শ্রাবণ ধারায় পর্ব-০২

0
209

#শ্রাবণ_ধারায় |২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

শহরে একা একটি ফ্লাট নিয়ে থাকে চিনি।ফ্লাটটি দ্বিতীয় তলায়।তার মা-বাবা গ্রামে একটি বিশাল বাগান বাড়িতে বসবাস করে।সে বিয়ের পর এ শহরে আসে বারিশের সাথে বারিশের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আর ফিরে যাওয়া হয়নি তার।এ শহরের মায়ায় সে একা একাই এখানে বাস করতে শুরু করে।মাঝে মাঝে মা-বাবার খাতিরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়।তবে না যাওয়ার বাহানাটাই বেশি।এখানে সে একটি টেলিভিশন সেন্টারে সংবাদ সংস্করণের কাজ করে।বেসরকারি চাকরি তাই মোটামুটি যা উপার্যন হয় তাতে একার পেট ভালোভাবেই চলে যায়।নিজের সকল চাহিদা পুরণের পর যে বাড়তি টাকা বেঁচে যায় তা সে তার সঞ্চয়ে রাখে।বাড়ি থেকেও প্রতিমাসে তাকে টাকা পাঠানো হয়।তবে সে টাকার ভাঁজ চিনি কখনো খুলে দেখে না।দুইমাসে আজ প্রথম সে বারিশের আত্মহত্যার চেষ্টা করার খবর পেল।তাই শত চেষ্টার পরও সে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারেনি বারিশের কাছে যাওয়ার থেকে।বারিশকে দেখতে গিয়ে কি সে ঠিক করেছে?নাকি এটাও বারিশকে বিয়ে করার মতো একটি চরম ভুল?
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে পাকা রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে চিনি।হাতে তার প্রয়োজনীয় কিছু কাঁচা বাজার।শাকসবজি আর একটি মাঝারি আকারের একটি রই মাছ।মাছটি দোকান থেকে কাটিয়ে নিয়েছে চিনি।বাড়িতে গিয়ে টমেটো আর আলু দিয়ে রান্না করবে ভেবেছে।আসরের আযান কানে আসতেই পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো সে।কতটা দেরি হয়ে গেল।অফিস থেকে সোজা হাসপাতালে গিয়েছিল সে।বাজার করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ অনেকটা দেরি হয়েছে।
চাবি দিয়ে ফ্লাটের দরজটি খুলে হাতের বাজারগুলো দরজার ভিতরে রাখে চিনি।বাইরে রাখা এক বোতল দুধ আর একটি খবরের কাগজ।সেগুলো নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে।ফ্লাটটা বেশি বড় নয় তবে তিনজনের একটি পরিবার বেশ ভালোভাবেই বাস করতে পারবে এখানে।একটি মাঝারি বসার ঘর, দুইটি শোয়ার ঘর,একটি রান্নাঘর এবং দুইটি ওয়াশরুম নিয়ে তৈরি ফ্লাটটি।চিনি নিজের মতো করে সাজিয়েছে তার বাসা। সে মানুষ হিসেবে ততোটা শৌখিন না হওয়ায় ঘর প্রয়োজনীয় আসবাবে ঠাঁসা।শৌখিন আসবাবের মধ্যে শুধুমাত্র একটি গোল্ড ফিসের একুরিয়াম দেখা যাচ্ছে। মাঝারি সাইজের টিভির পাশেই তার অবস্থান।একুরিয়ামটি আকারে বেশ বড়। তাতে আটটি গোল্ড রয়েছে।নয়টি ছিল একটি মারা গিয়েছে গত পরশু।একুরিয়ামটি বেশ সুন্দর করে সাজানো।ভিতরে অক্সিজেন প্রবেশের সুব্যবস্থা রয়েছে।মাছগুলো লেজ নাড়িয়ে একুরিয়ামের এপাশ ওপাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। বসার ঘরে তিন সিটের একটি সোফা এবং তার পাশে একটি সিঙ্গেল সোফা।কিছুটা দুরত্বে খাওয়ার টেবিল এবং তার পাশেই রান্নাঘর।বামদিকে পাশাপাশি দুটি ঘর।

চিনি খবরের কাগজটি সোফার সামনে রাখা টি টেবিলে রেখে বাজার নিয়ে রান্নাঘরে গেল।বাজারগুলো রেখে গ্যাসের চুলায় গরম পানি বসালো।এককাপ চা খাওয়া এখন একান্ত প্রয়োজন।পানি বসিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।বিছানার দিকে একপলক দেখে বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরলো সে।হঠাৎই থমকে গেল সে।চোখ বড় বড় করে আবারও বিছানার দিকে তাকালো সে।বিছানায় কেউ খুব আয়েশের সহিত চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।তা দেখে কেঁপে উঠল চিনি।শুঁকনো ঢোক গিলে এগিয়ে এলো বিছানার ধারে।উঁকি মেরে ব্যক্তিটির মুখ দেখার চেষ্টা করলো সে।তবে ব্যক্তিটি চাদরে নিজেকে এতো নিখুঁতভাবে মুড়িয়েছে যে তার শরীরের কোনো অঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।আবার ঢোক গিলে দুকদম পিছিয়ে গেল চিনি।মিন মিনিয়ে বলল,
– ক কে?কে?এই কে?

