শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-০২

0
163

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ২

কখনও শু‌নে‌ছেন একটা মে‌য়ে একটা ছেলের জন্য ১৪ বছর অপেক্ষা ক‌রে‌ছে! ঐশী কর‌ছে। ত‌বে সে যে আমার জন্য অপেক্ষা কর‌ছে সেটা সে মে‌নে নি‌চ্ছে না। আমা‌কে বুঝ‌তেও দি‌চ্ছে না অপেক্ষাটা আমার জন্যই সে কর‌ছে। তার সা‌থে যখন আমার প‌রিচয় হয় তখন আমার বয়স পঁ‌চিশ। ঐশীর সম্ভবত আঠা‌রো হ‌বে বোধহয়। পা‌রিবা‌রিকভা‌বেই আমাদের বি‌য়েটা ঠিক হ‌য়ে‌ছি‌ল। সে‌দিন আমার মতো বাবা-মা এবং প‌রিবা‌রের সবাই ঐশী‌কে খুব পছন্দ কর‌লেন। কথা ছি‌ল সাম‌নের আষাঢ় মা‌সে বি‌য়ে হ‌বে। তত‌দি‌নে আমার জবটাও কনফার্ম হ‌য়ে যা‌বে।

তখনও আমি বেকার ছিলাম। চাক‌রির সব ব্যবস্থা হ‌য়েই ছি‌ল, শুধু মা‌স দুই পর জ‌য়েন করব। অনে‌কেই এত বয়স পর্যন্ত বেকার থাকাটা‌কে ভা‌লো নজ‌রে দে‌খে না, কিন্তু আমার বাবা তেমন ছি‌লেন না। তি‌নি ছি‌লেন অন্যরকম এবং চমৎকার একজন মানুষ। চাক‌রি যে পাই‌নি তা নয়, আস‌লে চাক‌রির চেষ্টা তেমন ক‌রি‌নি। বাবা কর‌তেও দেন‌নি। তার ম‌তে বি‌য়ের পর চাক‌রি কর‌লেই হ‌বে, তার আগে জীবন‌কে অনুভব কর‌তে। বাবা ভা‌লো চাক‌রি কর‌তেন। সংসা‌রে অভাব বল‌তে কোনও নাম ছি‌ল না। বাবা তার ছে‌লে মে‌য়ে‌কে প্রচন্ড ভা‌লোবাস‌তেন। তার এ অতিমাত্রায় ভা‌লোবাসার ফলটা ভ‌বিষ্য‌তে আমা‌দের জীব‌নে খুব বেদনাদায়ক হ‌য়ে‌ছি‌ল। আস‌লে বাবা সবসময় এমনভা‌বে আগ‌লে রাখ‌তেন যে, তি‌নি না থাক‌লে আমরা কী করব তা ভা‌বি‌নি কখনও। হয়‌তো বাবাও কখনও ভা‌বেন‌নি তি‌নি অতি দ্রুত আমা‌দের ছে‌ড়ে চ‌লে যা‌বেন।

ঐশীর আর আমার বি‌য়ে ঠিক হবার পর মোবাই‌লে, চি‌ঠিতে আমা‌দের ভা‌লোই কথা হ‌তো। অল্প অল্প কথা বলা ধী‌রে ধী‌রে গভীর প্রে‌মে রূপ নি‌লো। তখনও অবশ্য কেউ কাউ‌কে ভা‌লোবা‌সি ব‌লি‌নি। ত‌বে দুজন যে দুজন‌কে খুব ভা‌লো‌বে‌সে ফেলে‌ছিলাম সেটা খুব বুঝতে পার‌ছিলাম। সারা‌দিন ওর সা‌থে কথা না বল‌লে যে‌ন দম আট‌কে আসার উপক্রম হ‌তো। দুজ‌নেই খুব ক‌রে বি‌য়ের তা‌রি‌খের জন্য অপেক্ষা কর‌তে লাগলাম।

বি‌য়ে ঠিক হবার পর বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে সময়টা তা একটা ছে‌লে এবং মে‌য়ের জন্য খ‌ুব বি‌শেষ হয়। একে অপর‌কে জানার বা বুঝার অনেক কিছু থা‌কে। ম‌নের ম‌ধ্যে জমা‌নো স্বপ্ন আর কথাগু‌লো দি‌য়ে একেকটা দিন মধুর থে‌কে মধুময় হ‌য়ে উঠে‌ছি‌ল। মধুর অপেক্ষায় অপেক্ষায় কা‌টছি‌ল দিন-রাত। আর সময়গু‌লো মধুর মত মি‌ষ্টি ছি‌ল।

