শ্রাবণ ধারা পর্ব-০৩

0
718

#শ্রাবণ_ধারা
//পর্ব-৩//
#সাদিয়া

পরদিন শুক্রবার।সবার ছুটির দিন।তাই সবাই বাসাতেই আছে শুধু আবির ছাড়া।সে কালকে সন্ধ্যায় যে বের হয়েছে বাসা থেকে আর বাসায় আসে নি।ধারা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে আছে।রুম থেকে বের হবে নাকি হবে না তা সে বুঝতে পারছে না।কালকে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পর এখন সে রুম থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না।তার ভয় হচ্ছে যদি আবার আজকেও কালকের মতো কিছু হয়।থাক বাবা এর চাইতে রুমে বসে থাকায় শ্রেয়।

—ধারা এই ধারা।

মায়ের ডাকে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয় ধারা।

—ক..কি হয়েছে আম্মু।

—না তেমন কিছু হয়নি।তুই নাস্তা করে রেডি হয়ে নে।

—রেডি হবো কেন?

—শ্রাবণ আসছে তোকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবে।

—তাদের বাড়িতে কেন যেতে হবে আবার।

ধারার মা চোখ গরম করে তাকাতেই ধারা কিছু না বলে রুমে চলে যায়।

—জীবনটা কেমন যেন হয়ে গেছে।কোনো ভ্যালু নেই।একদিনে ভাগ্য আমায় কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করালো।

এর মধ্যেই ধারার মায়ের গলার স্বর পাওয়া গেলো,
—ধারা শ্রাবণ এসে গেছে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।

—আসছি।

বলেই রেডি হতে শুরু করে ধারা।তৈরি হয়ে ড্রয়িং রুমে যেতেই চোখ যায় শ্রাবণের দিকে। নীল শার্ট আর অফহুয়াইট প্যান্টে শ্রাবণকে বরাবরের মতোই মাশাল্লাহ লাগছে দেখতে।কিন্তু ধারার তাকে সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণকে ধারার এখন দুনিয়ায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক বলে মনে হয়।

—ধারা ওখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?আয় খেতে আয় তাড়াতাড়ি।

—আসছি আম্মু।

নাস্তা শেষ করে শ্রাবণ আর ধারা শ্রাবণদের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো।পুরো রাস্তা শ্রাবণ দু’একটা কথা বললেও ধারা ছিলো নির্বাক।ঘন্টাখানেক বাদে তারা শ্রাবণদের বাড়ি পৌঁছালো। ঘরে ঢুকতেই তারা শ্রাবণের মাকে পেলো তিনি সোফায় বসে বসে চা পান করছেন আর পত্রিকা পড়ছেন।কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকালেন। শ্রাবণের সাথে ধারাকে দেখে তার যে খুব একটা ভালো লাগেনি তা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।ধারা নিচু স্বরে তাকে সালাম দিলো।শ্রাবণের মা সালামের জবাব দিয়ে আবারো পত্রিকা পড়ায় মনোনিবেশ করলো।
.
শ্রাবণের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা।বারান্দায় হরেকরকমের ফুল গাছ রয়েছে।ধারা মনোযোগ সহকারে ফুল গাছগুলো দেখছে।

—আমার ছেলেটাকে কেন ফাঁসালে?

কারো আওয়াজে ধারা পাশ ফিরে তাকায়। শ্রাবণের মা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ধারাকে উদ্দেশ্য করে আবারো প্রশ্ন করলেন,
—বলো কেন ফাঁসালে আমার ছেলেকে?

শ্রাবণের মায়ের কথায় ধারা অবাক।সে কখন শ্রাবণকে ফাঁসালো? শ্রাবণ নিজেই তো ধারার জীবনকে নরক বানিয়ে দিয়েছে।ধারা কিছু না বলে বাইরের দিকে নজর রাখলো।কোনো জবাব না পেয়ে শ্রাবণের মা রেগে আগুন।এতোটুকুন একটা মেয়ে তার কথার জবাব দিচ্ছে না তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে ভাবতেই তার শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠে। তিনি এক হাতে ধারার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ধারার গালে বসিয়ে দেয় এক চড়।

গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে শ্রাবণের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ধারা।

—বলো কেন ফাঁসালে আমার ছেলেকে?টাকার জন্য ফাঁসিয়েছো তাই না?বলো কতো টাকা চায় তোমার?কতো টাকা পেলে তুমি আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যাবে।কত টাকা পেলে মুক্তি দেবে তুমি
আমার ছেলেকে?

এতোক্ষণ ধারা যে কান্না আটকে রেখেছিলো তা যেন এখন বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে। কিছিতেই থামছে না।

—একদম কান্না করবে না। একদম না।এই সব ন্যাকা কান্না অন্য কোথাও গিয়ে করো।আমার সামনে তোমার এইসব ন্যাকামি চলবে না।তোমার বাবা-মায়ের শিক্ষা এইসব তাই না?এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে তোমার মা-বাবা তোমাকে কিভাবে ছেলেদের নিজের জালে ফাঁসাতে হয়।আমার ছেলেটাকেই পেলে ফাঁসানোর জন্য? আর কাউকে পাওনি?চরিত্রহীন মেয়ে একটা।

ধারার এবার হিচকি উঠে যায়।হিচকির কারণে সে কিছু বলতে পারছে না।
—মা..

