শেষ সূচনা পর্ব-০৮

0
236

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০৮
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। রাঁধুনির রান্না যতটা নিম্নমানের ভেবেছিলাম ততটা না। মোটামুটি বলা চলে। হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এলাম দুজনে। দলের অন্য সদস্যরা কেউ তখনো খাচ্ছে আবার কেউ এরিমধ্যে ট্রেনিং সেন্টার ঘুরতে বেরিয়ে গেছে সবার সাথে। আমি হাঁটছি জুহি মেয়েটার পিছুপিছু। ফায়ারিং রেঞ্জের ওখানে এসে থামল সবাই। একটা খোলা মাঠ এবং সেখানে ট্রেনিংয়ের কিছু যন্ত্রপাতি বসানো। পেছনে ঘন সুশৃঙ্খল বন। বনের বিপরীতেই একটা বড় পাহাড়। নিবিড় গাছপালার মধ্যে কোথাও কোথাও পাহাড়ের লালচে-সোনালি মাটি দেখা যাচ্ছে। ওখানেই ফায়ার করা হয়। যার কারণে সেখানে গাছপালা-অটবীর চিহ্নমাত্র নেই। যদিও-বা কোনকালে ছিল ফায়ারিং এর কারণে আজ তা গোড়া থেকে উন্মূলন হয়েছে।
সবাই যার যার মতো করে ঘুরতে লাগলো। মহিলা ট্রেইনাররা কেউ একা ঘুরছে, আবার কেউ কেউ আনকোরা পুরুষ সদস্যদের উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে। আমি কোনমতে ‘জুহি’ মেয়েটার নজর এড়িয়ে বনের দিকে হাঁটা ধরলাম। এই মুহূর্তে কোন মেয়ে সঙ্গ আমার ভালো লাগছিলনা। যতক্ষণ একটা মেয়ে নিজের আশপাশে থাকে ততক্ষণে নিজের ইচ্ছেমতোন চলাফেরা করা যায়না। তখন স্বেচ্ছাচারী শব্দটা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
ধীরপায়ে হাঁটছি ঘন সুশৃঙ্খল গাছপালায় ঢাকা বনের পথ ধরে। নাম না জানা কয়েক জাতের পাখি একনাগাড়ে কিচিরমিচির শব্দ করে খেলা করে যাচ্ছে। একটা আকাশি গাছের ফাঁক গলে শেষ বিকেলের স্বর্ণাভ সূর্যকিরণ তীর্যকভাবে এসে পড়েছে বনের আলুলায়িত ঘাসের উপর। সেই সোনালী রশ্মিতে কুয়াশাস্নাত ঘাসগুলো চিকচিক করে দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিপাশে। একটু তাকিয়ে থাকলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঢাকায় কুয়াশার দেখা না মিললেও এদিকটায় কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। বলাই দরকার, আমি অসম্ভব শীতপ্রিয় একজন প্রাণী। তবে এবারের শীতকালটা খুব একটা আনন্দদায়ক হবে না সেটা বুঝতে পারছি। ঐ টিনসেড দেয়া ঘরে শীতকালটা বড্ড এলোমেলো কাটবে এবার।
বনের একটু গভীরে যেতেই শরীরে শীত শীত অনুভূতি হল। আমি উদাসীন হয়ে দুইহাত পকেটে পুরে দিলাম।হঠাৎই শুকনো পাতার খচখচ শব্দে আমি সচকিতে পিছনে তাকালাম। বিস্ময়ে ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে রইলাম আমি। এই মেয়েটা এখানে কীভাবে এলো? আমি না তাকে এড়িয়ে চলে এলাম! ভূত-প্রেত না তো আবার!সূর্যের আলোটাও নিভু নিভু প্রায়। এটাই তো জ্বীন-পরীর আনাগোনার উপযুক্ত সময়! ভয়ে ত্রস্ত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তবু মুখে একটা ‘কিছু হয়নি, কিছু হয়নি’ ভাব এনে রাখলাম। মেয়েটা দূর থেকে সামনে এগিয়ে এলে আমি কানে কানে বলার মতো করে বললাম,
—–তুমি, এখানে কীভাবে?
মেয়েটি হেসে বলল,
—– আমিতো সেই শুরু থেকেই আপনার পিছনে ছিলাম। আপনি টের পান নি?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—- কই নাতো! — এরপর একটু সন্দিগ্ধ গলায় ভয়ে ভয়ে বললাম, “তুমি ভূত-টূত না তো? দেখি চিমটি কাটো তো আমার হাতে।
মেয়েটি একঝলক হেসে আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উলটো পিঠে চিমটি কাটল।
আমার সন্দেহ ঘুচলোনা। চিমটি দেওয়ার সময় হাতটা কেমন গরম গরম মনে হলো। মনে পড়ল, জ্বীন-ভূত তো আগুনের তৈরি!তাহলে… এও কি..?
—- নাহ আমিই চিমটি কাটব।- বলে নিজের কাছেই নিজের কণ্ঠটা বাচ্চাদের মতোন শোনাল। তবুও নাছোড়বান্দা আমি। জুহি হাত এগিয়ে দিলে আমি চিমটি কেটে চিন্তামুক্ত হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সে কটাক্ষে একবার আমার আপাদমস্তক চোখ ঘুরিয়ে বলল,
—– এই ইঁদুরের প্রাণ নিয়ে পুলিশ হবেন কী করে?
আমি ফিচ্ করে হেসে দিলাম। বললাম,
—- উঁহু, স্যার কী বলেছে শুনেছ? সিনিয়র-জুনিয়র মেইনটেইন! আর… আমার ছোটবেলায় একটা সমস্যা ছিল তাই একটু ভয় পাই। এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টার কিছু নেই।
