শৈবলিনী পর্ব-৪৯+৫০

0
486

#শৈবলিনী—-৪৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★গালে হাত দিয়ে বসে আছে আদিত্য। অসহ্য বিরক্তিতে চিড়বিড় করছে সারা শরীর তার। এতোদিন পর নূরকে কাছে পেয়েছে। কোথায় সে তার বউয়ের সাথে একটু একান্ত মুহুর্ত কাটাবে। তানা এই ডাকাত দল এসে ওর শান্তি কেঁড়ে নিলো। সবগুলো কেমন আড্ডায় মেতেছে দেখ। তারা নাকি আজ এখানেই আস্তানা করার প্ল্যান করে এসেছে। পিকনিক করবে,আনন্দ উল্লাস করবে আজ সারাদিন। মানে আদিত্যর রোমাঞ্চের পুরো ফালুদা করার পরিকল্পনা করে এসেছে এরা। মন তো চাচ্ছে এদের রেখে আমিই নূরকে নিয়ে পালিয়ে যাই এখান থেকে। কিন্তু সেটারও উপায় কই! আমার মহান বিবিজানও এদের সাথে কি সুন্দর আড্ডায় মেতে গেছে। এখানে যে তার বরটা পুড়ছে তার কোনো খেয়ালই নেই জনাবার। আমাকে রেখে তার বান্ধবীর সাথে আলাপে মগ্ন। আমাকে যেন তার চোখেই পড়ছেনা। কি একটা বউ কপালে জুটলো। এমনে চলতে থাকলে আমার আর বাবা ডাক শোনার কপাল হবে বলে মনে হচ্ছে না।

নূর আহানা আর শিখার সাথে বসে কথা বলছে।তবে আরচোখে সে বারবার তাকাচ্ছে আদিত্যর পানে। আদিত্যর এই বেচারাপন দেখে হাসিতো অনেক পাচ্ছে নূরের তবে আবার মায়াও লাগছে। লোকটা কেমন মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কিন্তু নূর কি করবে? এভাবে সবার সামনে তো আর উঠে গিয়ে তার কাছে যেতে পারছেনা। নূরের অবস্থা দেখে শিখা মুখ টিপে হেসে আহানার উদ্দেশ্যে নূরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
–আহানা,আমরা বোধহয় এসে ভুল করেছি। বেচারা লাভ বার্ডস দুটোর রোমাঞ্চে ব্যাঘাত ঘটলো তাইনা?

আহানাও শিখার কথায় সায় দিয়ে নূরকে টিজ করতে লাগলো। নূর অপ্রস্তুত হয়ে আমতাআমতা করে বলল,
–আরে না না, কি যে বলিসনা তোরা! এমন কিছুই না।

–তোদের দেখেত তাই মনে হচ্ছে।

শিখা হঠাৎ উচ্চস্বরে জিদানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–এই শোনো না। চলতো একটু ছাঁদে যাই। ছাঁদ থেকে পুরো ফার্মহাউসটা দেখতে নিশ্চয় আরও ভালো লাগবে।

শিখার কথায় বাকিরাও উৎসাহ দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ চলো ছাঁদে যাই।

ছাঁদে যাওয়ার কথা শুনে একপ্রকার আৎকে উঠলো নূর আর আদিত্য। দুইজন একসাথে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
–নাআআআআআ…

ওদের চিল্লানিতে সবগুলোর পিলে চমকে গেল। চোখ বড় বড় করে আতঙ্কিত চোখে সবাই তাকালো আদিত্য নূরের দিকে। জিদান বুকে এক দলা থুতু ছিটিয়ে আচম্বিত কন্ঠে বলল,
–এহনি আমার পরাণ ডা জাম্প দিয়া বেড়িয়ে আসতো স্যার। এভাবে চিল্লানোর কি হলো স্যার? ছাঁদেই তো যেতে চেয়েছে, মঙ্গলগ্রহে তো যেতে চায়নি। এভাবে উত্তেজিত হওয়ার কি আছে?

আহানাও বলে উঠলো,
–হ্যাঁ ভাইয়া, ছাঁদে যেতে মানা করছ কেন তোমরা?

আদিত্য থতমত কন্ঠে বলল,
–ওই আসলে, বৃষ্টিতে ছাঁদে পিচ্ছিল হয়ে আছে। পড়ে যেতে পারিস তোরা। তাই ছাঁদে যাওয়া যাবে না।

নূরও আদিত্যর সাথে সায় দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, ছাঁদে যাওয়ার দরকার নেই। তারচেয়ে বরং বাইরে সুইমিং পুল আছে,বিশাল গার্ডেন আছে সেখানে ঘোর। ছাঁদে দেখার কি আছে। ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।

এই পর্যায়ে দুই হাতে ভীড় ঠেলে দ্য মহান আবির এগিয়ে এলো আদিত্যর সামনে। এক ভ্রু উঁচু করে তীব্র সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আদিত্যর দিকে। সিআইডির এসিপি প্রদিয়মান-এর মতো আদিত্যর মুখের সামনে হাতের পাঁচ আঙুল নাচিয়ে বলল,
–কুছ তো গড়বড় হে দয়া। তুই ছাঁদে কেন যেতে দিচ্ছিস না আমাদের? সত্যি করে বল আসল ঘটনা কী? তুই কাউকে খু,ন করে ছাঁদে লুকিয়ে রাখিসনি তো? সেই কারণে আমাদের যেতে নিষেধ করছিস তাইনা? এখনতো আমরা যেয়েই ছাড়বো। তদন্ত তো করতেই হবে তুই কী ঘোটালা করেছিস?

