শ্রাবণ ধারায় পর্ব-১০+১১

0
123

#শ্রাবণ_ধারায় |১০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

ফারিশ তার লোকদের উদ্দেশ্যে বলল,
– ছেড়ে দে ওকে।

তারাও ফারিশের কথা মতো বারিশকে ছেড়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বারিশের বলহীন দেহটা।চিনি কাঁদতে কাঁদতে বারিশের মাথা নিজের কোলে তুলে মাটিতে বসে পড়লো।রাণী দৌরে এলো উপর থেকে বারিশের এ অবস্থায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে।চোখে বেরিয়ে এলো তার।পরমুহূর্তেই মুখে ভঙ্গি পরিবর্তন করে করুণ চাহনিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে আহত স্বরে বলল,
– একি আমার ছেলেটা এ কি অবস্থা? কে করেছে এটা ওর সাথে।

দৌড়ে এলো বারিশ কাছে।বারিশকে ধরতে যাবে তার আগেই চিনি নিজের অবস্থানে থেকেই রাণীকে নিজের দূর্বল হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো।চোখ ফেড়ে রাণীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– একদম আমার স্বামীকে স্পর্শ করবেন না।আমার স্বামীর টাকাই খান, পরেন,বিলাসিতা করেন অথচ আমার স্বামীকেই পাগল বানিয়ে মানসিক হাসপাতালে রেখে দিয়েছেন।আজকেই আমার বাড়ি থেকে বের হবেন।আপনি আর আপনার এই ছেলে।

এতক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বারিশ।চোটগুলো তেমন গুরুতর নয়।নিচের ঠোঁটে,কপালে আর পায়ে বেশি চোট লেগেছে।আস্তে ধীরে উঠে বসলো সে।চিনির কাঁধে হাত দিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলল,
– শান্ত হও।

ঘাড় ঘুরিয়ে বারিশের দিকে তাকালো চিনি।জোরে শ্বাস টেনে বলল,
– শান্ত হতে পারছিনা বারিশ। অনেক হয়েছে নাটক।এবার এটা বন্ধ হোক।এদের বাড়াবাড়ি আর নেওয়া যাচ্ছে না।

– এই ড্রামা তো তোমরা করছ স্বামী স্ত্রী। পাগল স্বামীর জন্য তোমার এতো চিন্তা তাহলে স্বামী যখন পাগলা গারদে ছিল তখন কেন একবারও দেখতে যাওনি?এখন যেই শুনলে বারিশের ফিফটি ফোর পার্সেন্ট শেয়ার তোমার নামে সেই অমনি সুর সুর করে চলে এসেছ এখানে।এসে পরম পতি ভক্তের নাটক করছ!

ফারিশ চিৎকার করে কথাটি চিনি ও বারিশের উদ্দেশ্যে বলল।চিনি চোখ বন্ধ করে একটি শ্বাস টেনে উঠে দাঁড়াল। ফারিশের সামনে গিয়ে তর্জনি তুলে ফারিশকে সতর্ক করে বলল,
– একটাও কথা শুনতে চাইনা তোমার মতো পশুর মুখ থেকে।এখনই এই বাড়ি থেকে বের হবে তুমি আর তোমার মা।আর না হলে এমন কিছু বলবো যা শুনে আর বাঁচতে ইচ্ছে করবে না বুঝলে।

রাগে গিজগিজ করতে করতে ফারিশে চিনির তর্জনি তোলা হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরলো।জোরে চাপ দিতেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো।সে দৃশ্য দেখে একমুহূর্ত বসে থাকতে পারলো না বারিশ।তৎক্ষনাৎ খুড়িয়ে খুড়িয়ে এসে ফারিশের মুখে চড় বসিয়ে দিলো।মুখে হাত দিয়ে পিছিয়ে গেল ফারিশ।এক হাতে চিনিকে আঁকড়ে ধরলো সে।ফারিশ রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
– ইউ বাস্টার্ড!

বারিশ দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
– এন্ড দিস বাস্টার্ড উইল মেক ইউর লাইফ হেল!সো গেট লস্ট ফ্রম মাই হাউজ!

