শ্রাবণ ধারায় পর্ব-০১

0
240

#শ্রাবণ_ধারায় |১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সাদা এপ্রোন পরিহিতা নার্স প্রাণপনে দৌড়ে মানসিক হাসপাতালের করিডর থেকে সাইক্রেটিস্ট জিদানের রুমে গেল।দরজায় দুবার কড়া নেড়েই দরজার হাতল বামে মোচড় দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সে।কোনোকিছু না ভেবেই এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করলো,
– স্যার একশো ছয় নম্বর কেবিনের রোগী ইনজেকশনের সুঁই দিয়ে নিজের হাতের শিরা ছিঁড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

ডা. জিদান তার ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীদের দেওয়া টেস্টগুলোর রিপোর্ট চেক করছিল।সহসা এমন উক্তি শুনে চমকে ওঠে সে।টেবিলের উপর শব্দ করে রিপোর্টগুলো রেখে চোখ বড় বড় করে জবাব দেয়,
– কি বলছেন এসব?ওনার সাথে কেউ ছিল না?ওনাকে তো এখন ঘুমের ওষুধ দেওয়ার কথা তাহলে এ অঘটন ঘটলো কিভাবে? আপনারা সবাই কোথায় ছিলেন?

মাথা নত করে ফেলল নার্সটি।মিন মিন করে কিছু উচ্চারণ করলো,
– আমরা তো…

নার্সের মিনমিন যেন চট করে মস্তক গরম করে ফেলল জিদানের সে প্রচন্ড জোরে টেবিলে একটি বারি দিয়ে বলল,
– চুপ থাকুন কোনো ধরনের লেইম এক্সকিউজ শুনতে চাই না আমি।ওনাকে কি মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে?পুলিশকে ইনফর্ম করা হয়েছে?জানেন তো এসব কেসে পুলিশের পারমিশন ছাড়া চিকিৎসা শুরু হয় না।

– জ্বী স্যার পুলিশকে ইনফর্ম করা হয়েছে।আর ওনাকে মেডিকেলেও নেওয়া হয়েছে।

– ওনার ওয়াইফকে ফোন করে খবরটা বলুন।দেখি এবার উনি কিভাবে না এসে পারে।এতোদিন উনি এড়িয়ে গেছেন এবার কিভাবে এড়িয়ে যান সেটাই দেখার পালা।

নার্স মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে ভাবুক স্বরে বলল,
– স্যার আমার না মনে হয় উনি এমনটা করেছে ওনার বউকে এখানে আনার জন্যই।বউটাও কি পাষাণ একবারও দেখতে এলো না পাগল স্বামীটাকে।

– এসব আমাদের দেখার বিষয় না আপনাকে যেটা বলেছি সেটা করুন।রোগী কি বেশি ইনজুরিড হয়েছে?

– অতটা হয়নি স্যার তার আগেই ওখানে সিমা চলে গিয়েছিল ওনাকে ইনজেকশন দিতে।যাওয়ার পর এ দৃশ্য দেখে তো চিৎকার করে ও সেখানেই জ্ঞান হারিয়েছে।পরে আমি গিয়ে দেখলাম হাত থেকে রক্ত পড়ছে।

– যান ওনার ওয়াইফকে ফোন করুন।

– জ্বী স্যার।

রুম থেকে বেরিয়ে ফোন থেকে “চিনি বুশরা” নামে সেভ করা নম্বরটিতে ডায়াল করলো নার্স মেয়েটি।নম্বরটি তার কাছে সেভ করাই আছে। কারণ এ নম্বরে আগেও অনেকবার ফোন করা হয়েছে। কখনো কল রিসিভ হয়েছে তো কখনো ইচ্ছাকৃত কল কেটে দেওয়া হয়েছে।আজ কল রিসিভ হয় কিনা সেটাই দেখার পালা।আজ দু’মাস যাবৎ এই চিনি বুশরার স্বামী এই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। তার মা তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে যায়।সকল খরচও সে বহন করে তবে এই দুই মাসে একবারও ছেলেকে দেখতে আসেনি সে।তাকে কল করা হলে সে বলে সে ব্যস্ত। তাই আর তাকে কল করা হয় না।স্ত্রীর নম্বরটা লোকটাই দিয়েছিল।তার যত পাগলমো তার স্ত্রীকে একবার দেখার জন্য।তবে পাষাণ হৃদয় স্ত্রীকে এই দুই মাসে একবারও আসতে দেখেনি নার্স প্রিয়ম।দুইবার কল করা হলো।কিন্তু দুইবারের একবারও কল রিসিভ হলো না। আবারও কল করা হলো এবার কল কেটে দেওয়া হলো অপর পাশ থেকে।তাও দমে গেল না প্রিয়ম।আবারও কল করলো “চিনি বুশরা” নামে সেভ করা নম্বরটিতে।এবার ফোন রিসিভ হলো।অপর পাশ থেকে শোনা গেল শক্ত ও গম্ভীর একটি মেয়েলি কন্ঠ,
– কি সমস্যা? ফোন দিচ্ছেন কেন বার বার?আপনাদের কতবার বলা হয়েছে আমাকে ফোন করবেন না?তারপরও কেন ফোন করেন?ঐ লোকটার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কতবার বলতে হবে আপনাদের?

