শেষ সূচনা পর্ব-০১

0
1220

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০১
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ।

মাতাল হয়ে বাসায় ফিরছিলাম আমি আর বন্ধু নাহিদ। অকস্মাৎ চোখ জোড়া আটকে গেল গলির মুখে একটা মেয়েকে ত্রস্ত-বিচলিত হয়ে কাঁপতে দেখে। ঘোলাটে নেশাতুর চোখেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, প্রচণ্ড শীতে বাচ্চা ছেলে গোসল করে এলে যেমন করে কাঁপে মেয়েটা ঠিক তেমন করে দাঁতের সঙ্গে দাত বাজিয়ে ই-ই-ই-ই করে কাঁপছে। একটা বদ্ধ দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে মেয়েটা। ক্ষানিক পরপরই পুঁটি মাছের মতো মুখ বের করে মনে সমুদ্র পরিমাণ ত্রাস নিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। হাতে একটা বড় বোঁচকা। একবার ভাবলাম,বাড়ি থেকে তল্পিতল্পা বেঁধে পালিয়ে এলো না তো? পরক্ষনেই ভাবলাম, নাহ, না জেনে অন্যের ঘাড়ে এমন অমূলক দোষ চাপানো পাপ।মহা পাপ।এই পাপের কথা মাথায় অনায়াসে এলেও, মদ খেলেও যে পাপ সেকথা আমার সরল মস্তিষ্কে তখনও ঢুকলনা। কারণ যে যেটা করে, সেটা নিজের কাছেই দামী, উৎকৃষ্ট মনে হয়। কোনরূপ সমাধানের আশায় ঢুলুঢুলু শরীরে নাহিদের দিকে ফিরলাম। ছারকপাল আমার! সে ততক্ষণে অনেকদূর হেঁটে চলে গেছে বাসার দিকে। ডাক দিলাম বার-কয়েক। শুনলনা। গ্রামের ছেলে জীবনে প্রথম মদ খেলে যা হয়। মাথাটা একেবারে নড়ে গেছে। তার বোধহয় দু’একটা ছিঁড়েও গেছে। অবিশ্বাস্য কিছু নাহ্। ধীরে ধীরে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পায়ে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে। বললাম,
—- আপনি এখানে এতো রাতে কী করছেন আপু? কোন সমস্যা? কেন আই হেল্প ইউ?
নিজেকে যথাযথ ঠিক রাখার অনন্ত চেষ্টা করেও শেষের কথাটা কেমন অসংযত, এবং খাঁটি মদ্যপায়ীর মতো নিজের কানে বাজলো। নিজেই যেন একটু চমকে উঠলাম।
মেয়েটা অন্যদিকে ফিরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।আমার কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়ে ফিরে তাকাল। তারপর তড়াক করে দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
—- আমার কাছে কিছু নেই। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।
তার কথার আগাগোড়া বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলাম। শরীর ঢলে আসছে। তথাচ শক্তি জুগিয়ে বললাম,
—- আমি আপনার ক্ষতি করবনা। এই নির্জন রাস্তায় একা কী করছেন? যান নিজের ঘরে যান।
মেয়েটা বলল,
—- ওও,করবেন না! আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন?
বললাম,
— কী?
—- কিছু টাকা দিতে পারবেন? পরে ফেরত দিয়ে দিবো। বাসায় যাব,ছিনতাই কারী টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে।
মেজাজটা হঠাৎ অজানা কারণে খিটখিটে হয়ে গেল। আগুনঢালা গলায় বললাম,
—- মগের মুল্লুক নাকি ভাই? চিনিনা, জানিনা, এমন একজন মেয়েকে টাকা দিতে যাব কোন দুঃখে?

মেয়েটা অধোবদনে চুপ করে রইল। রাতের নির্জনতা ক্রমবর্ধমান। কোথাও কোথাও ছেড়ে ছেড়ে মৃদুমন্দ আলো জ্বলছে। অদূরে রাস্তার পাশে একটা জারুল গাছে একঝাঁক জোনাকিপোকা সোৎসাহে টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে, কোন জোনাকি যুগলের বিয়ে বাড়ি যেন! দূরের কোন এলাকায় করুণ সুরে কুকুর কাঁদছে। কারো পৌষ মাস করো সর্বনাশ। এক্ষেত্রে জোনাকি যুগলের পৌষ মাস। দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা শহরের অবসন্ন পাকা রাস্তাটা মন ভরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাতেও তার শান্তি নেই। মিনিট পাঁচেক পরপর একটা গাড়ি পাকা রাস্তার ঘুমন্ত বুক মাড়িয়ে সোঁ করে পালিয়ে যায়। সদ্য উদ্ভিন্ন কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়ে আহাজারি করতে চায় ব্যস্ত সড়ক! ঠিক এই মাত্র সড়কের কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়ে বক্ষপিঞ্জরের ছিন্নভিন্ন করে একটা বড় ট্রাক তীব্র আলো ফেলে চলে গেল। মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে উভয়ের মুখ। আমি চমকে উঠলাম। মনে হলো এই মুখ আমি কোথাও দেখেছি। হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখেছি। খুব পরিচিত এই মুখ। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পড়ছেনা। মদ খাওয়ার উত্তম প্রতিদান! মাথা কাজ করছেনা৷ কিছু না ভেবেই আমি বলে ফেললাম,
—- আপনি আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আমি আর আমার বন্ধু থাকি একা।
মেয়েটা তেজী গলায় বলল,
— কী বললেন? আপনি তো বাজে লোক! যান চোখের সামনে থেকে। বেয়াদব কোথাকার।
আমি মুখ ভেঙ্গিয়ে বললাম,
—- ইশশ, এখন খুব সাহস দেখাচ্ছেন । একটু আগেই তো ভয়ে ঢকঢক করে কাঁপছিলেন৷ আমি আসতেই তো একটু প্রাণ ফিরে পেলেন।