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–ফালতু প্যাচাল বন্ধ কর।বললাম না ছাঁদে যাওয়া যাবে না, ব্যাস যাবে না।

আবির এবার তার সেনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–সৈন্যরা? রেডি? ওয়ান, টু,থ্রি এন্ড হামলা…….
বলেই একসাথে সবগুলো রেসের মতো প্রাণপণে দৌড়ালো ছাঁদের দিকে। আদিত্য আর নূর তাদের থামানোর উদ্দেশ্যে পিছে পিছে ছুটলো। কিন্তু ওই হামলাকারীদের থামাতে পারলোনা তারা। সেনার দল ছাঁদে এসেই থামলো। ছাঁদে এসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে যা দেখলো তাতে সবগুলোর মুখে দুষ্টু হাসি প্রতীয়মান হলো। আদিত্যর মাথায় হাত। নূরতো লজ্জায় পারেনা ছাঁদ ভেঙে মাটির নিচে ঠেসে যেতে। আবির বাঁকা হেঁসে বিদ্রুপের সুরে বলল,
–ওওওও আচ্ছা? তো এই কথা?

জিদান তার বুদ্ধিমত্তার প্রণাম দিয়ে বলল,
–কি কথা স্যার? আর আপনার কথা অনুযায়ী তো এখানে কোনো খু,ন টুন হয়েছে বলে মন হচ্ছে না।

আবির দুষ্টু হেঁসে বলল,
–আরে জিদান মিঞা খু,নতো হয়েছে। এখানে কাল রাতে বিড়াল মারা হয়েছে বুঝেছ?

–কেন স্যার? বেচারা বিড়াল কি দোষ করেছে যে সবাই তাকে মারতে বলে? জানেন আমার বন্ধুরাও না আমার বিয়ের রাতে বিড়াল মারতে বলেছিল। কিন্তু সারারাত খুঁজেও একটা বিড়াল পেলাম না স্যার। সকালের দিকে যাও একটা পেলাম তাকে দেখে আমার খুব মায়া হলো। তাই আর মারতে পারলাম না। আমার আবার অনেক দয়ার মন।

–আরে জিদান মিঞা তুমি গর্দভের গর্দভই থেকে গেলে। বিড়াল খোঁজার চক্করে বাসর রাত পার করে দিলে? তোমারে যে তোমার বউ এহোনো ল্যাংড়া, লুলা কইরা দেইনাই এইডাই হাজার শুকুর।

শিখা নূরের কাঁধে খোঁচা দিয়ে বলল,
–তাহলে এই কারণেই বুঝি আসতে দিচ্ছিলি না? রাতে তোদের রাসলীলার চিহ্ন রয়ে গেছে যে।
ব্যস আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা নূর। এই লজ্জাজনক অবস্থা থেকে বাঁচতে দৌড়ে চলে গেল। আদিত্য আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
–নে, দিলিতো আমার বউটাকে লজ্জায় ফেলে। হলোতো এখন শান্তি তোদের? এখন ময়নাতদন্ত শেষ হলে চল সবাই এখান থেকে।

হাসতে হাসতে নেমে এলো সবাই নিচে। শুধু অমালিয়া থেকে গেল। বোনের জন্য তার অনেক প্রশান্তি লাগছে। শেষমেশ ওর বোনটা সুখের ঠিকানা তো পেল। আমার জন্য আপু আর ভাইয়া অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। তাদের মাঝে সব ঠিক ঠাক দেখে মন থেকে যেন একটা ভারী বোঝা নেমে গেল অমালিয়ার। আমার জীবন তো যা হওয়ার হয়েই গেছে। কমছে কম আপুতো সুখে থাক। সুখী হওয়াটা ও ডিজার্ভ করে। গত কয়েকদিন তার বোনের কষ্ট দেখে নিজেরও অনেক কষ্ট হচ্ছিল তার। মনে মনে দোয়া চাইছিল আদিত্য নূরের মাঝে যেন সব ঠিক হয়ে যায়।খুব চিন্তা হচ্ছিল বোনের জন্য। তাইতো যখন আবির সবাইকে নিয়ে এখানে আসার প্ল্যান করলো তখন আর মানা করেনি। ওদের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে কিনা সেটা দেখতেই এখানে এসেছে ও। নাহলে এই ফার্মহাউসে সে কখনোই আসতো না। যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে নির্মম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই ফার্মহাউসেই তার জীবন লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। যদিও এখানকার কোনোকিছু তার ভালো করে মনে ছিলোনা। তবে পরে ও জানতে পারে এটাই সেই জায়গা। আর এটা জানা সত্বেও এখানে আসাটা ওরজন্য কতো কঠিন ছিলো তা কেবল ওই জানে। তবুও সে বোনের খবর জানতে মন শক্ত করে এখানে এসেছে। এখন সবকিছু ঠিক দেখে মনটা যেন হালকা হলো অমালিয়ার। অমালিয়ার চোখ গেল ফুলে সাজানোর দোলনাটার দিকে। উদাস মনে এগিয়ে গেল সে সেদিকে। দোলনার দড়ির সাথে পেঁচানো ফুলগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো। মনটা হঠাৎ ভীষণ বিষন্ন হয়ে উঠলো তার। বিয়ে,স্বামী, সংসার নিয়ে তারও কতো শখ, কতো স্বপ্ন ছিল। হঠাৎ ঝড়ে যেন সব তছনছ করে দিলো। এসব ভেবে চোখ ভরে উঠল অমালিয়ার। হঠাৎ ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো কেউ। অমালিয়া তাকিয়ে দেখলো, আদ্র। টিস্যু নিলোনা অমালিয়া। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আঙুল দিয়ে চোখ মুছে নিলো সে। আদ্র বলে উঠলো,
–জানি আমি তোমার মনের পুরুষ কখনো হতে পারবোনা। তবে একটা কথা বলতে চাই। মন থেকে ক্ষমা চাইলে নাকি উপর আল্লাহও একসময় মাফ করে দেন।আইনও মানুষকে শুধরানোর সুযোগ দেয়। ক্ষমা মহৎ গুণ। একবার আমাকে ক্ষমা করে দেখ। ওয়াদা করছি, দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো হাসব্যান্ড না হতে পারলেও একজন ভালো বন্ধু হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। প্লিজ, একবার শুধু আমাকে রে,পি,ষ্টের নজরে না দেখে সাধারণ একটা ব্যাক্তির চোখে দেখ। দেখবে দুজন দুজনার ভুলগুলোকে কাটিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করতে পারবো। একবার ভেবে দেখ আমার কথা প্লিজ।

