শ্রাবণ ধারায় পর্ব-০৩

0
143

#শ্রাবণ_ধারায় |৩|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

চিনি সেই কখন ঘরে খিল দিয়েছে ঘর থেকে বের হওয়ার নামই নেই।এদিকে ক্ষুদার্ত বারিশের পেট থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ আসছে।আওয়াজে বার বার চোখ বড় বড় করে নিজের পেট দেখছে বারিশ।একপলক পেট দেখে তো একপলক চিনির ঘরের দরজার দিকে দেখে।চিনির দরজা খোলার নাম না দেখে অবশেষে নিজেই রান্না ঘরে গিয়ে খাওয়ার কিছু খুঁজতে শুরু করে বারিশ।শুঁকনো কোনো খাবার পায় না।হতাশ হয়ে চিনির ঘরের কড়া নাড়ে,
– চিনি?কোনো খাবার আছে?গত রাত থেকে আমি না খাওয়া।

কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে ছিল চিনি।বারিশের করুণ স্বর বিবেক নাড়িয়ে দিল তার।ঘরে শুঁকনো খাবার বাড়ন্ত।নিরুপায় চিনিকে এখন ভাত তরকারি রাঁধতে হবে।শরীর থেকে কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নিচে নামল সে।নিজেকে ঠিকঠাক করে দরজা খুলল।চিনিকে দরজা খুলতে দেখে বারিশ গিয়ে সোফায় বসে।টিভি ছেড়ে সংবাদের চ্যানেলে দেয়।চিনি বেরিয়ে এল ঘর থেকে বারিশকে একপলক দেখে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে রান্না ঘরে যায় সে।পিছন থেকে শুনতে পায় বারিশ হা হুতাশ করে বলছে,
– ইশশ! কি দিন চলে এলো বারিশ মৃধা ক্ষুধার জ্বালায় পুড়ছে।

কয়েক কদম পিছিয়ে এলো চিনি।দরজা থেকে উঁকি দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
– আপনি যা করেছেন।তার শাস্তি আল্লাহ আপনাকে দিচ্ছে।

অসহায় দৃষ্টিতে চিনি চোখে চায় বারিশ।ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে হতাশার নিঃশ্বাস। মলিন কন্ঠে বলে,
– সেই।পাপ করেছি যখন ফল তো ভোগ করতে হবে।

চিনি আর কথা বাড়ালো না।রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।সবকিছু গুছিয়ে চুলো জ্বালাল সে।একে একে তেল,পেয়াজ,ব্লেন্ড করে রাখা মসলা,লবণ,সকল প্রকার মসলার গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে পানি দিয়ে দিলো।স্বস্তির শ্বাস ফেলে পিছন ঘুরতেই চোখ কপালে উঠে গেল চিনির।বড় এক চিৎকার দিয়ে উঠলো সে।সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘর থেকে দৌড়ে এল বারিশ।চিনিকে নিজের দিক ফিরিয়ে চিনির হাত পা দেখতে দেখতে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
– কি হয়েছে? কি হয়েছে?কোথায় পুড়েছে দেখি?

ন্যাকা কান্না শুরু করলো চিনি। বারিশের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বিরক্তির স্বরে বলল,
– উফ্! পুড়েনি ছাড়েন আপনি।

ছেড়ে দিল বারিশ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-তাহলে কি হয়েছে কাঁদছ কেন?

চিনি নাক টানতে টানতে ছল ছল চোখে বলল,
– মাছ কষাতে ভুলে গিয়েছি।ঝোলে পানি দিয়ে দিয়েছি।অ্যা অ্যা! এবার কি হবে?

চিনির কথা শেষ হতেই ফিক করে হেসে দিল বারিশ।শরীর নাড়িয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠল।পেটে হাত দিয়ে বার বার হাসি থামানোর চেষ্টা করছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো বারিশের।কোনোমতে হাসি থামিয়ে বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
– আহ্!দেখ তোমার দুঃখের কথা শুনে আমিও কেঁদে দিলাম।ও মা গো পেট ব্যাথা করছে।

চিনি রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। বারিশ ইশারায় মুক লক করা দেখালো।ঢোক গিলে বলল,
– এখন মাছ দিয়ে দাও।কোনো রকম একটু খেতে পারলেই হবে বেশি মুখরোচক হওয়ার দরকার নেই।

বলেই চলে যাচ্ছিল বারিশ কিছু একটা মনে পরতেই ফিরে এসে বলল,
– তোমার ফোনটা একটু দিবে? দরকার ছিল।

এক ভ্রু উঁচু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে বারিশকে দেখতে লাগল চিনি।না জানি আবার নতুন কোন ফন্দি আঁটছে?লোকটা কি এক মুহুর্তেও শান্ত হয়ে বসতে পারে না?চিনি এভাবে তাকাতে দেখে নিজেকে পা থেকে মাথা অবধি একবার দেখল বারিশ।সব ঠিকঠাক দেখে হালকা শব্দে কেশে গলা পরিষ্কার করল।আবার বিনয়ের সহিত বলল,
– ফোনটা কি একটু দেওয়া যায়?খুব আর্জেন্ট।