রাণী ভীত চোখে বারিশের দিকে তাকিয়ে আছে।সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ কিসের জোরে বারিশ এতোটা কঠোর হয়ে উঠলো।তাই বার বার ভ্রুকুটি করে বারিশকে পা থেকে মাথা অবধি মেপে চলেছে।ফারিশের রাগ আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল।সে চিনিকে হাতে ইশারায় দেখিয়ে বলল,
– এই রাস্তার মেয়েটার জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে ভাই?

বারিশ চিনিকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে চিনির চোখে চোখ রেখে বলল,
– যাকে তুমি রাস্তার মেয়ে বলছ সে আমার কাছে কতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বোধহয় চড়টা খেয়েই বুঝতে পেরেছ।

চিনি বারিশের হাতটি কাঁধ থেকে সরিয়ে দিলো।ফারিশের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে চোখ মোটা মোটা করে তাকিয়ে বলল,
– আমি কোনো রাস্তার মেয়ে নয়।আমার বাবা মায়ের পরিচয় আছে।বরং তুমি…!

আর বলতে দিলো না বারিশ।চিনির হাত ধরে ফারিশের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো।গম্ভীর স্বরে চিনিকে বলল,
– রুমে যাও চিনি।

চিনি হাত ছাড়িয়ে নিলো বারিশের থেকে। বলল,
– কেন আমি ঘরে যাবো কেন?সত্যি কোনো না কোনো একদিন তো সামনে আসবেই।

– তোমাকে এখানে সত্য বলতে বলেনি কেউ এখনই তুমি এখান থেকে রুমে যাবে চিনি।আমাকে রাগাবে না।

ফারিশ ভ্রু উঁচিয়ে কৌতুহল কন্ঠে বলল,
– না না কি বলছে ও?বরং আমি কি?বলতে দাও ওকে আমিও তো শুনি আমাকে নিয়ে কি এমন সত্যি আছে যা আমি নিজেও জানিনা।

এদিকে দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেছে রাণী।চোখ মুখ ছলছল করছে তার।এগিয়ে এসে ফারিশের হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– বাবা চল না এদের এসব আজেবাজে কথা শুণে লাভ নেই।

– না মা আমি শুনতে চাই। বলো…এখন কেন চুপ করে আছো?

চুপ করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে চিনি।বারিশ প্রসঙ্গ বদলে বলল,
– ও কিছু বলবে না।তোমারা আলাদা বাড়িতে থাকবে।আমি যখন মনে করবো তোমাদের টাকার প্রয়োজন তখন আমি টাকা পাঠিয়ে দিবো।কিন্তু তোমরা এখন থেকে বারিশ মেনশনে থাকবে না।কজ দা প্রোপার্টি ওনার ইজ হেয়ার।আর আমি চাই না তুমি এখানে থাকো।গট ইট?যাও এখন ইশান্ত তোমাদের নতুন বাড়িতে নিয়ে যাবে।

ফারিশ ও রাণী এখনও জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে বারিশ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– ওহ্ এটাই তো ভাবছ আমি কিভাবে এত কনফিডেন্সের সাথে কথাগুলো বলছি?কারণ আমি তো পাগল সো সেই হিসেবে আমি তো কোনো প্রোপার্টির মালিক হতেই পারিনা।তাও কেন আমি এই প্রোপার্টির মালিক হিসেবে নিজেকে দাবি করছি।

বলেই সোফার উপর রাখা কালো ব্যাগটি থেকে একটি কাগজ নিয়ে রাণী আর ফারিশের সামনে ধরলো।বলল,
– এটা দেখ। এটাতে একদম স্পষ্ট লেখা আছে আমার মেন্টাল হেলথ্ এখন একদম নরমাল।আর এটা ফরেন সাইক্রেটিস্ট থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট।তো এখন মনে হয় তোমাদের কোনো সন্দেহ নেই?এম আই রাইট মা?

