শেষ সূচনা পর্ব-০৯

0
219

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ ৯
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

জুহি উৎকর্ণ হয়ে আমার কথা শুনছে। চোখাচোখি হতেই নড়েচড়ে বসে চোখ ফিরিয়ে নিল। স্বর্ণা বলল,
—- হ্যাঁ শুনো তাহলে।
— বলো,
—- যেদিন ঢাকা থেকে এলাম,তারপর দিন একটা জায়গায় মিশন ছিল। সিলেট শহরেই। কিন্তু মিশন শুরুর আগেই তারা গুপ্তচর দ্বারা সব খবর পেয়ে যায়। আমরা কিছু করার আগেই তারা সতর্ক হয়ে গেল।… তারপর আর কী মিশন ফ্লপ। আমি…
—- তোমার এসব বলতে লজ্জা করছেনা? আমাকে এসব বলার মানে কী? স্বর্ণার অর্ধকথনের মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাম আমি।
ফোঁস শব্দে একটা চাপা প্রশ্বাস আমার কর্ণকুহর ভেঁদ করে গিয়ে হৃদয়ে দাগ কাটল। একটু খটকা লাগল আমার। ‘কী হয়েছে’ জানতে চাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই স্বর্ণা বলল,
—– হাতে গুলি লেগেছে,তলপেটে ছুরির পোঁচ লেগেছে। তোমার কথা মনে পড়ছিল খুব, একা একা হাসপাতালের বেডে। তাই ফোন দিয়েছি।

আমি খনিকের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলাম। শতচেষ্টাতেও নিরুচ্চার মুখে টুঁ শব্দ ফুটলনা। অনেক কষ্টে হারানো বাক্যগুলো খুঁজে নিয়ে মৃদুস্বরে বললাম,
—- এখন কেমন আছো?
স্বর্ণা যেন এ প্রশ্নের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। বলল,
—- আছি ভালোই। টনটনে ব্যথাটা লেগেই আছে। এক মাসের মধ্যেই আগের জায়গায় ফিরতে পারব কোনমতে।
—- আগের জায়গা আবার কী?
—- জানোই তো। নতুন করে বলতে হবে কেন?
সিমেন্ট-কংক্রিটে বাঁধানো ঘাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। পেছনে না তাকিয়েও অনুধাবন করলাম জুহি নিমিষহারা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কে জানে কি ভাবছে! অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝুপঝুপিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কথা বলতে বলতে সেটা টেরই পাইনি। সন্ধ্যের মৃদু আলোতে আমার ছায়াটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল। হাত বদলে বাম কান থেকে ডান কানে ফোন স্থানান্তর করলাম। ফোনের দুইপাশে দু’জনের মুখে রা নেই। একটু দূরে যাওয়ার পর আমি অনুচ্চস্বরে বললাম,
—- এসব কবে ছাড়বে তুমি?
—- কোনসব? উদাসকণ্ঠে বলল স্বর্ণা।
আমি এবার একটু গর্জে উঠলাম,
—- কেন? বুঝতে পারছনা? ফিডার খাও তুমি?
ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ শোনা গেলনা। অনবরত হাসপাতালের ব্যস্তসূচক একটা গমগম শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
আমি বললাম,
—- চুপ করে রইলে যে?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো,
— কী বলব? বলার মতো কিছু নেই।
আমি নমনীয় গলায় বললাম,
—- স্বর্ণা! আমার স্বপ্নের সেই তোমার শরীরটায় দিনের পর দিন এভাবে দাগ পড়ছে,ঝাঁঝরা হচ্ছে। এটা তো আমি সহ্য করতে পারিনা।
স্বর্ণা বোধহয় একটু হেসে বলল,
—- এই শরীরটা আগে থেকেই দাগি। এটা নিয়ে তোমার এতো উথাল-পাতাল কেন? একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখো। কতো ভালো ভালো মেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। দাগি মেয়েটাকে ভেতর থেকে আর দাগি করোনা প্লিজ।

মানুষের জীবনে ধাক্কা খাওয়াটা ভীষণ প্রয়োজন। ভীষণ! প্রত্যেকটা মানুষ ধাক্কা খেতে খেতে, নানান ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে যখন একপর্যায়ে এসে তার সুকুমার মসৃণ, অল্পতেই গলে যাওয়া মনটা ইস্পাত কঠিন হয় তখনই সে সত্যিকারের মানুষ হয়। তখন কঠিন ধাক্কাও সে হাসিমুখে সামলে নেয়। আমি সত্যিকারের মানুষ হয়েছি কিনা জানিনা। তবে একটানা ধাক্কা খেতে খেতে আমার মনটা কিঞ্চিৎ হলেও পাকাপোক্ত হয়েছে। এই ধাক্কাটাও সামলে নিলাম আমি। কিন্তু তার বলা শেষ কথাটির গভীরতা সমুদ্রসম। সেটা আমি আজকের এই আখ্যান পড়ুয়া পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
আমি কোন জবাব দিলাম না স্বর্ণার কথার। স্বর্ণা বলল,
—– আমি মাঝেমধ্যেই ফোন দিব। কিন্তু তুমি ভুলেও কখনো ফোন দিওনা।
—- আচ্ছা, ফোন দিলে বিকালের পর দিও। পুলিশের একবছরের ট্রেনিংয়ে আছি আমি।
—- তাই নাকি। কবে হলো এই চাকরি?
—- তুমি যেদিন চলে গেলে সেদিন।
স্বর্ণা কৌতুকের ছলে বলল,
—- তাহলে তো ফোন দেয়া যাবেনা দেখছি। চোর-পুলিশ বনবেনা।
— নাহ,তুমি ফোন দিও। সমস্যা নেই।
ফোনের ওপাশে কিছু লোকের সমাগম হলো বলে মনে হলো। পরমুহূর্তেই স্বর্ণা হাঁকুপাঁকু করে বলল,
— ঠিকাছে ছাড়ছি এখন।
— ঠিকাছে,বাই।

কথা বলতে বলতে অল্পদূরেই হেঁটে এসেছিলাম। পূনরায় ঘাটের কাছে এসে বসলাম। জুহি পুকুরের অস্বচ্ছ জলের দিকে বিমনা হ’য়ে তাকিয়ে ছিল। আমার আগমন টের পেয়েও একিভাবে বসে রইলো। আগবাড়িয়ে বললাম,
—- এখনো মন খারাপ নাকি?
জুহি একবার আমার দিকে তাকিয়ে পূনরায় পুকুরের দিকে শূন্যদৃষ্টি মেলে ধরে বলল,
—– নাহ,এখন ঠিকি আছি। কার সঙ্গে কথা বলছিলেন? আপনার না কেউ নেই!
আমি হেসে বললাম,
—- কেউ নেই। কিন্তু ছিল। সেই ছিল থেকেই একজন ফোন দিল। কথাটা কি সুন্দর মিলো গেল। তাই না বল!
জুহি থুড়থুড়ে বৃদ্ধের মতো করে হাসতে হাসতে নিজের কোলে নুইয়ে পড়লো এবং পরক্ষণেই খুঁ খুঁ করে কাশি দিতে দিতে তার হাসির গতি মন্থর হলো। আমি বললাম,
—- এতো হাসতে পার? কেউ দেখলে তো পাগল বলবে। বলবে, দ্যাখো কিভাবে সিনিয়রের সঙ্গে বসে হাসি-তামাশা করছে।
—- লোকের কথা লোকের মুখে। আমার কি আসে যায়?
—- সেটা ঠিক বলেছ।
—- তা কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?
—- প্রাক্তন প্রেমিকা। — সহজেই বললাম আমি।
—– প্রেমিক/ প্রেমিকারা প্রাক্তন হয় কেন?
