শ্রাবণ ধারা পর্ব-০২

0
804

#শ্রাবণ_ধারা
//পর্ব-২//
#সাদিয়া

ধারাকে অজ্ঞান হতে দেখে শ্রাবণ প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে বুঝতে পারলো আজকে ধারার উপর দিয়ে ঠিক কি তুফান বয়ে গেছে।শ্রাবণ ধারাকে সুন্দর করে বালিশে শুইয়ে দিয়ে সোজা হতে যাবে তখনই তার নজর পরে ধারার গালের দিকে।ধারার দুই গালেই অস্পষ্ট চার আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ধারার হাতের দাগ গুলোও আস্তে আস্তে নজরে এলো শ্রাবণের।দাগগুলো দেখেই শ্রাবণের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।সে জানে এই দাগ গুলোর এক মাত্র কারণ সে!

ধারার গালে আলতো করে হাত বুলালো শ্রাবণ।শ্রাবণের ভাবনা এখন একটাই, সে কি কোনো ভুল করেছে?বিশাল বড় ভুল?না!কোনো ভুল করেনি সে।কোনো ভুল করেনি।ভালোবাসায় কোনো ভুল থাকে না।সে তো শুধু ভালোবেসেছে।আর যা করেছে তা নিজের ভালোবাসাকে পেতে করেছে।কথায় আছে “Everything is fair in love and war” তাহলে সে ভুল করবে কি ভাবে।না করেনি সে কোনো ভুল।যা করেছে একদম ঠিক কাজ করেছে।ভালোবাসায় কোনো ভুল থাকতে পারে না।কোনো ভুলের স্থান নেই ভালোবাসায়।

ধারার জ্ঞান ফিরেছে আধ ঘন্টার বেশি সময়।জ্ঞান ফেরার পর থেকেই ধারা অনবরত কেঁদে চলেছে।আজ যেন তার চোখের জল বাধা মানছে না।তার নামে এতো বড় মিথ্যা রটানো হয়েছে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।যে মেয়ে ছেলেদের থেকে সবসময় দশ হাত দূরে থাকতো সেই তাকেই আজকে চরিত্র নিয়ে এতোগুলো কথা শুনতে হচ্ছে। ভাবতেই ধারার ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে।এমন সময় রুমে প্রবেশ করলো ধারার মা।ধারার মা রুমে প্রবেশ করতেই ধারা তার পায়ে পড়ে যায়।

—আম্মু বিশ্বাস করো শ্রাবণ স্যার যা বলেছে সব মিথ্যা।তার সাথে আমার কোনো কালে কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিলো না আর না আছে।উনি সব মিথ্যা বলছেন আম্মু।আমি অমন কিছুই করি নি যা তিনি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন।এই বিয়েটা হতে দিয়ো না আম্মু। দয়া করে এই বিয়েটা ভেঙে দাও।এই বিয়েটা হতে দিয়ো না।

ধারার মা এক ঝাড়ি দিয়ে ধারারকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
—দেখ ধারা এমনিতেই অনেক তামাশা হয়েছে।আর কোনো তামাশা চাইছি না।যা করার তা তো করেইছিস এখন লোক জানাজানি হওয়ার আগে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় মঙ্গল তোর জন্যও আর আমাদের জন্যও।

—আম্মু তুমি অন্তত আমার কথাটা বিশ্বাস করো।আমি এমন কিছুই করি নি।তর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই আর না ছিলো।

—দেখ ধারা আর নাটক করিস না অনেক হয়েছে।যে অঘটন ঘটিয়েছিস তা ঢাকতে বিয়ে হওয়াটা খুব দরকার।
এবার ধারা রেগে যায়।
—আরে তোমরা বুঝতে কেন চাইছো না কিছু করি নি আমি।কিচ্ছু না।যা করিনি তার শাস্তি কেন পাবো বলো তো?কেন পাবো?

—একদম চেচামেচি করবি না বলে দিলাম।একদম চেচামেচি না।তুই যদি এতোই নিরপরাধ হতিস তাহলে শ্রাবণ নিশ্চয় নাজমুলের কাছে বলতো তা শ্রাবণের সাথে তো শারীরিক…ছিঃ ভাবতেও আমার ঘেন্না হয় তুই আমার পেটের সন্তান।

—বিশ্বাস করো আম্মু সব মিথ্যা সব।

—হ্যাঁ সেই সবাই একসাথে মিথ্যা কথা বলছে আর তুই একমাত্র সত্যবাদী এসেছিস তাই না।শোন ধারা তুই যদি বিয়েতে রাজি না হোস তাহলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না আমরা। তখন গলায় দঁড়ি দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ থাকবে না।

মায়ের এমন কথায় ধারা দমে যায়।আমাদের রক্ষণশীল সমাজে যেকোনো বিষয়ে সবার আগে আঙুল মেয়েদের দিকে উঠে।তাদের নামের পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দাগকেও হাইলাইট করে সেখানে দেখানো হয় সেখানে তো ধারার নামে কত্তো বড় কেচ্ছা রটানো হয়েছে। যদিও ধারা এমন কিছুই করেনি তবুও দোষ এখানে ধারার।কই কেউ তো শ্রাবণকে একটা ধমকও দিলো না।আর ধারার উপর চলছে অমানবিক মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার।ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে কেন এতো পার্থক্য করা হয় আমাদের সমাজে?কেন করা হয়?