চিনির আচারণে একটু রাগ হলো প্রিয়মের। তবু নিজেকে সংযত রেখে সে তার মিষ্টি কন্ঠে বললো,
– আসলে ম্যাম আপনাকে একটি নিউজ দেওয়ার জন্য বললেন জিদান স্যার।

আবারও কর্কশ কন্ঠ ভেসে এলো অপর পাশ থেকে,
– কি নিউজ?

– জ্বী ম্যাম আপনার হাসবেন্ড হাত কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।এখন সে কেন্দ্রীয় মেডিকেলে ভর্তি আছে।এটাই বলার জন্য ফোন করা আপনাকে।

কয়েক মুহুর্ত অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না।শুধু শোনা গেল দ্রুতগতির নিঃশ্বাসের শব্দ। নিস্তব্ধতায় বাতাস ভারি হয়ে গেল।নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রিয়ম থমথমে স্বরে বলল,
– জ্বী ম্যাম আপনি কি একবার আসতে পারবেন।যদি আসতেন খুব ভালো হতো।যেহেতু রোগী মানসিক ভারসাম্যহীন তাই এই মুহুর্তে তার কাছে মানুষদের থেকে মানসিকভাবে সাহায্য পেলে রোগী অনেক জলদি রিকোভার করবে।আশা করি আপনি বিষয়টা বুঝবেন।

অপর পাশ থেকে আর কোনো জবাব পাওয়া গেল না।পাওয়া যাবেও বা কিভাবে কলটা তো আরও এক মিনিট আগেই কাটা হয়েছে।অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ না আসায় ফোনটা মুখের সামনে এনে দেখলো কল কেটেছে “চিনি বুশরা”। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো প্রিয়ম।সে সকল ভাবনা চিন্তা পরিত্যাগ করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে।

নীল শাড়িতে হাসপাতালে প্রবেশ করলো এক যুবতী।সকলের নজর তার উপর।সে এমনই সকলের নজর কাড়ে সবখানে।এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।শুভ্র তৈলাক্ত মুখে কোনোরকম প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই।কোমর অবধি রেশমি চুলগুলো হাঁটার গতিতে এলোমেলোভাবে উড়ছে।শরীরে নেই কোনো অলংকার।শুধুই গাঢ় নীল শাড়ি তাতেই তাকে তিলোত্তমা মনে হচ্ছে।

হাসপাতালের বেডে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে “বারিশ মৃধা”। বাম হাতের শিরা থেকে শরীরে রক্ত প্রবেশ করছে।ডান হাতে বেশ বড় আকারের একটি আপেল।কিছুক্ষণ পর পর আপেলে ছোট্ট করে কামড় বসাচ্ছে আর দরজার দিকে চেয়ে শ্বাস ফেলছে।আচমকাই মৃদু হাসলো সে জোরে একটি শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বলল,
– ইন থ্রি, টু,ওয়ান এন্ড হেয়ার সি ইজ।

নাকে চিরচেনা মিষ্টি সুঘ্রাণটি বারি খেতেই মুখের হাসি চওড়া হলো তার।চোখ খুলল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে চেয়ে বলল,
– ওয়েলকাম ব্যাক ম্যাম।

বারিশের কথা শেষ হতেই ছুটে এসে বারিশের হাতে থাকা আধ খাওয়া আপেলটি এক টানে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নীল শাড়ি পরিহিতা রমণী।তা দেখে শব্দ করে হাসলো বারিশ।বারিশের দিকে তর্জনি তুলে রক্ত চক্ষু রমণী কর্কশ স্বরে বলল,
– এসব কেন করছেন আপনি?বলেছিনা এসব করে কোনো লাভ হবে না।তারপরও এসব পাগলামি করে কি প্রমাণ করতে চায়ছেন হ্যাঁ?