ধূলিসাৎ প্রায় সম্মানের দড়িটা টানটান করে ধরতে ফস্ করে মিথ্যাটা বলে ফেললাম।
—- ওহহ আচ্ছা। সিনিয়র হন নি এখনো। হবেন। যখন হবেন তখন দেখা যাবে। এখন তো যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে আপনাদের ওখানে হাজির হতে হবে। আজকেই এসেছেন না!
—- ঠিকাছে চলো।
ফায়ারিং রেঞ্জের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আবার। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পথ চলে এসেছি। যেতে বোধহয় সন্ধ্যা পার হবে। খানিক আগে জ্বলজ্বল করা সূর্যটা ইতিমধ্যে পশ্চিমের বনে-বাদাড়ের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে। বন্য পাখিরা তাদের কলতান থামিয়ে যার যার নীড়ে ফিরে গিয়েছে। বাতাস শীতল। জুহি হাঁটছে আমার পাশাপাশি। একটু পরপর তাকাচ্ছে আমার দিকে। আড়চোখে আমি সেটা উপলব্ধি করতে পারলেও নিজস্ব নিয়ম বজায় রেখে চুপ করে রইলাম। সহসা নীরবতা ভেঙে জুহি বলল,
—- আপনার পরিচয় তো জানা হলোনা!
আমি না তাকিয়েই বললাম,
—- পরিচয় যে হতেই হবে তেমন কোন কথা আছে নাকি! আপনার দলের সবা-ই তো আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। সবাই কি আলাদা করে পরিচয় জানতে চাইছে তাদের কাছে?
আকর্ণ অপমানে কটকটে লাল হয়ে গেল মেয়েটার।তা দেখে আমি যেন পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। চোখেমুখে চাপা হাসির ছটা ফুটেছে আমার। সেই হাসি লুকাতে অন্যদিকে মুখ ঘুরালাম আমি। সে জড়িমা কণ্ঠে বলল,
—- না… জানতে চাইলাম আরকি…। না বললে নাই। এতো জোর কিসের। হু।
জুহির কথা শুনে অনেক্ক্ষণ পর মন খুলে হাসলাম আমি। ঠিক অনেকক্ষণ পর না। শেষ কবে মন খুলে হেসেছি সেটা আমারো অবিদিত। জুহি কৃত্রিম হাঁড়িপানা মুখ করে বলল,
—- ওমন ডাকাতের মতো হাসছেন কেন?
আমি হাসি থামিয়ে বললাম,
—- জানিনা, হাসি পেলে কী করার? আজ অনেকদিন পর মন খুলে হাসলাম। থ্যাংক্স!… আমি মিনহাজ আহমেদ। নিজ বাড়ি চট্টগ্রাম। থাকি ঢাকায়৷ একা। পড়াশোনা শেষ করলাম, দ্যান চাকরিতে এ্যাপ্লায়,, তুমি?
—- নাম তো জানেন। জুহি চৌধুরী। ঢাকাতেই স্থানীয়।বাবা নেই। এজন্য আমাকেই জীবন যুদ্ধে নামতে হয়েছে।
—- ওহহহ আচ্ছা। তবে এই বিষয়ে আমি একমত নই। আমি মনে করি, বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর, মেয়েরা ঘরের ভিতর। উপায় না পেয়ে যদি ঘরের বাইরে বেরুতেই হয় তাহলে তাদের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় পরেই বেরোনো উচিত।
তখন অন্ধকার নেমেছে। চলার পথটুকু বুঝা গেলেও মুখগুলো অস্পষ্ট। জুহি সেই অন্ধকারে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে ঢিমে হেসে বলল,
—- বেশ গোঁড়া মনোভাব আপনার। মেয়েরা এখন সব করে।
—- সব করতে তো নিষেধ করি নি। তাদের সৌন্দর্যটা কোথায় সেটা বুঝতে হবে। যাইহোক তোমাকে এসব বুঝিয়ে লাভ নেই। তুমি জীবন যুদ্ধে জয়ী হও এটাই চাওয়া।
একটু পর আমরা ব্যারাকের পাশে মাঠে ফিরলাম। তখন পরিদর্শক সবাইকে সামনে রেখে গুরুতর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে কি যেন বুঝাচ্ছিলেন। জুহি মহিলা ব্যারাকের দিকে চলে গেল। আমার উপস্থিতিতে বক্তা থমকালো একটু। সঙ্গে সবার উৎসুক দৃষ্টি পতিত হলো আমার দিকে।আমি কাছে আসতেই বক্তা সরলকণ্ঠে বললেন,
—- প্রথম দিনেই এতো অনিয়ম হলে চলবে কী করে? সবাই আছে অথচ আপনি হাওয়া খেতে নিজেই হাওয়া। এটা কোন কথা স্যার?
আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে যেতে বললাম,
—- স্যরি স্যার। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল বুঝতে পারিনি।
—- ঠিকাছে, দাঁড়াও এখানে এসে৷
আমি গিয়ে দলে ভিড়তেই তিনি সময় অপচয় না করেই আবার প্রাথমিক কিছু টিপস দিতে শুরু করলেন। প্রত্যেক সদস্য যখন মনোযোগ দিয়ে নিবিষ্টচিত্তে স্যারের অমোঘ বাণীগুলা শুনছিল অনিক দত্ত তখন আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অনর্থক সেই কুটিল হাসি আমার নিভু নিভু আগুনে যেন তুষ ঢেলে দিল। চোখ ফিরিয়ে উদ্গত রাগটা দাঁত খিঁচিয়ে দমন করলাম আমি৷