কথা শেষ করেই চলে গেল আদ্র। অমালিয়া পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আদ্রর দিকে। সেকি সত্যিই পারবে সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে?
__

পুল সাইডে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। মাটিতে চুলো খুঁড়ে, বিশাল পাতিলে গরুর মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্নার কাজ চলছে। সবাই মিলেই রান্নার কাজে সাহায্য করছে। সবার মাঝেই এক খুশিময় আমেজ বিস্তার করছে। আদিত্যরও যে এসব খারাপ লাগছে তা না।তবে সে তার বউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করার সুযোগ পাচ্ছে না এটাই তার আপসোসের কারণ। আহানা কিছুক্ষণ রান্নার কাজে একটু সাহায্য করে দিয়ে এসে পুলের পানিতে বসে থেকে একটু রিল্যাক্স করছে। কিন্তু আহানার আরাম হারাম করার জন্য সেখানে এসে টপকালো, আবির। আহানার পাশে এসে বসেই বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,
–কিরে বয়ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড কে অনেক মিস করছিস নাকি? চাইলে ডেকে নিতে পারিস। হাতে হাতে নাহয় তোদের বিয়েটাও সম্পূর্ণ করে দিবো। কতদিন আর ডেটিং করে শুধু শুধু বিল বাড়াবি?

আবিরের এই বিদ্রুপাত্মক কথায় আজ আহানার রাগ আর ঘৃণার থেকে বেশি কষ্ট হলো। কোথাও খুব তীব্র আঘাত হানলো। আহানা ব্যাথিত চোখে তাকালো আবিরের পানে। বেদনার্ত কন্ঠে বলল,
–আপনি কোন জনমের বদলা নিচ্ছেন আমার কাছ থেকে? আমার জানামতে তো আমি কখনো আপনার সাথে তেমন খারাপ কিছু করিনি। তাহলে আমাকে কীসের শাস্তি দেন এভাবে? জানেন, আমি একটা বইয়ে কিছু পড়েছিলাম। “কোনো এক জায়গায় এক জনগোষ্ঠী বাস করতো। তারা কোন গাছকে মেরে ফেলতে চাইলে, তারা গাছটাকে কাটতো না।বরং সবাই একসাথে সেই গাছের নিচে জড়ো হয়ে যেত। আর ইচ্ছেমতো গা,লি দিতো, অভিশাপ করতো। আর দেখতেই দেখতে গাছটা একসময় নিজেই মরে যেত।” বুঝতে পেরেছেন গল্পের মর্মটা? না বুঝতে পারলেও আপসোস নেই। আপনার কাছ থেকে আর আশাই কি করা যায়!

কথা শেষ করেই উঠে চলে গেল আহানা। আবিরের হঠাৎ কেমন অস্থিরতা অনুভব হতে লাগলো। বুকের বামপাশে কিছু একটা তীব্র ভাবে জ্বলতে লাগলো। গলা শুঁকিয়ে আসছে হঠাৎ। এই আন্নি আজ কীসব আবোলতাবোল বলে গেল। এসব বলার মানে কী হ্যাঁ? তুই আমার কথায় ঘৃণা দেখাবি, তুই কেন এসব বলবি ? বেয়াদব একটা। বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে এসব শিখেছে নিশ্চয়। আবির অস্থির হয়ে সি,গা,রে,ট ধরাতে নিলেও পারলোনা। কেমন যেন সব প্রচন্ড অস্থিরতায় এলোমেলো যাচ্ছে ওর। বুকটা ভীষণ খা খা করছে তার। পানি খাওয়ার জন্য উঠে গেল দ্রুত।

দূর থেকে এসব পর্যবেক্ষণ করলো নূর। কাজের মাঝেই হঠাৎ চোখ যায় ওদের দিকে। এদের মাঝে কোনো কাহিনি আছে বুঝতে পারলো নূর।তবে সেটা যে স্বাভাবিক কিছু না তাও বুঝতে পারলো সে। আহানার চোখের কষ্ট তার নজরে ঠিকই পড়েছে। এদের মাঝে কি সমস্যা হয়েছে জানতে হবে। কারণ দুজনেই যে কষ্টে আছে তা বুঝতে পারছে নূর। কোনোভাবে যদি এদের কষ্ট দূর করা যায় তাহলে খারাপ কি।
__

জিদান একটু ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজনে ভেতরের রুমে এলো। হঠাৎ শিখা জিদানকে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে দিলো। তারপর জিদানের উপর আধশোয়া হয়ে দুষ্টু ভঙ্গিতে তাকিয়ে শিখা চোখ টিপ দিলো। জিদান বেকুবের মতো বলে উঠলো,
–এই শিখা,তোমাকে কি ভুতে ধরেছে? এভাবে আক্রমনাত্মক হলে কেন আমার সাথে? দেখ আমাকে মেরোনা প্লিজ। আমি রোজ তোমার পা টিপে দিবো। তোমার কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে দিবো। যা বলবে তাই করবো। তাও আমাকে মেরোনা প্লিজ। চলো তোমাকে মটকা বাবার কাছে নিয়ে যাই। সে তোমার মধ্যে থেকে সব ভূত পে,ত্নী ছুমন্তর করে তাড়িয়ে দিবে।

শিখা রাগতে নিয়েও আবার রাগলো না।সে তো জানেই তার বরটার স্ক্রু ঢিলা। তাই হাসি বজায় রাখার চেষ্টা করে বলল,
–ধ্যাৎ!কি যে বলোনা। আচ্ছা শোনো না,আজ ছাঁদের নূর আর আদিত্য ভাইয়ার রোমান্টিক আয়োজন দেখে আমারও না কিছু কিছু হচ্ছে। তোমার হচ্ছে না?

জিদান বলে উঠলো,
–হ্যাঁ হচ্ছে তো আমার।

শিখা খুশি হয়ে বলল,
–কি হচ্ছে হুম?

