শ্যামারণ্য পর্ব-০২

0
368

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০২
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

লোহার শিকের গেইটটিতে সামান্য ধা’ক্কা দিতেই চাঁপা আর্ত’নাদ করে খুলে গেলো গেইটটি। নির্জন নিস্তব্ধ এই পরিবেশে সেই আর্ত’নাদ অনেকটা অশুভ শোনালো।
দুরু দুরু বুকে এগিয়ে যায় শ্যামা সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়িটা বেশ বড় জায়গা নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। একসময়ে হয়তো কোনো জমিদার বাড়ি ছিলো,এমন একটা ভাব রয়েছে। আশেপাশে বিভিন্ন রকম গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা,তার মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। গেইট থেকে বাড়িটা কাছে মনে হলেও বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় শ্যামাকে সেই পথ ধরে। এক সময় সে গিয়ে পৌছায় বাড়ির মূল ফটকের সামনে।
সামনের কয়েক ধাপ সিড়ি ডিঙিয়ে যাওয়ার পর দড়জা দেখতে পায় সে। বিশাল কালো কাঠের দড়জা,সেখানে খোদাই করা রয়েছে কিছু অদ্ভুত নকশা,এমন ডিজাইন সে আগে কখনো দেখেনি।
হবে হয়তো কোনো প্রাচীন নকশা,বাড়িটা তো কয়েক যুগ আগেই বানানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেসব কিছু আমলে না নিয়ে বুক ভরে একবার শ্বাস নিয়ে দড়জায় হাত দিতে যাবে তখনি হুট করে খুলে যায় দড়জাটি।

ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে পিছিয়ে যায় শ্যামা। পরে তার বয়সী একটি মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামা। মেয়েটি যে তারই মতো ইন্টারভিউ দিতে এসেছে সেটি তার অবয়ব দেখে বুঝতে সময় লাগলোনা।
মেয়েটিও তাকে হঠাৎ দড়জার সামনে দেখে চমকে গিয়েছিলো,পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সেও ধাতস্থ হয়। মেয়েটা একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত শ্যামাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর একটি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
“ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন বুঝি?”

শ্যামাও মেয়েটিকে ঠিক এই প্রশ্নটি করতে চেয়েছিলো,কিভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছিলো না। ভালোই হলো মেয়েটি নিজ থেকেই এই প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। তাড়াতাড়ি জবাব দেয় সে,
“হ্যা,আপনিও কি তাই?ইন্টারভিউ কেমন ছিলো?”

“কিসের ইন্টারভিউ,এক নাম্বারের ফ্রড এগুলো। এদের সবকিছুই অনেক আজিব। দরকারে পরে এসেছিলাম এতোদূর। কিন্তু এদের মতিগতি ভালো ঠেকছেনা আমার কাছে। আমার আগের আপুটা আমাকে বলেছিলো,সাবধান করেছিলো,আমি শুনিনি। ভেবেছিলাম উনি উনার কম্পিটিশন কমানোর জন্য আমাকে ভুলভাল বলেছেন।কিন্তু এখন বুঝেছি তিনি ঠিকই বলেছিলেন,শুধু শুধু সময় নষ্ট করেছি এখানে এসে। আপনাকেও সাবধান করে দিলাম আপু,এখন শোনা না শোনা আপনার ব্যাপার। আমি গেলাম,এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।”
এই বলে দ্রুত পায়ে হেটে চলে যায় মেয়েটি সেখান থেকে।

শ্যামার মেয়েটির কথা বোধগম্য হতে কিছু সময় লাগলো। পরক্ষণে মাথায় আসে, মেয়েটির থেকে ভালো করে জেনে নেওয়া হয়নি কি হয়েছে ভিতরে,কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে। তাই আর কথা বলার সুযোগ সে পেলোনা।
দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে দোটানায় পড়ে যায় শ্যামা। প্রথমে স্টেশনের লোকটি,এখন এই মেয়েটি…. নাহ,ধরতে গেলে শুরু থেকেই ব্যাপারটা গোলমেলে ছিলো। অজানা আশঙ্কায় তার মন কু ডাক দিচ্ছে। তার কি ফিরে যাওয়া উচিত? কথাটি মাথায় আসতেই পরক্ষণে ভাবনাটি ঝেড়ে ফেলে দেয় মাথা থেকে। নিজেকে প্রবোধ দেয়,
‘শক্ত কর নিজেকে শ্যামা। তুই কবে থেকে এতো ভীতু হলি? ভুলে যাসনা তুই এখানে কেনো এসেছিস। এটা একমাত্র রাস্তা বাবাকে বাঁচানোর। ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।’