আধ ঘন্টাখানেক পরে প্রারম্ভিক কিছু কথা শুনে আমরা ব্যারাকে ফিরলাম। যে যার মতো ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। সুবিশাল আয়তকার ব্যারাক ঘর। ঘরের এককোণা থেকে শুরু করে অনেকগুলো নড়বড়ে সিঙ্গেল খাট। আমার সবসময় কোণার দিকের জায়গা পছন্দ। আমি একটু হেঁটে গিয়ে কোণার একটা খাটে ব্যাগ ফেলে ধুপ করে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে অসহায় খাটটা ‘কেঁচকোঁচ’ করে আর্তনাদ করে উঠল। জীবনভর আলিশান প্রসাদে থাকা এই আমি’কে এখন এই খাটে এক বছর থাকত হবে? দীর্ঘ এক বছর? সময়টা নেহাৎ কম নয়। ভাবতেই মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো। জীবনে ভাবতেই পারিনি এমন একটা সময় আসবে। ভাবতেই পারিনি যে আমি আর আমার একাকিত্ম কখনো আলাদা হবো। আমিতো ভেবেছিলাম নিঃসঙ্গতাতেই আমি নিলীন হয়ে আমরণ মোহ্যমানের মতোন জীবনযাপন করব। কিন্তু না, আজ আমার একঝাঁক মানুষ রয়েছে যাদের সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখের অনুভূতি আদানপ্রদান করতে পারব। আজ আমি একা নই। আসলে মানুষ যা ভাবে তা হয়না, যা কখনো ভাবে না তাই হয়ে যায়। মানুষের উচিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চুল না ঝরিয়ে বর্তমান, সমাগত দিনটার প্রত্যেকটা ক্ষণ,প্রত্যেকটা মিনিট, দারুণভাবে উপভোগ করা। কিন্তু আমি সেটা পারিনি। মদ-সিগারেট নিয়ে সময়গুলো পার করেছি। আজ ভুলটা সেটা হাড় হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। পাশের খাটটির কটকট যন্ত্রণার শব্দে চমকে ব্যথাতুর হয়ে তাকালাম। আমার চেয়ে দ্বিগুণ জোর দিয়ে ধুপপ করে পাশের খাটে বসলো অনিক। কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছাড়াতে ছাড়াতে একগাল হেসে বলল,
—- বস, আমি কিন্তু আপনার পাশে থাকছি। আসেন তোষক বিছিয়ে নিই।
বলে সে খাটের নিচ থেকে একটা তোষক টেনে বার বের করল। খাটের উপর তুলতে তুলতে বলল, একটু হেল্প করেন না বস,বিছিয়ে নিই। পরে আপনারটা বিছিয়ে দিব।
আমি দ্রুত ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললাম,
—- নাহ,আমি কোন চিড়িয়াকে হেল্প করিনা। তুমি ঐ লাইনের খাটে গিয়ে শোও,আমার পাশে না।
অনিক ছদ্ম-করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনী বুকের উপর রেখে গদগদকণ্ঠে বলল,
—– কী বললেন বস? আমি চিড়িয়া?
আমি একপাশে মাথা দুলিয়ে একদম শিওর হবার ভঙ্গিতে বললাম,
—– হ্যাঁ তা নয়তো কী? ফার্স্ট ক্লাসের চিড়িয়া তুমি। যাও যাও ঐ পাশে গিয়ে শোও। আমার রাতে বাতকর্ম ছাড়ি।
অনিক হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে আলুথালু তোষক সহ চিত হয়ে খাটে গড়িয়ে পড়ল। এরপর মিনিট-দুই হাসল ওভাবে। ব্যারাকের বাকী সদস্যরা হাঁ করে গিলছিল সেই দৃশ্য। মনে মনে তারা নিশ্চয় ভেবেছে, একটা হায়ার গ্রেজুয়েট, ম্যাচিওর্ড চিড়িয়া পেতে যাচ্ছে তারা। যে হাঁটতে বসতে একটা বছর তাদের হাসিতে মাতিয়ে রাখবে। অনিক হঠাৎই আবার হাসি থামিয়ে চিত্ থেকে উপুড় হয়ে বলল,
—- ভালো বলেছেন। আমার দশজন বন্ধুই আমাকে চিড়িয়া বলে। এমনকি এলাকার প্রত্যেকেই আমাকে জোকার হিসেবে জানে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
—- ঠিকাছে, থাকো। কিন্তু আমাকে বেশি ডিসটার্ব করবেনা। হইচই তে আমি অভ্যস্ত নই। তোমাকে সরাসরিই বলে দিলাম। কিছু মনে করোনা।
অনিক বোধহয় আবার হাসি চাপিয়ে বলল,
—- আমি আপনার পাশেই থাকব। এবং আপনাকেই ডিস্টার্ব করব। আমি উদ্ধার করব, আপনার এই গাম্ভীর্যতার কারণ কী!
আমি বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে মুখ ঝামটা মেরে বললাম,
—- ঠিকাছে,এখন অন্তত চুপ থাকো।
—- ওক্কে। – কৃত্রিম চুপ হবার ঢংয়ে মুখে আঙুল দিয়ে বলল অনিক।