–আমার না পিঠে চুলকানি হচ্ছে। আর গ্যাস্টিকও হচ্ছে। সকাল থেকে টক ঢেকুর আসছে। বমি বমিও পাচ্ছে? আমি আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলাম নাতো?

শিখা এবার না রেগে আর থাকতে পারলোনা। মানে এমন একটা পায়জামা মার্কা জামাই ওরই কপালে জোটার ছিলো! শিখা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–একটা কথা বলোতো, তুমি কি ছোট বেলায় মাথায় কোথাও চোট পেয়েছিলে নাকি এটা জন্মগত ট্যালেন্ট? পুরো মুডটার রফাদফা করে দিলে। ধুৎ!

বলেই উঠে গেল শিখা। জিদান বেচারা এখনো বুঝতে পারছে না তার বউ হঠাৎ রাগলো কেন? বউটারে সত্যি সত্যিই বোধহয় ভূতে ধরেছে। মটকা বাবার কাছ থেকে তাবিজ আনতেই হবে। শিখা একটা ব্যাগে আজকের পিকনিক পার্টির জন্য কিছু ড্রেস এনেছিল। সেখান থেকে একটা একটা করে জিদানকে দেখিয়ে বলল,
–আচ্ছা বলোতো এর ভেতর থেকে কোনটা পড়বো।

জিদান প্রথমে একটা দেখিয়ে বলল,
–এটা ভালো লাগবে। এটা পড়ো।

শিখা বলল,
–কিন্তু এটার সাথে তো ম্যাচিং ইয়ার রিংস নেই।

জিদান আরেকটা দেখিয়ে বলল,
–তাহলে এটা পড়ো।

শিখা বলল,
–কিন্তু এটাতে আমাকে মোটা দেখাবে।

এভাবে কয়েকটা দেখানোর পর শিখা নিজে একটা সিলেক্ট করে বলল,
–হ্যাঁ এটা ঠিক আছে। আমি বরং এটাই পড়ি।

জিদান বলল,
–তুমি যখন নিজেই সিলেক্ট করবে তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করলে কেন? শুধু শুধু আমাকে খাটালে।

শিখা বলল,
–আসলে মা বলেছে সবসময় সব বিষয়ে স্বামীর কথা শুনবি। তাই তোমার রায় নিচ্ছিলাম। কিন্তু মাতো আর বলেনি যে স্বামীর কথা মানতেও হবে। সে-তো শুধু শুনতে বলেছিল তাই শুনলাম। বলেই হাসলো শিখা। জিদান কনফার্ম হয়ে গেল তার বউয়ের মধ্যে ভূতের পুরো জনগোষ্ঠী এসে হাজির হয়েছে। মটকা বাবা,আমি আসছি।
__

নূর কিছু মসলা নেওয়ার জন্য বাসার ভেতর রান্নাঘরের দিকে এলো। ওখানে একটু কম পড়ে গিয়েছিল তাই নিতে এসেছে। রান্নাঘরের দরজায় আসতেই হঠাৎ একটা হাত এসে ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। নূর হকচকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো এটা তারই দুষ্টু মিঃ নায়ক টা। আদিত্য নূরকে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। নূর চমকে উঠে বলল,
–আরে কী করছ? এসব কেমন পাগলামি?

আদিত্য নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নেশাময় কন্ঠে বলল,
–এসব ভালোবাসার পাগলামি। নিজের বউকে কাছে পাওয়ার পাগলামি। সেই সকাল থেকে একটুও কাছে পায়নি তোমাকে। আমার কেমন লাগছে তা কেবল আমিই জানি। তুমিতো মনের আনন্দে মজা করছ। একবারও এই অধমের কথা মনে হয়নি তোমার। একটুও মায়া নেই আমার জন্য তোমার।

নূর আমতাআমতা করে বলল,
–আমি কি করবো? সবার সামনে এভাবে তোমার কাছে কীভাবে আসবো? এমনিতেই ছাঁদের ব্যাপার নিয়ে সবাই টিজ করছে। তার ওপর সবার সামনে এভাবে এলে আরও খেপাবে।

–খেপানোর কি আছে? তুমি তোমার নিজের বরের সাথেই রোমাঞ্চ করছ অন্য কারোর সাথে তো আর না। কি একটা কপাল আমার। মানুষ অন্যের বউকে নিয়ে ইচ্ছেমত রোমাঞ্চ করে বেরায়। আর এক আমি, নিজের বউয়ের সাথেও মন খুলে একটু রোমাঞ্চ করতে পারিনা।

আদিত্যর এমন আপসোস পূর্ণ কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো নূর। আদিত্য চোখ কুঁচকে বলল,
–অনেক মজা নেওয়া হচ্ছে তাইনা? এখুনি মজা নেওয়া বের করছি। সকালে আমার অসম্পূর্ণ কাজটা এখন পূরণ করবো।
বলেই আদিত্য নূরের অধর পানে ঝুঁকতে লাগলো। নূর চোখ বড় বড় করে বলল,
–এই না না প্লিজ, দেখ কেউ চলে আসবে। পাগলামো করোনা। প্লিজ ছেড়ে দাও।

–আসুক যে আসার। আমার মর্নিং কিস বাকি আছে। সেটা এখন নিয়েই ছাড়বো।
বলেই আবারও এগুতে লাগলো সে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই নিবে, ঠিক তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে শিখা নূরের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। নূর হকচকিয়ে উঠে ঝট করে সরে গেল ওখান থেকে। আর বেচারা আদিত্যের নাকটা গিয়ে দেয়ালে গুতা লাগলো। আদিত্য নাক ধরে আবারও আপসোস করতে লাগলো। কোন জনমের বদলা নিচ্ছে এরা? সবগুলো যেন আমার রোমাঞ্চের দুশমন হয়ে গেছে। দেখে নিবো সব কয়টারে।

চলবে…..

