শ্রাবণ ধারায় পর্ব-৮+৯

0
141

#শ্রাবণ_ধারায় |৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে নিজের খাবার তৈরি করে নিল চিনি।রাতে বেশ একটা ভালো ঘুম হয়নি।কি করে সবকিছু ঠিক করবে সে চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে চিনির।তার উপর রাতে ফারিশ কোনো অঘটন ঘটাতে পারে এ ভেবেও ঘুম আসেনি তার।তাড়াতাড়ি রান্না শেষে খাবার নিয়ে রুমে চলে আসে চিনি।দরজা আঁটকে দিল ভালোভাবে।খাবারটি ছোট টেবিলে রেখে গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো সে। ওয়াশরুমে ঢুকে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সাওয়ার অন করতেই ঝুপ করে লাল তরল এসে পড়লো চিনির শরীরে।সহসা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে গেল চিনি।মৃদু চিৎকার করে বলতে লাগল,
– আহ্ রক্ত! রক্ত! রক্ত! বাঁচাও রক্ত!

কেউ এলো না চিনির চিৎকারে।আসবেও বা কিভাবে চিনির সে চিৎকার তো কারো কান পর্যন্ত পৌঁছাল না।চিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জড়োসড়ো হয়ে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়াল।কিছুক্ষণ ঝর্ণার পানির দিকে তাকিয়ে রইলো চিনি।কিছুটা সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে পানিতে হাত দিলো।বুঝতে পারল এটি লাল রং মিশ্রিত পানি।ঠাওর করল এটি নিশ্চয়ই ফারিশের কাজ তাকে ভয় দেখানোর জন্য ফারিশ এমন করেছে।ঝর্ণা বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো চিনি।ছাঁদে গিয়ে পানির ট্যাংক এর ঢাকনা খুলে কতক্ষণ পর্যবেক্ষণ চালাল।ট্যাংকের সব পানি ফেলে দেওয়া হলো।আবার নতুন করে পানি তোলা হলো।এসব ঘটনায় এক মুহুর্তের জন্যও ফারিশকে চোখে বাঁধল না চিনির।সে মিতুর কাছে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা ফারিশ কোথায়?

– ছোট সাহেব তো বের হয়েছে।

– ওহ্!

ফিরে আসতে যেও ঘুরে তাকায় চিনি মিতুকে আবারও জিজ্ঞেস করল,
– অফিস কে দেখে এখন?

– ছোট সাহেব দেখে।

– আচ্ছা আমি একটু বের হবো।তোমার কাছে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি ঘরেই আছি।

– আচ্ছা মিষ্টি বউ তুমি যাও আমি কাউকে কিছু বলবো না।

ভাবনা অনুযায়ী সকালের খাবার খেয়ে নিজের ফ্লাটের বেরিয়ে পড়লো চিনি।ফ্লাটে ঢুকেই সোফায় শুয়ে থাকা বারিশকে চোখে পড়লো তার।ভ্রুকুটি করে মনে মনে ভাবল,
– কি ব্যাপার বারিশ এখানে শুয়ে আছে কেন?

এগিয়ে এসে দেখতে পেল টিভি চলছে আর সোফায় শুয়ে নাক ডাকছে বারিশ।চিনি পা টিপে টিপে এসে বারিশের নাক বৃদ্ধ আঙুল ও তর্জনি দিয়ে চেপে ধরলো।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মুখ দিয়ে জোরে শ্বাস টেনে চোখ বড় বড় করে উঠে বসলো বারিশ।নাক ছেড়ে শব্দ করে হাসতে লাগল চিনি।আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রথমে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল বারিশের পরমুহূর্তে চিনিকে দেখে আরেকধাপ চমকে উঠলো বারিশ।মুখে হাত দিয়ে বলল,
– সর্বনাশ!তুমি এখানে?

মুচকি হেসে বারিশের মুখ থেকে হাতটি সরিয়ে দিলো চিনি।রসিকতা করে বলল,
– ভালোই তো বউকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমানো হচ্ছে।

বারিশ রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
– কিহ্? আমি নাক ডাকি?

চিনি সুর টেনে বলল,
– হ্যাঁ..

– একদম না মিথ্যা কথা।কই আমি তো কখনো শুনিনি।

– ওমা আপনি শুনবেন কিভাবে?যে নাক ডাকে সে কি কখনো শুনতে পায়?সে তো ঘুম থাকে।

– মিথ্যা কথা!আমি নাক ডাকি না।

– আচ্ছা পরেরবার আমি নাহয় আপনাকে প্রমাণ দেওয়ার জন্য ভিডিও করে রাখবো।

– ওকে।

বারিশের হঠাৎ চিনির গলায় চোখ গেল।কালশিটে দাগ হয়ে রয়েছে গলায়।বারিশ এগিয়ে এসে চিনির থুতনি ধরে মুখ তুলল।গলায় হাত বুলিয়ে উদ্বেগ স্বরে বলল,
– একি কি হয়েছে এখানে?

