শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-০৩

0
894

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

-খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? এভাবে ঘামছো কেন?

শাইনির কন্ঠস্বর শুনে তাজ্জব বনে গেলো বেলা। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার৷ চাঁদটা ঠিক পশ্চিম দিকে হেলে আছে৷ ওর মনে পড়লো, দুপুরে ঘুমানোর পর আর জেগে উঠেনি, এখন বোধহয় মাঝরাত। আর এতো রাতে শাইনি এখানে কী করছে? বেলা বিছানায় উঠে বসে অবাক হয়ে বলল,
-আপনি এখানে?
-হুম আমি।
-আমার ঘরে কী করছেন?
-বর বউয়ের ঘরে কী করবে? থাকতে এসেছি।
-থাকতে এসেছেন মানে? আমাকে এখনো উঠিয়ে দেওয়া হয়নি বুঝেছেন? থাকাথাকির কথা তো আগে বলা হয়নি!
শাইনি হেসে বলল, ‘বলা হয়নি বলে কি থাকতে পারবোনা? এই নিয়ম কোথায় লেখা আছে?’
-আপনার ফ্যামিলিকে আগেই জানানো হয়েছে।
-সেটা ফ্যামিলির বিষয়। আমি তাতে কী করব?
-আপনি যান এখান থেকে।
-যেতে আসিনি।
-এরকম কেন করছেন?
-তোমাকে পাওয়ার জন্য।
বেলা রাগে কটমট করে বলল, ‘এত সস্তা নই আমি। যে চাইলেন আর পেয়ে গেলেন।’
-এই যে, চাইলাম আর পেয়েও গেলাম। আইন ও ধর্ম মোতাবেক তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমার হাজব্যান্ড।
বেলা বলল, ‘হাজব্যান্ড মাই ফুট!’
-যা ইচ্ছে বলতে পারো।
-নির্লজ্জ লোক।