ব্যক্তিটি থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।বরং সে একটু নড়েচড়ে চাদরে নিজেকে আরেকটু মুড়িয়ে নিল।আরো ঘাবড়ে গেল চিনি।তার বাবা-মা হলে তো পাশের রুমে থাকতো।আর আসার আগে তাকে ফোন করে জানিয়ে আসে তাহলে এটা কে?তার রুমে তার বিছানায় শুয়ে আছে কে?চিনি আবারও ভীত স্বরে বলল,
– কে কে?

চিনির গলার স্বর এতটাই আস্তে ছিল যে নিজেও শুনতে পেল না তার কথা।গলা কয়েকবার খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল চিনি।আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,
– এই কে? আমার বিছানায় কে?

অমনি লাফ দিয়ে উঠে বসলো ব্যক্তিটি ডানে বামে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
– কই?কই?

ব্যক্তিটির মুখ দেখে চোয়াল শক্ত করে ফেলল চিনি।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– এই আপনি?আপনি এখানে কিভাবে এলেন?

চিনির কোনো কথা মাথায় ঢুকলো না বারিশের সে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো চিনির দিকে।চিনির রাগে লাল হওয়া চোখ দু’টো দেখে কয়েকবার পলক ফেলে চোখ ডলে আবার তাকায় চিনির দিকে।চিনি কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।চিনিকে দেখে শ্বাস ফেলল বারিশ চাদর টেনে আবার শুতে শুতে বলল,
– ওহ্ এটাতো আমার বউ।

চিৎকার দিয়ে উঠল চিনি।কর্কশ কন্ঠে বলল,
– বউ মানে কি? আর আপনি এখানে কিভাবে এলেন?

চাদরের ভিতর থেকেই উত্তর দিল বারিশ,
– পালিয়ে।

– কিহ্? আপনি পালিয়ে এসেছেন?কিন্তু কিভাবে?আর এখানে এসেছেন কেন?আমার বাসা ঠিকানা কোথায় পেলেন?

উঠে বসলো বারিশ। চিনির হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। চিনির হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিল।চিনির দিকে মুখ করে আসন করে বসলো সে।মুখে মন ভুলানো একটি হাসি টেনে বলল,
– একটা একটা করে প্রশ্ন করো বউ।এতো প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিতে গেলে তো আমি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবো। তখন তুমি বিধবা হয়ে যাবে।এটা কি ভালো হবে বলো?

এক টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল চিনি।রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
– কিসব আজে বাজে কথা বলছেন?যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দেন আগে।আর আপনি না আমাকে কথা দিয়েছিলেন আমাকে আর কখনো ডিস্টার্ব করবেন না।তাহলে এখন এখানে কি করছেন?ঘন্টা যেতে না যেতেই ভুলে গেলেন?অবশ্য আপনার জন্য এসব কোনো ব্যাপার না।

– হ্যাঁ কথা দিয়েছিলাম।তবে শর্ত ছিল যদি তুমি আমাকে ওখান থেকে বের হতে সাহায্য করো।যেহেতু ওখান থেকে বের হতে আমার তোমার সাহায্য লাগেনি তাই এই কথার আর কোনো মূল্য নেই।

প্রতিত্তোরে চিনি কোনো কথা বলল না।শুধু শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে আর ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।বারিশ চিনির ডান গাল টেনে চিনির মুখটা একটু কাছে আনল।ফিসফিস করে বলল,
– জিজ্ঞেস করছিলে না কিভাবে এলাম?পালিয়ে এসেছি।

বলেই গাল ছেড়ে দিল বারিশ।এখন থমথমে মুখে বসে আছে চিনি।তবে বারিশ চিনির এমন চাহনি বেশ একটা পাত্তা দিল না।সে নিজের মতোই বলে চলেছে,
– দেখ প্রথমে আমার মানসিক হাসপাতাল থেকে বের হওয়াটা বেশি জরুরি ছিল।কারণ মানসিক হাসপাতাল থেকে বের হওয়াটা অনেক টাফ।আর তাই আমি হাত কেঁটেছি।ওরা আমাকে মেডিকেলে এনেছে।আর সেখান থেকে পালিয়ে তোমার পিছু পিছু তোমার বাসায়।ঢুকেছি কোথা থেকে জানো?

