শ্যামারণ্য পর্ব-০৪

0
371

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০৪
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

স্টেশনের একটি বেঞ্চে বসে আছে শ্যামা। ক’ষ্টে বুক ফে’টে যাচ্ছে তার। এতোটা অপ’মানিত সে কখনো বোধ করেনি। এতটা ক’ষ্ট তখনো হয়নি যখন পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে এসে তার মুখের সামনেই নাক ছি’ট’কে চলে গিয়েছিলো বা তখনো হয়নি যখন নিজের ভাই যাকে সে নিজের সবটা দিয়ে মানুষ করেছিলো সে তাকে চারটি কথা শুনিয়ে বউয়ের হাত ধরে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলো বা তখনো হয়নি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সবকিছুতে ভালো করার পরেও বসের পাশে দৃষ্টি’ক’টু লাগবে বলে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিলো। কারণ তার কাছে সবসময় তার আত্মসম্মান সবচেয়ে বড় ছিলো। তারা তাকে তার গায়ের রঙ নিয়ে বিচার করতে পারলেও তার আত্মসম্মান বা যোগ্যতার উপর কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। কিন্তু আজ সে নিজের সেই গায়ের রঙকে পুঁজি করে এসেছিলো,তাই তাকে এই চরম অ’প’মানটা স’য্য করতে হলো। তার আত্মসম্মানে আ’ঘা’ত করার সুযোগ করে দিয়েছে সে নিজেই। তাই চরম আত্ম’গ্লা’নি তার মনকে বি’ষি’য়ে তুলছে। চোখের পানি বাধ মানছেনা।

ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে সে এই জায়গায়। রাতের শেষ ট্রেইনটাও ছেড়ে দিবে কিছুক্ষণ পর। হেনা এর মাঝে ষোলোটা মিসডকল দিয়েছে তাকে। হয়তো জানতে চায় কোথায় সে,কবে ফিরবে,টাকার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। কিন্তু ধরেনি সে ফোন। কি জবাব দিবে সে?তার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই তার কাছে এই মুহুর্তে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় শ্যামা। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। রেললাইন ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে সে। ফিরতে যেতে চায়না সে। ফিরে গিয়ে কি করবে?আসার সময় তো খুব বড় মুখ করে বলে এসেছিলো টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে,এখন গিয়ে কি বলবে যে টাকার ব্যবস্থা হয়নি? কালকে টাকা দিতে না পারলে তার অ’সুস্থ বাবাকে হাসপাতাল থেকে অ’প’মান করে বের করে দেওয়া হবে,চোখের সামনে ধুকে ধুকে ম’র’তে দেখতে হবে বাবাকে,হয়তো মা ও এই ধা’ক্কা’টি স’য্য করতে পারবেন না। আর হেনা…তাকে কিভাবে সামলাবে?নাহ আর ভাবতে পারছে না সে। আর ভাবতেও চায়না কিছু। মাথা প্রচন্ড ব্যা’থা করছে,অনেক ক’ষ্ট হচ্ছে তার। উপরওয়ালা এতোটা নি’ষ্ঠু’র কেনো তার প্রতি? দুঃখের পরে যদি সত্যিই সুখের দেখা পাওয়া যায় তাহলে তার সুখ কোথায়?তার ২৫বছরের জীবনে এখনো কি দুঃখের ঘড়া পূর্ণ হয়নি?এখনোকি বাকি আছে স’য্য করার?কিন্তু নাহ সে আর সয্য করতে চায়না। দূরে ট্রেনের সাইরেন শোনা যাচ্ছে। শেষ ট্রেনটি ছেড়ে দিয়েছে তাহলে। শেষ একবার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় শ্যামা,তারপর রেললাইনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়,ট্রেন কাছে আসলেই ঝা’পিয়ে পরবে,তার সকল ব্য’র্থতা সকল ক’ষ্ট তার জীবনের সাথেই শেষ হয়ে যাবে। মনে মনে বলে উঠে,
“ক্ষমা করে দিও আমাকে বাবা। এভাবে তোমার আগেই চলে যাচ্ছি। কিন্তু তোমাকে এভাবে চোখের সামনে ম’র’তে দেখার চাইতে এটিই ভালো। শুধু মা আর হেনাটার কোনো গতি করতে পারলাম না…..”
চোখ বন্ধ করে ফেলে শ্যামা। সে আর কিছু ভাবতে চায়না। মুক্তি চায় সে,একটু শান্তি চায়। ট্রেনের আওয়াজ এখন আরো ভালোভাবে পাওয়া যাচ্ছে,অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ট্রেনটা। হাত শক্ত করে মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামা,ভ’য়ে থরথর করে কাঁ’পতে থাকে। মৃ’ত্যু’ভয় কার না থাকে?