শাইনি কিছু না বলে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বেলা হতভম্ব হয়ে লাফ দিয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে। এই লোকের সাথে একঘরে থাকতে হবে ভেবেই গা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। ততক্ষণে শাইনি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর পায়তারা করছে। বেলা দিবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। এতোরাতে সবাই সবার ঘরে ঘুমাচ্ছে। শাইনি এসেছে এটা ওকে কেউ জানায়নি কেন আশ্চর্য! ওর বাবা-মায়ের চিন্তা, বিবেকবুদ্ধি কী লোপ পেয়েছে নাকি? যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে সবাই। ওর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধটুকু করছেনা কেউ! সারারাত আর ঘরে গেলোনা বেলা। ড্রইংরুমের সোফায় বসে কাটিয়ে দিলো। শেষরাতের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো বিধায় ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। তার জীবনের অর্ধের সুখ-শান্তি বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই শেষ। বিবাহ নামক সম্পর্কটায় বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো নাইমুর উদ্দীন সাহেবের ডাকে। মেয়েকে সোফায় বসে ঘুমাতে দেখে তিনি অবাকই হলেন। ঘর থাকতে এখানে কেন? তিনি আস্তে করে ডাকলেন বেলাকে।
-বেলা মা? এখানে ঘুমিয়ে আছিস কেন?
বেলা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘ডেকোনা তো!’
-ঘুমাবি যখন ঘরে যা না। এক্ষুনি সবাই উঠে পড়বে। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।
-ঘর খালি আছে? সব ঘরই তো ব্লক। আমার থাকার জায়গা কই?
-দিবার ঘরেই যা না।
-ওখানে তো..
-কী?
বেলা উত্তরে বলল, ‘কিছুনা। আচ্ছা যাচ্ছি!’
বলেই উঠে পড়লো সে। শাইনির কথা না বলে দিবার ঘরে চলে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো শাইনি নেই। বারান্দা, বাথরুম কোথাও সে নেই। বেলার মাথায় তখন ঘুরপাক খেতে লাগলো নানান চিন্তা। সত্যিই কী শাইনি এসেছিল? নাকি মনের ভুল বা স্বপ্ন? দৌড়ে রান্নাঘরে সীমার কাছে গেলো। তিনি মেয়েকে অস্থির হতে দেখে বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
বেলা অস্থিরতা গোপন করার চেষ্টা করে বলল, ‘কিছুনা।’
-দৌড়ে আসলি যে?
-ওই এমনিই।
বেলা বুঝতে পারছেনা কথাটা কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে। মায়ের সামনে শাইনির কথা বলতে ওর শরীর কাঁপছে, লজ্জা লাগছে। তবুও সাহস করে নিঃশ্বাস আটকে বলেই ফেলল,
-ও ও ওনি কোথায় মা?
সীমা বেগম বাসন ঘষছিলেন। মেয়ের কথায় অবাক হয়ে বললেন, ‘ওনি কে?’
-শ শাইনি।
-কোথায় আর থাকবে। ওর বাসায়ই নিশ্চয়ই।
বেলা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ওনি চলে গেছেন?’
-চলে গেছেন মানে? কোথায় চলে গেছে?
-বাসায়?
সীমা আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সকাল সকাল পাগল হয়ে গেলি নাকি? ও তো ওর বাসায়ই থাকবে। কোথায় আর যাবে? আচ্ছা তুই ওর সাথে কথাটথা বলিস তো?’
বেলা আমতাআমতা করে বলল, ‘না মানে হ্যাঁ। বলি তো।’
সীমা বেগম চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কাল রাতে কথা বলেছিলি? ফোন দিয়েছিলি?’
বেলা অবাক হয়ে ভাবলো কাল রাতে ফোন দিবে কেন? কাল তো শাইনি এ বাসায়ই এসেছিল। কিন্তু ওর মায়ের কথাবার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে শাইনি এখানে আসেইনি। অযথা মায়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তাই মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বেলা দিবার ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে বসতেই ভাবলো রাতের ঘটনা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেড সাইড টেবিলে একটা কাগজ পেয়ে ওর সম্পূর্ণ ধারণাই বদলে গেলো। হ্যাঁ, লোকটা সত্যিই এসেছিল। আবার চিরকুটও রেখে গেছে।
সেখানে লিখা, ‘তোমার সাথে ঘুমাতে এসে একাই ঘুমিয়েছি। ভীষণ রাগ হয়েছে আমার। তুমি যে সোফায় বসে হা করে ঘুমাচ্ছিলে তখন একটা চুমুও খেয়েছি। এভাবে কেউ ঘুমায় নাকি? আমার গার্লফ্রেন্ড নিশা তো এভাবে ঘুমায় না। অবশ্য তোমাকে কিউটই লাগছিলো৷ যাইহোক, ভোরবেলা আমি চলে এসেছি বাসায়। আসার সময় তুমি ঘুমিয়ে ছিলে দেখে আর জাগাইনি। আরেকটা কথা, হোটেলে আমাকে যে মেয়েটার সাথে দেখেছিলে ও-ই নিশা। ও ছাড়া আমার আর গার্লফ্রেন্ড নেই। না বলে চলে আসার জন্য স্যরি বউ!’

সবটুকু পড়ে কান গরম হয়ে গিয়েছে বেলার। যেন শাইনি ওর কানে কানে কথাগুলো বলছে। রাগে, দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে ওর। ওর ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়েছে লোকটা। ছিঃ! কাগজটা ছিঁড়ে, দুমড়েমুচড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো সে।
সীমা বেগমের ডাক শোনা যাচ্ছে। নাস্তা খেতে ডাকছে হয়তো। বেলা ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে চললো। কাজিনদের সঙ্গে বসে নাস্তা করে নিলো সে। তারপর খেলো মেহমানরা। সবাই আজ চলে যাবে। খবরটা শুনে বেলা স্বস্তি পেলো। নিজের ঘরটা অন্তত ফাঁকা পাওয়া যাবে!