বারিশের কোমল হাতের স্পর্শে চোখ বন্ধ করে ফেলল চিনি।শুঁকনো ঢোক গিলে গলা থেকে বারিশের হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
– কেন বলেছিলাম না আপনার ভাই আলতো গলা ছুঁয়েছে।

চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেলল বারিশ। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে চলে গেল।ঠোঁট উল্টে বারিশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো চিনি।কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই আইস ব্যাগ হাতে আবারও চিনির সামনে হাজির হলো বারিশ।সোফায় চিনির মুখোমুখি বসলো।মুখ উঠিয়ে আস্তে আস্তে বরফ দিতে লাগলো গলায়।শীতল ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করল চিনি।বারিশ বরফ দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বলল,
– সব ঠিক হবে।সবাইকে গুণে গুণে মুনাফা সহ আসল ফিরিয়ে দিবো।

ভারি কন্ঠে গম্ভীর এ কথা শুনে চোখ খুলে ফেলল চিনি।বারিশের চোখে চোখ রাখল সে দেখতে পেল অদ্ভুত এক দৃষ্টি।যে দৃষ্টি খুবই শান্ত শীতল তবে ভয়ংকরও বটে।গা ছমছমে এক দৃষ্টিভঙ্গি!ঢোক গিলল চিনি।সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।আপনার খাওয়ার জন্য কিছু রান্না করে দিয়েই আমি চলে যাবো।বাড়িতে আমাকে দেখতে পেলে ওরা সন্দেহ করবে।

– স্পাইন ক্যামেরাগুলো লাগিয়েছিলে রাতে?

– হ্যাঁ।আপনি যেভাবে বলেছিলেন সব সেভাবেই করেছি।

– তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।

– কি বিষয়ে?

– একদম অজানা একটি কথা।যা তুমি জানো না।

– আচ্ছা রান্না করে নিই সময় থাকলে শুনে যাবো।

– হুম।

– তুমি ঐ বাড়িতে যাবে চিনি।

সেদিন বৃষ্টিভেজা রাতে বারিশের সাথে সুন্দর একমুহূর্ত কাটানোর পর সকালে এমন কথায় থমকে যায় চিনি।শূণ্য মস্তিষ্কে বলে,
– কেন?আমি কেন ও বাড়িতে যাবো?যেখানে আপনাকে পেলে ওরা মেরে ফেলবে তাহলে সেখানে আমি গেলে আমার সাথে কি করবে?তারপর তো আপনার ঐ নোংরা ভাইটা আছে।আমি যাবোনা।

– চিনি প্লিজ সব কথায় আমার সাথে আরগিউ করা বন্ধ করো।

– আরগিউ করবো না মানে?আচ্ছা এজন্য বুঝি রাতে এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছেন? আমার কাছে এসেছেন?শুধুমাত্র আমাকে ঐ বাড়ি পাঠানোর জন্য?

এগিয়ে এলো বারিশ নিজের দু’হাতে চিনির মুখটা আগলে নিলো।চিনির চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বলল,
– দেখ চিনি আমার চোখের দিকে তাকাও।এই চোখে তোমার জন্য যে ভালোবাসাটা আছে তা কি তোমার মিথ্যা মনে হয়?তাহলে কেন তুমি আমাকে এতো বেশি অবিশ্বাস করো?তোমাকে ভালো রাখার জন্য আমি কতবেশি পরিশ্রম করি তারপরও আমি তোমার আপন না তাই না?আমাকে কখনো নিজের কাছের মানুষই মনে করো না তুমি তাই না?সবসময় ভাবো আমি তোমার ক্ষতি চাই।আমাকে কেন বিশ্বাস করো না তুমি?আমি কি মানুষ হিসেবে অনেক বেশি খারাপ?