জুহির চোখে-মুখে ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিতে রহস্য খেলছে। এই যেন নতুন কিছু আবিষ্কার করে নিবে সে। আমি একটু ভেবে বললাম,
—– কখনো নিজের ইচ্ছেই,আর কখনো পরিস্থিতির চাপে। ফিফটি ফিফটি। তবে মেয়ে মানুষের মন প্রহেলিকার মতো। বুঝা বড় কঠিন।
— হুমম সেটা জগতজুড়ে মানুষ জানে। তা নাম কী মেয়েটার? আর কেনই বা প্রাক্তন হলো?
—- নাম স্বর্ণা। একি স্কুলে পড়তাম। ওখান থেকেই ভালোলাগা। কলেজে এসে বলা না বলা ভালোবাসার শুরু। কিন্তু বেশিদিন টেকেনি। তার বাবা মা আমার দাদীর কাছে বিচার দেয়। পরে দাদী আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। পরে ঢাকাতেই পড়াশোনা শেষ করি আমি। এরিমধ্যে অনেককিছু ঘটে যায়।
একদিন মাতাল হয়ে বাসায় ফেরার পথে তার দেখা পেলাম। কিন্তু চিনতে পারিনি। আশ্রয় দেবার জন্য তাকে নিয়ে আসি বাসায়। পরেরদিন শুনি তার যত দুর্দশার কাহিনী। এরপরের সমস্ত ঘটনা একে একে বিবৃত করলাম জুহির কাছে।

প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটার ফলে সম্যক দুমড়ানো মোচড়ানো পরিবেশটা যেমন ঝড়ের তোড়ে গুম হয়ে থাকে আমার কথাগুলো শোনার পর জুহির সঙ্গে পুকুরের কৃত্রিম লালিত মৎস্যগুলোও যেন স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেল। টুপটুপ করে ডুব দেয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। নীরবতা ভেঙে জুহি বলল,
—- খাবার সময় হয়ে গেছে। যাই আমি।
—- ঠিকাছে যাও। -ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম আমি।

রাতে খাবার খেয়ে ব্যারাকে ফিরলাম। অনেকেই শুয়ে পড়েছে তখন। আবার কেউ কেউ তখনো বাইরে। আমি সোজা গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লাম। অনিক হঠাৎই ঘুম ভাঙার মতো করে জেগে উঠে বলল,
—- মানুষ বাথরুমে কী করে এতক্ষণ? সেই বিকাল থেকে… আচ্ছা, বাই এনি চান্স, তুমি কি জুহি মেয়েটার সঙ্গে লাইন মারতে চাইছেন নাতো?
ঠিক তখনি আমার মনে পড়লো অনিকের শব্দবোমা থেকে বাঁচার জন্যই আমি বিছানা না ঝেড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শব্দবোমা যখন মারতেই শুরু করল তাহলে আর ধুলোপড়া বিছানায় শুয়ে থাকার মানে হয়না। উঠে বসে আধ-গুটানো বিছানাটা ঠিক করতে করতে বললাম,
—– অনিক, তুমি একজন শিক্ষিত,গ্রাজুয়েট ছেলে। তোমার মুখে এমন স্থূল কথা মানায় না। মজা করো ভালো কথা। কিন্তু মজাটা লিমিটের মধ্যে হওয়া উচিত।
অনিক খানিক উদ্দীপ্তকণ্ঠে বলল,
—- মজা না! আমিতো লক্ষ্য করেছি। তুমি সুযোগ পেলেই ঐ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলো। ঘুরাঘুরি করো। পটিয়ে ফেল বস। ভালো মানাবো।
যা বুঝলাম। আর কয়েকদিন গেলে এই মাথামোটা অনিক সবাইকে বলে বেড়াবে এই ব্যাপারটা। আমি বিষয়টা চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
—- ঘুরাঘুরি করলেই তো আর লাইন মারা হলোনা। মানুষ মানুষের সঙ্গে ঘুরতেই পারে। কথা বলতেই পারে। এমন ভাবার কী আছে?