মুখে হাত দিয়ে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল বারিশ।বিড়বিড়িয়ে বলল,
– নাম চিনি অথচ বোম্বাই মরিচের মতো ঝাঁজ।বাট আই লাইক ইট।নোপ একচুয়েলি আই লাভ ইট।

বারিশকে বিড়বিড় করতে দেখে মেজাজ এবার সপ্তমে চড়ে চিনির।তর্জনি দিয়ে সামান্য ধাক্কা দেয় বারিশের নাকে।রাগে কটমট করে বলে,
– কি বলছেন বিড় বিড় করে?আমি আপনাকে বলছি মি.বারিশ মৃধা।আমি যখন বলেছি আমি আপনার কাছে আর কখনোই ফিরবো না তো ফিরবো না।আর আমি আপনাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলাম সেটা কোর্টে জমা দেননি কেন? এসব ড্রামা করে কোনো লাভ হবে না।দ্রুত ডিভোর্স পেপার কোর্টে জমা করার ব্যবস্থা করুন।

দৃঢ় স্বরে জবাব দিল বারিশ,
– নেভার এভার।

– নেভার এভার মানে কি হ্যাঁ? বলছিনা এসব পাগলামো করে কোনো লাভ হবে না।আপনি আমার মাথায় বন্দুক রেখেও আর ফেরাতে পারবেন না।বুঝেছেন?তাই বিষয়টাকে জটিল না করে সহজ স্বাভাবিকভাবে শেষ করুন বুঝেছেন?

বারিশ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চিনি কতটা বদলে গেল দু’মাসে মেয়েটা।আগের মতো চেহারায় তেমন লাবণ্যতা নেই।কথা বার্তায়ও কেমন খিটখিটে ভাব।মাথা নুইয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে সে।মলিন স্বরে বলে,
– আচ্ছা চিনি তোমারও কি মনে হয় আমি পাগল?মানসিক ভারসাম্যহীন?

গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল চিনি,
– সুস্থ হলে মানসিক হাসপাতালে রাখত না নিশ্চয়ই?

মুখ বাঁকায় বারিশ মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি।করুণ দৃষ্টিতে চিনির চোখে রাখে সে অসহায় স্বরে বলে,
– ঐ মহিলা আমাকে পাগল সাজিয়ে এখানে রেখেছে চিনি।যা হয়েছে সব ঐ মহিলার জন্য।আমাকে একটু সাহায্য করো চিনি।আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করো। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আমার কাছে ফেরার জন্য কখনোই ফোর্স করবো না শুধু আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করো।প্লিজ….

হঠাৎই বুকের ধুকপুক বেড়ে যায় চিনির।বারিশের এমন আহত স্বর এর আগে কখনো শোনেনি সে।আড় চোখে বারিশকে দেখে সে করুণ দৃষ্টিতে বারিশ চেয়ে আছে তার দিকে।মনে মনে ভাবে “কোনো ভারসাম্যহীন ব্যক্তি কিভাবে এতোটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলে?তাহলে কি বারিশ যা বলছে সেটাই সত্য?কিন্তু ঐ মহিলা বলতে সে ঠিক কাকে বুঝিয়েছে?” চিনি গলা পরিষ্কার করে বলল,
– ঐ মহিলা বলতে?

– রানী মৃধা।

চিনি চক্ষু কপালে তুলে অবাক স্বরে বলে,
– মা? মা কেন আপনার সাথে এমন করবে? আর আমিই বা কেন আপনাকে সাহায্য করবো?আমার সাথে এত কিছু করার পরও আপনি কিভাবে আমার থেকে সাহায্য চান?

– প্লিজ সাহায্য করো।তোমাকে আর কখনোই ডিস্টার্ব করবো না কথা দিচ্ছি চিনি।

বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ায় চিনি।পিছন থেকে করুন স্বরে বলা বারিশের কথাটি শুনে পা জমে যায় তার।সেখানেই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রই সে।পিছন না ফিরেই উত্তর দেয়,
– আচ্ছা ঠিক আছে আপনাকে আমি সাহায্য করবো। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে এরপর যেন আমাদের আর কখনো দেখা না হয়।

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে বারিশ মলিন স্বরে জবাব দেয়,
– হুম।

পিছন ফিরে তাকায় না চিনি দ্রুত গতিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় সে।চিনি যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বারিশ।চোখ ঘুরিয়ে ঝুলিয়ে রাখা রক্তের ব্যাগের দিকে তাকায় সে।আর অল্প রক্ত বাকি আছে।

চলবে…?