তোষক বিছানো শেষে সবাই মিলে ঘরটা একটু পরিষ্কার করলাম। খ্যাতনামা চিড়িয়া অনিক আমার সঙ্গে নিশ্চুপের অভিনয় করলেও অন্যদের সঙ্গে ঠিকি নানান প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে। আমার এসব হৈচৈ ভালো লাগলনা বেশিক্ষণ। তাই ধীরপায়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনের অগোচরেই যখন মেয়েদের ব্যারাকের দিকে চোখ গেল তখন সল্প-চেনা একটা মূর্তি চোখে পড়লো আমার। আজকেই পরিচয় তার সঙ্গে। উজ্জ্বল-শ্যাম বর্ণের দারুণ ব্যক্তিত্ব স্ফুলিঙ্গের চপলা, মিশুকগোছের সেই মেয়েটি। আমাকে দেখেই দূর থেকে বললো,— খেয়েছেন রাতে?
আমি বললাম,
—- নাহ খাবো। তুমি খেয়েছ?
—- হ্যা খেয়েছি,আমি হাঁস-মুরগির সঙ্গেই খেয়ে নিই। বলে খিলখিল করে হেসে ব্যারাকে ঢুকে গেল জুহি। আমি হেঁটে পুকুরঘাটের দিকে গেলাম। হাত-মুখ পরিষ্কার করে পুকুরঘাটে খানিকক্ষণ সময় ঘরে বসে রইলাম। আজ পাকেচক্রে কেন জানি স্বর্ণার কথা বারবার মনে পড়ছে। তবুও আমি বোলশূন্য। এতোদিন তো বেশ ছিলাম তার সকল দুর্মতির কথা না জেনে। আজ জেনেও কি সব এতো তাড়াতাড়ি ভুলে থাকা সম্ভব? সম্ভব না। প্রতিমুহূর্তে তাঁর সকল বলা কথায় আমার ভিতরটায় গুমরে গুমরে কাঁদছে।