বলে পাশে থাকা বালতিতে জামানো বৃষ্টি পানি দিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দিলাম। কয়েক ফোঁটা অবাধ্য জলকণা গিয়ে পড়ল মেয়েটা গায়ে। কথার মাধ্যিখানে জলের মধ্যস্থতায় একটু শিউরে উঠলো সে। নিচু নেত্রে কপালের দু’পাশের শিরায় আঙুল সঞ্চালন করতে করতে নিজেকে একটু ধাতস্থ করার চেষ্টা করলাম। তবুও আমার মদ্যপ বিকৃত মস্তিষ্ক অচেনা হয়েও চেনা এই মেয়েটির খোঁজ মস্তিষ্ক- তথ্যভাণ্ডার থেকে বের করতে পারলোনা। তথ্যভাণ্ডার মদের লীলায় বিমূঢ় হয়ে আছে। মেয়েটা আবার অনুনয়ের সুরে বলল,
—- আপনি ছাড়া এখানে কেউ নেই। প্লিজ কিছু টাকা দিয়ে হেল্প করুন। আমি আপনাকে বিকাশে পাঠিয়ে দিবো। নইলে খুব বিপদে পড়ে যাব।
একবার ভাবলাম টাকা দিয়ে দিলেই ফুরিয়ে গেল। পরে, পরিচিত মনে হওয়া এমন একটা মানুষকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা ভেবে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে মুখ থেকে পানি নিংড়ে ফোনটা বের করলাম। একটাই উপায়, বুয়াকে ফোন করে আসতে বলা। বললাম,
— আপনি ভুল বুঝছেন,আমি আপনাকে অতো কিছু ভেবে বলিনি।
প্রখর মদের গন্ধ নিজের নাকেই তোলপাড় শুরু করে দিচ্ছিল। এবার বোধহয় মেয়েটা টের পেল। নাক কুঁচকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ দূরে সরে দাঁড়ালো সে। ব্যাপারটা নিজ চোখে দেখেও কিছু বললাম না। একটু পর বললাম,
—- আমার যে বুয়া রান্না করে তাকে ফোন করে ডেকে আনি কী বলেন? তার সঙ্গে যেতে আপত্তি নেই তো?
— আগেতো ডাকুন৷ তারপর নাহয় দেখা যাবে।
আসন্ন ঘোর বিপদ সামনে রেখেও মেয়েটার বেয়াড়া কথারঢং’য়ে চরম বিরক্ত হলাম। প্রকাশ করলাম না। কপালের উপর চামড়াগুলো কুঁচকে গেল শুধু। কিছুক্ষণ ফোন হাতিয়ে খালার(বুয়া) নাম্বার বের করে ফোন দিলাম। এই খালা আমার খুব বিশ্বস্ত লোক। গত ছ বছর ধরে আমার ঘরে রান্না করে আসছে। দাদির খুব পছন্দ ছিল তাকে। দুই-এক দফা রিং পড়তেই খালা ঘুম জড়ানোর কণ্ঠে বলল,
—- হ্যাআআলো…
বুড়ির গলার কি তেজ! কর্ণকুহর ভেদ করে আমার মাতলামি অর্ধেক ছুটে গেল একেবারে।
—- খালা,একটা হেল্প লাগবে।
—- কি হেলেপ?এতো রাইতে কিজন্য ফোন করছেন? আমিতো সেই কবে রান্না কইরে ঘরে তালা দিয়ে আইছি।
—- আরে খালা শুন না আগে কথা।
বুড়ি খালা টেনে টেনে বললেন,
— কীইই?
— একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে। তোমাকে এক্ষুনি আমার বাসায় আসতে হবে। তার আগে গলির মুখে আস৷
খালা যে অবাক হয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো সে দৃশ্য যেন আমি না দেখেও অন্তর চক্ষু দিয়ে আমি পষ্ট অবলোকন করলাম।খালা বলল,
—- আফনে যে মদ-টদ খান হেইডা আমি জানতাম। কিন্তু আজকাল যে মাইয়া নিয়া আসেম হেইডা তো জানতাম না!
ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে আমার সর্বাঙ্গ পুলকিত করে পায়ের কাছে গিয়ে ঠেলাঠেলি করতে লাগলো। পাকা রাস্তায় পা ঠুকিয়ে গজগজ করে বললাম,
—- এখন তো মনে হচ্ছে মদ আমি না তুমি খেয়েছ! আমি কখন বললাম আমি মেয়ে নিয়ে আসছি। মেয়েটা বিপদে পড়ছে। তাড়াতাড়ি আস। নাহলে তোমার চাকরি নট!
বুড়ি একগাল হেসে বলল,
—- চাকরির ভয় আমারে দেখাইয়োনা। আইতাসি খাড়াও৷
—- ঠিকাছে রাখলাম।
ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটা ভূত দেখার মতো আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী আমিও ভূতগ্রস্তের মতো চমকে উঠলাম। মেয়েটা সম্মোহনী গলায় বলল,
—- আপনাকে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে! কণ্ঠটাও খুব চেনা লাগছে!
আমি প্রথমটা চুপ করে রইলাম। পরে গলা ফাটিয়ে হোহো করে ডাকাতের মতো হেসে উঠলাম। হাসির কারণ জানিনা৷ দূরে কুকুরের আর্তনাদ হুট করে থেমে গেল আমার হাসি শুনে। বললাম,
—- সত্যি বলছেন? আমারো আপনাকে খুব চেনা লাগছে। বলেই আরেক দফা অতলান্ত হাসির নহরে ডুব দিলাম।
খালা চলে এলো ঢলতে ঢলতে। আমার খোঁজে আশেপাশে তাকাল। আমি দু’পা পিছনে এসে ডাক দিলাম,
—- খালা এইদিকে।
খালা হাঁড়িপানা মুখে এগিয়ে এলো। মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে বলল,
—– সারাদিন কাজ কাম কইরা একটু শান্তিতে ঘুমাইতে গেছি, ওমনিই তোমার জ্বালা শুরু হয়ে গেছে না?
উত্তর দিলাম না। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— এখন যেতে আপত্তি নেই তো? কাল সকালেই আপনি চলে যেতে পারবেন।
মেয়েটা আর দ্বিরুক্তি না করে রাজী হয়ে গেল। খালাতে ছোট করে বললাম,” আপনি আজকে আমার বাসায় থাকবেন”

