শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-০৩

0
167

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৩

আমার মা বোন‌দের একটাই কথা, আমি কেন ব‌ত্রিশ বছ‌রের বু‌ড়ি‌কে বি‌য়ে করব? দে‌শে কী মেয়ের অভাব? নিশ্চয়ই ঐ মে‌য়ে আমা‌কে জাদু কর‌ছে। মা ‌বেশ ঝাঁঝালো ক‌ণ্ঠে বল‌লেন,
” সায়ন, তোর মতো এতো প্র‌তি‌ষ্ঠিত ছে‌লে, ‌যে কো‌নো মুহূ‌র্তে কম বয়সী সুন্দরী মে‌য়ে‌কে বি‌য়ে কর‌তে পা‌র‌বে। তাহ‌লে এতো এতো সুন্দরী মে‌য়ে ছে‌ড়ে কেন একটা বু‌ড়ি‌কে বি‌য়ে কর‌বি? কী জাদু কর‌তে ঐ বু‌ড়ি তো‌কে?”

আ‌মি তা‌দের কথা শু‌নে কিছুক্ষণ চুপ ক‌রে রইলাম। বল‌তে পা‌রেন খা‌নিকটা হতভম্বও হ‌য়ে গে‌ছিলাম। ‌কিছুক্ষণ নীরবতায় কা‌টি‌য়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে তা‌দের‌কে বল‌লাম,
“মা, তোমরা ঐশীর বয়স দেখ‌লে কিন্তু আমার বয়স দেখ‌লা না? তোমরা ঐশীর শা‌রিরীক সৌন্দর্য্য দেখ‌লো অথচ ওর অপেক্ষা, আমার প্র‌তি ওর ভা‌লোবাসা, সম্মান দেখ‌লে না? ঐশীর বয়স য‌দি ব‌ত্রি‌শের বে‌শি হয়, তে‌ার ছে‌লেও কিন্তু চ‌ল্লি‌শে পা দি‌য়ে‌ছে। আমার সমবয়সী সব বন্ধু‌, আত্মীয়‌দের ছেলে মে‌য়েও ব‌ড়ো হ‌য়ে গে‌ছে।
মা, তোমার বো‌নের ছে‌লে শফিকেই দেখ না, ও আর আমি তো সমবয়সী। একসা‌থে পড়ালেখা ক‌রে‌ছি। শ‌ফি‌কের মে‌য়ের বয়স চৌদ্দ বছর। সে‌দিন কথায় কথায় শ‌ফি‌কের স্ত্রী বলে‌ছি‌লেন, মে‌য়ের জন্য বি‌য়ের প্রস্তাবও আসা শুরু কর‌ছে। আমি আর ঐশী য‌দি সেই চৌদ্দ প‌নে‌রো বছর আ‌গে বি‌য়েটা ক‌রে ফেলতাম তাহ‌লে নিশ্চয়ই আমা‌দের সন্তান এখন ব‌ড়ো থাকত? আর তোমা‌দের নিশ্চয়ই ঐশী‌কে নি‌য়ে কো‌নো আপ‌ত্তি থাকত না।‌’

আমার কথা শু‌নে ছো‌টো‌বোন সা‌মিয়া বলল,
“বাবা মারা যাবার পর তাহ‌লে তারা বিয়ে কেন ভে‌ঙে‌ছিল? তখন হয়‌তো ভেবেছিল বাবা মারা গেছেন, টাকার মে‌শিন বন্ধ হ‌য়ে গে‌ছে, এ বা‌ড়ি‌তে হয়‌তো তা‌দের মে‌য়ে ভা‌লো খে‌তে, পর‌তে পার‌বে না, সে কার‌ণে তখন বি‌য়ে ভে‌ঙে দি‌য়ে‌ছিল। এখন যখন দেখ‌ছে বি‌য়ে ভাঙা মে‌য়ের বি‌য়ে হ‌চ্ছে ন‌া, ঘ‌রের খুঁ‌টি হ‌য়ে প‌ড়ে আছে সে কার‌ণে তোর পিছ‌নে লে‌লি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। যার নাম ভা‌লোবাসা, হ্যান ত্যান ব‌লে চালা‌চ্ছে।’