………………………………….

রাত দশটা পেরিয়েছে তখন। রুমের মধ্যিখানে দুই পাশে দুটি বড় কাঠের জানালা। আমার সুমুখের দেয়ালের জানালাটির একটি দুর্বল পাল্লা আধ-খোলা। অবসন্ন শরীরে কেউ বোধহয় সেদিকে খেয়ালই করেনি৷ জানালার লোহার শিকের ফাঁক গলে আমার দৃষ্টি সোজা চলে গেল দূর আকাশে। আজ আকাশটাও কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। চাঁদ নেই। নক্ষত্ররাও বিশ্রামে চলে গেছে। আকাশে পলকা মেঘ নিরুদ্দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোন স্থানে জমা হবার গুঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে। খাবার দাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে সবাই। সারাদিনের জার্নির ধকল শেষে সবাই এখন ক্লান্ত-শ্রান্ত। অল্পতেই ঘুম নেমে এলো সবার চোখজুড়িয়ে। কিন্তু আমার পাশে অবস্থিত চিড়িয়াটার ঘুম নেই। আমাকে জ্বালাতন করাই যেন তার একমাত্র কাজ।
অনেক্ক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে থাকার পর অনিক বলে উঠল,
—- ভাই ঘুমাবেন না?
আমি জানালার দিকে চোখ রেখেই বললাম,
— ঘুম এলেই ঘুমাব।
—- ঘুম না আসার কারণ কী? বাড়িতে বউ রেখে এসেছেন বুঝি? আহারে…। ভাবির ছবি-টবি আছে?
আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে পূনরায় আগে জায়গায় দৃষ্টি স্থাপন করে বললাম।
—- আমি কি বলেছি বাড়িতে বউ রেখে এসেছি?
—- বলতে হয়? ভাব দেখলেই বুঝা যায়। মনে হয় যেন হাজার বছর ধরে আপনি বউরে দেখেন না। বলেই অদ্ভুত এক গান ধরলো সে,

