শ্যামারণ্য পর্ব-০১

0
594

#শ্যামারণ্য
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

“কালো রঙের পাত্রী চাই”
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শিরোনামটির দিকে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসলো শ্যামা। মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো, “মেয়ের বয়স ২৫-৩০ এর মধ্যে হতে হবে,মেয়েকে অবশ্যই কুমারী হতে হবে। মেয়ের গায়ের রঙ কালো হওয়া আবশ্যিক”। অনেক কিছুই লেখা আছে তাতে,তবে শ্যামার নজর কেড়ে নেয় সর্বশেষ লাইনটি,যেখানে মোটা অক্ষরে হাইলাইট করে লেখা আছে “ইন্টারভিউতে পাত্রী নির্বাচিত হলে, তাকে ২৫লক্ষ টাকা নগদ প্রদান করা হবে।”

লাইনটি পরে বিচলিত হয়ে উঠে শ্যামা। টাকার খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে তার। যে গার্মেন্টসে কাজ করতো সেটি দেওলিয়া হয়ে যাওয়ায় চাকরিটা হারিয়েছে সে,টিউশনি দুটির টাকা দিয়ে বাবার ওষুধ আর সংসারের যাবতীয় খরচ চালানো অসম্ভব,তাই সকাল সকাল পত্রিকা নিয়ে বসেছিলো সে।
তখনি পত্রিকার এই কলামটির উপর নজর পরে তার। এই বিজ্ঞপ্তিটির প্রদত্ত প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আশ্চর্যজনকভাবে তার সাথে মিলে যায়। কিন্তু এই অদ্ভুত বিজ্ঞপ্তিটি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? যেখানে মা-বাবা শত চেষ্টার পরেও এই গায়ের কালো রঙের কারণে বা চড়া যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় তাকে বিয়ে দিতে পারেনি। সেখানে কেউ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তার কালো রঙের পাত্রী লাগবে,তাও কচি মেয়ে নয়,২৫-৩০ বছরের যুবতী। সবচেয়ে হা’স্য’কর ব্যাপার হলো চড়া মুল্যের যৌতুক চাওয়ার বদলে উল্টো তারাই ২৫লক্ষের মতো মোটা অঙ্ক দিবে পাত্রীকে।

ব্যাপারটি পুরোপুরি হা’স্য’কর এবং অবিশ্বাস্য। কেউ নিশ্চয়ই মজা নেওয়ার জন্যই এমন খবর ছাপিয়েছে। একদল লোক মানুষের অনুভূতির সাথে খেলা করে পৈ’শা’চিক আনন্দ পায়।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কলামগুলোর উপর মননিবেশ করলো। এরই মধ্যে ছোটবোন হেনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে,”আপু তাড়াতাড়ি আয়,বাবা কেমন যেনো করছে।”
মুহুর্তেই ধ্বক করে উঠলো শ্যামার বুক,হাতের পত্রিকাটি টেবিলে ফেলেই ছুটে যায় বাবা-মায়ের রুমের দিকে।

বাবার শ্বাস-প্রশ্বাস অসংলগ্ন দেখাচ্ছে,জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি,হাত দিয়ে বুকের বা পাশটা চেপে ধরে রেখেছেন। মা বাবার শিয়রে বসে চোখের পানি ফেলছেন। বুক হাহাকার করে উঠে শ্যামার এই দৃশ্যটি দেখে। কিন্তু ভেঙে পড়তে দেয়না সে নিজেকে,মুহুর্তেই শক্ত করে ফেলে তার অভিব্যক্তি। হেনাকে সিএনজি ডাকতে পাঠিয়ে নিজে বাবার মেডিকেল রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে মাকে কড়া গলায় বলে,
“নিজেকে শক্ত করো মা,বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়।”
মা তার আঁচল থেকে মুখ তুলে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার পানে,এই দৃষ্টির অর্থ শ্যামা ভালো করেই জানে। এই দৃষ্টির অর্থ হলো ‘তোর বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?’
মা এই মুহুর্তে তার কাছে যা শুনতে চায় তা হলো ‘চিন্তা করোনা মা,বাবা খুব শিগ্রয়ই ঠিক হয়ে যাবে’
কিন্তু এই মিথ্যা আশ্বাসটুকু সে দিলোনা তার মাকে,চোখ ফিরিয়ে নিলো সে দৃষ্টির অকথ্য প্রশ্ন’বা’ণ থেকে।