চোখ বড়বড় করে সেই কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে রাণী। শুঁকনো ঢোক গিলল।বারিশ আফসোসের সহিত বলল,
– ইশশ!কত চেষ্টা করলে আমাকে পাগল প্রমাণ করে আমার সব প্রোপার্টি লুটপাট করে খাবে সবকিছুতে জল ঢেলে দিলাম আমি তাই না?আফসোস! বারিশের সাথে এতোদিন থাকার পরও তোমরা বারিশের ওকাদ জানলে না।যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে।

বলেই বারিশ সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে নিজের ঘরে চলে গেল।চিনিও বারিশের পিছু পিছু দৌড়ে গেল।বারিশ রুমে ঢুকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।চারিদিকে চোখ বুলাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো তার।চিনি আহত চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে বারিশকে দেখছে।বারিশ চিনিকে দেখতে পেয়েই মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে চিনি দৌড়ে এসে বারিশে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– জানেন আমার জানে পানি ছিলনা যখনই শুনেছি আপনি ওদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছেন।

বারিশ আলতো হাসলো।চিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– বারিশ না চায়লে বারিশকে ধরা এতো সহজ?আমি তো শুধু ঐ রিপোর্টটির অপেক্ষা করছিলাম।কাল রাতেই রিপোর্টটি মেইল করেছে ডাক্তার। তাই ভাবলাম বউকে ছেড়ে আর এভাবে থাকা যাচ্ছে না।যাই বউয়ের কাছেই যা হবে দেখা যাবে।

– আমি অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।ওরা যদি আপনার কোনো ক্ষতি করে দেয়।

– দিয়েছে তো।

চোখ খুলে বারিশের বুক থেকে মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায় চিনি।ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
– কই কি?

বারিশ নিজের ঠোঁট আর কপাল হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলল,
– দেখছ না কিভাবে মেরেছে।

চোখ বড়বড় করে ফেলল চিনি।উদ্বেগ স্বরে বলল,
– ইশশ!তাই তো কতটা কেঁটে গিয়েছে। আমি পড়ে পড়ে মার খেলেন কেন?দুই একটা তো নিজেও বসিয়ে দিতে পারতেন।

– আমি ভদ্র ছেলে মারমারি করি না।

মুখ ভেংচি দিলো চিনি।বারিশকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
– বসুন আমি এন্টিসেফ্টিক নিয়ে আসি।

রাণী আর ফারিশ এখন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।তাদের মাথায় জট পাকিয়ে গিয়েছে। বারিশ এভাবে রিপোর্ট সহ হাজির হবে তা তারা কখনো কল্পনা করতে পারিনি।ভাবনার মাঝেই ইশান্ত এসে যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলল,
– স্যার ম্যাম চলুন।

রাণী ফারিশের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– চল ফারিশ। যা ভাবার ঠান্ডা মাথায় বসে ভাবতে হবে। এখন বারিশ যা বলছে তাই কর।

ফারিশ কটমট চোখে উপরে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।পিছন পিছন রাণীও ছুটলো।

চলবে….

#শ্রাবণ_ধারায় |১১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

কতদিন পর আবার নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে থেকে দিনের শুরু হলো।চোখ পিটপিট করতে করতে বিছানায় বসে আসে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বারিশ।বিছানার সামনেই বিশাল জায়গা জুড়ে সাদা গ্লাস যেখান থেকে সূর্যের আলো বিনাদ্বিধায় বারিশের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বারিশকে আজ অনেক বেশি প্রাণোচ্ছল আর শুভ্র লাগছে।চোখে সূর্যের প্রখর আলো এসে পড়াতে চোখ খুলতে পারছে না সে।বারিশ বিছানা থেকে উঠে গ্লাসের সামনে দাঁড়াল। গ্লাস থেকে নিচে চোখ পড়তেই দেখা মিলল রং বেরঙের বাহারি ফুলের মেলা।উদোম গায়ে দাঁড়িয়ে ফুলের বাগান দেখতে লাগল সে।গাঢ় নীল শাড়িতে কফি হাতে ঘরে প্রবেশ করল চিনি।বারিশকে এমন উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখে হাত দিয়ে সামান্য কাশল।পিছন ঘুরে তাকাল বারিশ।চিনি নরম স্বরে বলল,
– আপনার কফি।

বারিশ চোখের ইশারায় কাঁচে টি-টেবিলটি দেখাল।চিনি কফিটি সেখানে রেখে বারিশের দিকে চেয়ে রইলো।বারিশ ওয়াশরুমে যেতে পা বাড়িয়েও থেমে গেল।চিনির দিকে ফিরে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– কিছু বলবে?