চিনির সহজ সরল উত্তর,
– ঐঘরে আছে দেখেন।ফোন নিয়ে যদি ভুলভাল কিছু করেন তাহলে খবর আছে।

মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে এলো বারিশ।চিনি তার মতো আবারও রান্নায় মনোযোগ দিল।রান্না শেষে খাওয়ার টেবিলে ভাত তরকারি এনে সোফায় বসা বারিশের দিকে দৃষ্টি ফেলল সে।ফোনে খুব উত্তেজনার সহিত কিছু একটা করছে।এগিয়ে এল চিনি। খপ করে ফোনটা কেড়ে নিল হাত থেকে বারিশ হঠাৎ মনোযোগ ভঙ্গ হওয়ায় বোকা চোখে চেয়ে রইলো চিনির মুখের দিকে।চিনি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই লাফ দিয়ে উঠলো কর্কশ স্বরে বলল,
– একি আপনি আমার ফোনে গেম খেলছেন?এটা আপনার খুব আর্জেন্ট কাজ?আমার ফোনে এসব গেম খেললে ফোন স্লো হয়ে যাবে।এটা আইফোন না বুঝছেন।এসব গেম খেলার জন্য নয় এই ফোন।যান খেতে যান।টেবিলে খাবার দিয়েছি।

বারিশ বোকা চোখে তাকিয়ে আছে।খাবারের কথা শুনে আর এক মুহুর্ত বসল না সোফায়।কিছুটা দৌড়েই এল টেবিলে।পছন্দসই একটি চেয়ার টেনে।নিজে নিজেই প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করে।পরপর এক নিঃশ্বাসে কয়েক লোকমা খেয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে সে।চিনির দিকে চেয়ে চক চকে চোখে বলে,
– অনেকদিন পর আজ মনে হচ্ছে মানুষের খাবার খাচ্ছি।উফ্!হাসপাতালের ঐসব টেস্টলেস তরকারি খেতে খেতে আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।থ্যাংক ইউ বউ।

বারিশের কথায় চোখ ভরে ওঠে চিনির।পর মুহুর্তে বারিশের বলা “বউ” শব্দটা শুনে গুমোট হয়ে যায় চিনির মুখ।গম্ভীর স্বরে বলে,
– বার বার বউ বলবেন না আমাকে।আমি আর এখন আপনার বউ না।

– কিভাবে?

মুখে খাবার তুলতে তুলতে বেশ খানিকটা হেয়ালি করে বলল বারিশ।চিনি কপাল কুঁচকে বলে,
– কিভাবে মানে?আমি আপনাকে ডিভোর্স পেপার দিই নি?ওটাতে আমি স্ব ইচ্ছায় স্বাক্ষর করেছি।

– কিন্তু ওটা তো আমি কোর্টে জমা দিইনি।এবং এই ফাইলটা বন্ধ করে দিয়েছি।আর তুমি যেটায় সই করেছ সেটা ডিভোর্স পেপার না।ওটাই লেখা ছিল আমরা কেউ ডিভোর্স চাইনা আমরা বিষয়টা নিজেদের মধ্যে সলভ করে নিয়েছি।গট ইট?

চোখ বেরিয়ে এল চিনির অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
-মানে ঐটা ডিভোর্স পেপার ছিল না?

বারিশ মাছে কাঁটা বাছতে বাছতে দু’দিকে মাথা নাড়াল।নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– নোপ। আর তুমি যদি এখন ইসলামের কথা বলো তাহলে ইসলামে সরাসরি বলা হয়েছে মেয়েরা তালাক দিতে পারবে না।আর আমি মরে গেলেও তোমাকে তালাক দিবো না।সো স্টিল নাও উই আ’র হাসবেন্ড ওয়াইফ।

বারিশের কথায় মাথা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করল চিনির।কিসব প্রলাপ বকে চলেছে বারিশ কিছু মাথায় ঢুকছে না চিনির।চিনি হিসাব মেলাতে ব্যস্ত এদিকে খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল বারিশ।প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে সযত্নে তাকে রেখে দিল।বেরিয়ে এসে চিনির উদ্দেশ্যে বলল,
– সরি তোমার জন্য ওয়েট করলাম না।আচ্ছা তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।আমিও ঘুমাতে যাই খুব ঘুম পেয়েছে।

বারিশ রুমে চিনির রুমে চলে গল।চিনি হতাশার স্বরে বলল,
– এভাবে ধোঁকা দিল আমাকে?সেই শুরু থেকে আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলেছে।

বিশাল বড় বিলাসবহুল কামরার এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করছে রাণী।পাশেই সুদর্শন যুবক একের পর এক ফোন কল করছে।রাণী চিন্তিত স্বরে বলল,
– পাগলটা কোথায় যেতে পারে?

সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি বলে উঠল,
– মা ভাই কিন্তু পাগল না।

অগ্নি চোখে যুবকটিকে সতর্কতার স্বরে বলল,
– চুপ করো। আমার থেকে বেশি খাওনি তুমি।আমি কি বলেছিলাম ওকে আমার চোখের সামনে চাই।তাহলে এখনও হাজির করতে পারলে না কেন?এখানে বসে বসে নিজের চেহারা না দেখিয়ে তো খুঁজতে যেতে পারো।

– আমি কোথায় খুঁজবো? কোথায় আছে তা আমি জানি?