৩!!
আমা‌দের বি‌য়ে ঠিক হওয়ার কিছু‌দিন পর।
এক‌দিন সন্ধ্যারা‌তে হঠাৎ ক‌রে বাবার বু‌কে হালকা ব্যথা হয়। আমরা সবাই ভে‌বে‌ছিলাম গ্যা‌স্টি‌কের ব্যাথা। তা-ই ততটা গুরুত্ব দেই‌নি। বাবাও তেমন গুরুত্ব দেন‌নি। তি‌নিও সারা সন্ধ্যা আমা‌দের সা‌থে জ‌মি‌য়ে গল্প কর‌লেন। মা ছোলা বুট দি‌য়ে মু‌ড়ি মাখ‌লেন সেটা খে‌লেন। চি‌নি ছাড়া আদা চা খে‌লেন। ত‌বে সে‌দিন গভীর রা‌তেই বাবা খুব অসুস্থ হ‌য়ে প‌ড়লেন। হাসপাতা‌লে নেওয়া পর্যন্ত তা‌কে বাঁচা‌নো গে‌ল না। গা‌ড়ি‌তেই শেষ নিঃশ্ব‌াস ত্যাগ কর‌লেন।

আমা‌দের হা‌সিখু‌শিময় প‌রিবা‌রে অন্ধকা‌রের ছাঁয়া না পু‌রো অন্ধকারই নে‌মে এলো। বাবা মারা যে‌তে না যে‌তেই সংসা‌রে অভাব কী বুঝ‌তে শুরু করলাম। বাবার চাক‌রি থে‌কে পেনশন হিসা‌বে তেমন কিছুই পাই‌নি। যা পে‌য়ে‌ছি তার বে‌শির ভাগ, বাবার জন্য গ‌রিব‌দের খাওয়া‌নো এবং বাবার কিছু দায় দেনা ছি‌ল সেখা‌নে চ‌লে যায়। পু‌রো সংসা‌রের দায়ভার এসে পড়ল আমার উপর। প‌রিবা‌রে লোক তো কম না। আমি, মা, ছোট দুই বোন আর এক ভাই। এতগু‌লো লো‌কের খরচ তো কম না! কথায় আছে বিপ‌দে পড়‌লে কা‌ছের লোক চেনা যায়। স‌ত্যি তাই! বাবা মারা যাবার পর বহু কা‌ছের লোক‌কে চি‌নে‌ছি। যারা বাবার থে‌কে বহু সু‌যোগ সু‌বিধা নি‌য়ে‌ছে, তারাও আমা‌দের এ দু‌র্দি‌নে মুখ ফি‌রি‌য়ে নি‌য়ে‌ছিল।

বাবার মৃত্যুর দুঃখ বিলাস করার মত সুযোগ পাই‌নি। প‌রিবা‌রের হাল ধর‌তে হ‌য়ে‌ছিল। নি‌জের প‌রিবা‌রের খা‌তি‌রে নামল‌াম জীবন যু‌দ্ধে। দিন রাত ক‌ঠোর প‌রিশ্রম করাই ছি‌ল মূল লক্ষ্য। এত বিপ‌দের ম‌ধ্যেও একটা ভা‌লো কাজ হ‌লো তা হ‌লো প‌রের মা‌সে আমার চাক‌রিটা হ‌য়ে গেল। ত‌বে বেতন যা‌ পেতাম, তাতে এত ব‌ড়ো প‌রিবা‌রের সবার প্র‌য়োজন মেটা‌তে অনেক কষ্ট হ‌তো। ভ‌াবলাম ক‌য়েকটা টিউশ‌নি করা‌বো, কিন্তু সকাল নয়টা থে‌কে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ ক‌রে টিউশনি করা‌নোর মত সময় হ‌তো না, এনা‌র্জিও থাকত না। তা-ও কষ্ট হ‌লেও সকাল ছয়টায় একটা আর রাত সা‌ড়ে আটটায় একটা মোট দু‌টো টিউশনি করাতাম। এ প‌রি‌স্থি‌তি‌তে বি‌য়ে করাটা‌কে শ্রেয় ম‌নে করলাম না। তাছ‌াড়া বি‌য়ে মা‌নে অনেক বড়ো দা‌য়িত্ব। এত বড়ো দা‌য়িত্ব নেওয়ার মত সাহস তখন আমার ছিল না। আর প‌রি‌স্থি‌তিও ছি‌ল আমার বিপ‌ক্ষে।