চিনি উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে পরমুহূর্তেই ডানে বামে মাথা নাড়াল।ভ্রু কুটি করল বারিশ।চিনি আমতা আমতা করে বলল,
– আব আসলে মানে আমি…!

বারিশ কয়েক কদম এগিয়ে এলো।কালো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের পকেটে হাত গলিয়ে চিনির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।জিজ্ঞেস করল,
– কি বলবে?বলো..

চিনি ঢোক গিলে জিভ দিয়ে তার শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল।ইতস্তত স্বরে বলল,
– আসলে আমি চাকরিটা ছাড়তে চাইছি না।

বারিশ থুতনিতে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
– আচ্ছা ঐ নিউজ এডিটের কাজটা?তো আমাকে কেন বলছ?কাজ নেওয়ার সময় কি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

শেষের কথাটি বলে বারিশ চিনির দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো।চিনি অপরাধী দৃষ্টিতে কোণা চোখে একপলক বারিশের মুখের দিকে দেখল।চিনির চঞ্চল দৃষ্টির চঞ্চলতা আরো বেড়ে গেল।এখন এখান থেকে যেতে পারলেই বোধহয় তার শ্বাস স্বাভাবিক হবে।বারিশ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– তোমার ইচ্ছে হলে করবে না ইচ্ছে হলে করবে না।তোমার চাকরি তোমার যা ইচ্ছা করো।

চিনি ভীত চোখে বারিশের মুখের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,
– আপনি আমার উপর রেগে আছেন?

বারিশ চোখ কুঁচকে বলল,
– কেন বলো তো?

– জানি না কিন্তু মনে হচ্ছে রেগে আছেন।

– হ্যাঁ আছি একটু রেগে।

– কেন?

– জানি।আর তাছাড়া সব সময় সবাইকে ভালো লাগে না।

বলে বারিশ ওয়াশরুমে চলে গেল।এদিকে টলমল চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে চেয়ে রইল চিনি।নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ বের হতে লাগল।বারিশ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেও চিনিকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো।পর পর কয়েকবার পলক ফেলে এগিয়ে গেল চিনির দিকে।মাথা নিচু করে চিনির মুখ দেখল।চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।বারিশ হতভম্ব হয়ে গেল।দ্রুত চিনিকে বুকে টেনে নিয়ে উদ্বেগ কন্ঠে বলল,
– আরে আরে কাঁদছ কেন ম্যাম?আমি তো এমনিই মানে…!

সঙ্গে সঙ্গে ফুপিয়ে কেঁদে দিল চিনি।বারিশ এবার একদম বোকা বনে গেল।চোখ বড় বড় করে দাঁত দিয়ে ভিজ কাটল।বিড়বিড়িয়ে বলল,”ডোজটা বেশি হয়ে গেল মনে হচ্ছে।”
বারিশ চিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– এইটুকুতেই লেবুর রস বেরিয়ে গেল?আর আমাকে যে দুইমাস ধরে এভাবে ইগনোর করেছ?আমার তো তাহলে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে হয়।কি বলো?কেমন সে দৃশ্য বলো তো?বারিশ মৃধা হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে তার বউয়ের জন্য!

সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে হাসতে শুরু করলো চিনি।বারিশ চোখ বড়বড় করে মাথা চুলকে বলল,
– কি হলো?এই বৃষ্টি এই রোদ?দৃশ্যটা কি এতোটাই ফানি?

চিনির হাসির বেগ আরো বেড়ে গেল।বারিশ চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
– কি? কি হলো?এতো হাসছ কেন?

চিনি হাসি থামিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়াল। বাচ্চাদের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
– তাহলে আমি কাজটা করি?