“মনে হয়, তোমাকে হাজার বছর ধরে দেখিনা
আমার এই শূন্যতা কে বুঝে গো সকিনা। ”

গান শুনে কয়েকজন কাঁথার নিচ থেকে মাথা তুলে আবার শুয়ে পড়ল। হালকা শীত পড়ার কারণে সবাই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছিল।
আমি তারস্বরে বললাম,— বললাম তো রে বাবা।আমি সিঙ্গেল। আমার কেউ নেই। আর এটা কেমন গান? জীবনেও শুনিনি।
—– ওরি বাবা এমন করে বললে যেন আমি মেয়ে। আমাকে সিঙ্গেল সেটা শুনিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রেম করতে নামার জন্য। আর,এটা আমার সৃষ্টি করা গান। আমি নিমিষে গান বানাতে পারি।
— ঠিকাছে গান বানাও তুমি, আমি ঘুমালাম। বলেই উল্টো পাশ ফিরে কাঁথা মুড়ি দিলাম।
সে কিছুক্ষণ গুঁতাগুঁতি, ডাকাডাকি করে শেষে হাঁপিয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে সবাইকে তাড়াতাড়ি উঠতে হলো। সচরাচর আমার এতো তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাস নেই। কিন্তু পড়ে পড়ে ঘুমানোরও অবকাশ নেই।
ব্রাশ হাতে নিয়ে কচকচ করে দাঁতে চালাতে চালাতে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটছিল সবাই। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে মাঠে উপস্থিত হতে হবে। আমি ঢিমেতেতালে হাঁটছিলাম। অনতিদূরে মেয়েদের দলটাকে দেখা গেল গোল হয়ে ব্রাশ করতে করতে কথাবার্তা বলছে। আমি সাদা বকের মতো গলা বাড়িয়ে জুহিকে খুঁজছিলাম। কেন খুঁজছিলাম জানিনা। মনের বিপরীতে আমি চলিনা। মনে কথাতেই হয়তো খুঁজছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠে ভেসে এলো,
—- ওখানে খুঁজে লাভ নেই। আমি এখানে।

আমি বিস্ময় নিয়ে পিছনে ফিরলাম। অবাক করা কাণ্ড। এই মেয়েটা আমার পিছনে কবে এলো? আশ্চর্য!

—- কখন আপনার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি। বড্ড খামখেয়ালি দেখি আপনি। কিচ্ছু খেয়াল করেন না। কাকচক্ষু দাঁতে ব্রাশের নরম শলাকাগুলো চালাতে চালাতে অস্পষ্ট গলায় বলল জুহি।
ঘুমঘুম চোখে আমি একটু হেসে বললাম,
—- শুভ সকাল। তুমি আমার পিছনে কী করছেন?
—- শুভ সকাল, আপনারা গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। আর কিছুনা।
— ও তাই নাকি।
— জ্বি।
জুহির পরনে একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট। আর ম্যাচিং করা একটা পায়জামা। বর্তমান যুগে যেটাকে প্লাজু বলা হয়৷ ঝুরঝুরে সিল্কি চুলগুলো এলো করে ছাড়ানো পিঠময়। মুখমণ্ডল কিঞ্চিৎ তৈলাক্ত। ঘুমে কাবু হওয়া চোখদ্বয়ে ফোলা ফোলা ভাব। গুলফাম ঠোঁটে আলগা পেস্ট লেগে আছে ছড়িয়ে। একসঙ্গে কমনীয় এবং মজাদার দেখাচ্ছিল তাকে।