ধারা এবং শ্রাবণের মা দুজনেই পিছনে তাকালো।শ্রাবণ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শ্রাবণের রাগ সম্পর্কে তার মা অবগত তার তিনি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললেন।কিন্তু দমলেন না।

—শ্রাবণ এই রাস্তার মেয়ের জন্য তুই আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস?কি জাদু করেছে এই মেয়ে তোকে?

শ্রাবণ শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
—মুখ সামলে কথা বলো মা।যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না।

—কি জানি না আমি বল?আমি তো চাই জানতে।জানতে চাই আমি। আমি জানতে চাই এই মেয়ে কেন তোকে ফাঁসালো?

—আমি আবারো বলছি আজেবাজে কথা বলো না।আমাকে কেউ ফাঁসায়নি।দোষ সব আমার।

—অসম্ভব আমি বিশ্বাস করি না।তুই কোনো দোষ করতে পারিস না। সব দোষ তো এই নষ্টা মেয়ের।

শ্রাবণের মায়ের দেওয়া একের পর এক অভিযোগে ধারার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। ধারার কান্নার আওয়াজে শ্রাবণের রাগ দ্বিগুন হয়।রাগে শ্রাবণের মাথা যেন ফেটে যাচ্ছে। রুমে থাকা কাঁচে সেন্টার টেবিলে এক লাথি দেয় শ্রাবণ।ঝনঝন আওয়াজে পুরো ঘরে কাচঁ ছড়িয়ে যায়।শ্রাবণের এমন রূপে শ্রাবণের মা ঘাবড়ে যায়।

—আজ যা বলেছো তা বলেছো কিন্তু এর পর যেন তোমার মুখে ধারা বিপক্ষে একটা শব্দও না শুনি।আর যদি শুনেছি তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।চলো ধারা তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

শ্রাবণের এই কথায় ধারা হনহন করে বেরিয়ে যায়। এই জায়গায় সে আর এক মূহুর্তও থাকতে পারছে না।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার।এখান থেকে বের হতে পারলে তার জীবন বাঁচে।

গাড়িতে বসে ধারা অনবরত কেঁদে চলেছে।ঘ
থামাথামির নাম নেই।ধারার কান্নার এক একটা শব্দ শ্রাবণের বুকে অজস্র ক্ষতের জন্ম দিচ্ছে। শ্রাবন ধারার কান্না সহ্য করতে পারছে না কিছুতেই। শ্রাবণ জানে না তার একটা মিথ্যার জন্য ধারাকে আর কতকিছু সহ্য করতে হবে।

—ধারা প্লিজ এবার তো কান্না থামাও।এতো কাঁদলে শরীর খারাপ করবে তোমার।

শ্রাবণের কথায় তাছ্যিলের হাসি হাসলো ধারা।একবার শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো।শ্রাবণ ধারা চোখে নিজের জন্য স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পেলো।কই ওই চোখে তো আগে এতো ঘৃণা সে দেখতে পেতো না সে তাহলে আজ কেন সব পাল্টে গেলো? তার একটা মিথ্যার জন্য?কিন্তু সে তো ধারাকে পেতেই মিথ্যা বলেছিলো।ওইদিন মিথ্যা কথাটা না বললে যে সে সারাজীবনেরজন্য ধারাকে হারিয়ে ফেলতো।ধারা সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হয়ে যেতো।তা শ্রাবণ কিভাবে মেনে নিতো।সে একবার ভালোবাসা হারিয়েছে।জীবন তাকে দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসার সুযোগ দিয়েছে দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিয়েছে।সে কি করে আবারো একই ভুল করতে পারতো।না সে দ্বিতীয় বার আর একই ভুল করেনি।সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়েছে হোক সেটা একটা মিথ্যার বিনিময়ে।

শ্রাবণ ধারাকে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সে কি ধারার ভালোবাসা পাবে?ধারার চোখে তো সে নিজের জন্য এক আকাশ পরিমাণ ঘৃণা দেখতে পায়।সে তো ধারার ভালোবাসার পাত্র হতে চেয়েছিলো।ঘৃণার পাত্র সে হতে চাই নি।কিন্তু আজ নিজের কারণেই সে ধারার ঘৃণার পাত্র হয়ে গেলো। শ্রাবণের জন্য ধারার এই ঘৃণা কি কখনো শেষ হবে? নাকি শ্রাবণের জন্য এই ঘৃণা ধারার মনের এক কোনে সারাজীবন রয়ে যাবে?শ্রাবণ কি ধারার এই ঘৃণা সহ্য করতে পারবে? ভালোবাসার মানুষের ঘৃণা সহ্য করা যে খুব কঠিন।খুব কঠিন।মানুষ সব সহ্য করতে পারলেও নিজের ভালোবাসার মানুষের ঘৃণা কখনও সহ্য করতে পারে না। ভালোবাসার মানুষের ঘৃণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই।শ্রাবণেরও নেই।কিন্তু শ্রাবণকে তা সহ্য সহ্য করতে হবে।হয়তো আজীবন!

#চলবে…