রাণী ভাবুক স্বরে বলল,
– চিনির কাছে নেই তো?

চট করে জবাব দিলো ছেলেটি,
– তা কিভাবে সম্ভব? চিনি কোথায় ভাই কি করে জানবে?

– তাও খোঁজ নাও।ও কোথায় থাকে কি করে সব খোঁজ।

-ব্লান্ডারটা তো তুমি এখানে করেছ শুধু শুধু ভাইয়ের বিয়ে দিতে গেলে কেন?ও না থাকলে এতোকিছু হতো না।

– যা হওয়া হয়েছে এখন কি করবে দেখ।

– হুম খুঁজছি আমি।

“হ্যালো! চিনি বুশরা বলছেন?আমি সাইক্রেটিস্ট জিদান খান।

সকাল সকাল ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে চিনির।চোখ মুছতে মুছতে ফোন রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে আশা কথাটি শুনে ঘুম কেটে যায় চিনির।ঢোক গিলে বলল,
– হ্যাঁ।আমি চিনি জ্বী বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি।

– আপনার স্বামী বারিশ মৃধা পলাতক আপনি কি তার বিষয়ে আমাদের কোনো তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারেন?

আবার ঢোক গিলল চিনি।কি বলা উচিত বুঝতে পারল না।আমতা আমতা করে বলল,
– কি আশ্চর্য পালিয়েছে তো আমাকে কল করেছেন কেন?খুঁজে দেখুন কোথায় আছে।দেখুন আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি আমার সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ নেই।তার সাথে আমার….

থেমে গেল চিনি।কাল বলা বারিশের কথা অনুযায়ী বারিশের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি।কিছুক্ষণ ভেবে নিচু স্বরে বলল,
– তার সাথে আমার আর এখন কোনো সম্পর্ক নেই।পাগলের সাথে সংসার করা যায় না বুঝতে পেরেছেন?আমাকে আর ফোন করবেন না।

খট করে ফোন কেটে দিল চিনি।বুকের বাম পাশে হাত রাখতেই অনুভব করল দ্রুত গতির হৃৎস্পন্দন।

ঘুম ঘুম চোখে হায় তুলতে তুলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বারিশ।টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল চিনি এলোমেলো বারিশকে দেখে থমকে গেল সে।ছোট্ট একটি গোল মুখ। সেখানে খুব নিখুঁত কারুকাজে ছোট ছোট দু’টো চোখ,ছোট্ট একটা সরু নাক আর ছোট্ট ঠোঁট বসানো।ছোট চোখ দু’টোতে ঘুম লেগে থাকায় ফুলে উঠেছে।পাপড়িগুলো বেশ আকর্ষনীয়।সোজা চুলগুলো পুরোটাই কপালে কিছু তো চোখের উপরও পড়েছে।গায়ের রং হলুদ ফর্সা।শরীরের গড়ন বুঝি বেশি মোটাও নয় আর চিকনও নয় একদম ঠিকঠাক। এ কয়দিনে চেহায় কেমন মলিনতা এসেছে।চিনির গভীর দৃষ্টিতে হাসল বারিশ।এগিয়ে এসে চিনির কপালের ডান পাশে চট করে অধর ছুঁয়ে শব্দ করে চুমু খেল।মুহুর্তেই আবার দুরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ালো।আচমকা ঘটনায় মূর্তির মতো থমকে রইলো চিনি।বারিশ আবারও এগিয়ে গেল কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– আই নো, আই লুক মোর হ্যান্ডসাম হোয়েন আ’ম মেসি।সো ডোন্ট লুক এট মি লাইক দ্যাট। ইউ নো,হোয়াট আ শাই বয় আই এম!

আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না বারিশ।ফিসফিসিয়ে বলা কথায় কেঁপে উঠলো চিনি।সে বরাবরই বারিশের এমন কানে ফিসফিস করে কথা বলা ভয় পায়।ভরাট কন্ঠ যখন খাদে নামে তখন যে শুনতে কতটা ভয়ংকর লাগে তা যে শোনে শুধু সেই বোঝে।যতবার বারিশ চিনির কানে এভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলে ততবারই চিনি কোনো ঘোরে চলে যায়।যে ঘোরটা সুখময় বেদনাদায়ক।বারিশের বলা শেষের বাক্যটি শুনে মুখে বাঁকা করে চিনি।বিড়বিড় করে বলে,
– এহ্ শাই বয়!লজ্জা নামের কিছু আছে আপনার মধ্যে? থাকলে প্রাক্তন স্ত্রীর বাসায় জোর করে ঢুকে থাকতেন না।

চিনির বিড়বিড়ানি কানে গেল বারিশের।সে চিনির কথা শুধরে দিয়ে বলল,
– নট অনলি পাস্ট।ইউ আ’র মাই পাস্ট, প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার।গট ইট?

চলবে…?