।

🍁🍁

দু-তিনজন পুলিশ ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজকে আসতে দেখে একজন পুলিশ ফায়াজের সামনে গিয়ে বলল,
“আপনি ফায়াজ নওয়াজ খান?”

ফায়াজ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“জি!”

“আপনার নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে(একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে)। আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।”

ফায়াজ কাগজ হাতে নিয়ে না পড়েই বলল,
“কোন অপরাধে?”

পুলিশ লোকটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনি আজ সকালে মি.আতিফের মাথা ফাটিয়েছেন। তিনি এখন হসপিটালে এডমিট আছেন। আপনার নামে কমপ্লেইন করেছেন তার বাবা। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”

ফায়াজ ডান ভ্রু চুলকে বলল,
“আচ্ছা। আমি ১০মিনিটের মধ্যে আসছি।”
মেহের ফায়াজের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফায়াজের নির্লিপ্ত ভাব মেহেরকে অবাক করে দিচ্ছে। থানায় যাওয়া যেন ওর কাছে ডাল-ভাত।

পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল,
“জি অবশ্যই।”

ফায়াজ গুটিগুটি পায়ে উপরে যাচ্ছে। মেহেরও ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ রুমে গিয়ে তুষারকে ফোন করল। তুষার ফোন রিসিভ করতেই ফায়াজ বলল,
“তাড়াতাড়ি থানায় আয়। আর উকিলের সাথে কথা বল। আমার জামিনের ব্যবস্থা কর।”

তুষার ফায়াজের কথা শুনে বলল,
“ভাই কি হয়েছে? কি করেছিস? থানায় কেন?”

“সে অনেক কথা। আজ সকালে একটার মাথা ফাটিয়েছি। আমি এখন থানায় যাচ্ছি। ফোন রাখছি।”

ফায়াজ ফোন কেটে বেডসাইড টেবিলের উপর ফোন রেখে পেছনে ঘুরে মেহেরকে দেখল। মেহের কাঁদছে।
ফায়াজ মেহেরের সামনে আসতেই মেহের বলল,
“আপনি ওদের সাথে যাবেন? আমার না খুব ভয় লাগছে। আপনি ওদের সাথে যাবেন না প্লিজ।”

ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
“বোকা মেয়ে, ভয় পাচ্ছো? আমার অভ্যাস আছে। এর আগে অনেক বার গিয়েছি। আবার ফিরেও এসেছি। চলে আসব। ড্রাইভারকে বলে যাব ও গিয়ে তোমার রিপোর্ট নিয়ে আসবে। আমি আসছি। নিজের খেয়াল রেখো।”

মেহেরের ভালো লাগছে না। কেন জানি খুব ভয় লাগছে। ফায়াজ পুলিশের ভ্যানে উঠল। মেহের মেইনডোরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। ফায়াজ ভ্যান থেকে মেহেরকে দেখছে। কেউ একজন ওর জন্য কাঁদছে। কেন জানি ভালো লাগছে।

ফায়াজ যেতেই মেহেরের সব শূন্য শূন্য লাগছে৷ বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে,দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেহের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরো বাড়িটা দেখছে উদাসীন ভাবে।
মেহের নিজের ঘরে গিয়ে চুপ করে বসে আছে। ফায়াজের কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও মেহেরের কাছে নয়। পুলিশকে সব সময় দূর থেকে দেখেছে।
আর আজ বাড়িতে পুলিশ এসেছে আর এসে বাড়ির একজনকে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক নয় খুবই ভয়ানক বিষয় মেহেরের জন্য। মেহের কিছুতেই মানতে পারছে না। বিছানার চাঁদর খামচে ধরে রেখেছে৷
ফায়াজকে নিয়ে গিয়ে কি করবে? ছেড়ে দিবে তো? না কিছু করবে? মেহের কি করবে বুঝতে পারছে না? হাত-পা অনবরত কাঁপছে।

মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলছে,
“এখন আমার কি করা উচিত? কি করব আমি? কাকে বলব? বাবাকে(ফায়াজের বাবা) একটা ফোন করব? কিন্তু তিনি তো দেশে নেই। আপু.. আপুকে একটা ফোন করি।”
মেহের ফোন নিয়ে দ্রুত মাহিকে ফোন করল। মাহি ফোন রিসিভ করতেই মেহের কাঁদছে।

মাহি বিচলিত হয়ে বলল,
“মেহের কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? ফায়াজ কিছু করেছে?”

মেহের কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“হ্যাঁ, ফায়াজ মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।”

মাহি মেহেরের কথা শুনে আতংকিত সুরে বলল,
“মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে মানে? তোর মাথা ফাটিয়েছে? তুই এখন কোথায়?”

মেহের রাগান্বিত সুরে বলল,
“আপু, আমি বলেছি আমার মাথা ফাটিয়েছে? ও একটা ছেলের মাথা ফাটিয়েছে। আর কিছুক্ষণ আগে পুলিশ এসে থানায় নিয়ে গেছে।”

মাহি বসে ছিল। মেহেরের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল।
“পুলিশ? কি বলছিস?”