– হ্যাঁ করো তোমার ভালো লাগলে করো প্রবলেম নেই।

– ধন্যবাদ।

চিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই চিনির হাতের কব্জি আঁকড়ে ধরলো বারিশে।লাজুক মুখে ফিরে তাকাল চিনি।বারিশ কোমল স্বরে বলল,
– আজ আমরা একটু বের হবো।তুমি কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় আমার অফিসের সামনে দাঁড়াবে।

ডানদিকে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো চিনি।হাত ছেড়ে দিবো বারিশ। আজ কতদিন পর অফিসে যাবে সে।সুন্দর ভাবে পরিপাটি করে নিল নিজেকে।কালো সুট প্যান্ট আর সাদা শার্ট।পায়ে কালো সুজ।দেখতে বেশ হিরো হিরো লাগছে।ফোনে কাউকে ফোন করে বলল,
– তোমার আজ যাওয়া লাগবে না।আমিই ডাইভ করবো আজ।বুগাট্টিটা বের করো।

অপর পাশ থেকে উত্তর এলো,
– জ্বী স্যার।

রাণী এবং ফারিশের জন্য দেওয়া বাড়িটাও বিশাল বড়।অনেকগুলো কক্ষের মধ্যে দু’জন দু’জনের পছন্দসই দুটি কামরা বেছে নিয়েছে।সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানার একপাশে দম মেরে বসে আছে ফারিশ।ঘরের দরজায় শব্দ হতেই চেঁচিয়ে বলল,
– এসো।

ঘরে প্রবেশ করলো কালো সেমি স্কার্ট এবং সাদা শার্টের একটি মেয়ে।বাহারি কাগজে মুড়ানো একটি বাক্স ফারিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিনয়ের সাথে বলল,
– স্যার এই পার্সেলটি আপনার জন্য এসেছে।

ফারিশ ভ্রুকুটি করে মেয়েটির দিকে একনজর দেখে বাক্সটি নিজের হাতে নিল।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
– যাও…

– জ্বী স্যার…

বিনয়ী স্বরে কথাটি বলে ধীর পায়ে কামরা ত্যাগ করলো মেয়েটি।ফারিশ ধীরে ধীরে বাহারি কাগজটি খুলে ফেলল।বাক্সটি খুলতেই চোখে পড়লো একটি পুরনো মোটা ডায়েরি। পাশেই রঙিন কাগজ।ফারিশ প্রথমে কাগজটি খুলে দেখল।কাগজে লেখা,”নিজের সীমার মধ্যে থাকতে শেখো।”

চোখ ছোট করে ফেলল ফারিশ। পাশে আরেকটি রঙিন কাগজ। এটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে বেশ বড়।সেটা খুলতেই তব্দা খেয়ে যায় ফারিশ।সেখানে কিছুটা এমন লেখা ছিল..”তুমি মৃধা বাড়ির ছেলে নও তোমাকে রাণী মৃধা রাস্তা থেকে উঠিয়ে মৃধা বাড়িতে এনেছিল।সে নাকি তোমাকে রাস্তায় পরে থাকতে দেখেছি।না জানি কোন পাপের ফল তুমি।নাহলে কেউ রাস্তায় কেন তার বাচ্চাকে ফেলে যাবে?”

হতবাক ফারিশ মুখে হা দিলো।আলতো ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
– হোয়াট?

ডায়েরিটি বের করল।ডায়করিটির উপরে কোনো নাম নেই।কভারটি উল্টাতেই পাওয়া গেল বড় বড় করে লেখা,
“শিরনামহীন”
পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখা গেল এক সুন্দর নারীর ছবি।ছবির নিচে নিপুন হাতের লেখায় লেখা “হৃদয়হরনী নাকি হৃদয়ক্ষরনী?”
কিছুই মস্তিষ্কে ঢুকছে না ফারিশের। এটা কার ডায়েরি? আর এই মেয়েটাই বা কে?মস্তিষ্ক একদম শূন্য হয়ে গিয়েছে তার।হাত পা শীতল হয়ে আছে।ছবিটির পর বেশ কয়েক পৃষ্ঠা একদম ফাঁকা।তারপরই কালো কলমে বড় করে লেখা “অবশেষে চার হাত এক হলো।”