ট্রেনটা তার থেকে কয়েক হাত দূরে চলে এসেছে,ঝা’পিয়ে পরার প্রস্তুতি নিবে তখন হঠাৎ করেই জোর এক দমকা হাওয়া গায়ে আ’ছড়ে পড়ে তার।এতোটাই তী’ব্র ছিলো সে ঝা’পটা যে সে দুকদম পিছিয়ে যেতে বা’ধ্য হয়। তখনি তার ফোনটি ক’র্কশ সুরে বেজে উঠে,এই নিস্তব্ধ রেললাইনে যা অনেক তী’ব্র শোনা যাচ্ছিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভুলেই যায় সে কি করতে যাচ্ছিলো। তার হুঁশ ফিরে যখন ট্রেনটি তার পাশদিয়ে ক্র’স করে তী’ব্র বেগে চলে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ট্রেনটির যাওয়ার পানে যেটি কিছুক্ষণ আগে সে তার মুক্তির শেষ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলো।

ফোনটি এখনো তার স্বরে বেজে চলেছে। শ্যামা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আননোন একটি নম্বর থেকে কল আসছে। এতোরাতে তাকে কে ফোন করলো? হাসপাতালের কথা মাথায় আসতেই তড়িঘড়ি করে ফোন ধরে সে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

“হ্যা…হ্যালো”

“শ্যামা…..”,এক অজানা অপরিচিত পুরুষকন্ঠ ভেসে আসে অপর প্রান্ত থেকে,তার বিক্ষি’প্ত মন মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায়। কিছু একটা যেনো আছে সেই কন্ঠে, সেই কন্ঠস্বর তার নাম ধরে ডাকতেই একটি ঘোরের মধ্যে চলে যায় শ্যামা। যেনো সময় থমকে গেছে সেখানেই,শুধু সে আর এই অজ্ঞাত পুরুষটি রয়েছে এই পৃথিবীতে। আবার…আরও একবার তার কন্ঠস্বর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে তার মন।

“ম’র’তে চেয়েছিলে বুঝি?”

চমকে উঠে শ্যামা,ঘোর অনেকটা কেটে যায় তার এমন প্রশ্ন শুনে।সে যে ম’র’তে যাচ্ছিলো সেটা এই অজ্ঞাত লোক কিভাবে জানলো?তার উপর কি নজর রাখা হচ্ছে?সে তার চারদিক ভয়ে ভয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। এরই মাঝে আবার ভেসে আসে সেই কন্ঠস্বর।

“আমাকে খোঁজার চেষ্টা করোনা শ্যামা। আমি আমার প্রতি কৌতুহল পছন্দ করিনা। সামশের নিশ্চয়ই বলেছে তোমাকে”

“ক…কে আপনি?কোথা থেকে বলছেন?আর আমার নাম জানলেন কি করে?আর সামশের কে?”

“ভয় পাচ্ছো বুঝি? ভালো….খুব ভালো,আমাকে ভয় করা অপছন্দ নয় আমার। কিন্তু আমি প্রশ্ন একদম পছন্দ করিনা শ্যামা,আর তুমি বড্ড বেশি প্রশ্ন করছো এই মুহুর্তে।”

“কিসব আবোল তাবোল বলছেন আপনি আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা”

“কিছুই বোঝা লাগবেনা তোমার। হেটে স্টেশন পর্যন্ত আসো। সামশের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে সেখানে,সে তোমাকে নির্জনা কুঠিতে ফিরিয়ে আনবে। শেষ ট্রেন যেহেতু চলে গেছে,মরার পরিকল্পনা আপাতত বাদ।এতোরাতে আমার হবু স্ত্রীর বাইরে থাকাটাও আমি পছন্দ করিনা শ্যামা।”

লোকটির প্রতিটি শব্দে নতুন চমক পাচ্ছে শ্যামা। ‘নির্জনা কুঠি’ ‘হবু স্ত্রী’ এই শব্দগুলো অনেককিছুই খোলসা করে দেয় তার কাছে। সে বুঝতে পারে যে এই লোকটিই সেই কা’পুরুষ যাকে একটু আগে রিজেক্ট করে এসেছে সে,আর সামশের নিশ্চয় সেই মনিবভক্ত বুড়োটা। এই বে’হায়া লোককে মুখের উপর মানা করে দেওয়ার পরেও উনি তার উপর নজর রাখছেন,আবার রাতের বারোটা বাজে ফোন করে হুকুম করছেন উনি উনার গাড়ি পাঠিয়েছেন,সে যেনো ফিরে আসে। এই লোকের কি মাথা খারাপ?তার উপর সে তার সুন্দর কন্ঠস্বর দিয়ে তাকে বশ করে ফেলেছে যেনো। এইযে তার এখন এতো রাগ হচ্ছে,কিন্তু সে কোনো মতেই লোকটির উপর চি’ল্লিয়ে দু কথা শুনিয়ে দিতে পারছেনা যেমনটা ওই মনিবভক্ত বুড়োকে দিয়েছিলো। এক মিনিট, এই লোক তার নাম্বার পেলো কি করে?তার নাম জানলো কি করে?

“আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?আর আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”
জবাবে সে ওই প্রান্তের লোকটির কন্ঠের চরম বির’ক্তি উপলব্ধি করে,”শ্যামা বড্ড প্রশ্ন করো তুমি। বললাম তো আমার…..”

“হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার আপনাকে প্রশ্ন করা পছন্দ নয়,মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। শুনতে শুনতে কান পঁচে গিয়েছে একেবারে। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমিও আপনার কথা শুনবোনা। রাখছি আমি!” এই বলেই ফোন টা কেটে দেয় সে,কিন্তু ফোনটা ব্যাগে সরিয়ে না রেখে হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে উৎসুক হয়ে,কেনো জানি সে চায় লোকটি তাকে আবার ফোন করুক।

ফোনের স্ক্রিনের দিকে গত পাঁচ মিনিট ধরে তাকিয়ে আছে সে,কিন্তু বে’হায়া লোকটি আর ফোন করছেনা তাকে। এতে তার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। আশাহত হয়ে ফোনটি রেখে দিতে যাবে তখনি আবার বেজে উঠে ফোনটি। শ্যামা তা এক সেকেন্ডের ভেতর রিসিভ করে কানে লাগায়।

ওই প্রান্ত থেকে চাপা হাসির ধ্বনি ভেসে আসে তার কানে,লোকটি বলে উঠে,”বাহ শ্যামা,তুমিতো খুব দ্রুত রিসিভ করো ফোন?আমিতো ভেবেছিলাম তোমাকে ফোনে পাবোই না। যা রাগ তোমার,আমিতো ভেবেছি এতোক্ষণে হয়তো ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছো নয়তো মোবাইলটাই তুলে আ’ছা’ড় মে’রেছো। আচ্ছা এমনটা নয় তো যে তুমি আমার কলের অপেক্ষায় ছিলে?” এই বলে ব’জ্জা’ত লোকটি আবার হাসতে থাকে।

এদিকে লোকটির কথা শুনে লজ্জায় গাল দুটি গরম হয়ে যায় শ্যামার। আস্ত ব’দের হাড্ডিতো লোকটি। শর্তগুলো শুনে ভেবেছিলো রসকষহীন এক ধনী ঘরের খা’ট্টাস হবে,কিন্তু এ লোক তো আস্ত এক শয়তান। এর পেটে সব শয়তানি বুদ্ধি। কিন্তু ও নিজে জবাব দেওয়ার মুখ রাখলো কই,যে গতিতে ফোনটা ধরেছে সে লোকটিকে ভুল প্রমাণিত করার জোর নেই। তবু সে আমতা আমতা করে বললো,

“ওই এমনি ফোন হাতে ছিলো সেখানে চাপ লেগে গেছে। আমি কেনো আপনার ফোনের অপেক্ষা করতে যাবো?আশ্চর্য! আপনি নিজেকে কি ভাবেন?”

(চলবে)