বাবা আর মাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠতে উঠতে হেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”দড়জা বন্ধ করে ঘরে যা। আমরা কেউ না ডাকলে ভুলেও দরজা খুলবিনা। ফোনের কাছাকাছি থাকবি। হাসপাতালে কিছুর দরকার হলে যাতে তোকে জানাতে পারি।”
হেনা মলিন মুখে সম্মতিতে মাথা নাড়ালো।

শ্যামা ড্রাইভারকে তাগাদা দিতেই সিএনজি চলতে লাগলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। বাবার অবস্থা আরও খারাপ দেখাচ্ছে। চিন্তিত মুখে শ্যামা ড্রাইভারকে জলদি চালানোর তাগাদা দিতে থাকে। ড্রাইভারও বুঝতে পারে তাদের স্পর্শ’কা’তর অবস্থা,তাই সেও সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করছে জলদি হাসপাতালে পৌছানোর। পাশ থেকে বাবা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে উঠলো,
“মা রে,ক্ষমা করে দিস তোর এই অ’প’দা’র্থ বাবাকে। সারাজীবন শুধু দিয়েই গেলি,তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না আমি। আমাকে ম’রেই যেতে দে,তাহলে হয়তো তোর বোঝা একটু হালকা হবে।”

কথাগুলো কানে যেতেই চেতে যায় শ্যামা,চোখ থেকে আটকে রাখা অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ে। চোখ পাকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ধরে আসা গলায় বলে উঠে,
“চুপ করো তুমি!আরেকটাও বা’জে কথা বলবেনা একদম। তুমি আমার বোঝা কে বলেছে তোমাকে?তুমি আমার বাবা,বাঁচতে হবে তোমাকে। আরও একশো বছর বাঁচবে তুমি। আমি সব ঠিক করে দিবো। আরেকটু ধৈর্য ধরো শুধু।”
মা ডুকরে কেঁদে উঠে,বাবার চোখের কর্ণিশ বেয়েও গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।

হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় বাবাকে। কেবিন থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে আসার পর তার দিকে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায় শ্যামা। ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে বলে,
“মিস শ্যামা,আমরা উনাকে শুধু প্রাথমিক নিরাময়টাই দিতে পারি। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? আপনার বাবার হার্টে ছিদ্র রয়েছে। তার উপর উনি ডায়াবেটিস এর রোগী। এবারের অবস্থা অনেক সিরিয়াস, জলদি অপারেশন না করালে উনাকে বাঁচানো যাবেনা।”

ডাক্তারের কথা শুনে কলিজা কেঁপে উঠে শ্যামার,বাবাকে হারানোর কথা সে ভাবতেও পারেনা।আচমকা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়ে বসে সে,
“ডক্টর আপনি অপারেশনের ব্যাবস্থা করুন। টাকার ব্যাবস্থা আমি করছি।”

ডাক্তার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে,
“মিস শ্যামা,আপনি শিউর তো টাকা যোগাড় করতে পারবেন?আপনার বাবার অপারেশনের জন্য কিন্তু ১০লক্ষ টাকার মতো লাগবে।”

শ্যামা আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে,
“আমি শিউর। আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।”
ডাক্তার তার দৃঢ় অভিব্যক্তি দেখে আশ্বস্ত হওয়ার ভঙ্গিতে সম্মতি জানিয়ে চলে যায়।

ডাক্তার যাওয়ার পর মা তার হাত টেনে ধরে হতবাক নয়নে চেয়ে বলে,”মারে এতোগুলা টাকা এতো জলদি কোথায় পাবি তুই?”