মাথা নত করে বারিশের করুণ সুরে কথাগুলো শুনল চিনি।বুকটা ধক করে উঠলো চিনির।অপরাধী সুরে আমতা আমতা করে বলল,
– দেখুন বারিশ আমি এসব মিন করে কথাটা বলিনি।আমি বলতে চাইছি আমি ওখানে গেলেই কি ওরা আমাকে ঢুকতে দিবে?তার উপর ওরা জানে আমার আর আপনার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তাহলে আমি সেখানে এখন কোন অধিকারে যাবো?কোন পরিচয়ে যাবো?এখন তো আমি আর মিসেস মৃধাও নই।

চিনির কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলল বারিশ।তা দেখে চিনি দাঁত দিয়ে জিহবা কেটে বলল,
– না মানে ওরা জানে যে এখন আর আমি মিসেস মৃধা নই।এমনিতে তো আমি মিসেস মৃধা-ই।

বলে মেকি হাসে চিনি।বারিশ চিনির হাতে চাপ দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– গতকাল রাতে কি বলেছিলাম ভুলে গিয়েছ?

ডানে বামে মাথা নাড়ে চিনি।তৎক্ষনাৎ তার মনে পড়ে গেল গতরাতে বারিশের হিসহিসিয়ে বলা কথাটি,”মিষ্টি বউ,আমরা এখন হাসবেন্ড ওয়াইফ।সো লেট মি ফিল ইউ!”কেঁপে ওঠে চিনি।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না তার।

– কি পুড়ে গেল?কি পুড়ে গেল?

বলতে বলতে বসার ঘর থেকে দৌড়ে এলো বারিশ। রান্না ঘরে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার।চিনি ফ্রাই প্যানে খুন্তি ডুবিয়ে এক ধ্যানে সামনে থাকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।মুখে তার লাজুক হাসি।এদিকে মসলা পুড়ে কয়লা।বারিশ চোখ বড় বড় করে এগিয়ে এলো চিনির দিকে। উঁকি দিয়ে চিনির মুখ দেখলো।চিনির দৃষ্টি লক্ষ্য করে বাইরে তাকাল।কাউকে দেখতে না পেয়ে চিনির মুখের সামনে তুড়ি বাজাল।সঙ্গে কেঁপে উঠল চিনি।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে।পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই ফ্রাই প্যানের দিকে তাকিয়ে জোরে চিৎকার দিল চিনি।
– এ কি মসলা পুড়ে গেল কিভাবে?

বারিশ মৃদু রাগি স্বরে বলল,
– একটা কাজও তুমি ঠিক করে করতে পারো না।কোন আমলে চলে গিয়েছিলে বলো তো?থাক তোমার আর রান্না করতে হবে না আমি ডিম ভেজে খেয়ে নিবো। তুমি যাও।

বলে গোমড়া মুখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল বারিশ।চিনির মন খারাপ হয়ে গেল।কিছু রান্না করতে পারলো না।আবার সময়ও নেই হাতে তাই তাড়িতাড়ি কোনো রকম আলু ভেজে রেখে চলে যায়।আসার সময় বারিশ তাকে বার বার বলেছে,
– সাবধানে থাকবে।আর খুব শীঘ্রই আমি আসবো।

চলবে….

#শ্রাবণ_ধারায় |১০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

ফারিশ তার লোকদের উদ্দেশ্যে বলল,
– ছেড়ে দে ওকে।

তারাও ফারিশের কথা মতো বারিশকে ছেড়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বারিশের বলহীন দেহটা।চিনি কাঁদতে কাঁদতে বারিশের মাথা নিজের কোলে তুলে মাটিতে বসে পড়লো।রাণী দৌরে এলো উপর থেকে বারিশের এ অবস্থায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে।চোখে বেরিয়ে এলো তার।পরমুহূর্তেই মুখে ভঙ্গি পরিবর্তন করে করুণ চাহনিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে আহত স্বরে বলল,
– একি আমার ছেলেটা এ কি অবস্থা? কে করেছে এটা ওর সাথে।

দৌড়ে এলো বারিশ কাছে।বারিশকে ধরতে যাবে তার আগেই চিনি নিজের অবস্থানে থেকেই রাণীকে নিজের দূর্বল হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো।চোখ ফেড়ে রাণীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– একদম আমার স্বামীকে স্পর্শ করবেন না।আমার স্বামীর টাকাই খান, পরেন,বিলাসিতা করেন অথচ আমার স্বামীকেই পাগল বানিয়ে মানসিক হাসপাতালে রেখে দিয়েছেন।আজকেই আমার বাড়ি থেকে বের হবেন।আপনি আর আপনার এই ছেলে।

এতক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বারিশ।চোটগুলো তেমন গুরুতর নয়।নিচের ঠোঁটে,কপালে আর পায়ে বেশি চোট লেগেছে।আস্তে ধীরে উঠে বসলো সে।চিনির কাঁধে হাত দিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলল,
– শান্ত হও।