—- হ্যাঁ ঘুরতেই পারেন। চাইলে আমি মনোবিজ্ঞানী হতে পারতাম বুঝলেন। মানুষের চোখ দেখলেই আমি সব পড়ে ফেলতে পারি। আমাকে ঠকানো সহজ না।
—- তুমি বেশি কথা বলো অনিক। আমার চোখে কি এমন দেখতে পেলে যে তোমার এসব মনে হল?
অনিক বিজ্ঞের মতো চকচকে সেইভ করা গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
—- উহু আপনার চোখে না। জুহির চোখে দেখেছি। কুচ তো গড়বড় হে…
—- তাহলে তুমি সেই জুহিকে বললেই পার এসব। তারপর লাথি মেরে মেরে ক্যাম্প থেকে বের করবে তোমাকে।
বিছানা গোছানো শেষ। উক্ত কথাটা বলেই আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
অনিক বারকয়েক কানের কাছে,” বস রাগ করলে নাকি? ” বলে ঘ্যানঘ্যান করে পরে নিশ্চুপ হলো। আমিও স্বস্তির একটা নিশ্বাস মনের আনন্দে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আরো টেনে কাঁথা মুড়ি দিলাম।

এভাবেই কাটছিল ক্যাম্পের বন্দী দিনগুলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ট্রেনিং, সারাদিন নানা ব্যস্ততা শেষে বিকালের সময়টাতে বনে-বাদাড়ে ঘুরাঘুরি আর ছোটখাট আড্ডার সংমিশ্রণে নানান চড়াই-উতরাই, আলো-আঁধারির খেলার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। আমার অবসরে থাকা শরীরটা এবার ভেঙে পূনরায় গড়ছে। অনিকসহ আরো কয়েকজন মেয়ে-ছেলে একসঙ্গে মিলে বিকেলের সময়টা পার করি। ট্রেইনারপ্রভাষকরা এটা নিয়ে তেমন কিছুই বলেন না। বরং হেসে বলেন, “ভালো, ভালো, সিনিয়র-জুনিয়র আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা ভাল।” অনিক সেই জোকার টাইপ ই রয়ে গেছে এখনো। যে কোন সময় যে কারোর সঙ্গে স্থূল রসিকতা করতে তার একটুও বাঁধে না। তবে কাজের সময় সবাই হিংসা করে তাকে দেখে। সব দিক থেকেই তার পরিপক্বতার ছাপ পাওয়া যায়। একদিন কথা কথায় উদ্ভব হয়েছে, অনিক বিবাহিত। ছাত্রাবস্থাতেই বাবা -মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে যাতে ছেলে বখে না যায়। এমন কথা শুনে হয়তো-বা আড্ডা দলের কয়েকজন যুবতীর মন ভেঙে খানখান হয়েছে। হাজার হোক, অনিক সুদর্শনও কম নয়। লম্বাচওড়া বলিষ্ঠ দেহ, চাঁছাছোলা দাড়িবিহীন শান্ত মুখটা দেখলেই যেকোন মেয়ে আড়চোখে একবার দেখতে ভুলেনা। দেখতে গোবেচারাব এই ছেলেটাকে এখন বৌ- সংসার ছেড়েই তার থাকতে হচ্ছে। হতে পারে শূন্যতাটা লঘু করতেই অহোরাত্র এমন সবাইকে মাতিয়ে রাখে। এতোদিনেও জুহির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি ঠিক আমি জানিনা। তবে তার আচার-আচরণে কিছুটা ভিন্নতা কমবেশি সবাই পর্যালোচনা করে। আগাগোড়া মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় অনিক’র বলা কথার সত্যতাটুকু টের পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। একেবারে বর্ণচোরা বলা যায়। অবশ্য প্রচ্ছন্ন বর্ণের খোলসটা উন্মুক্ত করার জন্যও আমি উৎসাহী নই। আমি আমার মতো বেশ আছি। সময় কাটানোর জন্য পর্যন্ত ঠিক আছে এরচেয়ে বেশি কিছু ভাবাও ধৃষ্টতা আমার জন্য। স্বর্ণাকে ফেরাবো কী করে সে নিয়েও দুশ্চিন্তার শেষ নেই আমার। মাঝে মধ্যে দশ কিম্বা পনের দিন পর ফোন দেয় সে। তার ফোনের অপেক্ষায় ডাঙায় লাফিয়ে পড়া নরমমনা মাছটির মতো ছটফট করতে থাকে আমার পুরো অন্তঃকরণ।