শ্যামা মাকে আশ্বস্ত করে,
“মা আমি একটা ব্যবস্থা করে নিবো,তুমি চিন্তা করোনা। তুমি বাবার পাশে থাকো,আমি হেনাকে পাঠিয়ে দিবো একটু পর। আমার টাকার ব্যবস্থা করতে যেতে হবে।”
মা মাথা দুলিয়ে সায় দেয়,তাকে রেখে বেড়িয়ে আসে শ্যামা।

বাহিরে আসার পরেই তার শক্ত নির্ভীক অভিব্যক্তি খসে পড়ে। হাত পা কাঁপতে থাকে তার ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তার কথা চিন্তা করে। ওদের সামনে বলে তো দিলো টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এতোগুলো টাকা তাকে এতো দ্রুত কে দিবে?তার না কোনো বন্ধু-বান্ধব আছে যার কাছে সে হাত পাতবে না কোনো আপনজন যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে।
কিন্তু বাবা মারা যাবে শুনে সাথে সাথে সকালে পড়া সেই হাস্য’কর বিজ্ঞপ্তিটি চোখের সামনে ভেসে উঠে তার। মানুষ বিপদে পড়লে নাকি খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
তারও এখন একি অবস্থা হয়েছে। এই মুহুর্তে সেই অবিশ্বাস্য বিজ্ঞপ্তিটি তার অনেক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। এক বুক আশা আঁকড়ে ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় শ্যামা। সামনে অনেকটা পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে।

————————————

অনেক পুরনো দেখতে প্রাসাদময় বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামা। বাড়ি গিয়ে পত্রিকার ঠিকানাটি আর তার বায়োডাটা সাথে নিয়েই বেড়িয়ে পরেছিলো এই গন্তব্যের উদ্দেশে সে। স্টেশনে নেমে স্টেশনমাস্টারকে “নির্জনা কুঠি” জায়গাটিতে কিভাবে যেতে হয় জানতে চাইতেই লোকটি কেমন করে যেনো তাকিয়েছিলো তার দিকে। আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলো,”সেখানে আপনে কেনো যাইতে চান?”

শ্যামা খানিকটা বির’ক্ত হয় লোকটির এমন প্রশ্নে।
সে এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলো,”আমার ওদিকে কাজ আছে।”

সে খানিকটা চিন্তিত স্বরে বলে উঠে,”আপা জায়গাটা কিন্তু ভালা না,ওই গ্রামের মানুষ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে জায়গাটা।দেখলেই কেমন গা ছমছম কইরা উঠে। আইজ পর্যন্ত তেমন কেউ ওইদিকে যাওয়ার পথ জিগায় নাই। কিন্তু আইজকে আপনে সহ তিনজন ওইখানে যাওয়ার পথ জিগাইলেন। বাকি দুজনেই আপনার মতো যুবতী মাইয়া আছিলো,গায়ের রঙও একি। আপা সাবধানে থাকিয়েন।”

গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটির কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলো শ্যামা। আসলেই জায়গাটাতে কেমন গা ছমছম ভাব রয়েছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে,সূর্য ডোবার আগ মুহুর্তের আলো ছায়ার খেলায় সামনের বাড়িটিকে অনেক ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। তবে সে লোকটির সাবধানবাণী নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তার চিন্তা অন্য জায়গায়।
তার আগে আরও দুজন এসেছে। তাদের মধ্যেই কাউকে বাছাই করে ফেলা হয়নি তো?তাহলে তো তার শেষ পথটাও বন্ধ হয়ে যাবে এবার।

দুরু দুরু বুকে অনিশ্চয়তার সাথে এগিয়ে যায় গেইটের দিকে শ্যামা। আশেপাশে দাড়োয়ান বা এমন কাউকে দেখতে পেলোনা সে। হাত বাড়িয়ে লোহার শিকের গেইটটিতে সামান্য ধাক্কা দিতেই চাঁপা আর্তনাদ করে খুলে যায় গেইটটি।

চলবে।