ঐশীর বাবা‌কে ব‌লে বি‌য়েটা ভে‌ঙে দিলাম। তি‌নি অবশ্য ব‌লেছিলেন তারা অপেক্ষা কর‌বে, কিন্তু ভেবে‌ছিলাম কতদিন অপেক্ষা করবে? আমার সমস্যা কত‌দি‌নে সমাধান হ‌বে তা জানি না। আমি চাই না অনিশ্চয়তায় ঐশী জীবন নষ্ট করুক। একটা বিবাহযোগ্য মে‌য়ে‌কে বাবা মা কত বছর-ইবা ঘ‌রে রাখ‌কে চাই‌বে। তা-ও ঐশীর বাবা বল‌লেন,
“একবার ঐশীর সা‌থে কথা ব‌লে দে‌খো।”

ঐশী যখন আমার সাম‌নে আসল, আমি তখন ওর চো‌খে চোখ রাখ‌তে পা‌রি‌নি, কথাও বল‌তে প‌া‌রি‌নি। একটা মানু‌ষের সা‌থে শত শত স্বপ্ন সা‌জি‌য়ে সে স্বপ্ন নি‌জ হা‌তে ভে‌ঙে, কোন ‌চো‌খে তাকাতাম তার চো‌খে। কোন মু‌খে কথা বলতাম। আমার চোখ যেমন মা‌টি‌তে স্থির ছিল, তেমন মা‌টির দি‌কে চোখ স্থির রে‌খেই চ‌লে এসে‌ছিলাম। ওর দি‌কে তাকা‌লে হয়ত ওর চো‌খের অশ্রু দেখতাম। যা দেখার সাহস আমার ছিল না। বা‌ড়ি ফি‌রে শুধু একটা মে‌সেজ ক‌রে ব‌লে‌ছিলাম,
“শ্রাব‌ণের জলধারা সবার জীব‌নে আসে ন‌া। কা‌রো জীব‌নে শ্রাবণ মাস অপেক্ষার মাস হ‌য়ে থে‌কে যায়।”
আমার মে‌সেজ এর প্র‌তিউত্ত‌রে ঐশী ছোট্ট একটা লাইন লি‌খে পা‌ঠি‌য়েছিল,
“আমি সে শ্রাব‌ণের অপেক্ষায় থাকব।”
আমি আর কো‌নো উত্তর দেই‌নি। কারণ বুঝ‌তে পে‌রে‌ছিলাম শ্রাবণ আমা‌দের জীব‌নে ভা‌লোবাসাময় মুগ্ধতা নি‌য়ে নয় বরং চোখ ভরা জল নি‌য়ে আস‌তে চ‌লে‌ছে। সেদি‌নের পর ওর সা‌থে আমার আর কখনও কথা হয়‌নি।

তারপর আমাদের জীবন থে‌কে চ‌লে গে‌ল চৌদ্দ‌টি বছর। বোন‌দের বি‌য়ে দি‌য়ে‌ছি, ভাই‌কে ভা‌লো চাক‌রির ব্যবস্থা ক‌রে দি‌য়ে‌ছি। নি‌জেও বেশ প্র‌তিষ্ঠিত। ত‌বে এখনও আমি বি‌য়ে ক‌রি‌নি। আস‌লে সু‌যোগ হ‌য়ে ওঠে‌নি। ইদা‌নিং প‌রিবার থে‌কে মা‌নে মা আর বোনরা মি‌লে মে‌য়ে দেখ‌ছে। বে‌শির ভাগ মে‌য়ে আমার বয়স শু‌নে রি‌জেক্ট ক‌রে দি‌চ্ছেন। কেউ কেউ আবার বেশ প্র‌তি‌ষ্ঠিত ব‌লে বি‌য়ে কর‌তে চাই‌ছেন। আমার তেমন বি‌শেষ পছন্দ নেই। মা বোন‌দের পছন্দই পছন্দ। ত‌বে ম‌নের কো‌ণে এখনও ঐশীর বসবাস। একই শ‌হরে থাকার দরুন ঐশীর সা‌থে ক‌য়েকবার দেখা হয়ে‌ছিল, ত‌বে কথা হয় না। না সে কথা ব‌লে, না আমি। আমা‌রা এ‌কে অপ‌রের দি‌কে তাকাই‌নি পর্যন্ত। ‌ছো‌টো মামার কাছে শু‌নে‌ছিলাম সে এখনও বি‌য়ে ক‌রে‌নি, কিন্তু কেন? উত্তরটা হয়‌তো আমার অজানা নয়, তবুও নি‌জে‌কে নি‌জে অন্ধকা‌রে রাখ‌তে খারাপ লা‌গে না।