“হ্যাঁ আপু। আমি এখন কি করব? আমার ভয় লাগছে খুব। তুমি আমার কাছে চলে এসো।”

“আমি আসছি। আসছি আমি। তুই চিন্তা করিস না।”
মাহি দ্রুত ফোন রেখে তূর্জকে ফোন করল।

.

মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি গেটের দিকে। দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এল। তারপর চুপচাপ বিছানায় এসে বসে পড়ল।
মাহি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মেহু!”

মেহের মাহিকে দেখে কিছুটা সাহস পেল। মাহি ওর কাছে যেতেই মেহের কেঁদে দিল।
“আপু এখন আমি কি করব? ভালো লাগছে না। খুব টেনশন হচ্ছে।”

মাহি মেহেরকে শান্তনা দিচ্ছে নানাভাবে।
“আচ্ছা এ-সব কি করে হলো?”
মেহের সবটা খুলে বলল। মাহি বারবার
শান্তনা দিয়ে বলল,
“তুই ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তূর্জ গেছে৷ আমাদের ফোন করে সব জানাবে।”

বিকেলে রিপোর্ট চলে এলো মেহেরের। হাত ভাঙেনি। কিছুটা চুট লেগেছে তাই কিছুদিন মেডিসিন নিতে হবে,ভারি জিনিসপত্র তোলা যাবে না।

~পুলিশ স্টেশন ~
ফায়াজ আর ফায়াজের বন্ধুরা বসে আছে। কিন্তু জামিন হচ্ছে না। যার মাথা ফাটিয়েছে সেও যথেষ্ট ক্ষমতাবান ও স্বনামধন্য পরিবারের ছেলে। ফায়াজের বন্ধুরা কিছু করতে পারছে না। তূর্জও চেষ্টা করছে।
ফায়াজ চোখ মুখ লাল করে বসে আছে। ওর রাগ হচ্ছে প্রচুর। ইচ্ছে করছে সব গুড়িয়ে দিতে। এই প্রথম এমন হচ্ছে। এর আগে জামিন নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নি। আর এই মুহুর্তে যাকে প্রয়োজন তিনি দেশের বাইরে আছেন। আজকে হয়তো ফায়াজকে থানায় থাকতে হবে। ফায়াজের মেহেরের জন্য টেনশন হচ্ছে। একা বাড়িতে আছে।

ফায়াজ তুষারকে ডেকে বলল,
“মেহের বাড়িতে একা আছে। ও একা থাকতে ভয় পায়। একা থাকতে পারবে না। ওকে ওদের বাসায় দিয়ে আসিস।”

তুষার শান্তনা দিয়ে বলল,
“তুই টেনশন করিস না। তোর জামিন হয়ে যাবে।”

ফায়াজ ওর পিঠ চাপকে বলল,
“জানি হবে না। রাত হয়ে গেছে। হওয়ার হলে এতক্ষণে হয়ে যেত। ওর মাথা না ফাটিয়ে মার্ডার করে দিলাম না কেন?” (দাঁতে দাঁত চেপে)

“ভাই, শান্ত হ।”

তূর্জ মাহিকে জানাল,”ফায়াজের আজ জামিন হবে না।”

মাহি সেটা কিছুতেই মেহেরকে বলতে পারছে না। মেহেরকে এমনিতেই সামলানো যাচ্ছে না। সারাদিন কিছু খায় নি। মেডিসিন নিতে হবে তাই মাহি ওর জন্য খাবার নিয়ে এলো।
“মেহু খেয়ে নে। মেডিসিন নিতে হবে।”

“ফায়াজ আসুক। আমরা সবাই এক সাথে খাব।”

মাহি চুপ করে গেল। মেহেরকে কি করে বলবে। তূর্জও চলে এসেছে। তূর্জ মাহির দিকে তাকাল। মাহি ইশারা করল। আর সেটা মেহেরের চোখে পড়ল।
“আপু, ভাইয়া তোমরা আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছো?”

মাহি চুপ করে আছে। আর তূর্জ ভাবছে মেহেরকে সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত।
“আজ ফায়াজের জামিন হবে না। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

মেহের ছলছল চোখে তূর্জের দিকে চেয়ে আছে। ফায়াজকে ছাড়ে নি। মুভির মতো কি ফায়াজকে পুলিশরা মোটা লাঠি দিয়ে মারবে? নাকি রিমান্ডে দিবে?
এ-সব আর ভাবতে পারছে না। ভাবতেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে।
মেহের চুপচাপ উঠে গেল। নিজের রুমে গিয়ে ফায়াজের বাবাকে ফোন করল।

ফায়াজের বাবা একটা মিটিংয়ে ছিলেন। তাই ফোন রিসিভ করে নি। মেহের বারবার বলছে, বাবা ফোনটা রিসিভ করুন। আপনাকে খুব দরকার। প্লিজ রিসিভ করুন।

বারবার ফোন বাজায় এসিস্ট্যান্ট ফোন রিসিভ করল। মেহের বলল ইমার্জেন্সি তাই উনাকে ফোনটা দিতে।
এসিস্ট্যান্ট ফোন দিতেই ফায়াজের বাবা বলল,
“কি হয়েছে মেহের?”