আবারও বেশ কয়েক পৃষ্ঠা সাদা।একটি পৃষ্ঠায় লেখা,”এক আর এক তিন?নাকি চার?নয় মাস পর বোঝা যাবে।ভাবছি ওকে নিয়ে বাড়িতে যাবো।সবাইকে আমাদের বিয়ের বিষয়টা জানাবো।”

আবারও বেশ কয়েক পৃষ্ঠা সাদা।একটি পৃষ্ঠায় অনেকটা জায়গা জুড়ে লেখা এবার,”আমি অন্যায় করেছি।আমার বৃষ্টিকে ঠকিয়েছি আমি।আমি কিভাবে পারলাম বৃষ্টি থাকতেও অন্যকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে?আমি তখন কেন বলতে পারলাম না আমি বিবাহিত?আমি বারিশের বাবা?ডায়েরিতে আমি শুধু আমার খুশির মুহুর্তগুলোই এক দুই লাইতে প্রকাশ করতাম।কিন্তু আজ প্রথমবার আমি আমার দুঃখের মুহুর্তে কিছু লিখছি।আর এটাই আমার শেষ লেখা।আমি জানিনা আমার লাশ আমার বৃষ্টি আর বারিশ পাবে কিনা।ওদের জন্য আমার জীবনের সব অর্জন আমি উৎস্বর্গ করে গেলাম।আমার বারিশকে তুমি দেখে রেখ সৃষ্টিকর্তা।হৃদয়ক্ষরণী!…”

এরপর আর কোনো লেখা পাওয়া গেল না।পুরু ডায়েরিটিতে শুধুমাত্র এইকয়েকটিই লেখা।ফারিশ ভাবুক কন্ঠে বলল,
– বৃষ্টি? বারিশ?বারিশের বাবা?মানে আমার বাবা?

পাশের কয়েকটি পাতলা কাগজ একসাথে পিন করা সেটা খুলল বারিশ।
“প্রতিটি মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে আমারও আছে।উনি খুব ভালো ছেলে।বাবা-মায়ের খুব বাধ্য।বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেল।বাসর ঘরে বসে তার অপেক্ষায় পথ গুণছিলাম।ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেল সে এলোনা।সে না আসায় আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।বুঝতে পারলাম হয়তো সে এ বিয়েতে রাজি নয়।ঠিক করলাম বাবার বাড়িতে ফিরে যাবো।হাসপাতালের পাশ থেকে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম ময়লার ভিতর এক নবজাতক হাত পা ছড়িয়ে খেলছে।পাশেই একটি রাস্তার কুকুর আবর্জনা থেকে খাবার খাচ্ছে। বুক কেঁপে উঠলো আমার।দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলাম।আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজ করতে লাগলাম এই বাচ্চার বাবা-মাকে।কাউকে চোখে না বাঁধলে বুঝতে পারলাম কেউ ইচ্ছা করে বাচ্চাটা এখানে ফেলে গিয়েছে। মানুষ কতটা নৃশংস হলে একটা দুধের বাচ্চাকে এভাবে ময়লার মধ্যে ফেলে যায়।তাকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম।বাড়ির সবাই বেশ অবাক হলো।সবাই জেরা করতে শুরু করে এটা কার বাচ্চা কোথা থেকে এনেছি।সবাইকে বিষয়টা খুলে বললে সবাই বিশ্বাস করলো শুধু আমার ভাবি বাদে। তার ভাষ্যমতে বাচ্চাটা নাকি আমার অবৈধ সন্তান। কথাটা শোনার পর ইচ্ছা করছিল নিজেকে শেষ করে ফেলি।কিন্তু এই ফেরেস্তাটার কথা চিন্তা করে নিজেকে কোনো মতে সামলে রাখলাম।পরদিন ওনার বাড়ির লোক এলো আমাদের বাড়িতে।সকালে চিল্লাপাল্লা শুনে নিচে গিয়ে দেখলাম ওনাদের বাড়ি থেকে ওনার বোন আর ওনার খালা এসেছে।তারা কেঁদে কেঁদে কিছু বলছে।এগিয়ে যেতেই আমার দিকে তেড়ে এলো তারা…

চলবে….