আমি সা‌মিয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘‌তারা বাবা‌কে টাকার মে‌শিন ভাব‌লে, তোরাও তো আমা‌কে তা-ই ভেবেছিস এতো বছর। নয়‌তো এত বছর যাবত কেবল তোদের জন্য করেই গেলাম, বি‌নিম‌য়ে তোরা আমা‌কে কী দি‌য়ে‌ছিস? কখ‌নো ভু‌লেও আমার বি‌য়ের কথা ম‌ু‌খে এনে‌ছি‌লি? তোর‌া চাই‌লে কিন্তু আমার বি‌য়ে আরও আগে হ‌তে পারত, কিন্তু চ‌ল্লিশ বছর হওয়ার পরও কেউ আমার বি‌য়ের কথা ভা‌বিস‌নি। সবসময় তো‌দের কী লাগ‌বে? তো‌দের সংসা‌রের কী লাগবে? তো‌দের জামাইর কী লাগ‌বে ক‌রেছিস। শেষ‌মেস বাধ্য হ‌য়ে আমা‌কেই আমার বি‌য়ের কথা মা‌’‌কে বলতে হ‌য়ে‌ছে। এর আগে তো‌দের টনক ন‌ড়ে‌ছিল? একবারও ভে‌বে‌ছি‌লি আমার বি‌য়ের কথা?
যখন বাবা মারা যান, তখন সা‌মিহার বয়স ছিল ১৮, তোর ১৫, আর শা‌মীম এর ১২। বাবা মারা যাবার পর তো‌দের লেখাপড়া শেষ করালাম, বি‌য়ে দিলাম, শামীম‌কে চাক‌রি দিলাম। এত‌কিছুর ম‌ধ্যে তোদের একবারও ম‌নে হয়‌নি যে ভাইটা বাবা মারা যাবার পর আমা‌দের জন্য এত করল তার কথা একটু ভা‌বি? আজ যখন নি‌জেই নি‌জের খু‌শি থাকার মাধ্যম খুঁজ‌তে চাইলাম তখন এত বা‌জে কথা?
সে‌দিন ঐশীর বাবা বি‌য়ে ভা‌ঙে‌ননি, বরং আমিও দা‌য়িত্ব নি‌তে পারব না ব‌লে কাপুরু‌ষের ম‌তো বি‌য়ে ভে‌ঙে চ‌লে এসে‌ছিলাম। ঐশী‌র সা‌থে কথা পর্যন্ত ব‌লি‌নি। চো‌রের ম‌তো চ‌লে এসে‌ছিলাম। সে‌দিন তোরাও তো আমা‌কে সাহস দিয়ে ব‌লিস‌নি, ভাইয়‌া, বি‌য়ে কর। যে ঘ‌রে হাঁড়ি‌তে পাঁচজনার চাল রান্না হয়, সে হাঁ‌ড়ি‌তে ছয় জনার রান্না কর‌তে তেমন কষ্ট হ‌বে না। আমরা চল‌তে পারলে সে-ও পার‌বে। বরং ব‌লেছিলি, এখন বি‌য়ে নামক ঝা‌মেলা কাঁ‌ধে নেওয়ার দরকার নেই। আর আজও ঐশী আমা‌কে বি‌য়ের জন্য ব‌লে‌নি। এমন‌কি ঐশী কিংবা ওর প‌রিবার জা‌নেও না যে, আমি ওকে আবার বি‌য়ে কর‌তে চাই। ত‌বে শীঘ্রই আমি আবার বি‌য়ের প্রস্তাব পাঠাব।”

মা বেশ রা‌গি এবং বিরক্ত ক‌ণ্ঠে বললেন,
“যে ‌মে‌য়ে বি‌য়ে ক‌রে এখনও আসে‌নি, কেবল কথা উঠে‌ছে ওম‌নি ভাই বো‌নের মা‌ঝে ঝা‌মেলা পা‌কি‌য়ে দিল? কেমন অপয়া মে‌য়ে! খবরদার সায়ন, আমি সাফ সাফ ব‌লে‌ দি‌চ্ছি ঐ মেয়ে এ ঘ‌রে বউ হ‌য়ে আস‌লে আমি ঘর ছে‌ড়ে চ‌লে যাব।”
“মা, সারাজীবন তু‌মি কেবল আমা‌কে হুকুম ক‌রেই গে‌লে, কখ‌নো আমার অনু‌রোধ রে‌খে‌ছো কী? সবসময় কেবল বাকি‌দের কথা ভাব‌লে, আমার কথা ভে‌বে‌ছো? বি‌শেষ ক‌রে বাবা ম‌ারা যাবার তোমরা সবাই কেবল আমা‌কে প্র‌য়োজন মেটা‌নোর মানুষই ভে‌বে গে‌লে। আমার প্র‌য়োজনটা বুঝ‌লে না।”