#শৈবলিনী—৫০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★পিকনিক আর সারাদিনের হৈ হুল্লোড় শেষে রাতে সবাই মিলে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। যদিও আদিত্যর এসবে এক বিন্দুও ইন্টারেস্ট নেই। তারতো কেবল তার বউটাকে একটু একলা চাই। কেউ ওর বউটাকে একটু একলা ছাড়ে না কেন ভাই? এবার তো ধৈর্যের মা বোন হয়ে যাচ্ছে তার। মনতো চাচ্ছে সবগুলোকে উষ্ঠা মেরে আটলান্টিক মহাসাগরে পাঠিয়ে দিতে। অসভ্যের দলগুলো এসে জুটেছে কপালে। আদিত্য সবার থেকে ছাড়া পেতে বলে উঠলো,
–আচ্ছা এখন অনেক তো আড্ডা হলো। এবার সবাই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমারও অনেক ঘুম পেয়েছে। চলো নূর আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
বলেই পাশে বসে থাকা নূরের হাত ধরে ওকে উঠে আসার ইশারা করলো। কিন্তু কুটিল আবির তা হতে দিলেতো। সে ফোড়ন কেটে বলে উঠলো,
–লাহোল বিল্লালের পুত, কি কস এইগুলা! আমরা কি এইখানে ঘুমাইতে আইছি! আরে মাত্র তো রাত শুরু হলো। আভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হে মেরে দোস্ত। আমাদেরতো সকাল পর্যন্ত পার্টি করার প্ল্যান। কোনো ঘুমানোর কাহিনি চলবেনা আজ। ঘুমানো ইজ নট এলাউড। হোয়াট সে গাইস?

বাকিরাও আবিরের সাথে সায় দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–ইয়েস। আজকে পার্টি অল নাইট হবে।

আদিত্যর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম। এখন কি রাতভর তাকে এই ফালতু মজলিসে বসে থাকতে হবে? এ কেমন অবিচার। গলা ছেড়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে আদিত্যর। ওর অবস্থা বুঝতে পেরে সবাই মিটমিট করে হাসছে। আদ্র আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
–কিন্তু আবির ভাই, প্ল্যান কি সোটাতো বলো। মানে আমরা এখন করবোটা কি?

ওয়েল আমরা প্রথমে একটা গেম খেলবো। সবাই বলো কি গেম খেলা যায়? শিখা বলে উঠলো,
–আমরা বালিশ ঘোরানো গেম খেলতে পারি। মিউজিকের সাথে আমরা বালিশ পাস করবো। যার কাছে মিউজিক বন্ধ হবে তাকে যা করতে বলা হবে তাকে তাই করতে হবে।
সবাই শিখার আইডিয়া টা পছন্দ করলো। অতঃপর শুরু হলো বালিশ খেলা। মিউজিকের সাথে সাথে সবাই বালিশ পাস করতে লাগলো। কিন্তু আদিত্যর এসবে মন নেই। সেতো তার নিজের কারসাজিতে ব্যাস্ত আছে। সবার অগোচরে আদিত্য নূরের সাথে একেবারে চেপে গিয়ে বসলো। তারপর পেছন থেকে বাম হাত টা উঠিয়ে নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। হকচকিয়ে উঠলো নূর। আদিত্যর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
–কি করছ, ছাড়োনা প্লিজ। কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?

নূরের কথায় আদিত্যর কোনো ভাবান্তর হলোনা। বরং সে উল্টো আরো কামিজের নিচ দিয়ে খোলা কোমড়ে স্লাইড করতে লাগলো। কেঁপে উঠছে নূর। কিন্তু সবার সামনে নিজেকে ছাড়াতেও পারছেনা। অগত্যা ওভাবেই বসে বসে আদিত্যর অত্যাচার সহ্য করতে লাগলো। খেলা চলছে আপন গতিতে। প্রথমে বালিশ থামলো জিদানের কাছে। জিদানকে টাস্ক দিতে চাইলো শিখা। সে বলল জিদানকে শিখার রুপের প্রশংসা করে একটা কবিতা বলতে হবে।জিদান উঠে দাঁড়িয়ে আত্মগর্ব করে বলল,
–এটাতো আমার বা হাতের খেল। এখুনি শোনাচ্ছি শোনো।
“যখন তুমি সাদা শাড়ি আর লাল টিপে সেজে বের হও,
মা কসম দেখতে পুরো অ্যাম্বুলেন্স মনে হও।
যখন তুমি সবুজ শাড়ি লাল টিপে সেজে বের হও,
মা কসম দেখতে পুরো ট্রাফিক সিগনাল মনে হও।
আর যখন রেগে গিয়ে যখন তুমি অগ্নিমূর্তি হয়ে যাও,
মা কসম পুরো শেওড়া গাছের পেত্নীকে হার মানাও।

জিদানের এই আলট্রা প্রো লেভেলের বেকুব মার্কা কবিতা শুনে সবগুলো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আবির হাতে তালি বাজিয়ে বলল,
–ওয়াহ,জিদান মিঞা ওয়াহ! কি দিলা! তুমি মিঞা ভুল প্রফেশনে চলে এসেছ। আরে তোমার তো কবি হওয়ার দরকার ছিল। হুমায়ুন আহমেদও ফেল তোমার সামনে। নোবেল টা তোমার কাছে আসার জন্য নিশ্চয় কান্তাছে।

জিদান আবিরের কথায় গর্ববোধ করে বলল,
–থ্যাংক ইউ স্যার। এসবতো ওই আমার ছাগলের দুধ খাওয়ার গুণ। কখনও অহংকার করিনি।