দুই মিনিট হাঁটার পর বাসায় পৌঁছে গেলাম। দুইতলা বাড়ি আমাদের। নিজস্ব বাড়ি। বাবা-মা দেশ বিদেশে ভ্রমণ করছে। জ্ঞান হবার পর থেকে দাদীকে ছাড়া কাছে পায়নি কাউকে৷ বাবা-মা আছে। তবে তারা ব্যাবসায়ী কাজে ব্যস্ত থাকত সবসময়। দাদীর কাছেও বড় হয়েছি আমি। সেই দাদীও লীলাখেলার সমাপ্তি ঘটিয়ে তিন বছর আগে পরপারে পাড়ি জমাল। গেট ডিঙিয়ে ভিতরে যেতেই দেখি নাহিদ দরজার সাথে হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বেচারা! চাবি তো আমার কাছেই ছিল! পুরো বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা লাইট পর্যন্ত জ্বালানো হয়নি। একপাশে সরিয়ে নিলাম তাকে নাহিদকে। এরপর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। খালাকে বললাম,
—- খালা,আপনি ওনাকে গেস্ট রুমটা একটু গুছিয়ে ঠিক করে দিন। আর খাবার দিয়ে দিবেন তাকে। আমি ঘুমাব। অনেকদিন পর গলায় মধু পড়েছে তো…. ঘুম পাচ্ছে।
বলে সুইচ বোর্ডে চাপ দিয়ে বিস্রস্ত পায়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম। আলো জ্বললো ঠিকি। কিন্তু সেই আলোর প্রভা আমার পাপী মুখ উদ্ভাস করে সুযোগ পায়নি৷ পেছনে আর ফিরে তাকালাম না। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কুম্ভকর্ণের মতো একটি ঘুম দিব। মেয়েটার চিন্তাও মাথা থেকে পুরোপুরি ঝাড়তে পারলাম না। সেই ট্রাকের এক ঝলক আলো আমার মানস সরোবরে এতোটা প্রভাব ফেলবে ভাবতে পারিনি। সারাদিনের ক্লান্ত,অবসন্ন চোখে রাজ্যের ঘুমপরীরা নেমে এলো মুহূর্তেই।

রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর পার হয়ে গেছে। কোন কিছুর শব্দে হঠাৎ যন্ত্রের মতো চোখ দু’টো খুলে গেল। তন্দ্রাবিষ্ট চোখে লক্ষ্য করলাম, কাঁচের ধূসর রঙের দরজার পেছনে একটা নারী অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রিভলবার।

চলবে…