মায়ের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা বলে,
—আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ আম্মু।কথাটা যেদিন বুঝতে পারবে হয়তো আমাকে হারিয়ে ফেলবে।তখন শত চেষ্টা করেও আমাকে ছুঁতে পারবে না।হায়হুতাশ করা ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না তোমাদের সামনে।

কথাটা বলেই ধারা দরজা ঠেলে বাহিরে চলে যায়।আর ধারা মা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।আচ্ছা তার মেয়ে কি সত্যিই নির্দোষ? সত্যিই কি তার নামে মিথ্যা রটানো হয়েছে? কিন্তু এতে করে শ্রাবণের কি লাভ?সে কেন ধারাকে বদনাম করতে চাইবে?আর যদি বদনামই করার হতো তাহলে ধারার সাথে নিজের নাম কেন জুড়ে দিলো?
অনেকগুলো প্রশ্ন এখন ধারার মায়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যার একটার উত্তরও তার কাছে নেই।এই সকল প্রশ্নের উত্তর জানা যে খুব দরকার।খুব দরকার।

🍁
ধারা আর শ্রাবণের বিয়েটা অবশেষে সম্পন্ন হলো।বিয়েতে শ্রাবণের বাড়ির তেমন কেউ ছিলো না।শুধু শ্রাবণের বাবা, বড় ভাই আর শ্রাবণের চাচা উপস্থিত ছিলো।ধারা বাসা থেকেও শুধু ধারার বাবা আর কাকা।আবির এই বিয়ের ঘোর বিরোধিতা করেছিলো।যে জানে তার বোন কখনোই এমন নিচু মানসিকতার কাজ করতে পারে না।সে বার বার তার বাবা কাকাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে।এক পর্যায়ে পরাজিত হয়ে ঘর থেকেই চলে গেছে।

বিয়ের ঝামেলা মিটতেই ছাঁদে চলে যায় ধারা।এখন রাত নয়টা।চারদিকে নিরবতা।ধারা আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।আজ বড্ড অসহায় লাগছে তার নিজেকে।কেউ তাকে বিশ্বাস করলো না।নিজের আপন জনেরা তাকে দূরে ঠেলে দিলো।সেই আপন জনদের চোখের মনি ছিলো সে আজ সেই আপন জনদের চোখের বালি সে।ধারার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা তপ্ত অশ্রু।আপন জনদের অবহেলায় এতো পীড়া থাকে তা ধারা জানতো না।শ্রাবণের একটা মিথ্যার কল্যাণে তাও জানা হয়ে গেলো।বাবা বলতো জীবনে ভালো খারাপ সকল কিছুর অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।হয়তো এই অভিজ্ঞতাটাও তার প্রয়োজন ছিলো।

পাশে কারো উপস্থিত টের পেয়ে চোখ খুলে তাকায় ধারা।পাশে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে ধারা শ্রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—কেন করলেন এমন?
শ্রাবণ নিরব।ধারা আবার বলে,
—কি পেলেন আমার নামে এতো বড় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে?

এবার মুখ খোলে শ্রাবণ,
—যা পেতে চেয়েছিলাম তা তো পেয়ে গেছি।আর তো কিছু চাই না।তবে চাওয়ার জিনিসটা যে এভাবে পেতে হবে ভাবতে পারি নি।তবে অবশেষে পেয়েছি এটাই বা কম কিসে!

—কি এমন পেতে চেয়েছিলেন যার জন্য আমাকে এমন করে বদনাম করতে হলো?

ধারা প্রশ্নে শ্রাবণ কিছু সময় নিরবতা পালন করে বলে,
—তোমাকে।
এতটুকু বলেই শ্রাবণ হনহন করে ছাঁদ ত্যাগ করলো।ওই দিকে ধারা অবাক হয়ে শ্রাবণের যাওয়ার দিকে তাকওয়ে আছে।কি বলে গেলো শ্রাবণ?সে তাকে(ধারাকে)পেতে চেয়েছিলো মানে কি?ধারার মাথা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।মনে হচ্ছে যে আবারো জ্ঞান হারাবে।কিন্তু নাহ এবার সে নিজেকল শক্ত রাখবে।আর জ্ঞান হারালে চলবে না।হুটহাট অবাক যে এখন তাকল মাঝেমধ্যেই হতে হবে তা সে এতোক্ষণে খুব ভালো ভাবেই বুঝে গেছে।এতো চাপ কি নেওয়া যায়!আরো কিছুক্ষণ ছাঁদে কাটিয়ে ধারা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।এখন একটা ঘুমের তার খুব প্রয়োজন।সারাদিন অনেক ধকল গেছে তার উপর দিয়ে।এখন একটা ঘুম না দিলে সে পাগল হয়ে যাবে নিশ্চিত।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ।