শ্যামারণ্য পর্ব-০৫

0
342

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০৫
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

“ওই এমনি ফোন হাতে ছিলো সেখানে চাপ লেগে গেছে। আমি কেনো আপনার ফোনের অপেক্ষা করতে যাবো?আশ্চর্য! আপনি নিজেকে কি ভাবেন?”

“তোমার হবু বর” লোকটি এখনো সমান তালে হেসেই চলেছে ওই প্রান্তে। তার হাসির শব্দ এদিকে শ্যামার পুরো শরীরে জ’লুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।

“আপনাকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। বললাম তো আপনাদের ওই শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আবার ফোন কেনো করেছেন বলুন,না হলে রাখছি। এর পরের বার কিন্তু সত্যি আর পাবেন না ফোনে।”

এবার হাসির আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় ওই প্রান্তে,লোকটির গম্ভীর গলা ভেসে আসে অপর প্রান্ত থেকে,”আমাকে বিয়ে করবে নাকি করবেনা সেটা নাহয় এখানে ফিরে ঠিক করলে শ্যামা? আপাতত অনেক রাত হয়েছে,এতোরাতে তোমার বাইরে থাকাটা ভালো লাগছেনা আমার। স্টেশনে ফিরে এসো জলদি,সামশের তোমাকে নিয়ে আসবে।”

লোকটির কন্ঠে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট,এমন ভাবে তার নাম ধরে ডাকছে,এতো স্নিগ্ধ তার বলা কথাগুলো যা অজান্তেই শ্যামার মনে অজানা অনুভুতির ঝড় তোলে। এভাবে তো কেউ তাকে কখনো বলেনি। কোনো পুরুষ মানুষকি তাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে?তার জন্য উৎকন্ঠায় পথ চেয়ে বসে থাকতে পারে? ভাবনাগুলো মনে আসতেই তার পুরোনো তিক্ত স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে মন। নিজেকে প্রবোধ দেয়,’নাহ…সব মনের ভুল তোর। নিজের আবেগগুলো এভাবে বিলিয়ে দিসনা। কষ্ট পাবি,সীমাহীন কষ্ট’ নিজেকে সামলে নিয়ে নত কন্ঠে আবার বলে উঠে,

“আমার জন্য এতো চিন্তা করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে,দয়ার সাগর আপনার মন বলতে হবে। অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এতো চিন্তা করছেন।”

“মাঝে মাঝে ক্ষনিকের পরিচিতি যথেষ্ট হয় কাউকে আপন করে নেওয়ার জন্য,আবার মাঝেমাঝে সারাজীবনের পরিচিত মানুষগুলো হঠাৎ অপরিচিত হয়ে যায় শ্যামা।”

লোকটির কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় শ্যামা। তার কথাগুলোতে যেনো একরাশ বেদনা আর একাকিত্বের ছাপ রয়েছে,তবে এতো স্নিগ্ধ কেনো তার কন্ঠ? এতো সুন্দর কেনো তার কথাগুলো? সে তাকে ব্যঙ্গ করছে,বারবার রিজেক্ট করছে তবু সে এতো সুন্দর করে তার সাথে কথা বলছে কেনো?
“খুব সুন্দর চিন্তাভাবনা আপনার। কিন্তু আমি তবুও আপনার কাছে ফিরে যেতে পারবোনা,সরি।”

“কেনো পারবেনা বলবে আমাকে?”

“বললাম তো,আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমি আপনার কথা শুনবোনা।” আমতা আমতা করে জবাব দেয় সে।

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়,তারপর আবার বলতে শোনা যায়,”তাহলে তোমার প্রশ্ন দুটির উত্তর দিলে তুমি আমার কথা শুনবে?সোজা গিয়ে গাড়িতে বসবে,আর ফিরে আসবে বাড়িতে?”

শ্যামা সামান্য ইতস্ততভাবে জবাব দেয়,”হ্যাঁ ঠিক আছে,আপনার কথা মেনে নিব।”

“কথা দিচ্ছো তো?আমি কিন্তু কথার খেলাপ পছন্দ করিনা শ্যামা।”

এই প্রথম বার বিরক্তি বোধ করে শ্যামা লোকটির কথায়,”হ্যাঁ বাবা কথা দিচ্ছি। এবার বলুন তো আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন?আর আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন।”

ওই প্রান্ত থেকে আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। এদিকে শ্যামার বুকের বা পাশটায় ধুম ধাম শুরু হয়ে গেছে। খুব এক্সাইটেড ফিল হচ্ছে কেনো জানি। আচ্ছা লোকটি কি হঠাৎ বলে উঠবে যে আমি ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ার কিং বা এমন আধ্যাত্মিক কোনো কিছু,সে সবার মন পড়তে পারে,এভাবেই সবটা জেনে নিয়েছে তার মন পড়ে? লোকটির দৃষ্টিশক্তি অনেক প্রখর,তার ক্ষমতাবলে তার ঘরের জানালা থেকেই এতোদূর দেখতে পাচ্ছে? বুকটা উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করছে তার।

শ্যামার সকল ফ্যান্টাসির উপর পানি ঢেলে দিয়ে অপর প্রান্ত থেকে জবাব আসে,
“যাওয়ার সময় তো নিজেই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলেছিলে সামশেরকে, আমাকে যেনো বলে দেয় ‘শ্যামা অসহায় হতে পারে কিন্তু দুর্বল নয়’ এমন আরো হাবিজাবি কতকিছু,নিজেই নিজের নাম বলেছো ভুলে গেলে?এমন ভাবে চিল্লিয়ে বলেছো,আমিতো দোতলায় বসেও শুনেছি,মুখস্ত হয়ে গেছে আমার। এদিকে নিজে ভুলে বসে আছো।
আর রাগের মাথায় তোমার বায়োডাটার ফাইলটা সোফার উপরে রেখেই চলে গিয়েছো,সেখান থেকেই পেয়েছি তোমার নাম্বার।
দুটো প্রশ্নের উত্তরই তোমার জানার কথা,কিন্তু নাহ আমি পছন্দ করিনা জেনেও তোমার প্রশ্ন করতে হবে। এবার জবাব শুনে শান্তি হয়েছে নিশ্চয়ই?এবার আর কোনো কথা নয়,সোজা গিয়ে গাড়িতে বসো। আমি অপেক্ষা করছি।” এভাবে গজগজ করতে করতে ফোনটা কেটে দেয় লোকটি।

একবুক ভগ্ন ফ্যান্টাসি নিয়ে আস্তে আস্তে হাটা ধরে শ্যামা স্টেশনের দিকে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলো ‘ভাগ্যিস লোকটি তার মন পড়তে পারেনা। যদি পারতো তাহলে সে তার ভাবনাগুলি শুনে নিশ্চয়ই হেসে কুটিকুটি হতো এতোক্ষণে,তারপর নিশ্চয়ই আমাকে রসিয়ে রসিয়ে খোঁচা দিতো বদের হাড্ডি লোকটি। কিভাবে জবাব দিলো দেখো,যেনো মস্ত বড় উপকার করে ফেলেছে আমার উপর। এই সোজা জবাব গুলো শুরুতেই দিয়ে দিলে কি হতো?আমার মনে এমন ভাবনা আসতো নাকি?আর আমিও কেমন কিসব ভাবছিলাম,প্রচুর রেস্ট দরকার তার বোঝা ই যাচ্ছে। একটু আগে ম’র’তে যাচ্ছিলো আর এখন আধ্যাত্মিক ফ্যান্টাসি নিয়ে বসেছে…ধুরর’

ভাবতে ভাবতে রেললাইন ধরে হাটতে থাকে সে। রাতের শীতল হাওয়া তার মনটা জুড়িয়ে দিচ্ছে।আকাশে রুটির মতো সাদা গোল চাঁদ উঠেছে,যা চারপাশ রুপোলী আলোয় আলোকিত করে রেখেছে। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক। মনের অজান্তেই মুচকি হাসি খেলা করে তার ঠোঁটে,মনটা শান্ত হয়ে গেছে তার একদম। এতোটা শান্তি শেষ কবে অনুভুত হয়েছিলো,আদোও হয়েছিলো কিনা তার জীবনে সে জানেনা। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রচন্ড ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে যেনো এই মুহুর্তে সে যেকোনো কিছু করতে পারবে,যেকোনো বিপদ মোকাবেলা করতে পারবে। মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে,কোনো দুঃখ থাকবেনা। এই অসীম মনোবল কোথা থেকে এসেছে জানেনা শ্যামা।
জানবে কি করে? সে তো বুঝতেই পারেনি তার মনের অজানা অনুভূতিগুলো। তাই জানতেও পারেনি তার এই অজানা অনুভূতিগুলো তার ভবিষ্যৎকে কিভাবে প্রভাবিত করবে।

সম্পুর্ন অজ্ঞাত শ্যামা হাটতে থাকে তার অজানা ভবিষ্যতের দিকে। এক সময় গিয়ে পৌছায় স্টেশনে। সেখানেই সে সকালের ওই বুড়োটিকে দেখতে পায়।
তাকে দেখে দ্রুত কদমে এগিয়ে আসে তার দিকে। নতজানু হয়ে বলে উঠে,”মনিব আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিতে। আমার সাথে আসুন দয়া করে।”

শ্যামা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়,তারপর লোকটির পিছু পিছু গিয়ে উঠে বসে গাড়িতে। গাড়ি চলা শুরু করলে সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

‘আচ্ছা এইযে লোকটির কারণে এতোদূর অজপাড়া গ্রামে তার আসা,এতো কথা তার সাথে,তার তো নামটাই জানা হলোনা!’ হঠাৎ তীব্র বাসনা জাগে তার মনে সেই অজ্ঞাত পুরুষটির নাম জানতে। মনের মধ্যে ভাবনাটির উদয় হতেই চালকের আসনে বসা বুড়োটিকে প্রশ্ন করে বসে সে।
“আচ্ছা চাচা,আপনার মনিবের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে আমার কিন্তু তার নামটাও তো জানিনা আমি। উনার নাম কি?”

“মাফ করবেন ম্যাডাম,উনি আমার মনিব। আমি তার নাম নিতে পারবোনা,মনিবকে নাম ধরে ডাকা মানে তার অসম্মান করা। ”

চরম বিরক্তি আর বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে আবার জানালার বাইরে তাকায় শ্যামা। এ কোন যুগের মানুষরে বাবা। এই জমানায় এতো লয়াল মানুষ আছে নাকি?এমন লয়াল মনিবভক্ত চাকর সে আগে কখনো দেখেনি। নামটা ঠিকই রেখেছে সে ‘মনিবভক্ত বুড়ো’।

“ঠিক আছে। আমি নাহয় আপনার মনিব থেকেই জেনে নিবো। দয়া করে এবার এটা বলবেন না আমি উনার নামটাও জানতে চাইতে পারবোনা।”

সামশের কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। মনিবের হুকুম মেয়েটিকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনতে। বেশি কিছু বললে আবার সন্ধ্যার মতো রেগে চলে যাবে। তখন মনিব নিশ্চয়ই রেগে যাবেন।

নির্জনা কুঠির মূল ফটকের সামনে দাঁড়ায় গাড়িটা। সামশের গাড়ি থেকে নেমে মাথা নীচু করে শ্যামার জন্য অপর পাশের দরজাটি মেলে ধরে যাতে সে নামতে পারে। শ্যামার এসব আধিক্যেতা মোটেই পছন্দ নয়,এই লোক তাকে এমনভাবে সম্মান করছে যেনো সে এই ঘরের মালকিন। নিশ্চয়ই ওই ব’জ্জাত লোকটাই বুঝিয়েছেন যে আমি উনার উনার হবু বউ। উনিতো আবার আগেভাগেই সব ঠিক করে রেখেছেন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সামশেরের পিছু পিছু যেতে থাকে শ্যামা।

বাড়িতে প্রবেশ করে এদিক ওদিক উঁকিযুকি দিয়েও মানুষটির টিকিটাও দেখতে পেলোনা সে,যে তাকে এখানে আসার জন্য এতো হম্বিতম্বি করছিলো ফোনে। সামশের তাকে বসার ঘর পেরিয়ে পাশের একটি ঘরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে হয়তো এই ঘরেই অপেক্ষা করছে মানুষটি। কিন্তু ঘরটিতে দ্বিতীয় কোনো মানুষের উপস্তিতি না দেখে আবার হতাশ হতে হয় তাকে।

ঘরটি মাঝারি আকারের,বেশি কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু মস্ত বড়ো একটি ডায়নিং টেবিল এবং তাকে ঘিরে রাখা কালো কাঠের কিছু চেয়ার। দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা ডায়নিং রুম। এখানে তাকে নিয়ে আসার কারণ জানতে বেশি অপেক্ষা করতে হলোনা তাকে। সামশের ই বলে উঠলো, “মনিব বলেছেন আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আয়োজন করার। দয়া করে আসন গ্রহণ করুন। আর কিছু দরকার হলে নিশ্চয়ই আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না।”

“আমি খাবোনা এখন,ক্ষিদে নেয় আমার। আপনি আপনার মনিবকে ডাকুন। তার সাথে কথা বলা দরকার আমার।”

“মনিব বলেছেন আপনি যতক্ষণ খাবার না খান,তার সাথে আপনার কথা বলা বারণ।”

রাগে জিদে শ্যামার মাথার রগ দপদপ করে কাঁপতে থাকে। ভারী ব’জ্জাত লোকতো! সে খেয়াল করে দেখছে,সেই পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি থেকে এখানে আসার সফর পর্যন্ত সবটা উনার ইচ্ছামতোই চলে আসছে।
সে কোথায় যাবে,কি করবে,কি করবেনা সব উনিই ঠিক করে দিচ্ছেন। এই যে তাকে এখন জোর করে গিয়ে টেবিলে বসতে হবে,খেতে হবে,সেটাও উনার ইচ্ছামতোই হবে। কিন্তু সবটা বুঝতে পেরেও সে কেনো তার ইচ্ছামতো করে চলেছে সে বুঝে উঠতে পারছেনা। সেটা তার আসল রাগের কারণ।

ডায়নিং টেবিলে বিভিন্ন রকমের আইটেম বাটিতে ঢেকে রাখা হয়েছে। শ্যামা চেয়ারে বসে একটা একটা করে ঢাকনা উল্টাতে থাকে,অনেক কিছুই আছে এখানে। পোলাও, মুরগীর রোস্ট, মাছ ভাজা,চিংড়ির ঝাল,বেশ আমলে নিয়েই আজকের ভোজ তৈরি হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। গরুর মাংসের বাটিটার ঢাকনা তুলতেই মাংসের মুখরোচক গন্ধ নাকে এসে লাগে তার। মাংসের বাটিটা দেখে মনের জমাট বাধা কষ্ট গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকায়। গরুর মাংস তার বাবার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। কিন্তু মাংসের যা দাম তাই কখনো কিনে খাওয়াতে পারতোনা। সেবার তার স্টুডেন্ট এ প্লাস পাওয়ায় ছাত্রের মা বড় করে অনুষ্ঠান করেছিলো,সেখানে পোলাও মাংস প্যাকেট করে বাড়ির জন্যেও দিয়েছিলো। সেদিন অনেকদিন পর বাবাকে তৃপ্তি করে খেতে দেখেছিলো সে। বাবা তার আর্থিক অক্ষমতার কারণে কোনো আবদার করেন না,কিন্তু উনি না বললেও সবটা সে বুঝতে পারে। আর বুঝতে পারে বলেই এই পোলাও মাংস তার গলা দিয়ে নামবে না। সে সামশের কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“দুঃখিত চাচা,আপনাকে এতো রাতে কষ্ট দিচ্ছি। আপনাদের ঘরে সাদা ভাত হবে?আসলে এতো রাতে এতো ভারী খাবার খেতে পারবোনা আমি।”

সামশের কিছু উপলব্ধি করবার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,”অবশ্যই হবে ম্যাডাম। মাফ করবেন এই অ’ধ’মকে,আমার আরও খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।”

শ্যামা স্মিত হেসে বলে,”প্লিজ বিচলিত হবেন না চাচা,আপনি অনেক ভালো আয়োজন করেছেন সত্যি। আমারি শরীরে একটু সমস্যা।”

“সেটা আপনার মহত্ব ম্যাডাম,আমি এক্ষুণি আসছি খাবার নিয়ে। একটু অপেক্ষা করুন”

সামশের যাওয়ার পর ব্যাগ হাতড়ে মোবাইলটা বের করে শ্যামা। হেনাকে একটা ফোন করা দরকার। সে সবটা পিচ্চিটার উপর চাপিয়ে দিয়ে এখানে এসে বসে আছে। মেয়েটি নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় ম’রে যাচ্ছে। হেনাকে কল দিয়ে দুইবার রিং করার পরপরই ফোন রিসিভ করে হেনা,তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওইপ্রান্ত থেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠে,

“হ্যালো আপু! কোথায় তুই? এতোবার ফোন করলাম রিসিভ করছিস না ফোন। এদিকে মা বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করতে করতে এইমাত্র ঘুমালো। কিছু একটা বুঝিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তুই কই?কবে ফিরবি?”

“হেনা শান্ত কর নিজেকে একটু। সরি এক জায়গায় আটকে পড়েছি তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি,আমি আজ ফিরবো না আর। তুই চিন্তা করিসনা। কাল চলে আসবো আমি।”

“তুই জানিস আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম? মা এদিকে কেঁদে কেঁদে সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে,বাবার অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই,ডাক্তার বার বার টাকা কখন জমা দিবো জিজ্ঞেস করছে। তার উপর তুই ফোন ধরছিস না। আমি আর কোনো কিছু বুঝতে না পেরে ভাইয়া কে ফোন করেছিলাম।”

ভাইয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে শ্যামা,”দিব্যকে ফোন করেছিলি?তা কি বললো সে বাবার অবস্থা শুনে? এসেছিলো দেখতে?”

হেনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে জবাব দেয়,”ভাইয়া বলেছে সে অনেক জরুরি মিটিংয়ে আছে,অযথা ফোন করে যাতে বিরক্ত না করি।”

শ্যামা এমন কোনো জবাব ই আশা করেছিলো,তবু হেনার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে বুকে চিনচিনে এক ব্যাথা অনুভব করলো। তার বাবাভক্ত ভাইটাকে আজকাল চেনায় যায়না।
“এই জন্যই তোকে আর মা কে এতো করে বলি যাসনা ওর কাছে। সে আমাদের থেকে অনেক দূর চলে গেছে। তবুও কেনো যেচে পড়ে অপমানিত হতে তার সাথে যোগাযোগ করিস বলতো? মা যে তোর ফোন ধার করে লুকিয়ে দিব্যকে কল দেয় সেটা আমি জানিনা তা কিন্তু না। আমি দেখেও না দেখার ভান করতাম,ভাবতাম একদিন তোরা নিজেই বুঝতে পারবি।” বলতে বলতে চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে শ্যামার।
হেনা ওপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব না দিয়ে শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

“আচ্ছা কান্না বন্ধ কর এবার। বাবার জ্ঞান ফিরেছিলো?”

হেনা আস্তে আস্তে উত্তর দেয়,”একবার কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলো,তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। পরে আবার জ্ঞান হারিয়েছে। আপু তুই টাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিস?”

এই প্রশ্নটাকেই এড়িয়ে চলতে চাইছিলো শ্যামা,এখন কিভাবে বলবে যে এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
“আমি কালকে আসি,তারপর সব বলবো হেনা।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। জলদি চলে আসিস।”

“হুমম আসবো। খেয়েছিস?মা খেয়েছে?”

“হ্যাঁ খেয়েছি একটু আগে। মা তো খেতেই চাইছিলো না,শুধু কেঁদে চলেছে। অনেক কষ্টে অল্প কিছুটা খাওয়াতে পারলাম।”

ছোট্ট বোনটির জন্য খুব মায়া হয় শ্যামার। কতই বা বয়স তার?সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। এই বয়সের বাচ্চারা দুরন্তপনায় চষে বেড়ায় পুরো শহর। আর তাকে একা হাতে অসুস্থ বাবা-মা কে সামলাতে হাসপাতালের চক্কর দিতে হচ্ছে। আর নিতে পারছেনা শ্যামা। আরও ভাবলে আবার ভেঙ্গে পড়বে সে। রাখছি বলে ফোনটা রেখে দেয় সে।

মাথা তুলে সামশের কে খাবারের বাটি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোটেই অবাক হলোনা সে। লোকটি কিভাবে কখন রুমে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে,সে তার উপস্তিতি বুঝতে পারলোনা কেনো,এই প্রশ্নগুলো আর ভাবায় না তাকে। এমনকি এখানে আসার পর থেকেই যে সে তার উপর অনবরত কারো দৃষ্টি অনুভব করছে,সেই ব্যাপার টাও গা সওয়া হয়ে গেছে তার।
সে ভুতপ্রেত এসবে বিশ্বাস করার মতো বোকা নয়,তবে এই পর্যন্ত যতকিছু হয়েছে তা একে বারে দেখেও না দেখার ভান করার মতো নির্বোধও নয়। সে কমপক্ষে এতোটুকু জানে যে যাদের সংস্পর্শে সে এখন রয়েছে,তারা আর যাই হোক কোনো সাধারণ মানুষ নয়। কিন্তু সবকিছু বিবেচনা করে এটুকুও বুঝতে পেরেছে যে তারা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছেনা। তবে তাদের কোনো উদ্দেশ্যে অবশ্যই রয়েছে। এর উত্তর একমাত্র সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিই দিতে পারে। তার সাথে একবার কথা বলা খুব জরুরি।

(চলবে)