শেষেমেশ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলেই মাছটা ছলাৎ করে জলে লাফিয়ে পড়ে আমার শরীরে প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে দিয়ে যায়। একটা বড় নিঃশ্বাসসমেত কথা শুরু হয় আমাদের। তাও অতি অল্প সময়। যতটা সময় ধরে হয় ততটা সময়-ই আমার মনের ঘুলঘুলি দিয়ে অনবরত ফিনফিনে শীতল বাতাস বইতে থাকে। সেই অনুভূতি আন্দাজের বাইরে।
ধীরে ধীরে আরো সময় অতিবাহিত হতে লাগল। জুহির ট্রেনিংয়ের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমাকে আরো ছ মাস থাকতে হবে ক্যাম্পে। কালই জুহিদের শেষ দিন এই ক্যাম্পে। এরপর হয়তো কোন থানায় কনস্টেবল পদে নিয়োগ করা হবে তাকে।
আজ জুহির ইচ্ছেতেই করো সঙ্গে না বসে একটু আগে আগে তার সঙ্গে বনের দিকে বেরিয়েছি। কয়েকদিন আগেই এমনটাই বলে রেখেছিল সে। চলে যাবে,তাই ফেলতে পারিনি।
দুজনে হাঁটছি বনের থরে থরে সাজানো গাছের ফাঁকে সরু পথ ধরে। এদিকটা পরিষ্কার করা হয়নি অনেকদিন। পাতা পড়ে বিছিয়ে গিয়েছে পুরো বনজুড়ে। সেই শুকনো পাতার উপর খচখচ শব্দে করে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি নিবিড় বনে। শীত শেষে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় এটা। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। গাছের পাতা নড়ছে না। বিকেলে সূর্যের মরা আলোটাকেও তেজের অবধি নেই। আমি কুলকুল করে ঘেমে চলেছি। একটু পর পর আঙুল দিয়ে কপাল নিংড়ে ঘাম চুইয়ে ফেলছি। জুহি সেই দৃশ্য দেখে অযথা নাক সিঁটকাচ্ছে। অথচ সেও ঘেমে নেয়ে একাকার। ট্রেনিং শেষে পুলিশি জামা পড়ে আসতে চেয়েছিল সে, কিন্তু আমিই তাকে কাপড় ছেড়ে আসতে বলি। গুলফাম একটা মেয়েলি টিশার্ট পরে আছে সে। পিঠের ঘাম চুইয়ে বিবর্ণ ধারণকরা টিশার্ট ঢাকতে চুলগুলো পিঠময় ছেড়ে দিয়েছে। এই প্রথম অদ্ভুত মোহ জাগানো খোলা চুলে দেখলাম জুহিকে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমানো ঘামগুলো সূর্যের তেরছা আলোতে হঠাৎ হঠাৎ ফিনিক ছড়িয়ে দিচ্ছিল দিকবিদিকে। অপ্সরীর মতো কোমল দেখাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে আমার পুরুষালী মন এক নিষিদ্ধ মায়ায় জড়াতে ইচ্ছে হলো। নিজেকে বুঝালাম। শুধু স্বর্ণাই আমার। অন্যের দিকে ধাবিত হওয়া চলবেনা। জুহি হঠাৎ বিরক্তিসূচক চ কারান্ত শব্দ করে অত্যাধিক গরম নিয়ে কিছু একটা বলতো গিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,
—- একটু পর পর ওমন করে তাকিয়ে কি দেখছেন বলুন তো।
এরকম অনুযোগ সচরাচর আমি শুনিনা। একটু বিচলিত হয়ে বললাম,
—– নাহ, এই ছ মাসে তো খোলা চুলে দেখিনি। তাই আজ দেখে একটু অদ্ভুত লাগল। তাই…
—- ওহহ তাই নাকি? তা কেমন দেখাচ্ছে? আগের’চে ভালো না খারাপ?