নিজের মনোবল দৃঢ় করে দরজায় মৃদু আঘা’ত করে শ্যামা। কয়েকবার আঘা’ত করার পরেও যখন কেউ দড়জা খোলেনা,তখন সে দড়জায় সামান্য ঠেলা দেয়,তাতে দড়জা সামান্য ফাঁক হয়। সে এবার একটি নিঃশ্বাস নিয়ে পুরোপুরি দরজাটি খুলে ভিতরে প্রবেশ করে।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথে একটি দমকা শীতল হাওয়া শ্যামাকে ভেদ করে চলে যায়। এক মুহুর্তের সেই হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় তার পুরো শরীরে। সেখানেই জমে যায় শ্যামা। তার হঠাৎ ভয় হচ্ছে খুব। এমনটা কেনো মনে হচ্ছে বুঝতে পারছেনা সে।
ঘরটিতে মৃদু বাল্বের আলো জ্বলছে,জানালার সবকটা পর্দা টানা,বাইরের আলো এখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। দমকা হাওয়াটি তাহলে কোথা থেকে এলো?
মৃদু আলোয় সে আশেপাশে এই বাড়ির কাউকে খুজতে লাগলো কিন্তু কাউকেই সে দেখতে পেলোনা ঘরটিতে। কিন্তু এখানে প্রবেশের পর থেকেই মনে হচ্ছে এক জোড়া চোখ তার উপর প্রতিনিয়ত নজর রেখে চলেছে। মনে হচ্ছে তার প্রতিটি গতিবিধি,প্রতিটি অভিব্যক্তি,এমনকি তার প্রতিটি হৃদ স্পন্দন লক্ষ্য করছে সে দৃষ্টি।

“আপনিও কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?”

চরম উৎকন্ঠায় বিচলিত শ্যামা হঠাৎ অপরিচিত কন্ঠস্বরের কথাগুলি শুনে আঁতকে উঠে। চমকে সেদিকে তাকায় সে।
দেখতে পায় বসার ঘরের কোনার সোফাটাতে বসে আছেন একজন লোক। বয়স ৭০ বা তার বেশিতো হবেই। মুখের বলিরেখা গুলো বয়সের ছাপ স্পষ্ট বহন করে,মাথায় চুল তেমন নেই বললে চলে,তার সাথে রয়েছে এক গাল সাদা দাড়ি যা তার পেট অবদি ঠেকেছে। চোখের নিচে গর্তের মতো হয়ে কালি জমেছে,তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনেহচ্ছে যেনো কত রাত ঘুমান না। পরনে তার অদ্ভুত এক আলখেল্লা যা তার পা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। লোকটি বেশ অদ্ভুত।

লোকটির আকস্মিক আগমণ তার মনের সূক্ষ্ম চিন্তার রেখাগুলো গুলো আরও গাড়ো করে তোলে। উনি কি এখন এলেন নাকি শুরু থেকে এখানেই ছিলেন?যদি উনি এখানেই ছিলেন তাহলে একটু আগে সে দেখতে পেলোনা কেনো?আর যদি এখন এসে থাকেন তাহলে সে তার উপস্তিতি বুঝতে পরলোনা কেনো? এমনকি এখনো,লোকটি তার সামনে বসে আছে,তাকে চোখে দেখতে পারছে,কিন্তু তার উপস্তিতি সে এখনো বুঝতে পারছেনা,যেনো লোকটি তার সামনে থেকেও নেই সেখানে।তার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরছে। কিন্তু সেগুলো করার সাহস সে পেলোনা। তার প্রশ্নগুলো তার নিজের কাছেই হাস্য’কর মনে হচ্ছে। তাকে না পরে পা’গ’ল ভেবে ইন্টারভিউ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। সে মনে মনে ভেবে নেয় হয়তো মৃদু আলোয় সে কোনার দিকটা ভালো করে খেয়াল করেনি।সে নিজেকে সংযত করে উত্তর দেয়,
” জ্বি,আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি।”

লোকটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে,তাকে একবারও পলক ফেলতে দেখেনি সে এই পর্যন্ত। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অস্বস্তিতে পড়ে যায় শ্যামা। লোকটি যেনো তার অন্তর ভেদ করে তার সব গোপন কথা জেনে নিচ্ছেন তার দৃষ্টির মাধ্যমে। লোকটি হঠাৎ চোখ সরিয়ে সামনের সোফার দিকে ইশারা করলেন। তারপর বললো,
“আপনি বসুন,আমি আসছি।”
এই বলে লোকটি উঠে দোতলার দিকে চলে যায়।

এতোক্ষণ ধরে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করে শ্যামা। টলতে টলতে গিয়ে বসে সোফার উপর। এখানে এসেছে বেশি সময় হয়নি,এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তার মনে হচ্ছে যেনো কত যুগ কেটে গেছে। মনটা কেমন অস্থির হয়ে আছে তার। সে মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের আশপাশটা ভালোভাবে দেখতে থাকে।