মেহের কাদো কাদো হয়ে বলল,
“বাবা প্লিজ কিছু করুন। ফায়াজকে পুলিশ নিয়ে গেছে। উনার বন্ধুরা কিছু করতে পারছে না। আপনি কিছু করুন।”

ফায়াজের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কি করেছে আবার? ওকে আমি কতবার ছাড়িয়ে আনব?”

মেহের নিচু স্বরে বলল,
“বাবা উনি কিছু করে নি। যা হয়েছে আমার জন্য হয়েছে। সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। প্লিজ উনাকে ছাড়িয়ে আনুন। আমার কিছু ভালো লাগছে না। প্লিজ বাবা।”

“কি হয়েছে তাই বলো। মেহের আমাকে সব খুলে বলো।”

মেহের সব ঘটনা খুলে বলল।
“বাবা, জানেন তো উনার কি পরিমাণ রাগ। রাগের বশে ভুল করে ফেলেছে। উনাকে ছাড়িয়ে আনুন না। পুলিশ বলেছে ছাড়বে না।”

“আচ্ছা, আচ্ছা তুমি টেনশন করো না। আমি দেখছি।”

মেহের ফোন হাতে নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
“ফায়াজের জন্য এমন কেন করছি আমি? উনাকে পুলিশ নিয়ে গেছে তাতে আমার কি? উনি তো আমার সাথে কত অন্যায় করেছে। আমি কেন উনাকে নিয়ে ভাবছি? উনি একটা ছেলেকে মেরেছে তাই শাস্তি পাচ্ছে। তাতে আমার কি?”
না মেহের পারছে না এ-সব বলে নিজেকে শান্ত করতে। বুঝাতে পারছে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কি জড়িয়ে গেছে? মায়ায় বাঁধা পড়েছে? ফায়াজকে ছাড়া কেন বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগছে?

🌺🌺

মেহের চুপ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল না খেয়ে। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো। মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে অনুভব করে কেউ জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কিন্তু এই স্পর্শ তো ফায়াজের না। মেহের নড়ে-চড়ে ঘুরে দেখে মাহি ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।
মেহের মাহিকে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হয়তো রাত ২টোর মতো বাজে। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। দূরে কয়েক বাড়িতে আলো জ্বলছে। মেহের এই প্রথম ফায়াজকে এত মিস করছে। ফায়াজকে কোনো দিন মিস করবে, ফায়াজের জন্য কখনো কষ্ট পাবে ভাবতে পারে নি। ফায়াজ কি করছে, খেয়েছে কি না, কিছুই জানে না। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

মাহি সকালে ঘুম ভেঙে মেহেরকে বিছানায় না দেখতে পেয়ে মেহেরের খোঁজ করে বারান্দায় খুজে পায়। বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে।
মাহি মেহেরকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার বোনটা ফায়াজকে ভালোবেসে ফেলেছে। খুব ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ফায়াজ? ফায়াজ কি ওর ভালোবাসার মূল্য দিতে পারবে?”

মেহের ড্রয়িংরুমে ঘুমঘুম চোখে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। ফায়াজ কখন আসবে। তুষার ফোন করে বলেছে ফায়াজের জামিন হয়ে গেছে। গাড়ির শব্দে মেহের দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ফায়াজ শুকনো মুখে গাড়ি থেকে বের হলো। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। হয়তো ঘুমায় নি সারারাত। চুলগুলো এলোমেলো। ফায়াজের সাথে চোখাচোখি হতেই মেহের আলতো হাসল। ফায়াজ বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। মাহিকে দেখে ফায়াজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

মেহেরের দিকে না গিয়ে মাহির সামনে গিয়ে বলল,
“তুমি এখানে? ”

মাহি ইতস্তত করে বলল,
“আসলে মেহের খুব কান্নাকাটি করছিল। বলছিল একা ভয় লাগছে। তাই ওর রিকুয়েষ্টে এখানে এসেছি।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই মাথাটা ঘুরে গেল। ফায়াজ মেহেরকে ধরে ফেলল।
তারপর বিচলিত হয়ে বলল,
“মেহের কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”

মেহের কথা বলতে পারছে না। ফায়াজ মেহেরকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল।
মাহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফায়াজের অস্থিরতা দেখছে। ফায়াজ মাহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু করো।”

মাহি ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“গতকাল থেকে একটা দানা-পানিও খায় নি। হাজার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারি নি। সারারাত ঘুমায় নি। সকালে বারান্দায় পেয়েছি ওকে। তোমার জন্য আমার বোন কত চিন্তা করে আর তুমি ওর জন্য কি করেছ? কষ্ট ছাড়া কিছুই দেও নি।”
মাহি চলে গেল।
ফায়াজ মেহেরের দিকে অপলক কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মেহের চোখ বন্ধ করে আছে। ফায়াজ মেহেরের পাশে গিয়ে শুইয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল।

চলবে…..!