আমি একটু হেসে বললাম,
— শুনেছি মেয়েরা নিজেদের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে। আমি কি আর ভিন্ন কিছু বলতে পারি? ভালোই তো লাগছে। সুন্দর।
জুহি শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—- প্রশংসা করতে কে বলেছে? সত্যিটাই বলবেন আপনি।
—- সত্যিই তো সুন্দর লাগছে। কিন্তু সুন্দর লাগানোর জন্য তো তুমি চুল ছেড়ে দাও নি। কাপড় ঘামে জবজবে হয়ে গেছে তাই ছেড়ে দিয়েছ। কি মনে কর আমি বুঝিনা?
জুহি আরক্ত হয়ে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল,
—- এতোকিছু খেয়াল করতে কে বলেছে?
আমি ফিচেল হেসে বললাম,
—- করি নি তো। চোখে পড়েছে,আমার কী দোষ?
জুহি তখনো অন্যদিকে ফিরে কথা বলছিল। একপাশ দেখেই ভালো বোঝা যায় মিটিমিটি হাসছে সে।বলল,
—- পড়েছে ভালো কথা তাই বলে সেটা বলতে হবে কেন?মানুষকে লজ্জা দিতে ভালোবাসেন বুঝি আপনি?
বললাম,
—- নাহ মানুষকে লজ্জা দেওয়া, চটপট করে কথা বলা, আড্ডা মাস্তি করা আমার ধাতে নেই।
—- তবে? ফিরে তাকাল সে।
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে অনুরাগশূন্য কণ্ঠে বললাম,
—- তবে আর কি!কাল তো চলে যাবে। তাই একটু হাসি ঠাট্টা করে নিচ্ছি আরকি। এজন্মে আর দেখা নাও হতে পারে।
—- আপনি পূর্ণজন্ম বিশ্বাস করেন?
—- করিনা। কথার কথা আরকি।
—- ওহহ আচ্ছা।
—- হুমমম।

এরপর দু’জনে বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটলাম। কেউ যেন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা। নিজ নিজ অভিধানের সকল শব্দ অজানা কারণে বিস্মৃতের দারপ্রান্তে পৌঁছেছে। একটু পর সে ভারী করুণ গলায় বলল,
—- একসঙ্গে দুই জায়গায় মায়া লাগলে কী হয় জানেন?
কেন জানি মনে হলো এই মুহূর্তে এরকম আলোচনা কোনভাবেই সমীচীন নয়। এজন্য নিজেই অন্য প্রসঙ্গ ধরে বললাম,
—- তোমাকে কোন থানায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে? ঢাকার ভেতরেই? না বাইরে?
জুহি সেকথার ধারেকাছেও ঘেঁষলনা। বিমূঢ়ের মতো আমার দিকে কয়েক পলক নিরুদ্যমে চেয়ে থেকে বলল,
—- আমার কথার উত্তর দিন আগে।
আমি একটু থেমে বললাম,
—- কী হয়? জানি মায়া জিনিসটা খারাপ। কিন্তু কখনো ওরকম সিচুয়েশনে পড়িনি। তাই বলতে পারছিনা।
জুহি একটা মাটির ছোট দলা পা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
—- আপনি না খুব ভালো। সিনিয়র হয়েও আমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছেন। আমার খারাপ দিনগুলোতে আমার সঙ্গ দিয়েছেন। আপনার কাছে আমি ঋণী।
—– এতো তুচ্ছ ব্যাপারে ঋণী হবার কিছু নেই। তোমার সঙ্গতে আমারো তো একাকিত্ম ঘুচেছে। হিসাব সমান সমান।
জুহি কিছুক্ষণ কথা বলল না। একটু পর ধরা গলায় বলল,
—- বাকী ছ মাস মিস করবেন না আমাকে?