যে যার মতো মুখ হাত ধুয়ে খেয়ে নিল। প্রথমদিনের ট্রেনিং হলো কোন ড্রেস ছাড়াই। কারণ শুরুতে সবার শারীরিক ফিটনেস ঠিক করা হবে ;এরপর মূল ট্রেনিং। এবং এতে প্রচুর পরিমাণে জটিল কাজগুলো করতে হয়। মোট তিনজন সিনিয়র অফিসার ট্রেনিংয়ের তত্ত্বাবধানে ছিল। আমাদের থেকে অল্প দূরেই মেয়েদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছিল। পুরোদমে এগিয়ে চলল প্রশিক্ষণ। একটা মজার বিষয় হলে, প্রশিক্ষণ মাঠের অনিক আর বাইরের অনিকের মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মাঠে সে সবার টপ বলা চলে। প্রত্যেকটা কাজের প্রত্যেকটা ট্যাগে সে এগিয়ে। যেন অনেক পুরোনো অভিজ্ঞ সে। মাঠে এসে এই পরিবর্তন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। কতকটা ঈর্ষান্বিত হয়েই সবাই পুরোপুরি ট্রেনিংএ মনোযোগ দিল৷ কিছু হিংসা আর ঈর্ষা মঙ্গলময় হয়।

প্রথমদিনের ট্রেনিং কিছুটা ছেড়ে ছেড়ে গড়িমসি করে চললো। তবুও নবাগতরা যথেষ্ট হাঁপিয়ে উঠেছে। বিকেলে কেউ আর হাঁটতে, ঘুরতে বেরোলো না। সবাই শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিল। আমিও তাই করলাম। একা তো আর ঘুরঘুর করার উপায় নেই। তখনি মনে পড়লো আমার জুহির কথা। কাল থেকে তো সেই আছে আমার সঙ্গে। হোক জুনিয়র। তবুও এই সুন্দর বিকেলটা নষ্ট করতে চাইনা। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। চিড়িয়া অনিক আমার পিছ ধরে বলল,
—– কই যাও? চলো একসাথে যাই।
আমি থেমে গিয়ে মুখটা কঠিন করে ধূর্ত হেসে বললাম,
—– বাথরুমে যাচ্ছি যাবে? চলো একসাথে যাই!
অনিক আমার আপাদমস্তক একবার দেখে বলল,
—- বাথরুমে একসাথে কেন? গে নাকি?
ধীরে ধীরে মনের মধ্যে একটা অসম বিরক্তি গাঁট বাঁধছিল। এবার সেই গাঁট বাঁধা হয়ে গেলে দৃপ্তকণ্ঠে বললাম,
—- ধুরর শালা, থাকো তো। গেলাম।
বলে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলাম আমি। পেছন থেকে শোনা গেল,
—- আজব, শালা হলাম কেমনে। আমার কিন্তু বোন-টোন নেই৷ বাপ-মায়ের একটা ছেলে আমি।

মনে মনে চিড়িয়াখানার জন্তুটার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে পুকুর ঘাটে এসে বসলাম। প্রশংসনীয় সাহস!আমাকে বলে কিনা গে! ছিঃ ছিঃ।

—- আপনার কী কোন কারণে মন খারাপ।

একটুখানি চমকালাম। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় আওয়াজের উৎসের দিকে আমার চোখদ্বয়কে সযত্নে পৌঁছে দিল। সন্ধ্যে হয় হয় এমতাবস্থায় কি কালকের মতো ভূত-প্রেত এলো নাকি! নাহ এতো সেই ভূত ভেবে বসে থাকা সুন্দরী প্রাণীটি অপর পাশের ঘাটে বসে আছে। ঘাটগুলোর দূরন্ত খুব একটা বেশি নয়।। কিন্তু তার মুখের উপর এমন বিষাদ,বিতৃষ্ণার ছায়া পড়েছে কেন? কিসে তার চপলা রূপটা কেড়ে নিয়ে হৃদয়ে ক্লেষের জলকল্লোল বইয়ে দিয়েছে? উচাটন মনে প্রশ্ন জাগলো। কিন্তু আগে আমার উত্তর দেয়াটা জরুরি। বললাম,
—- আমার মন সবসময় একটু খারাপই থাকে। ভালো থাকার কোন কারণ খুঁজে পাইনা তো তাই। কিন্তু তোমার মনটা খারাপ কেন?
—- মৃত বাবা আর অসুস্থ মায়ের কথা মনে পড়ছে।ছোট ভাই আছে অবশ্য ঘরে। কিন্তু সে ছেলেমানুষ, কতক্ষণ মায়ের সেবা করতে পারবে সে? —- সহজেই বলে দিল জুহি। যেন আমাদের বহুদিনের পরিচয় এবং আমাকে কথাগুলো বলার জন্য সে আকুল হয় আছে।
আমি নিজের উরুতে চাপড় মেরে খানিক উচ্চস্বরে বললাম,
—- হ্যাঁ,এজন্যই বলেছিলাম। মেয়েরা ঘরেই ভালো। হুহ! এসেছেন পুলিশ হতে। যাও ঘরে ফিরে মায়ের সেবা করো।
—- উপার্জন না করলে খাবে কী? ঘরেই যদি বসে থাকি।… কেন? কিছুদিন পর আপনার কষ্ট হবেনা আপনার পরিবারের জন্য ?
আমি শ্লেষ কটাক্ষে চেয়ে বললাম,
—- উঁহু, পরিবার থাকলেই তো। আপন কেউ থাকলেই তো! তবেই না কষ্ট হবার সুযোগ ছিল।