সবাই মজা নিলেও শিখা চোখ গরম করে দাঁত কটমট করে তাকালো জিদানের দিকে। যেন বলছে,জিদানের বাচ্চা তুই বাসায় চল তারপর আসল পেত্নীর রুপ দেখাবো তোকে। খেলা আবার শুরু হলো। এবার বালিশ ঠেকলো আহানার হাতে। আহানাকে টাস্ক দিলো আদ্র। সে আহানাকে বাবলুর অভিনয় করে দেখাতে বলল। আহানা উঠে দাঁড়িয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়াল। আদ্রর উদ্দেশ্যে বলল,
–আচ্ছা শোন ভাইয়া, ধর তুই বাবা। তো তুই এখন আমাকে কিছু আনতে বা করতে বল যেমন বাবা বাবলুকে বলে সবসময়।
আদ্র রাজি হয়ে ওর বাবার মতো করে বলল,
–এই বাবলু আমার পাম্প টা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করার কিছু আনতো।
আহানা বাবলুর মতো করে রোবটের মতো হেঁটে এসে বলল,
–এইযে সাব, লইয়া আইছি।
–কি এনেছিস?
–সাব এইযে স্যানিটারি মিস্ত্রি লইয়া আছে। ওরা সব ধরনের পাম্প ঠিক করে দেয়। আপনের পাম্পও ঠিক করে দিবে।
–ওই গাধার বংশধর, আমার আস্থমার পাম্পের কথা বলেছিলাম। সেটার জন্য তুই স্যানিটারি মিস্ত্রি নিয়ে এলি! তুই জীবনেও একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারবিনা? গাধা কোথাকার।

–হ্যাঁ হ্যাঁ বলেন,পাইছেন তো খালি আমারেই। নিজেই কইলো কিছু নিয়ে আসতে। আবার নিয়ে আসলাম তাতেও দোষ। আপনি নিজেই তো কথায় টিকে থাকেন না। আবার আমারে কন গাধা।

আহানার অভিনয় দেখে আবারও হাসলো সবাই। বাবলুর কমতি যেন পুরন করে দিলো আহানা। খেলা আবারও শুরু হলো। এবার আদ্রর কাছে ঠেকলো। আদ্রকে টাস্ক দিলো আবির। আদ্রকে ছোটবেলার কোনো ফানি ইন্সিডেন্ট বলতে বলল। আদ্র বলতে লাগলো,
–ছোটবেলায় একবার আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাসায় তালা লাগানো। ভাবলাম হয়তো মা বাইরে গেছে। আমি ততক্ষণে পাশের বাসার আন্টির বাসায় গিয়ে সময় কাটাতে চাইলাম। আন্টি আবার আমাকে খুব স্নেহ করতো। তো আমি যাই সেখানে। কিন্তু বাসায় ঢুকেই দেখি আন্টির সাথে অন্য একটা লোক ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলো। লোকটা উনার হাসব্যান্ড না। কারণ তাকে আমি চিনতাম। যাইহোক তখন তো আর আমি এসব বুঝতাম না৷ তো আমি বোকার মতো বলে উঠলাম “আন্টি আপনারা কী রেসলিং রেসলিং খেলছেন? আমাকেও নিন না খেলায়। আমি রেফরি হবো।” আমার কথায় তারা প্রচুর ঘাবড়ে গিয়ে নিজেদের ঠিক করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আন্টি আমাকে বলল, আমি যেন এখানে যা দেখেছি তা তার স্বামীকে না বলি। তাহলে তিনি আমাকে অনেকগুলো চকলেট দিবেন। আমি মাথা ঝাকিয়ে রাজি হয়ে যাই। একটু পরেই উনার হাসব্যান্ড আসে। উনি কিছুটা সন্দেহ করতে পারে। আমাকে জিজ্ঞেস করে এখানে কেউ এসেছিল কিনা। আমি আবারও বোকার মতো বলে উঠি, ” না এখানে কিছু হয়নি । এখানে ওই লোকটাও আসেনি। আর আঙ্কেল আন্টি রেসলিং রেসলিং খেলেছিল না। আমি এসব কিছু আপনাকে বলবো না। তাহলে আন্টি চকলেট দিবে না” ব্যাস তারপর আর কি। বাকিটা ইতিহাস।

আদ্রর কাহিনি শুনে আবারও হাসির রোল পড়ে গেল। না চাইতেও অমালিয়াও হেঁসে দিলো। যা দেখে খুশি হলো আদ্র। আজ প্রথম সে মেয়েটাকে হাসাতে পেরেছে। এটাই পরম পাওয়া তার জন্য। খেলা আবারও স্টার্ট হলো। এবার ঠেকলো নূরের কাছে। নূরকে আদিত্য টাস্ক দিবে বলল।সে বলল,
–নূর,তুমি আজ গান শোনাবে আমাদের। তোমার কন্ঠে শুধু ঝাড়িই শুনেছি। আজ একটু গান শোনাও।

নূর ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল,
–কি বলছ এসব? গান আর আমি! ইম্পসিবল। প্লিজ আমার দ্বারা সম্ভব না। এসব গান টান আমি জীবনেও গাইনি। আমি পারি না।

–আরে সবাই গান পারে। শুরু ইচ্ছে থাকতে হয়। গাওনা প্লিজ।
বাকিরাও আদিত্যর সাথে সায় দিয়ে নূরকে গান গাওয়ার দাবিতে স্লোগান করতে লাগলো। নূর না পেরে বলে উঠলো,
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করছি। তবে প্রমিজ করো কেউ গান শুনে হাসবে না।

সবাই প্রমিজ করলো। নূর গলা ঝেড়ে গাওয়া শুরু করলো,
♬ আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়
♬ আমরা করবো জয় একদিন।
♬ আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়
♬ আমরা করবো জয় একদিন

নূরের গান শুনে সবগুলো নির্বিকার ভঙ্গিতে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর সবাই একসাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আদিত্যও নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলোনা। মুখের হাসি ফুসস করে বেড়িয়ে গেল। নূর আদিত্যর বাহুতে কিল মেরে বলল,
–এখন হাসছ কেন? আমি এইজন্য বলেছিলাম গান গাইবোনা। আমি পারিনা গান গাইতে। এখন হাসা বন্ধ করো। নাহলে গলা টিপে ধরবো।

আদিত্য কোনরকমে নিজের হাসি থামিয়ে বলল,
–সমস্যা তোমার গাওয়া নিয়ে না। তুমি ভালোই গাও। কিন্তু এই সিচুয়েশনে কেউ এমন গান গায়? যেন কোনো স্কুলের প্যারেড হচ্ছে এখানে।
–হ্যাঁ তো কি করবো? আমি কি গান বাজনা শুনি নাকি। ছোটবেলায় এই গানটা গেয়েছিলাম তাই এটাই পারি।