আমি একটা উদ্গত দীর্ঘশ্বাস প্রাণপণে চেপে গম্ভীর হয়ে মৃদু মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম,
—– হুমম,করব, করর…
এরপর আবার দুজনে চুপ। আবার শব্দভাণ্ডার খালি।
প্রদীপ্ত কণ্ঠে চমক ভাঙল আমার। জুহি অশ্রুসজল চোখে কঠিন গলায় বলল,
—- আসলে কি জানেন? আমরা জীবনটাকে যতোটা সোজা ভাবি জীবন আসলে ততটা সোজা না। আমি ভেবেছিলাম, চাকরি পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ, ট্রেনিং করব ছ মাস থেকে চলে আসব। ব্যস। ভেবেছিলাম মায়া জিনিসটা বাসায় ভাই আর মায়ের কাছে সংগোপনে রেখে এসেছি। কিন্তু না। সিন্দুক ফুঁড়ে সে আমার সঙ্গ নিল। চলে এলো এই পর্যন্ত। ইন্দ্রজালে বাঁধলো ক্যাম্পের এককোনায় ব্যারাকের কিছু মানুষকে। আপনি, অনিক ভাই, জহির ভাই, সাথী, শিরিন, সব্বাইকে… বলতে বলতে চোখভর্তি ঢলঢলে অশ্রু চোখ চেপে কপোলে গড়িয়ে দিচ্ছিল জুহি। আমি তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলাম। এটাও বুঝতে পারলাম মেয়েটার মায়া বেশি। এই ধরিত্রীতে যে পোড়াকপালের মায়া বেশি সেই মরেছে। দিবানিশি কপাল ঠুকে যদি এই মায়ার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যেত, তবেই তাদের শান্তি।

আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু নিঃশব্দে দু’জনের দশআঙুল এক করে হালকা চাপ দিয়ে শান্তনা দিলাম। কেন জানি আমার কঠিন মনটাও জুহির প্রস্থানের কথা ভেবে কাদার মতো কোমল, তরল থকথকে হয়ে গেল। বিশাল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে হৃদয়তটে হু হু বাতাসে মোচড় দিয়ে উঠছে হৃদপিণ্ডের এমুড়োওমুড়ো। ওভাবেই হাত ধরাবস্থায় ব্যারাকে ফিরে এলাম আমরা। কেন জানিনা হাতটা কোনপক্ষ হতেই ছাড়ার অনুমতি আসছিল না। না এ পক্ষ থেকে না ও পক্ষ হতে। দীর্ঘক্ষণ পরখ করলে দুটি মন একটি হাত বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, জন্মজন্মান্তর ধরে এভাবে আবধ্য দু’টি প্রাণ।
অবাক করা ব্যাপার, সেদিন প্রায় গভীর রাতেই স্বর্ণা ফোন দিল। চুপচুপি কথা বললাম। তবুও কেন জানি কোথায় একটা অশান্তি। স্বর্ণা আমার ব্যাপারটা ধরতে পারলো। আমি নানান ছলে বলে কৌশলে এড়িয়ে গেলাম। ছোট-বড় কোন বর্শিই আমার চোয়াল ফুঁড়তে পারলনা।
পরদিন সকালে মেয়েদের দলটি পূর্ণ প্রশিক্ষণ শেষে বিদায় নিল। যাবার বেলায় জুহি মুচকি হেসে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে বলল, কয়েকদিন পর যখন আমার কথা প্রায় ভুলতে বসবেন, আমি চাই, তখনই আপনি চিঠিটা পড়বেন। আসি…
দূর থেকে অনিক সেই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেল।

চলবে…