মা আরও রাগ ক‌রে বললেন,
“এসব কথা ঐ মে‌য়েটা তো‌কে শি‌খি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে?”
“মা, সব বি‌ষ‌য়ে ওকে টে‌নে দোষ দেওয়া কী ঠিক? ও কেন শেখা‌বে? আমি কী ছাগল, না‌কি গাধা যে উচিত কথা বল‌তে পারব না? তো সব‌কিছু‌তে ওর দোষ কেন দি‌চ্ছো?”
“‌কেন দিব না? ওর আক্কেল নেই? এতো বছর বি‌য়ে ক‌রে‌নি কেন? আমরা কী ওয়াদা দি‌য়ে রেখে‌ছিলাম যে, আমা‌দের ঘ‌রের বউ করব? সে কার‌ণে অপেক্ষা ক‌রো? নিজ দো‌ষে অপেক্ষা ক‌রে বু‌ড়ি হ‌লে তার দায় আমা‌দের না। আমার তো ম‌নে হয় ত‌লে ত‌লে ঘটনা অন্য‌কিছু। মে‌য়ে অপেক্ষা কর‌তে চাইল আর বাবা মা রা‌জি হ‌য়ে গেল? নি‌জে‌দের বি‌বেক নেই, এত বছর পর্যন্ত মে‌য়েকে ঘ‌রের খুঁ‌টি কেন ‌রে‌খে‌ছে? মে‌য়ে তো দেখ‌তে খারাপ না। শু‌নে‌ছি ব্যাং‌কে সরকা‌রি চাক‌রি ক‌রে, সে মে‌য়ের জন্য তো ভা‌লো ভা‌লো বি‌য়ের প্রস্তাব আসার কথা। তাহ‌লে তারা কেন এত বছর মে‌য়ে‌কে বি‌য়ে দেননি? মে‌য়ে বল‌ল, তোর জন্য অপেক্ষা কর‌ছে আর তারা মে‌নে নি‌লো? নি‌জে‌দের বিচার বি‌বেচনা নেই? আর তোর ম‌নে হয় বাঙালী বাবা মা‌য়েরা মে‌য়ে‌দের কথার এতো গুরুত্ব দেয় যে মে‌য়ে‌কে এতগু‌লো বছর পর্যন্ত ঘ‌রে ব‌সি‌য়ে রা‌খে? ওর ছো‌টো বোন‌দেরও তো বি‌য়ে বাচ্চা সব হ‌য়ে‌ছে, তাহ‌লে ওকে কেন বিয়ে দেয়‌নি?”

মা‌য়ের কথায় আম‌ারও ম‌নেও স‌ন্দে‌হের বীজ অঙ্কু‌রিত হ‌লো। আস‌লেই তো? ঐশী বলল আর ওর প‌রিবার এতো সহ‌জে ওর কথা মে‌নে নি‌লো? কেন? মা আমার মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে বলল,
“‌তোর ধারণা ভুল যে তো‌কে আমরা আমা‌দের প্র‌য়োজনে ব্যবহার কর‌ছি। তো‌কে আমি সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লোবাসি। তোর ভাই বো‌নেরাও তো‌কে অনেক ভা‌লোবাসে সম্মান ক‌রে। তোর বাবার মৃত্য‌‌ুর পর তুই-ই তো ওদের জীব‌নে তার স্থান দখল ক‌রে‌ছিস। হ্যাঁ আমরাও ভুল ক‌রে‌ছি। তোর কথা তেমন ভা‌বি‌নি তা নয়, আস‌লে কীভা‌বে যেন সময় পে‌ড়িয়ে গেল। তুই ঐশী‌কে বি‌য়ে কর‌তে চাইলে কর। আমরা আপ‌ত্তি করব না। তার আগে ওর বিষ‌য়ে একটু ভা‌লো ক‌রে খোঁজ খবর নে। জ্ঞানী গু‌ণীরা ব‌লেন, বি‌য়ে কাজ, ঘর কাজ, নাও কা‌জে তাড়াহু‌ড়ো কর‌তে নেই। ভা‌লো ক‌রে খোঁজ খবর নি‌য়ে এগো‌তে হয়। ”

মা এর কথায় আমার ম‌স্তিষ্ক বেশ ঘু‌রে গেল। তি‌নি যা বল‌লেন তা ঠিক। আমি কী একটু বে‌শি তাড়াহুড়া করে ফেল‌ছি না? আমার উচিত খোঁজ খবর নেওয়া। ঐশীর বাবার সা‌থে সরাস‌রি কথা বলা।

(সায়ন য‌দি তখন পিছন ঘুরত তাহ‌লে ওর মা‌য়ের ঠোঁ‌টের কো‌ণের রহস্যময় হাসিটা দেখত। হা‌সিটা এমন যেন তি‌নি বিনা ক‌ষ্টে, বিনা হা‌তিয়ারে যুদ্ধ জয় ক‌রে‌ছেন। ফাঁকা মা‌ঠে গোলটা তি‌নিই দি‌য়ে‌ছেন।)

চলবে।