ঘাড় ঘুরিয়ে বারিশের দিকে তাকালো চিনি।জোরে শ্বাস টেনে বলল,
– শান্ত হতে পারছিনা বারিশ। অনেক হয়েছে নাটক।এবার এটা বন্ধ হোক।এদের বাড়াবাড়ি আর নেওয়া যাচ্ছে না।

– এই ড্রামা তো তোমরা করছ স্বামী স্ত্রী। পাগল স্বামীর জন্য তোমার এতো চিন্তা তাহলে স্বামী যখন পাগলা গারদে ছিল তখন কেন একবারও দেখতে যাওনি?এখন যেই শুনলে বারিশের ফিফটি ফোর পার্সেন্ট শেয়ার তোমার নামে সেই অমনি সুর সুর করে চলে এসেছ এখানে।এসে পরম পতি ভক্তের নাটক করছ!

ফারিশ চিৎকার করে কথাটি চিনি ও বারিশের উদ্দেশ্যে বলল।চিনি চোখ বন্ধ করে একটি শ্বাস টেনে উঠে দাঁড়াল। ফারিশের সামনে গিয়ে তর্জনি তুলে ফারিশকে সতর্ক করে বলল,
– একটাও কথা শুনতে চাইনা তোমার মতো পশুর মুখ থেকে।এখনই এই বাড়ি থেকে বের হবে তুমি আর তোমার মা।আর না হলে এমন কিছু বলবো যা শুনে আর বাঁচতে ইচ্ছে করবে না বুঝলে।

রাগে গিজগিজ করতে করতে ফারিশে চিনির তর্জনি তোলা হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরলো।জোরে চাপ দিতেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো।সে দৃশ্য দেখে একমুহূর্ত বসে থাকতে পারলো না বারিশ।তৎক্ষনাৎ খুড়িয়ে খুড়িয়ে এসে ফারিশের মুখে চড় বসিয়ে দিলো।মুখে হাত দিয়ে পিছিয়ে গেল ফারিশ।এক হাতে চিনিকে আঁকড়ে ধরলো সে।ফারিশ রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
– ইউ বাস্টার্ড!

বারিশ দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
– এন্ড দিস বাস্টার্ড উইল মেক ইউর লাইফ হেল!সো গেট লস্ট ফ্রম মাই হাউজ!

রাণী ভীত চোখে বারিশের দিকে তাকিয়ে আছে।সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ কিসের জোরে বারিশ এতোটা কঠোর হয়ে উঠলো।তাই বার বার ভ্রুকুটি করে বারিশকে পা থেকে মাথা অবধি মেপে চলেছে।ফারিশের রাগ আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল।সে চিনিকে হাতে ইশারায় দেখিয়ে বলল,
– এই রাস্তার মেয়েটার জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে ভাই?

বারিশ চিনিকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে চিনির চোখে চোখ রেখে বলল,
– যাকে তুমি রাস্তার মেয়ে বলছ সে আমার কাছে কতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বোধহয় চড়টা খেয়েই বুঝতে পেরেছ।

চিনি বারিশের হাতটি কাঁধ থেকে সরিয়ে দিলো।ফারিশের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে চোখ মোটা মোটা করে তাকিয়ে বলল,
– আমি কোনো রাস্তার মেয়ে নয়।আমার বাবা মায়ের পরিচয় আছে।বরং তুমি…!

আর বলতে দিলো না বারিশ।চিনির হাত ধরে ফারিশের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো।গম্ভীর স্বরে চিনিকে বলল,
– রুমে যাও চিনি।

চিনি হাত ছাড়িয়ে নিলো বারিশের থেকে। বলল,
– কেন আমি ঘরে যাবো কেন?সত্যি কোনো না কোনো একদিন তো সামনে আসবেই।

– তোমাকে এখানে সত্য বলতে বলেনি কেউ এখনই তুমি এখান থেকে রুমে যাবে চিনি।আমাকে রাগাবে না।

ফারিশ ভ্রু উঁচিয়ে কৌতুহল কন্ঠে বলল,
– না না কি বলছে ও?বরং আমি কি?বলতে দাও ওকে আমিও তো শুনি আমাকে নিয়ে কি এমন সত্যি আছে যা আমি নিজেও জানিনা।

এদিকে দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেছে রাণী।চোখ মুখ ছলছল করছে তার।এগিয়ে এসে ফারিশের হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– বাবা চল না এদের এসব আজেবাজে কথা শুণে লাভ নেই।

– না মা আমি শুনতে চাই। বলো…এখন কেন চুপ করে আছো?