এই ‘নির্জনা কুঠি’ নামের বাড়িটি দোতলা বিশিষ্ট একটি বিস্তৃত বাড়ি। বাইরে থেকে অনেক পুরোনো মনে হলেও ভেতরটা বেশ পরিপাটি। সেই কাঠের দরজা,ঘরের আসবাবপত্র,মাথার উপরের এই ঝারবাতিটাতেও একটা আভিজাত্যের ছোয়া রয়েছে। দেখেই বোঝা যায় এই বাড়ির মালিক বেশ শৌখিন আর নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক। এতো ধনী ঘরের লোক এভাবে পাত্রী খুঁজছেন কেনো?তাও কালো যুবতী মেয়ে,উনিতো চাইলেই অনেক সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পারেন। কথাগুলো মাথায় আসতেই থমকে যায় শ্যামা। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে শুধু অপারেশনের টাকা যোগাড় করা ছিলো,দুদন্ড বসে ব্যাপারটা ভাবার সময় হয়নি তার। কিন্তু এখন ভাবনাগুলো স্পষ্ট হতেই মনে অদৃশ্য ভয় দানা বাধতে শুরু করে তার।

আচ্ছা এরা কোনো মানব’পা’চারকারী দল নয়তো?এভাবে প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েদের নিয়ে বিক্রি করে দেয়না তো?পরক্ষনেই মাথা নেড়ে ভাবনাটি বাদ দিলো সে। নাহ,এমন হলে আগের মেয়ে দুটো এই বাড়ি থেকে বেরোতেই পারতো না। তাহলে এর রহস্য কি হতে পারে?পাত্রের মধ্যে কি তাহলে কোনো খুঁত আছে?বয়স বেশি বা কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত?নাহ আর ভাবতে পারছেনা শ্যামা। হাতের উপর মাথা ভর দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

বাইরে সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই,ভেতরে মৃদু আলো গুলো পুরোপুরি আলোকিত করতে পারেনি বাড়িটি। চারদিকে আলো-আধারের ছায়ার মাঝে কোনো বিপদ লুকিয়ে নেই তো? সে একজন যুবতী মেয়ে,এভাবে ভরসন্ধ্যায় একটি অজানা অচেনা নির্জন বাড়িতে বসে আছে,সে কোথায় আছে তার পরিবারের কেউ জানেনা। এইখানে তার কিছু হলে কেউ জানতেও পারবেনা। কিন্তু এতোদূর এসে তার খালি হাতে ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছেনা।

মনের দুশ্চিন্তায় যখন নিজের ভাবনায় ডুবেছিলো,তখনি সেই লোকটির গলা আবার শুনতে পায় সে। মাথা তুলে তাকাতেই লোকটিকে সামনের সোফায় বসে থাকতে দেখতে পায় সে। অথচ লোকটি কখন ফিরে এলো আর কখনি বা তার সামনে এসে বসলো সে বুঝতেও পারেনি। তাই হঠাৎ তার আওয়াজ শুনে হকচকিয়ে যায় সে,কিন্তু তার চেয়ে বেশি চমকে উঠে তার বলা কথাটি শুনে।

“মনিবের আপনাকে পছন্দ হয়েছে। আপনি উত্তীর্ণ হয়েছেন ইন্টারভিউতে। এখন আপনার মতামত জানার পালা।”

ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করে শ্যামা,
“পছন্দ হয়েছে মানে?আপনারা তো আমার নামটি পর্যন্ত জানেন না। আর মনিবের পছন্দ হয়েছে মানে?উনি এখানে আছেন?কই উনাকে তো দেখলাম না।উনি আমাকে কখন দেখেছেন,কিভাবে পছন্দ করেছেন?”

“ছোট মুখে বড় কথা মাফ করবেন ম্যাডাম,কিন্তু একটা জিনিস আপনাকে স্পষ্ট বলে দিতে চাই। আমার মনিবের তাকে প্রশ্ন করা একদম পছন্দ নয়। তাকে জানার কৌতুহল তিনি পছন্দ করেন না। এই বিয়ে যদি আপনি করতে চান তাহলে কিছু শর্ত আপনাকে মানতে হবে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না আপনি।”

এইতো লাইনে এসেছে,যা ভেবেছিলো সে। নিশ্চয়ই বড় কোনো ঘাপলা আছে এর মধ্যে। ভেতরে ভেতরে বেশ রেগে গেলেও,রাগটা হজম করে সে পুরোটা শোনার সিদ্ধান্ত নিলো। বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“বাকি আরও কি কি শর্ত আছে জানতে পারি?”

লোকটি তার কন্ঠের কৌতুকের ছাপ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শান্তভাবে বলতে লাগলো,”আমি বিষয়টা পুরোটাই বুঝিয়ে বলছি আপনাকে…

(চলবে)