বিকেলের দিকে বেলার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন এলো। সীমা বেগম কথা বললেন। তারপর বেলার কাছে ফোন দিতে বললেন শাইনির মা নাজনীন বেগম। বেলা ইতস্তত করে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি!’
-ওয়ালাইকুম সালাম। আন্টি বলছো কেন? মা ডাকবে কেমন?
বেলা নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘জি মা।’
-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
-ভালো আছি। কথা বলতে আনইজি লাগছে?
-একটু একটু।
-আমাকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। মনে করবে নিজের আম্মুই। শাইনি যেমন আমার ছেলে, তেমনি তুমিও আমার মেয়ে।
-জি আচ্ছা।
-আসলে আমার ছেলের বিষয়ে কিছু কথা বলতেই ফোনটা দিলাম।
বেলা সচকিত হয়ে উঠে বসলো। বলল, ‘কী কথা?’
নাজনীন বেগম মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আসলে শাইনি একটু অন্যধাঁচের মানুষ। আমি মা হয়েও আজ পর্যন্ত ওকে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে পারিনি। সে সবসময় নিজের মতোই চলাফেরা করে। কারো কথা কানে নেয়না। আজ থেকে প্রায় তিনমাস আগে, হুট করে একদিন তোমাকে কারোর বিয়েতে দেখে। পরবর্তীতে বাসায় এসে জানায় সে তোমাকে বিয়ে করবে। সবাই তো আমরা অবাক। প্রথমে আমরা রাজি হইনি কারণ ছেলে ভীষণ উড়নচণ্ডী স্বভাবের। কিন্তু ওর জেদের কাছে হার মেনে অবশেষে তোমাকে দেখলাম। আমাদেরও পছন্দ হলো। তখনো জানিনা শাইনির ফ্রেন্ড নিশা ওর গার্লফ্রেন্ড। জেনেছি তোমাদের বিয়ের পর, মানে কাল রাতে। এখন আমি বুঝতে পারছিনা কী করব? তোমাকে জানানো উচিৎ বলেই সবটা জানালাম। এদিকে শাইনি বলছে ও তোমাকে কিছুতেই ছাড়বেনা আবার ওর গার্লফ্রেন্ডকেও না। এ অবস্থায় আমার মাথায় কিছু আসছেনা। তুমি ভেবেচিন্তে আমাদেরকে জানিও। আমি চাইনা আমার ছেলের জন্য তুমি স্যাক্রিফাইস করো। কজ তুমি ভীষণ ভালো একটা মেয়ে।’

বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব ও জানে। নাজনীন বেগমের কাছ থেকে নতুন বিষয়ে জানতে পারলো, বিয়ের তিনমাস আগে থেকেই ওর ওপর শাইনির নজর ছিল? স্ট্রেঞ্জ! কখনো তো ওকে দেখেছে বলে মনে পড়েনা বেলার। সে ধীর কন্ঠে বলল, ‘বুঝতে পারছিনা আমি কী করা উচিৎ।’
নাজনীন বেগম ফোনের ওপাশ থেকে হতাশাজনক কন্ঠে বললেন, ‘ভাবো। ভেবে সময় নিয়ে আমাকে জানিও। পুত্রবধূ হিসেবে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন সবটাই তোমার ওপর ডিপেন্ড করছে মা।’
-হ্যাঁ।
-তোমার ফাইনাল এক্সাম কবে?
-এইতো কিছুদিন পরেই।
-আচ্ছা এক্সামের পরে না-হয় আমাকে জানিও? এখন স্ট্রেস নিতে হবেনা।
বেলা মৃদু কন্ঠে বলল, ‘জি আচ্ছা।’
-এখন রাখছি। আর আমি যে ফোনে তোমাকে এসব বললাম সেটা শাইনিকে বলোনা। ভীষণ রাগবে তাহলে।
-ওনি কী রাগী?
বেলার প্রশ্ন শুনে নাজনীন বেগম হাসলেন। বললেন, ‘না রাগী না। তবে মাঝেমধ্যে রেগে গেলে হুঁশ থাকেনা আরকি৷ তোমাকে সে ছাড়বেনা আগেই বলে দিয়েছে। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি কর‍তে না করেছে।’
-কেন এমন করছে তাহলে? অন্য কারো সাথে সম্পর্ক থাকলে আমাকেই কেন বিয়ে করল?
-জানিনা মা।
-ঠিক আছে। রাখি।

ফোন কেটে বেলা ‘থ’ মেরে বসে রইলো। এসব তার সাথে কি হচ্ছে। স্বয়ং শ্বাশুড়ি মা ফোন করে তার ছেলেকে ছাড়ার কথা বলছে! বিয়ের দু-দিন গড়িয়ে তিনদিনে পড়লো তাতেই নাজেহাল অবস্থায় ফেলেছে বেলাকে। এ কেমন পরিবার আর কেমন শিক্ষাদীক্ষার লোকজন?

চলবে..ইনশাআল্লাহ!