গলার আওয়াজ নিচু করে ফেলল বারিশ। আবারও চিনি গাল টেনে তর্জনি দিয়ে জালানার দিকে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলল,
-ঐখান থেকে।ভালই হয়েছে দুইতলায় থাক।আমাকে বেশি কষ্ট করতে হয়নি।

চিনি এখনও ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছে বারিশের দিকে চেয়ে।গাল থেকে ঝাড়া দিয়ে বারিশের হাত সরিয়ে দিলো।উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাত তুলে বলল,
– এখনই বের হন আমার বাসা থেকে।

বারিশ বুকে হাত গুঁজে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
– প্রশ্নই আসে না।হুহ্

– প্রশ্নই আসে না মানে?আপনি আমার বাড়িতে এসে আমার বিছানায় শুয়ে আছে আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।এখনই বের হবেন আমার বাড়ি থেকে।না হলে আমি কিন্তু চিৎকার করে লোকজন ডাকবো।পুলিশ ডাকবো।

– বারিশ মৃধার সাহস বরাবরই একটু বেশি জানই তো। এখন
কিছুতেই বাইরে বের হওয়া যাবে না।এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে খবর চলে গিয়েছে।আর তুমি চিৎকার করো আমার প্রবলেম নেই।বাট যখন লোকজন জানবে চিনি বুশরার ঘর থেকে একটি ছেলেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছে তখন বিষয় কেমন দেখাবে?অতি অসাধারণ দৃশ্য।চোখ বন্ধ করো চোখ বন্ধ করো দেখতে পাবে আমিও দেখতে পাচ্ছি।

বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল বারিশ। বারিশের কথা যৌক্তিক মনে হলো চিনির।একটি একা মেয়ের বাসা থেকে একটি ছেলেকে দেখলে লোকজন নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না তা।নিজেকে শান্ত করে নরম স্বরে বারিশকে জিজ্ঞেস করল,
– কি চান আপনি?কি করলে আপনি এখান থেকে চলে যাবেন?

হাসে বারিশ। স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
– আমাকে কিছুদিন থাকতে দাও।সময় হলে আমি নিজেই চলে যাবো।

বারিশ স্বাভাবিক স্বরে বললেও চিনির কাছে বেশ অদ্ভুত শোনালো সেই স্বর।কেমন ভারি আর শীতল লোমহর্ষক স্বর।
আর কোনো কথা বাড়ালো না চিনি।আচমকা তার মনে পড়লো সে চুলায় পানি গরম করতে দিয়ে এসেছিল।দৌড়ে রান্না ঘরে গেল সে।পানি শুঁকিয়ে হাঁড়ি জ্বলছে।বারিশ কিছু বুঝতে না পেরে সেও দৌড়ে চিনির পিছু পিছু এল।জিজ্ঞেস করল,
– কি হলো?

শকুনির দৃষ্টিতে একপলক বারিশকে দেখল চিনি।মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের করলো না।চুলা বন্ধ করে বারিশকে এড়িয়ে নিজের রুমের পাশের রুমে চলে গেল চিনি।দরজায় দাঁড়িয়ে পিছু না ফিরেই বলল,
– আমার বাসায় থাকতে হলে আমার সাথে কথা বলা যাবে না।

রুমে চলে গেল চিনি।বারিশ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
-এ কেমন শর্ত?

সামনে গহনার হাট বসিয়ে বসে আছে রাণী মৃধা।মহিলা মধ্য বয়সী হলেও বেহুঁশি পনায় এখনো ষোল আনা।শখের কোনো শেষ নেই তার।আজ এর শখ তো কাল ওর শখ।আজ হঠাৎ করেই তার গহনা কেনার শখ জেগেছে। তাই স্বর্ণকারকে ডেকে গহনার মেলা বসিয়েছে সে।দুটি গহনা পছন্দসই হলো। বাকিগুলো নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করল সে।গায়ে হালকা গোলাপি শাড়ি।শরীরে যথেষ্ট সোনার অলংকার রয়েছে তবে তার কাছে এগুলো পর্যাপ্ত নয়।তাই মাত্র কেনা একটি গহনার সেট থেকে গলার অলংকারটি গলায় পরে নিল সে।দরজা থেকে একজন যুবক বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে তার উদ্দেশ্যে বলল,
– মা ভাই নাকি মেডিকেল থেকে পালিয়েছে।

চমকে উঠলো রাণী মৃধা।চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো যুবকটির দিকে।রাগে কটমট করে বলল,
– এতো বড় দুঃসাহস?খুঁজে বের কর ওকে।ও যদি মরেও যায় তবু ওর লাশ আমার চোখের সামনে চাই।বুঝেছিস?

চলবে….?