চুপ করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে চিনি।বারিশ প্রসঙ্গ বদলে বলল,
– ও কিছু বলবে না।তোমারা আলাদা বাড়িতে থাকবে।আমি যখন মনে করবো তোমাদের টাকার প্রয়োজন তখন আমি টাকা পাঠিয়ে দিবো।কিন্তু তোমরা এখন থেকে বারিশ মেনশনে থাকবে না।কজ দা প্রোপার্টি ওনার ইজ হেয়ার।আর আমি চাই না তুমি এখানে থাকো।গট ইট?যাও এখন ইশান্ত তোমাদের নতুন বাড়িতে নিয়ে যাবে।

ফারিশ ও রাণী এখনও জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে বারিশ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– ওহ্ এটাই তো ভাবছ আমি কিভাবে এত কনফিডেন্সের সাথে কথাগুলো বলছি?কারণ আমি তো পাগল সো সেই হিসেবে আমি তো কোনো প্রোপার্টির মালিক হতেই পারিনা।তাও কেন আমি এই প্রোপার্টির মালিক হিসেবে নিজেকে দাবি করছি।

বলেই সোফার উপর রাখা কালো ব্যাগটি থেকে একটি কাগজ নিয়ে রাণী আর ফারিশের সামনে ধরলো।বলল,
– এটা দেখ। এটাতে একদম স্পষ্ট লেখা আছে আমার মেন্টাল হেলথ্ এখন একদম নরমাল।আর এটা ফরেন সাইক্রেটিস্ট থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট।তো এখন মনে হয় তোমাদের কোনো সন্দেহ নেই?এম আই রাইট মা?

চোখ বড়বড় করে সেই কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে রাণী। শুঁকনো ঢোক গিলল।বারিশ আফসোসের সহিত বলল,
– ইশশ!কত চেষ্টা করলে আমাকে পাগল প্রমাণ করে আমার সব প্রোপার্টি লুটপাট করে খাবে সবকিছুতে জল ঢেলে দিলাম আমি তাই না?আফসোস! বারিশের সাথে এতোদিন থাকার পরও তোমরা বারিশের ওকাদ জানলে না।যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে।

বলেই বারিশ সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে নিজের ঘরে চলে গেল।চিনিও বারিশের পিছু পিছু দৌড়ে গেল।বারিশ রুমে ঢুকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।চারিদিকে চোখ বুলাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো তার।চিনি আহত চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে বারিশকে দেখছে।বারিশ চিনিকে দেখতে পেয়েই মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে চিনি দৌড়ে এসে বারিশে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– জানেন আমার জানে পানি ছিলনা যখনই শুনেছি আপনি ওদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছেন।

বারিশ আলতো হাসলো।চিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– বারিশ না চায়লে বারিশকে ধরা এতো সহজ?আমি তো শুধু ঐ রিপোর্টটির অপেক্ষা করছিলাম।কাল রাতেই রিপোর্টটি মেইল করেছে ডাক্তার। তাই ভাবলাম বউকে ছেড়ে আর এভাবে থাকা যাচ্ছে না।যাই বউয়ের কাছেই যা হবে দেখা যাবে।

– আমি অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।ওরা যদি আপনার কোনো ক্ষতি করে দেয়।

– দিয়েছে তো।

চোখ খুলে বারিশের বুক থেকে মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায় চিনি।ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
– কই কি?

বারিশ নিজের ঠোঁট আর কপাল হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলল,
– দেখছ না কিভাবে মেরেছে।

চোখ বড়বড় করে ফেলল চিনি।উদ্বেগ স্বরে বলল,
– ইশশ!তাই তো কতটা কেঁটে গিয়েছে। আমি পড়ে পড়ে মার খেলেন কেন?দুই একটা তো নিজেও বসিয়ে দিতে পারতেন।

– আমি ভদ্র ছেলে মারমারি করি না।

মুখ ভেংচি দিলো চিনি।বারিশকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
– বসুন আমি এন্টিসেফ্টিক নিয়ে আসি।

রাণী আর ফারিশ এখন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।তাদের মাথায় জট পাকিয়ে গিয়েছে। বারিশ এভাবে রিপোর্ট সহ হাজির হবে তা তারা কখনো কল্পনা করতে পারিনি।ভাবনার মাঝেই ইশান্ত এসে যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলল,
– স্যার ম্যাম চলুন।

রাণী ফারিশের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– চল ফারিশ। যা ভাবার ঠান্ডা মাথায় বসে ভাবতে হবে। এখন বারিশ যা বলছে তাই কর।

ফারিশ কটমট চোখে উপরে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।পিছন পিছন রাণীও ছুটলো।

চলবে….