পশ্চিম আকাশের সূর্যটা ডগডগে লালবর্ণের গোলক পিণ্ডের আকার ধারণ করেছে। এবং এর আশেপাশের আকাশটা আলোহিত আভা দ্বারা ছেয়ে গেছে। ঘাট থেকে দৃশ্যটা একদম পরিস্ফুট। জুহি অন্যরকম স্বরে বলল,
— ওও… নেই? তাহলে সেই বিষয়ে আপনার কথা বলা মানায় না।… আপনার পরিবার কেন নেই সে ঘটনা অন্যদিন শুনব। আজ না।
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—- ঠিকাছে মন খারাপ করো না। বাসায় কথা বলো।কিছুটা ভালো লাগবে।
ঠিক তখনি আমার ফোনটা পকেটে বিপবিপ করে উঠল। অস্ফুটে ”অসময়ে কে ফোন দিল ” বলে ফোনটা বের করলাম আমি। অপরিচিত নাম্বার! ফোন রিসিভ করলাম কে হতে পারে ভেবে ভেবে। কানে দিয়ে বললাম,
— হ্যালো
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শুনা গেল এবং পরক্ষণেই মেয়েলী কণ্ঠের তরঙ্গ ফোনে ভেসে এলো,
— কেমন আছো?
ভ্রুকুটি করলাম আমি,
—- ভালো,কে বলছেন?
অনুদিত একটা শ্লেষাত্মক হাসি শোনা গেল। বলল,
—- চিনতে পারলেনা? নষ্টা মেয়েটাকে ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি!
কথাটা তীরের মতো এসে বিঁধলো আমার হৃদয়ে। আচম্বিতেই যেন এক ছটা রক্ত দৌড় দিতে চাইল হৃদপিণ্ডের আনাচে-কানাচেতে। অস্ফুটে বললাম,
—- স্বর্ণা!
— হুমমম স্বর্ণা।
আনন্দের আতিশয্যে আমি যেন দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম। আপ্লুতকণ্ঠে বললাম,
—- নাম্বার পেলে কোথায়?
—- পেয়েছি, নাম্বারের মতো তুচ্ছ জিনিস জোগাড় করা আমার কাছে কিছুই না। এই স্বর্ণা তো সেই অজ্ঞ স্বর্ণা না! বুঝলেনা।
— হুমমম বুঝলাম। তো তারপর… আমি তো ভেবেছিলাম…
কথার মাঝখানেই স্বর্ণা বলল,
—- একটা গুরুতর কাহিনী ঘটে গেছে।
আমি কথাটা সম্পূর্ণ না করেই ব্যগ্র হয়ে বললাম,
— কী কাহিনী?
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জুহির মুখের রংটা বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। উৎকর্ণ হয়ে আমার কথা শুনছে। চোখাচোখি হতেই নড়েচড়ে বসে চোখ ফিরিয়ে নিল সে।

চলবে….