এভাবে খেলা চলতে থাকলো। একেক জন একেক ধরনের বিনোদন দিতে লাগলো। সবার শেষে এলো আবিরের পালা। আদিত্যর ঠোঁটে সয়তানি হাসি। এবার এসেছে উট পাহাড়ের নিচে। এখন বদলা নিবে আদিত্য। ওর রোমাঞ্চ নষ্ট করার কঠিন প্রতিশোধ নিবে সে। আদিত্য বললো আবিরকে টাস্ক সেই দিবে। আদিত্য বাঁকা হেঁসে বলল,
–তোকে ডান্স করতে হবে।

আবির তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–এটাতো আমার বা হাতেরও না, মাত্র এক আঙুলের খেল।

আদিত্য বলল,
–আগে পুরোটা শুনেতো নে মেরে লাল। তোকে শিলা কি জাওয়ানি গানে আইটেম ডান্স করতে হবে। তাও আবার মেয়ে সেজে। আমার না তোকে ওভাবে দেখতে ভীষণ মন চাচ্ছে।

আবির ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
–এই কি বলসিছ এসব! তোর নজর ঠিক লাগছে না আমার কাছে। মতলব কি তোর হ্যাঁ? আমার মাঝে তুই শিলা কি জাওয়ানি দেখতে পাস?
আবির নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–ভাবি আপনার হাসব্যান্ড এর ক্যারেক্টর কিন্তু আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। জলদি কিছু করেন।আমার মাঝে নাকি সে শিলা কি জাওয়ানি দেখতে পায়। এইটা কোনো কথা!

আদিত্য বলল,
–এসব ড্রামা করে কোনো লাভ হবে না। জলদি টাস্ক কমপ্লিট কর। আর না করতে পারলে সবার সামনে কান ধরে বল, মাফ চাই, গু খাই।

আবির এটিটিউট দেখিয়ে বলল,
–মাফ চাইবে আবির! নো চান্স। ঠিক আছে, এ আর এমন কি। এখুনি দেখাচ্ছি তোদের।
আবির উঠে দাঁড়িয়ে নাচার প্রস্তুতি নিতে নিলে আদিত্য বলে উঠলো,
–আরে দাঁড়া, আগে তোকে সুন্দর করে রেডিতো করতে দে। গার্লস, আবিরকে একটু সুন্দর করে রেডিতো করো তোমরা।
শিখা আর অমালিয়া উঠে গিয়ে আবিরকে মেকআপ করে তাকে আইটেম ডান্সের জন্য প্রস্তুত করলো। আবিরের গায়ের টিশার্ট টা উপর দিকে তুলে ভাজ করে ব্লাউজের মতো বানিয়ে দিলো। ওড়না প্যান্টের উপর দিয়ে পেঁচিয়ে পড়িয়ে পুরোপুরি তৈরি করে দিলো। আবিরের এই আবতার দেখেই সবগুলোর হাসতে হাসতে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম। মিউজিক প্লেয়ারে শিলা কি জাওয়ানি গান ছাড়া হলো। আবির একদম ক্যাটরিনার মতোই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে লাগলো। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে আবেদনীয় ভঙ্গিমা করতে লাগলো। সবগুলোর এবার হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা। এতো হাস্যকর জিনিস দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একেক টা। ডান্সের এক পর্যায়ে আবির আদিত্যর কাছে এগিয়ে এলো। আইটেম ডান্সারের মতো আদিত্যকে সিডিউসড করে নাচতে লাগলো। আদিত্যও পিছিয়ে থাকলো না। সেও উঠে গিয়ে আবিরের সাথে নাচা শুরু করে দিলো। যেমনটা মুভির হিরো আইটেম ডান্সারের সাথে নাচে, সেই ভঙ্গিতে নাচতে লাগলো আবিরের সাথে। আদিত্যর দেখাদেখি বাকি ছেলেগুলোও উঠে গেল। সবগুলো একসাথে উড়াধুরা নাচতে লাগলো। মেয়েরা শুধু এসব দেখে হাসতে লাগলো।

নূরও ওদের দেখে হাসছিল।ধীরে ধীরে একসময় তার নজরের সীমানায় শুধু আদিত্যই দৃশ্যমান হলো। আদিত্যর ওই হাসিমাখা উচ্ছ্বসিত মুখে নজর আটকে রইলো তার। হাঁটু ভাজ করে তার উপর থুতনি ঠেকিয়ে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলো ওই সুদর্শন পুরুষের মুখপানে। কতো সুন্দর প্রফুল্লিত দেখাচ্ছে তাকে। হাসলে কতোনা সুন্দর লাগে তাকে। চোখের শুভ্রতায় যেন তারার ঝিলমিল করছে।হাসিতে তার গালে পড়া ওই টোলটা আরও বেশি মনকাড়া। আর এই হাসিটাকেই একসময় কেঁড়ে নিয়েছিলাম আমি। কতো অবজ্ঞা করেছি তাকে। কতো কষ্ট দিয়েছি। অথচ এতকিছুর পরও এই ব্যক্তিটি শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোই বেসে গেছে আমাকে। এই লোকটা আমার জীবনে আজ সুখের রাজ্য এনে দিয়েছে।যে সুখের কখনো কল্পনাও করিনি আমি। কখনো যে সুখের স্বপ্ন দেখতেও ভয় হতো। তাইতো সবসময় নিজেকে দূরে রাখতাম এসব থেকে। ভাবতাম এসব আমার জন্য না। হয়তো আমার ভাগ্যে এসব নেই। কিন্তু আজ সেই না দেখা স্বপ্নই বাস্তবে রুপ দিয়েছে এই লোকটা। অসীম ভালোবাসা দিয়ে এই সামান্য নূরকে করেছে অসামান্য। আমাকে করে দিয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী। এতো সুখের কি যোগ্য আমি? তার এই অসীম ভালোবাসার পরিবর্তে কি দিতে পারবো আমি তাকে? এসব ভেবে অজান্তেই চোখ ভরে উঠল নূরের। এই অশ্রু সুখের,অনাবিল খুশির। আজ যেন নতুন করে প্রেমে পড়ছে নূর। সেই কিশোরী মেয়ের প্রথম প্রেমে পড়ার মতো অনূভুতি হচ্ছে নূরের। এই প্রেমিক পুরুষের প্রেমে নিজেকে ভাসাতে মন চাইছে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেমিকের সাথে অচেনা দেশে পালিয়ে যাওয়ার মতো প্রেম হচ্ছে। প্রেমিকের সাথে বৃষ্টিতে ভিজে একগুচ্ছ কদম ফুল নিয়ে নাচার মতো প্রেম হচ্ছে। এসব আবেগের প্রগাঢ়তা নূরের চোখে আনন্দ হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বিমোহিত, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে ওর নব্য প্রেমিকের পানে। যারজন্য প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পুরো পৃথিবী ভুলে যেতে চায় নূর।