সে‌দিন হুট ক‌রেই একটা পা‌র্কে দেখা হয়ে গেল। হাজা‌রো জরতা ভে‌ঙে তার সাম‌নে গি‌য়ে দাঁড়ি‌য়ে জি‌জ্ঞেস করলাম,
“‌কেমন আছো?”
ঐ‌শী কিছুক্ষণ স্থির চো‌খে আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ছিল। হয়‌তো ভাব‌তে পার‌ছে না, চৌদ্দ বছর পর আমি নিজ থে‌কে আবার তার সা‌থে কথা বলব। খুব হালকা ক‌ণ্ঠে বলল,
“ভা‌লো আছি। আপ‌নি?”
“হুম ভা‌লো। তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?”
“ভ‌া‌লো। আপনার?”
“ভা‌লো আছে।”
“ওহ। আচ্ছা চ‌লি।”
আ‌মি কিছুক্ষণ ঐশীর দি‌কে তা‌কি‌য়ে থে‌কে বেশ তাড়াহু‌ড়ো ক‌রেই বললাম,
“এখনও বি‌য়ে ক‌রোনি কেন?”
‌সে এবারও কিছুটা সময় স্থির হ‌য়ে রইল। তারপর বলল,
“কা‌রও শ্রা‌বণের মুগ্ধতায় ভরা বৃ‌ষ্টি হ‌বো ব‌লে আজও সে শ্রাব‌ণের অপেক্ষায় আছি।”
ওর কথাগু‌লো ‌যেন আট‌কে আস‌ছিল। বোধ হয় কান্না আটকা‌তে চাই‌ছে। গলা নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পার‌লেও নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পারল না ওর বাদামী র‌ঙের চোখদু‌টে‌া। টপটপ ক‌রে ক‌য়েক‌ফোটা অশ্রু গাল বে‌য়ে পড়‌তে লাগল। আমি একরাশ মুগ্ধতা নি‌য়ে কান্ন‌ারত ঐশীকে দেখ‌তে লাগলাম। আমার কা‌ছে ওকে ত্রিশ উর্ধ্ব কো‌নো রমনী লাগছিল ন‌া বরং সেই আঠা‌রোর স্নিগ্ধ কি‌শোরী লাগ‌ছিল যা‌কে প্রথম দেখে‌ছি। যা‌কে দে‌খে‌ছিলাম চৈ‌ত্রের তপ্ত ‌বিকা‌লে। সে বিকা‌লে সে আমার জীব‌নে একরাশ শীতলতাময় শ্রাবণ নি‌য়ে উপ‌স্থিত হ‌য়ে‌ছিল। আমাকে ওর দি‌কে ওমন তা‌কিয়ে থাক‌তে দে‌খে ও আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। হনহন ক‌রে হাঁট‌তে হাঁট‌তে চ‌লে গেল। আমি একম‌নে ওর যাবার পা‌নেই চে‌য়ে রইলাম।

আ‌মিও বা‌ড়ি ফি‌রে আসলাম। হাঁট‌তে হাঁট‌তে সুন্দর একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সিদ্ধান্তটা নি‌তেই আমার এত বছ‌রের দুঃখ, কষ্ট, গ্লানী, সব যেন হাওয়ায় মি‌লে গেল। মনটা অদ্ভুত আন‌ন্দে ভ‌রে উঠল। বা‌ড়ি ফি‌রে মা, বোন‌কে জানালাম বি‌য়ে কর‌লে ঐশী‌কেই বি‌য়ে করব, কিন্তু তা নি‌য়ে ঘ‌রে তুলকালাম বাঁধল। বল‌তে পা‌রেন ঘ‌রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হ‌লো। যেখা‌নে অপরাধীর কাঠগড়ায় ঐশী‌কে দাঁড় করা‌নো হ‌লে‌া। সব অপরাধ আমার ছিল, তবুও আমার প‌রিবার অনর্গল ঐশী‌কে দোষী ক‌রে যা‌চ্ছিল।

চল‌বে…