আদিত্য সবার সাথে নাচে মশগুল ছিলো। হঠাৎ ওর চোখ গেল নূরের দিকে। নূরের ওই বিমোহিত চোখের নজর আর চোখের অশ্রু সবই নজরে পড়লো তার। আদিত্য হঠাৎ ভীড় থেকে সরে এগিয়ে গেল নূরের দিকে। কোনকিছু না বলে সোজা নূরের হাত ধরে টেনে দ্রুত পায়ে নিয়ে যেতে লাগলো উপরের দিকে। নূরও বিনাবাক্যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আদিত্যর পানে তাকিয়ে থেকে তার সাথে যেতে লাগলো। বাকিরা সবাই এহেন কান্ডে হতবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো। কতক্ষণ পর আবির বলে উঠলো,
–ছ্যা ছ্যা, কি বেশরম আজকালকার পোলাপান। এতগুলা মাইনষের মধ্যে কেমন বউরে উঠায় নিয়ে গেল! এসব দেখার আগে চোখে চশমা কেন পরলাম না।

জিদান বলে উঠলো,
–কষ্ট পায়েন না স্যার। স্যারের মনে হয় জোরে বাথরুম চাপছে। তাইতো এমনে গেল। নাইলে কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে গেলে তো বিষয় টা দুর্গন্ধপূর্ণ হয়ে যেত। আর ম্যামকে নিয়ে গেল যাতে বাথরুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে। স্যার একা একা বোর হয়ে গেলে ম্যাম গান গেয়ে উনাকে এন্টারটেইন করতে পারবে। যদিও ম্যামের গান শুনে মনে হয় না স্যারের এন্টারটেইন হবে।বরং প্রেসার আরও মাঝপথে আঁটকে যেতে পারে।
জিদানের কথায় আরও একবার হেঁসে দিলো সবাই।

আদিত্য নূরকে সোজা রুমে নিয়ে এসে দরজা আঁটকে দিলো। নূর এখনো কেমন বিমোহিত নজরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে আদিত্যর পানে। আদিত্য রুমের ভেতর এসে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
–কি হয়েছে প্রাণপাখী, কাঁদছিলে কেন তুমি? বলো আমাকে কি হয়েছে তোমার?

নূর এখনো নির্বিকার, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখছে আদিত্যকে। যেন দেখার শেষ হচ্ছে না তার। চোখের ভেতর শুষে নিতে চাচ্ছে আদিত্যকে। নূরের নিরবতা দেখে আদিত্য আরও উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে নূরের। নূর একই ভাবে অপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল আদিত্যর দিকে। আদিত্যর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসানী কন্ঠে বলল,
–প্রেম হয়েছে। প্রেমে পড়েছি আমি। প্রথম প্রেমের সুখময় অশ্রু এটা।

কথাটা বলে নূর আবেদনময় এক হাসি দিয়ে অন্য দিকে সরে গেল। আদিত্য পেছন থেকে নূরের হাত ধরে মোহময় হেঁসে বলল,
–আচ্ছা? তো কে সে? কার প্রেমে পড়েছ শুনি?

নূর পেছনে না ঘুরেই দুষ্টু করে মুচকি হেসে বলল,
–আছে একজন? অনেক সুদর্শন, অনেক আকর্ষণীয় সে। দেখলে শুধু দেখতেই মন চায়।

আদিত্য নিচের ঠোঁট কামড়ে নীরব হেঁসে বলল,
–তাই নাকি? সে কি আমার চেয়েও সুন্দর?

–হ্যাঁ অবশ্যই। কোথায় তুমি আর কোথায় সে। তার সাথে তো কোনো তুলনায় চলে না তোমার। সে সবথেকে সেরা, সবচেয়ে সুদর্শন, সবচেয়ে মোহময়,সবচেয়ে মনকাড়া। দিন থেকে রাত ফুরাবে, রাত থেকে দিন হবে তবুও তার প্রসংশা করে শেষ করা যাবে না। সে আমার সেরা প্রেমিক পুরুষ।

আদিত্য এবার বাঁকা হেঁসে নূরকে টান দিয়ে নিজের বুকে ফেলল। পেছন থেকে নূরকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ নিয়ে বলল,
–স্বামীর সামনে নিজের প্রেমিকের প্রসংশা করছ? এতবড় দুঃসাহস তোমার! এই ঘোর অপরাধের জন্য শাস্তিতো তোমাকে দিতেই হবে। ভয়াবহ শাস্তি।
বলেই নূরের কানে আলতো করে কামড় দিলো আদিত্য। ঘাড় কাত করে লাজুক হাসলো নূর। আদিত্য একটু ঝুঁকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো নূরকে। নূর লুকিয়ে পড়লো আদিত্যর বুকের মাঝে। বাইরে সবাই লাউড মিউজিক বাজিয়ে নাচগানে মত্ত। আর ভেতরে দুটো ভালোবাসাময় যুগ্ম মন তাদের পূর্ণতায় মত্ত।

চলবে…..